#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৫
হঠাৎ-ই কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করল। সবার মধ্যে নেমে এসেছে নিগুঢ় সন্ধ্যার মতো পিনপতন নীরবতা। দর্শন নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য নিজের উপরই রাগ হলো। মুখ ফস্কে এত বড় সত্যিটা কি করে বলে ফেলল। এতদিন তো নিজের মধ্যে চাপা রেখেছিল, এখন কেন পারল না? এখন ওরা নানার প্রশ্ন করবে কি উত্তর দিবে, শুধু শুধু অস্বস্তিতে পড়বে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেল কেউ কোন প্রশ্ন করল না হয়তো ওকে বিব্রত করতে চায় না। দর্শন মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। কিন্তু বেশিক্ষণ সেটা আর পারল না।
রুশান ওর স্বস্তিতে পানি ফেলে বলল,
“অর্ষা? তুই অর্ষাকে……
রুশানের মুখে অর্ষার নাম শুনে দর্শনের বুকের ভেতর শিহরণ বয়ে গেল। কত দিন, কত মাস, কত বছর পরে কারো মুখে ওর নাম শুনল। এতদিন কেউ ওর নাম নেয়নি। হয়তো ভেবেছে দর্শন ওকে ভুলে গেছে।
দর্শনের মনটা হঠাৎ সাহসী হয়ে উঠল। স্পষ্ট উত্তর দিল,
” হ্যা, অর্ষা। আমি অর্ষাকে এখনো ভালোবাসি।”
রুশান কিছুটা ক্ষিপ্ত হলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
“এতকিছুর পরেও? এতকিছুর পরেও ওকে ভালোবাসিস? লাইক সিরিয়াসলি?”
ওর প্রশ্নে দর্শন বিরক্ত হলো কি-না জানা নেই কিন্তু অর্পা বিরক্ত হলো। মুখে কিছু না বললেও চোখেমুখে বিরক্তি ভাব ফুটে উঠল। সেদিকে চোখ পড়তেই রুশান চুপসে গেল। ও আর বাড়তি প্রশ্ন করল না। দর্শন আরো গম্ভীর হয়ে গেল।
অর্পা সবার দিকে একবার চেয়ে বলল,
“কই আমাদের তো কখনো কিছু বলিস নি। আমরা ভেবেছি তুই সব ভুলে লাইফে মুভ অন করেছিস। ভালো আছিস।”
“কারণ আমি চাইনি আমার জন্য আমার বন্ধুরা আর সাফার করুক, ডিস্টার্ব হোক। তাই সবটা নিজের মধ্যে গোপন রেখেছি।”
“সাড়ে সাতটা বছর একাই সাফার করেছিস। অথচ আমরা ভেবেছি সব নরমাল হয়ে গেছে। তুই ভুলে গেছিস সব।”
দর্শন মৃদু হাসল। মৃদু হেসে বলল,
“প্রথম ভালোবাসা কি ভুলা যায় যদি তা সত্যিকারের ভালোবাসা হয়? হয়তো কিছু ভুল ছিল তাই ওকে হারিয়ে ফেলেছি।”
“এত বছর ওর খোঁজ করিসনি কেন? ইনফ্যাক্ট এখনো?”
“যে নিজ থেকে হারিয়ে যায় তাকে কি খোঁজা যায়?”
“তা অবশ্য ঠিক। কোথায় যে গেল আর কেন গেল?”
“আমি চাই ও ওর মতো ভালো থাকুক। ও যা করেছে তাতে ওকে না পাওয়ার আফসোস কখনো হবে না।”
“এভাবে আর কত?”
“জানি না। জানতে চাই না। আমি ভালোবাসি ব্যস।”
“শুধু ভালোবাসিস? নাকি ঘৃণাটুকুও করিস?”
“যাকে ভালোবাসি তাকেই তো ঘৃণা করা যায়। সেক্ষেত্রে হয়তো ঘৃণাও করি।”
সবাই চুপ। কেউ ওর এই কথার প্রেক্ষিতে আর কোন কথা বলল না। থমথমে পরিবেশ। দর্শন এত বছর পরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে এসে পরিবেশটা গম্ভীর করে দিল। সব স্বাভাবিক করতে বলল,
“ভাবছি কাজে লেগে যাব। আর বেকার বসে থাকতে ভালো লাগছে না।”
ওর কথায় সায় দিয়ে রাতুল বলল,
“ইউএস থেকে বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে নিজেকে যদি বেকার বলিস তাহলে আমরা কি বলব?”
