প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড) পর্ব ২১

#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-21

অর্ষা ফ্রেশ হয়ে ডার্ক গ্রিন রঙের একটা শাড়ি পরেছে। ও অবশ্য খুব ভালো শাড়ি পরতে পারে না। এই কয়েকদিন অনেক বার শাড়ি পরা হয়েছে তাই হালকা হালকা শিখেছে আর সে অনুযায়ীই আজ নিজে নিজে শাড়ি পরেছে। দর্শন ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেছে। অর্ষা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু খুলে বের হতে পারছে না। কেমন লজ্জা লাগছে। এই বাড়িতে নতুন ও। চারদিকে অপরিচিত মানুষ। এত মানুষের ভীড়ে নিজেকে কি করে সামলাবে। আর তাছাড়া এত বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে। বারোটা বাজে রুম থেকে বের হচ্ছে বিষয়টা খুবই লজ্জার।
এসব ভাবতে ভাবতে অর্ষা দরজা খুলে ফেলল। ড্রয়িংরুমে তেমন মানুষ নেই। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অর্ষা রুম থেকে বের হলো কিন্তু কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না। রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। রান্নাঘরে অনেক মানুষ। মানুষে গিজগিজ করছে। অর্ষা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।

একজন মহিলা ওকে দেখে বলল,
“এই তো বউ উঠেছে।”
অর্ষা বউ উঠেছে কথাটা শুনে আরও লজ্জা পেল।
অর্ষা লজ্জা পেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“ওই একটু দেরি হয়ে গেল। আসলে নতুন জায়গা তো ঘুম আসছিল না। ঘুমাতে অনেক রাত হয়েছে বিধায় দেরি হয়ে গেল….! ”
অর্ষাকে কাচুমাচু করতে দেখে উপস্থিত সবাই মুখ টিপে হাসছে। দর্শনের মা সবাইকে ধমক দিয়ে বলল,
” হাসছো কেন তোমরা? এত বেলা হয়েছে মেয়েটার নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেয়েছে। অর্ষা, এসো মা, আমার সাথে এসো। আমি তোমাকে নাস্তা দিচ্ছি।”

“দর্শন আসুক। তারপর নাস্তা করব।”

“আচ্ছা, তাহলে এসে বস।”
দর্শন আসার পর দুজনেই নাস্তা করে নিল। নাস্তা শেষ করে দর্শন দিশাকে কল করে খোঁজ খবর নিচ্ছে।

অর্ষা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। দর্শন এসে ওর পাশে ধপ করে শুয়ে পড়ল।
“কী ব্যাপার? এসেই শুয়ে পড়লে কেন?”

“তুমি শুয়ে আছো কেন?”

“আমাকে বলেছে রেস্ট নিতে তাই রেস্ট নিচ্ছি। রাতে রিসিপশন, বিকাল থেকে সাজগোজে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। বিকাল থেকে কত ধকল যাবে তাই রেস্ট নিতে বলেছে।”

“আমাকেও বলেছে রেস্ট নিতে।”

অর্ষা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তোমার রেস্টের কি দরকার? তুমি তো আর ভারী লেহেঙ্গা, ভারী গয়না, মেক আপ পরে বসে থেকে থেকে কোমড় আর পা ব্যথা করবে না। আমি জানি এসব তোমার আমার কাছাকাছি থাকার ধান্দা।”

“হয়তো বড়রা আমাদের রেস্টের বাহানায় রোমান্স করার সুযোগ করে দিয়েছে।”

দর্শন, অর্ষার চুলে হাত দিতেই অর্ষা সরে গিয়ে বলল,
“রেস্ট করতে বলেছে, রেস্ট করো। একদম চুলে হাত দিবে না।”

“তাহলে গায়ে হাত দেই?”

“কোথাও হাত দিবে না। সরো। দূরে।”

ঘুমের মধ্যে অর্ষার মনে হচ্ছে কেউ ওর মুখে ফু দিচ্ছে। অর্ষা ধরফরিয়ে উঠে বসে। দর্শন ওর মুখে ফু দিচ্ছিল।
“তুমি! আমি ভয় পেয়ে গিয়েছি।”

“আমার কী দোষ? তুমি আমাকে নিষেধ করেছো তাই গায়ে হাত দেইনি, মুখে ফু দিচ্ছি। অনেকক্ষণ তো ঘুমালে, চারটা বাজে। ওরা এসে কয়েকবার ডেকে গেছে।”

অর্ষা দরজার দিকে তাকাল। দরজাটা খোলা। ঘড়িতে চারটা বাজে। বুঝতে পারছে না এত ঘুম কোথায় থেকে আসছে। শুনেছে বিয়ের আগে না-কি অনেক ঘুম পায় কিন্তু বিয়ের পর কেন এত ঘুম পাচ্ছে?
“ফ্রেশ হয়ে নেও, তারপর কিছু খেয়ে তৈরি হতে শুরু করো। তোমাকে সাজাতে চলে এসেছে।”
অর্ষা হাই তুলতে তুলতে ফ্রেশ হতে গেল। দর্শন অবাক হয়ে শুধু ওকে দেখছে। এ মেয়ে এত ঘুমাচ্ছে কেন? বিয়ের পর ঘুম কুমারী হয়ে গেল নাতো?

