প্রেম_তুমি পর্ব ৩

#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৩

দর্শন অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখছে। ভর দুপুরের কড়া রোদ মেয়েটার গালে এসে পড়েছে। মুখটা ঘেমে আছে। সামনে ও পেছনের অপেক্ষাকৃত ছোট চুলগুলো ঘাড় ও কপালে লেপ্টে আছে।ডায়েরিটা হাতে নিতেই কেমন অদ্ভুত একটা আভা মেয়েটার মুখে ছড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছে ওর প্রাণ পাখি ফিরে এসছে। মেয়েটা মিষ্টি হেসে পাশের মেয়েটাকে কি যেন বলছে। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরল। দর্শনের ব্রেইন কি যেন একটা বলছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা পরিচিত। না ঠিক পরিচিত না, ওকে কোথাও দেখেছে। কোথায় দেখেছে। ব্রেইনকে প্রেশার দিতেই মনে পড়ল।
দর্শন নিজে নিজেই বলে উঠল,
“এইরে! সকালে লাইব্রেরীতেই তো এই মেয়েকে দেখলাম। কেমন বিষন্নতা ছেয়ে ছিল মুখে। চোখ দুটো তার রাত জাগার প্রমাণ দিচ্ছিল। আচ্ছা ডায়েরির জন্য নয়তো?”
দর্শন গভীর ভাবে ভেবে অবাক হলো। একটা মেয়ে একটা ডায়েরির জন্য এমন ছটফট করতে পারে? মন খারাপ করে, রাত জেগে চেহারার এই অবস্থা করতে পারে? অনুভূতি কতটা প্রখর হলে, কতটা ভালোবাসলে এতটা পাগলামি করতে পারে। দর্শন আবারও অর্ষার দিকে তাকাল। সকালে অর্ষার চেহারায় যে বিষন্ন ভান ছিল সেটা এখন আর খুঁজে পাচ্ছে না। চেহারায় আলো ঝলমল করছে। এর মানে এই না যে ও হাসছে। অর্ষা ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। দর্শনের বুকটা ধুক করে উঠল। মেয়েটা কাঁদছে। কেন কাঁদছে? ওর বুকে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেন জানি খুব খারাপ লাগছে।

অর্ষাকে প্রিয়া শান্তনা দিচ্ছে। অর্ষা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ডায়েরি ছুয়ে ছুয়ে দেখছে আর মনে মনে বলছে,
“তোমাকে ছুতে না পারি তো কী হয়েছে তোমাকে নিয়ে লেখা অব্যক্ত নিগুঢ় অনুভূতি তো ছুতে পারি। রাখতে পারি নিজের কাছে। তাতেই সন্তুষ্ট এই আমি।”

সারারাত দর্শনের ঘুম এলো না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করেছে। রাত জাগার কারণে চোখ লাল হয়ে গেছে। চোখ জ্বালা করছে। ভোর চারটা বাজে। চারদিকে অন্ধকার। দর্শন বিছানা ছাড়ল, কি করবে বুঝতে পারছে না। কোন ডিসিশন নিতে পারছে না। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আট তলা বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলার আলিসান ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রাতের বেলায় উপর থেকে সবকিছু অন্য রকম লাগছে। মনে হচ্ছে শত শত জোনাকির স্রোতে ভাসছে। বারবার অর্ষার মুখটা ভেসে উঠছে। সেই তৃপ্তি মাখা মুখ। পড়াশোনার বাইরে কোন কিছু ভাবতে চায়নি। জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ডাক্তারি পড়া, বড় ডাক্তার হওয়া। এ পথে কখনো কোন বাঁধা রাখেনি। যত বাঁধা এসেছে দু হাতে সরিয়ে দিয়েছে। প্রেম ভালোবাসাও ওর স্বপ্নের পথে বাঁধা হতে পারে কিন্তু কেন জানি অর্ষার প্রতি টান অনুভব করছে। অনেক ভেবে দেখল কিন্তু কোন সমাধান করতে পারছে না। ওর চোখ জ্বালা করছে। চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। দর্শন রুমে গিয়ে দেয়াল ঘড়িটা দেখল। পাঁচটা বাজে। সকালে কলেজে যেতে হবে। তাই ঘুমানো প্রয়োজন। দর্শন বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করতেই রাজ্যের ঘুম চোখে নেমে এল। তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।

.

লাল আর ফোলা চোখ নিয়ে দর্শন ক্লাসে গিয়ে উপস্থিত হলো। রুশানের পাশে গিয়ে বসল। ওর চেহারা দেখে রুশান কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। গতকালের ব্যাপারটার জন্য কিছুটা রাগ করে আছে। নিজ থেকে কিছুতেই কথা বলবে না বলে বাড়ি থেকে পণ করে এসেছে। কিন্তু ওর চেহারা দেখে রুশান নিজের পণের কথা ভুলে গিয়ে আচমকা প্রশ্ন করে বসে,
“দোস্ত, ঘুম কেমন হলো?”