“ডিগ্রি আছে কিন্তু জব নেই। তোরা জব করছিস। সেক্ষেত্রে আমার দিক থেকে এগিয়ে আছিস।”
তামিম বলল,
“তাহলে তুই ও এগিয়ে যা।”
“হ্যা, লাইফে আগাতে চাই। ভালো কিছু অর্জন করতে চাই। জীবনে অনেক কিছু করার আছে। কয়েকটা হসপিটাল থেকে অফার পেয়েছি বাবা-মায়ের সঙ্গে আলোকে করে দেখি কোথায় ভালো হবে দেন জয়েন করে নিজের যোগ্যতা প্রদর্শন করব।”
“অবশ্যই। বসে থেকে কাজ নেই। এখন শুধু অর্জন করতে হবে। তাহলেই মেয়েদের লাইন পড়ে যাবে পেছনে।”
অর্পা ধমক দিয়ে বলল,
“মেয়েদের লাইন ছাড়া জীবনে কিছু নেই?”
তামিম জিভে কামড় দিয়ে বলল,”সরি সরি।”
অর্পা সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“আমার আড্ডা এখানেই শেষ। এখন তোরা মনের খুশিতে মেয়ে মেয়ে করে গদগদ কর। এতদিনেও মানুষ হলি না।”
অর্পা দুম করে উঠে চলে গেল। সবাই রুশানের দিকে চেয়ে বলল,
“তোকে বলল না তো?”
রুশান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
~~~
রাত বারোটা বেয়াল্লিশ মিনিট। অর্ষা হাই তুলছে। ডান হাতে চোখ ডলে বড় দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল। চুলগুলো এলোমেলো করে উঠে গেল। অনেক ক্লান্ত লাগছে। শরীর মেজমেজ করছে। ফ্রেশ হয়ে চুলগুলো বেঁধে লাইট অফ করে বিছানায় গা এলালো। অনেক ধকল গেছে আজ। আগামীকাল অফিসে একটা মিটিং আছে। তারই প্রেজেন্টেশন তৈরি করল রাত জেগে। চোখ বন্ধ করতেই চকিত হয়ে সাথে সাথে চোখ খুলে ফেলল। মনটা অশান্ত লাগছে। হঠাৎ করে ভালো লাগছে না। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে ফেসবুকে লগইন করল। সার্চ লিষ্ট থেকে দর্শনের নাম বের করল। অনেক দিন ধরে ওর আইডিতে টু মারা হয় না। ওর আইডিতে গিয়ে অর্ষা হতাশ হলো। আপডেট কিছু নেই। শেষ এক মাস আগে একটা পিক পোস্ট করেছে। দর্শন তেমন এক্টিভ থাকে না। কখনো দু-চার লাইন পোস্ট করেনি। মাঝেমধ্যে নিজের পিক আপলোড করে। তাই দর্শনের সম্পর্কে কোন ইনফরমেশন পায়না। ও কি করে, কেমন আছে কিছুই বুঝা যায় না। অর্ষার ধারণা ওর অন্য আইডি আছে। নয়তো একটা মানুষ এত নির্লিপ্ত কি করে থাকতে পারে। অর্ষা দর্শনের পিকটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর ওর আইডি থেকে বের হয়ে হাবিজাবি কতগুলো নাম সার্চ করে সার্চ লিষ্ট থেকে দর্শনের নাম সরিয়ে দিল। যদি কেউ দেখে ফেলে!
অর্ষা মোবাইল কেউ ধরবে না তবুও মনের তৃপ্তির জন্য একাজ করে। অর্ষা মোবাইল রেখে চোখ বন্ধ করল। কিছুক্ষণ অশ্রু বিসর্জন দেওয়া জরুরি। অতীত ওকে ভালো থাকতে দেয় না। যতই কাজে ব্যস্ত থাকুক, নিজেকে ব্যস্ত রাখুক, সফলতার দাঁড় প্রান্তে পৌঁছে যাক না কেন অতীতের স্মৃতিগুলো কিছুতেই মন থেকে মুছা সম্ভব না। প্রফেশনাল পর্যায়ে যতই সাকসেস হোক না কেন ব্যক্তিগত জীবনে যে পিছিয়ে আছে। ব্যক্তিগত জীবনের হারকে প্রফেশনাল লাইফের সাকসেস দিয়ে ঢাকা যায় না। অর্ষা পারছে না। তাই ফলাফলস্বরুপ চোখের পানি পড়ছে।
প্রিয়া অর্পাকে মেসেঞ্জারে কল দিল। গতকাল রাতেই ফেসবুকে অর্পার একটা পিক দেখেছে। পিকটা ঢাকার স্বনামধন্য একটা রেস্টুরেন্টের প্রবেশ দাঁড়। অর্পা নিশ্চয়ই দেশে ফিরেছে। রাতেই কল দিতে চেয়েছিল কিন্তু এত রাতে কাউকে কল দেওয়া অনুচিত ভেবে আর দেয়নি। আজকে অফিসে এসে কাজের ফাঁকে অর্পাকে কল দিল প্রিয়া। অর্পা শুয়ে ছিল। প্রিয়ার কল দেখে উৎসুক হয়ে উঠে বসে। কল রিসিভ করে উৎফুল্ল মনে।
“হেই, প্রিয়া কেমন আছো?”
