#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-২৩
অর্ষার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। আকস্মিক যেকোনো মুহূর্তে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়বে। এর কারণ চারটা দিন দর্শনের সাথে দেখা হবে না। চার দিনের জন্য বাবার সাথে থাইল্যান্ড যাচ্ছে। দর্শনকে এখনো জানানো হয়নি। জানলে কি রিয়েকশন দেবে সেটাও জানা নেই। পাঁচদিন পরে ওর পরীক্ষা। পড়াশোনা নিয়ে বেশ ব্যস্ত আছে।
তবে জানাতে তো হবেই। না জানিয়ে তো যেতে পারবে না। আর বাড়িতেও ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। লাগেজ গোছাতে হবে।
“হেই!”
দর্শন ওর পাশে এসে বসল। অর্ষা ওর দিকে শুকনো মুখে তাকাল। দর্শন ওর শুকনো মুখ আর রেসপন্স না পেয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকাল।
“কিছু হয়েছে অর্ষা? মন খারাপ?”
অর্ষা ম্লান হাসল। তারপর দর্শনের ওই চিন্তিত চোখের দিকে তাকাল। কত যত্ন সে চোখে। অর্ষা দৃষ্টি নত করে বলল,
“মন খারাপ।”
দর্শন বিচলিত হয়ে বলল,
“কেন? কী হয়েছে?”
অর্ষা ওর দিকে না চেয়েই বলল,
“আগামীকাল বাবার সাথে থাইল্যান্ড যাচ্ছি। চারদিন কলেজে আসব না।”
দর্শন কিছুটা হতভম্ব হয়ে বসে রইল। চোখে মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বলল,
“কেন? হঠাৎ থাইল্যান্ড কেন?”
অর্ষা দর্শনের দিকে তাকাল। তারপর মলিন মুখে বলল,
“বাবা অফিসের কাজে যাচ্ছে। সাথে আমাকেও নিয়ে যাবে। অফিসের কাজের জন্য তিনদিন আর একদিন আমাকে নিয়ে ঘুরবে।”
“আশ্চর্য! তোমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছে?”
“সব সময়ই আমাকে নিয়ে যায়। আমাকে রেখে কোথাও যায় না। আমি বাসায় একাই থাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাবা বলেছে এখন তো আমি বড় হয়েছি, একা বাসায় রেখে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া উপর তলার ছেলে আমাকে বিরক্ত করত এটা জানার পর তো অসম্ভব।”
“কোন রিলেটিভের বাসায় থাকবে।”
অর্ষা দর্শনের দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্য হাসল।
তারপর বলল,
“রিলেটিভ থাকলে তো? দাদা-দাদি মারা গেছেন, বড় চাচ্চু, মেঝ চাচ্চু কানাডা থাকেন। সো কোন রিলেটিভ নেই।”
দর্শন আশ্চর্য হলো। তারপর বলল,
“নানাবাড়ি?”
অর্ষা নিঃসংকোচে বলল,
“নেই। আমার নানাবাড়ি নেই। আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। আগে গিয়ে মেমের সাথে কথা বলে আসি। আমি প্রোগ্রামে থাকতে পারছি না সেটা জানাতে হবে।”
দর্শনের ভালো লাগছে না। কেমন অশান্তি লাগছে মনের ভেতর। অর্ষাকে চারদিন দেখবে না। ভাবতেই বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে আসছে। অর্ষার দিকে তাকাল। ওর কি কষ্ট লাগছে না? বুকের ভেতর ব্যথা হচ্ছে না। অর্ষা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে যাওয়ার জন্য।
দর্শন আচমকা ওর হাত ধরে। অর্ষা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করছিল, এখান থেকে পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আর সম্ভব হবে না।
অর্ষা ছলছল চোখে ওর দিকে তাকাল। দর্শন চোখ নামিয়ে নিল। অর্ষার ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। চোখে জল ছলাৎ ছলাৎ করে উপচে পড়ছে।
দর্শন বিষন্ন স্বরে বলল,
“বোকা মেয়ে মন খারাপ করছো কেন? দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তাছাড়া আমার পরীক্ষা। পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকব সময় পেরিয়ে যাবে। আর ভিডিও কলে তো কথা হবেই।”
অর্ষা মৃদু হাসল। দর্শন যে ওকে স্বান্তনা দিল সেটা তো অজানা নয়।
দর্শন ওকে গেট অবধি এগিয়ে দিয়ে নিজেও বাড়িতে চলে গেল। ওদের ক্লাস নেই। প্রোগ্রামের জন্য কিছু কিছু স্টুডেন্ট আসছে যাচ্ছে। অর্ষার জন্য দর্শন এসেছিল। এখন তো ও আর থাকছে না তাই কলেজে আসার কিংবা থাকার কোনো মানেই নেই। নিজেও বাসায় চলে গেল।
….