অর্ষা রিসিপশনের জন্য তৈরি হয়ে গেল। ভারী লেহেঙ্গা, গয়না আর মেক আপ নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের দিক থেকে চোখ সরাতেই পারছে না। মুচকি হেসে নিজেকে দেখছে। পেছনে থেকে এসে দর্শন ওকে জড়িয়ে ধরতেই অর্ষা লাফিয়ে ওঠে।
“আমার সাজ নষ্ট করো না। দূরে থাকো।”

দর্শন দূরে সরে গেল তাৎক্ষনিক। তারপর মুখ মলিন করে বলল,
“বিয়ের পর দেখছি একদম পাত্তাই দিচ্ছো না। এক দিনে এভাবে বদলে গেলে? জানি না বাকি জীবনে কি করবে।”
দর্শন কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়ল আর অর্ষাও ওর দুঃখী দুঃখী ফেস দেখে গলে গেল।
“কিছুক্ষণ পরে মেহমান আসবে, ফটোশুট হবে। তাই চাচ্ছিলাম না যে সাজ নষ্ট হোক। আমি তো তোমার পছন্দে, তোমার জন্যই সেজেছি।”
বলেই দর্শনকে জড়িয়ে ধরল।
“তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? তোমাকে ভালো না বাসলে কাকে বাসব?”
দর্শন সেই সুযোগ নিয়ে অর্ষার ঘাড়ে, গলায় চুমু একে জড়িয়ে ধরল।

~~~~~

বিয়ের বছর ঘুরতে চলল। এই এক বছরে অর্ষাকে অনেক কিছু ফেস করতে হয়েছে। দর্শন পাশে ছিল তাই সব প্রতিবন্ধকতা হাতে হাত রেখে মোকাবিলা করেছে। কনসিভ করার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ মতো মেডিসিন, এক্সারসাইজ, খাওয়াদাওয়া সব মেইনটেইন করে চলেছে দুজন মিলে। কিন্তু এই এক বছরে কোন সুখবর আসেনি। দর্শনের মা আকার ইঙ্গিতে অনেকবার বাচ্চা-কাচ্চার কথা বলেছে। ছেলের বয়স যাইহোক অর্ষার বয়স তো কম হলো না। তাছাড়া ছেলের বয়স যেমনই হোক বিয়ের পর মায়েরা নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চায়। অর্ষা তার এই চাওয়া বুঝতে পারলেও পূরণ করতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই আশা ছেড়ে দেয়, হতাশ হয়ে পড়ে, তখন দুচোখে দূর দূর পর্যন্ত হতাশা ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না। জীবন তখন অর্থহীন মনে হয়। মরে যেতে ইচ্ছে করে। ওওয়াশরুমে বসে বসে কাঁদে যেন কেউ দেখতে না পায়। বুকের ভেতর হু হু করে উঠে। মনের ভেতর শূন্যতা অনুভব হয়। মনে হয় এই জীবনে যতটুকু আছে সেটাও হারিয়ে ফেলবে। কম চেষ্টা তো করছে না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই জুটছে না।

একদিন বিকেল বেলায় দর্শনের মা, দর্শনকে ডাকতে ওর রুমে যায়। অর্ষা তখনও অফিস থেকে ফেরেনি। ঘরে গিয়ে দর্শনকে না পেয়ে ফিরে আসছিলেন। দর্শন হসপিটালে যাবে। তাই ওকে খেতে ডাকতে গিয়েছিলেন কিন্তু ও ওয়াশরুমে। ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন আর ঠিক তখনই কিছু মেডিকেল ফাইল চোখে পড়ে। ফাইলের উপরে বাচ্চাদের ছবি। দর্শন হার্ট সার্জন তাই ওর হাসপাতালের ফাইল হতেই পারে না। হয়তো কোন বাচ্চার ফাইল অথবা কোন গর্ভবতী মেয়ের ফাইল। কৌতূহল নিয়ে ফাইল হাতে তুলে নিলেন। অর্ষার নাম দেখে চমকে গেলেন। মনে মনে আশা জাগল হয়তো ও প্রেগন্যান্ট, কিন্তু না। প্রথম পাতা দেখে ধারণা পালটে গেল। অর্ষা কনসিভ করার চেষ্টা করছে। পরের পাতাগুলো দেখে তার মন ভারী হয়ে গেল। তিনি একজন গাইনী স্পেশালিষ্ট। তাই বুঝতে কিছু বাকি নেই। এক বছর ধরে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে অর্ষা। ওর মধ্যে অনেক কমপ্লিকেশন রয়েছে। তাই কনসিভ করতে পারছে না। আরেকটা ফাইল রয়েছে নিচে। পারমিশন ছাড়া অন্যের জিনিস ধরা উচিত না কিন্তু তিনি কৌতূহল মেটাতে নিচের ফাইলটা হাতে নিলেন। ডেট দেখে বুঝতে পারলেন এই রিপোর্ট আট-নয় বছর আগের। অর্ষা আট-নয় বছর আগে কোন ট্রিটমেন্ট নিয়েছিল। রিপোর্ট