“আমি ভালো আছি। তুমি ঢাকায়?” প্রিয়ার কৌতূহলী প্রশ্ন।
“হ্যা, দশ-বারোদিন ধরে এসেছি আবার চলে যাব।”
“চলে যাবে? মানে?”
“আমি ওদেশেই স্যাটেল হব। কিছুদিনের জন্য এসেছি।”
প্রিয়া মন খারাপ করে বলল,
“এতদিন ধরে এসেছো অথচ আমাকে একবার বলোনি।”
অর্পা ভেবে দেখল ঠিকই তো। মেয়েটা প্রায়ই ওকে কল করে, মেসেজ দিয়ে খোঁজ খবর নিত। ওকে জানানো উচিত ছিল।
“সরি ইয়ার, আসলে হঠাৎ করে চলে এসেছি তেমন প্ল্যান ছিল না। আসো একদিন মিট করি।”
“অবশ্যই। কবে সময় হবে জানিও।”
“আচ্ছা জানাব। তা কেমন চলছে দিনকাল?”
“চলছে, চাকরি জীবন খারাপ না। বাসা থেকে বিয়ে দিতে চায় এটাই খারাপ খবর।”
“বিয়ের বয়স তো হয়েছে, বিয়ে করে নেও।”
“আমার বান্ধবীরা কেউ বিয়ে করেনি। তুমি তো এখনো বিয়ে করোনি। বড় বোনকে আগে বিয়ে করতে হয়।”
“ভালো ছেলে পেলে করব আমার সমস্যা নাই।”
প্রিয়া কিছুক্ষণ কাচুমাচু করল। তারপর বলল,
“একটা চমকে যাওয়ার মতো খবর শুনবে?”
“কী”
“অর্ষা…..”
“অর্ষা! অর্ষা কী?”
বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল।
“অর্ষা ছ’মাস হবে ঢাকায় আছে।”
“অর্ষা ঢাকায়? এতদিন কই ছিল?”
“বাহিরে ওর চাচাদের কাছে। জানো ও অনেক বদলে গেছে। লাইফ নিয়ে যার বিন্দুমাত্র ভাবনা ছিল না সে এখন সব কিছুতেই সিরিয়াস। অনেক কঠিন হয়ে গেছে।”
অর্পা বিশ্বাস করতে পারছে না অর্ষার খবরটা। ও এতদিন পরে? আর এখন ঢাকায়? দর্শন জানেও না। অর্ষা কি একবারও দর্শনের খোঁজ করেনি? হয়তো করেনি। যদি করত তবে জানত! অর্পা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কী করে আজকাল?”
“ও আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার। ভালো স্যালারিতে জব করছে। সব সময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।”
“ওর সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে। ওকে নিয়ে আসতে পারবে?”
“জানি না আসবে কি-না। তবে চেষ্টা করব।”
“চেষ্টা করো। আবার চলে যাব কবে আসব জানি না। ওকে বলো আমি ওকে দেখতে চাই।”
“আচ্ছা। বলব।”
অর্পার মনে একটা আশা যদি যাওয়ার আগে দর্শন আর অর্ষাকে মুখোমুখি করতে পারে। ওদের মুখোমুখি হওয়া জরুরি। অর্ষা রাজি হলে ওকে দর্শনের মুখোমুখি করবে। যত প্রশ্ন আছে সব ক্লিয়ার হবে। এখন ওর রাজি হওয়ার পালা।
…..
অর্ষা অফিস শেষে অফিসের পোশাকে খাবার অর্ডার করে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। অপেক্ষা করছে প্রিয়ার জন্য। প্রিয়া এলো আরো দশ মিনিট পর। ওর ঘর্মাক্ত মুখ দেখে কিছু বলল না। প্রিয়া চেয়ার টেনে বসে টিসু নিয়ে কপাল মুছল।
“সরি দোস্ত, দেরি হয়ে গেল। শোন তোকে একটা তাজা খবর দেই অর্পা আপু এসেছে। আবার নাকি চলে যাবেন।”
“কেন?”
“তার সেখানেই ভালো লেগেছে। আমি যাব মিট করতে। তুই যাবি?”
প্রিয়া প্রশ্নটা করে ঢোক গিলল। অর্ষা প্রসংগ এড়িয়ে গেল। অর্পার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সমস্যা এক জায়গায়।
চলবে…..
(নতুন করে লিখলাম, এলোমেলো ও ছোট হয়ে গেছে।)