চারটা দুর্বিষহ দিন কেটেছে দর্শনের। অস্থিরতা, আক্ষেপ আর পাগলাটে দিন কেটেছে। চারটা দিন বারবার মনে হয়েছে বুকের ভেতরটা ফাঁকা। একদম ফাঁকা। চারদিকে সবাই থাকলেও কি যেন নেই নেই মনে হত। অর্ষা অনেক দূরে চলে গেছে। ধরা ছোয়ার বাইরে, চোখের আড়ালে। পড়তে বসলে মন বসত না। বারবার মনে হত একটা কল করা যাক। তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা। অর্ষাও বিরক্তিকর দিন পার করছিল। সারাদিন হোটেল রুমে শুয়ে-বসে থাকা অথবা লনে, ক্যাফেতে বসে থাকা। এভাবে কথা বলতে বলতে পড়াটা আর হয়ে উঠত না।
আজ দুপুরে অর্ষা এসেছে। খবর পেয়ে বিকেল বেলায় ছুটে এসেছে দর্শন৷ তখন মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। সূর্যের মুখ সারাদিন দেখা যায়নি। এমনই মেঘাচ্ছন্ন দিনে দর্শন অর্ষার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। থেমে থেমে বাতাস বইছে। অর্ষা বাসায় এসে শাওয়ার নিয়ে খেয়ে কেবল শুয়েছে। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। একটু ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু দর্শনের কল পেয়ে লাফিয়ে উঠতে হয়। ওর আসার খবর শুনে দর্শন চলে এসেছে ওকে দেখার জন্য। এমন পাগলামি ভালোই লাগে। অর্ষা বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। নিচের দিকে তাকাল কিন্তু দর্শনকে দেখা যাচ্ছে না। বাইরে বাতাস বইছে, সাথে শহরের ধুলো। অর্ষা যতদূর চোখ যায় খুঁজল দর্শনকে। কিন্তু দেখা গেল না। অর্ষার ইচ্ছে করছে উড়াল দিয়ে নিচে নেমে যেতে কিন্তু সেটা যে সম্ভব না। উড়াল দিতে গেলে একদম উপরে যেতে হবে নিচে নয়। অর্ষা বারান্দা থেকে দৌড়ে রুমে গেল। আয়নায় নিজেকে দেখল। জামা চেঞ্জ করে, মুখে স্নো দিয়ে, চুলটা আঁচড়ে নিল ভালো করে। হাতে ওর দেওয়া ব্রেসলেটটা পরে নিল, পায়ে পায়েলটা তো আছেই। ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক দিয়ে নিজেকে কয়েক সেকেন্ড দেখে জুতা পরে দৌড়ে ঘর থেকে বের হলো। লিফট দিয়ে নিচে নেমে দর্শনকে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকতে দেখল একটা বেঞ্চে। বাইরে বাতাসের তীব্র ঝাপটায় হয়তো দাঁড়ানো যাচ্ছিল না তাই ভেতরে এসে বসেছে। অর্ষা কয়েক সেকেন্ড স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইল। অনুভূতিটা এমন যে কত বছর পরে দেখল। দর্শন তখনও ওকে দেখেনি। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ-ই লিফটের দিকে অর্ষাকে দেখে। ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে। ঘায়েল করা সে হাসি। বুকের মাঝে হৃদপিন্ড সেখানে অস্থির অস্থির করছে ঠিক সেখানে গিয়ে লাগে।
দর্শন বসা থেকে দাঁড়াল। অর্ষা দৌড়ে ওর সামনে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। শরীরের কাঁপন বেড়েই চলেছে। দর্শন ওকে দু’হাতে আগলে ধরে বলল,
“প্রচন্ড মিস করেছি তোমাকে। দেখো বুকের কম্পন তোমার ছোয়ায় বেড়ে চলেছে।”