পড়ে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। অর্ষার অনেক সমস্যা আছে। ওর মা হওয়ার চান্স কম। এই জন্য এক বছর ট্রিটমেন্ট করে ফল পায়নি। নয় বছর আগে থেকে এখন পর্যন্ত ট্রিটমেন্ট চলছে। এত বড় একটা সত্যি লুকানো হয়েছে। উনাদের ঠকানো হয়েছে। যেহেতু এখনো ওর ট্রিটমেন্ট চলছে এর মানে দর্শন সবটা জানত। নিজের ছেলেও সত্যিটা লুকিয়ে আসছে। গোপনে ট্রিটমেন্ট করছে। যেখানে নিজের পেটের ছেলে এত বড় ধোকা দিয়েছে সেখানে পরের মেয়েকে কি বলবেন। চোখে পানি চলে এসেছে। চোখ মুছে দ্রুত তিনি ফাইল রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

রাতে খাবার টেবিলে সুনসান নীরবতা। দর্শনের মা মুখ ভার করে চুপচাপ খাচ্ছেন। দর্শন বাবাকে ইশারা করে কারণ জানতে চাইলে বাবা মাথা নাড়িয়ে জানায় কিছু জানে না। ওর মা ডালের বাটি নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালে অর্ষা এগিয়ে দেয়। অর্ষা এগিয়ে দেওয়ায় তিনি আর হাত দেননি। ডালও নেননি। মায়ের এহেন ব্যবহারে দর্শন আর অর্ষা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। বুঝতে পারছে না কেন নিল না, এর মানে কি অর্ষা উনার রাগের কারণ।
দর্শন সঠিকভাবে জানতে জিজ্ঞেস করল,
“মা, হাসপাতালে কিছু হয়েছে?”

“হাসপাতালে কি হবে? বাড়িতে সমস্যার অভাব যে অন্য জায়গা থেকে ধার করতে হবে?আফসোস হয় সারাজীবন কী করলাম? নিজের ছেলেমেয়েদের আপন হতে পারিনি। তাদের বিশ্বাস ও ভরসার পাত্র হতে পারিনি। ভালো ডাক্তার হতে পেরেছি, জীবনে অনেক নাম কামিয়েছি কিন্তু ভালো মা হতে পারিনি এ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।”

সবাই উনার মুখের দিকে চেয়ে আছে। হঠাৎ কি এমন হলো যে এমন কথা বলছে।
“কি বলছো মা? তুমি কখনোই ব্যর্থ মা হতে পারো না৷ আজ আমরা সফল তোমার জন্য। তুমি অবশ্যই একজন আদর্শ মা।”

দর্শনের মা তাচ্ছিল্য হাসল। তারপর দর্শনের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
“আসলেই? যদি তোদের মনের কাছাকাছি থাকতাম, তোদের সঠিক শিক্ষা দিতে পারতাম তবে আজ তোর কাছ থেকে ধোকা খেতাম না। এতবড় সত্য তুই আমাদের কাছ থেকে লুকাতি না।”
দর্শন বুঝতে পারছে না কোন সত্যি লুকিয়েছে ও।
“কি লুকিয়েছি মা?”

দর্শনের মা অর্ষার দিকে তাকাল। অর্ষা খাওয়া থামিয়ে স্থির হয়ে আছে। ওর মা কঠিন গলায় বলল,
“এই যে অর্ষার মা হওয়ার চান্স খুবই কম। এই সত্যিটা তুই সবার থেকে লুকিয়েছিস। ঠকিয়েছিস তোরা।”
দর্শনের মা খাবার রেখে উঠে দাঁড়াল।কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেলেন। ওর বাবা অবাক হয়ে ওদের দিকে চেয়ে রইলেন। তিনি এই সত্যিটা শুনে এই মুহুর্তে শকড। রিয়েক্ট করতে ভুলে গেছেন। অর্ষা নিজের মুখ চেপে ধরল। ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। দর্শন কাকে সামলাবে বুঝতে পারছে না।
অর্ষা ঘরে নেই। হঠাৎ কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। দর্শনের কিছুই ভালো লাগছে না। কি করে অর্ষাকে স্বাভাবিক করবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটা খাবার টেবিলে বসে অনেকক্ষণ কেঁদেছে। ওকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে চলে গেল দর্শন। অর্ষাকে রেলিংয়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। অর্ষা স্থির দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। দর্শনের বুক কেঁপে উঠল। হাত-পা কাঁপছে ওর। কি করছে ও? কোন অঘটন ঘটাবে না তো?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here