অর্ষা হালকা লজ্জা পেল। ওর লজ্জার সাথে আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ছে ভারী বর্ষণ। দর্শন ওকে বুক থেকে সরিয়ে আকাশ পানে চায়। তাল মিলিয়ে বড় বড় ফোঁটা ছন্দ সৃষ্টি করছে। দর্শন অর্ষার দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। অর্ষা ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। কিছু বোঝার আগেই ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল গেটের বাইরে। অর্ষা বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে।
“দর্শন, কী করছো? ভিজে যাচ্ছি তো।”
বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
“আজ তোমার সাথে ভিজতে চাই।”
“পরশু তোমার পরীক্ষা, অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
দর্শন ওর কথা শুনছেই না। ওকে টেনে ওর বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে গেল। তারপর দু’জন হাতে হাত রেখে ভিজতে লাগল প্রেমের স্রোতে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে মৃদু বাতাস। হাতে হাত রেখে দুজন বাচ্চাদের মতো দৌড়াচ্ছে। রাস্তার দু’ধারে কয়েকজন ছাতা মাথায় হাঁটছে। কেউ কেউ আবার ভিজে একাকার। অনেকেই ওদের পাগলামি দেখছে। দুজন প্রেমিক যুগল বৃষ্টি বিলাশ করছে।
….
দর্শনের আজ প্রথম পরীক্ষা। গায়ে হালকা জ্বর। সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার পর মাঝরাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে ওর। পরের দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছে সারাদিন। মেডিসিন নিয়ে আগের চেয়ে সুস্থ হলেও হালকা জ্বর থেকে যায় গায়ে। সেই জ্বর নিয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছে আজ। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। দুদিন ধরে কিছু মুখে তুলতে পারেনি। অর্ষা তাই ওকে বকাবকি করছে।
“কতবার বলেছিলাম তোমাকে? হ্যা? আমার কথা তো শুনবে না। এবার জ্বর নিয়ে বসে থাকো। বললাম ভেজার দরকার নেই তোমার পরীক্ষা আছে৷ এখন ভালো করে প্রিপারেশন নিতে পারছো? পরীক্ষা ভালো হবে?”
“আরেহ, তুমি তো বকেই যাচ্ছো। একটু শুভকামনা তো জানাবে?”
অর্ষা রেগেমেগে বলল,
“আর শুভকামনা! তোমার চেহারা দেখেছো?”
দর্শন ওর কথা শুনে কিঞ্চিৎ হাসল।
তারপর বলল,
“কেন চেহারা দেখে প্রেম পাচ্ছে না?”
তারপর ফিক করে হাসল। ওর হাসি দেখে অর্ষা আর রাগ করে থাকতে পারল না। ও নিজেও হেসে ফেলল। দর্শনকে কিছুক্ষণ দেখে বলল,
“ভালো করে পরীক্ষা দিও। পরীক্ষা শেষে দেখা করে যেও।”
দর্শন ওর গাল টেনে ধরে বলল,
“আচ্ছা। এখন আমি যাই?”
অর্ষা স্মিত হেসে বলল,
“আচ্ছা।”
দর্শন কিছুদূর গিয়ে আবারও ঘুরে অর্ষাকে দেখল। অর্ষা মিষ্টি হাসল।
সবটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলিশা দেখছিল। ওদের প্রেমালাপ ওর কাছে আদিখ্যেতা লাগছিল। মনে মনে রাগে ফুসফুস করছে।
“তোমাদের এই আদিখ্যেতা আমার আর সহ্য হচ্ছে না। খুব শীঘ্রই একটা ব্যবস্থা করব।”
আগাম একটা করে বেশি পর্ব পড়তে চাইলে আমাকে ফ্লো করুন ✊🖐️
চলবে……