দর্শন চমকে যায় ওর কথায়। নড়ে-চড়ে বসে। চুল আর চশমাটা ঠিক করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ঘুমিয়েছি তো। ভালো, বেশ ভালো।”
জোরপূর্বক মুখে হাসির রেখা টেনে নিল।

রুশান নাক কুঁচকে বলল,
“না ঘুমিয়ে যে চোখ-টোক ফুলিয়ে ঢোল বানিয়ে ফেলেছিস সেটা কী আয়নায় দেখিসনি? অবশ্যই দেখিসনি। দেখলে এমন অভিনয় করতি না।”

দর্শনের মুখটা চুপসে গেল। ক্লাসে স্যার চলে আশায় ওদের কনভারসনের ওখানেই সমাপ্তি ঘটল। রুশান পুরো ক্লাসে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

ক্লাস শেষে অফ পিরিয়ডে দর্শনের গ্রুপ ক্লাসের বাইরে আড্ডা দিচ্ছে। বন্ধুরা নানান কথা বলছে। দর্শন আনমনে কি যেন ভাবছে আর মাঝেমধ্যে হু হা করে যাচ্ছে। রাতুল ওকে অন্যমনস্ক দেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
“দোস্ত, মন খারাপ? কিছু হয়েছে?”

দর্শন চমকে উঠে। নড়ে-চড়ে মুখে হাসি ফোটাল। কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না ওর মনের কথা।
“কী হবে? ঠিক আছি।”

তামিম বলল,
“তোর যে কিছু একটা হয়েছে সেটা সবাই অনেকক্ষণ ধরে নোটিশ করছি। কি ব্যাপার বল তো।”

দর্শন ভাবল বলেই দেই। ওরা হেল্প করতে পারবে। কিছু সাজেশন পাওয়া যাবে।
দর্শন কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলল,
“মেয়েটাকে পেয়েছি।”

সবাই এক সাথে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
“কোন মেয়েটা?”

তারপর হতবাক হয়ে সবাই সবার দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। সবাই কৌতূহল হয়ে ওকে চেপে ধরল। দর্শন একে একে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। পিনপতন নীরবতা। কেউ নক খুটছে, কেউ মাথা চুলকাচ্ছে। দর্শন হতাশ হয়ে বসে আছে। রুশান সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে কিছুটা জোরে বলল,
“আমি একটা কথা বলি?”

সবার দৃষ্টি রুশানের দিকে। দর্শন কৌতূহল নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। কিছুটা আশা জেগে উঠেছে। রুশান পারমিশনের অপেক্ষা না করে বলল।
“দর্শন ট্রাই করে দেখতে পারিস। যা বুঝলাম মেয়েটা তোকে অনেক ভালোবাসে। জীবনে অনেক কিছু পেতে পারিস কিন্তু হতে পারে এমন ভালোবাসা জীবনে আর কখনোই এলো না। তখন আফসোস করবি। তুই যেই বিবরণ দিলি তাতে বুঝা যাচ্ছে মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী। ভালো একটা বয়ফ্রেন্ড পাওয়ার সব এবিলিটি আছে। সো হোয়াই নট?”

দর্শন কাচুমাচু মুখ নিয়ে বলল,
“এসব আমার প্লানে ছিল না।”

রুশান মুচকি হেসে ওর কাঁধে চাপট মেরে বলল,
“প্রেম ভালোবাসা প্লান করে আসে না রে বলদ। এর জন্য আলাদা প্লান করতে হয় না। হুট করে এসে লুট করে নিয়ে যায়।”

দর্শন সংশয় নিয়ে বলল,
“নারে, দোস্ত। আমি এখনো শিওর না। আমি পড়াশোনার বাইরে কিছু ভাবতে চাই না। যদি আমার পড়ার ক্ষতি হয়ে যায়?”

তামিম বলল,
“ইয়েস। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছিস। তোর ধ্যান জ্ঞান সবকিছু পড়াশোনা। প্রেমের ঝামেলায় যাস না। প্রেম ভালোবাসা অনেক প্যারা। তারপর সব হারাবি। ডাক্তার কেন কিছুই করতে পারবি না জীবনে। বরবাদ হয়ে যাবি।”

রুশান ধমকে উঠে।
“শা*লা, আমি কি বরবাদ হয়ে গেছি? আমারও তো জিএফ আছে। কই আমি তো কখনো রেজাল্ট খারাপ করিনি। এসব ভুলবার সাজেশন একদম দিবি না।”

দর্শনের ভালো লাগছে না। দুজন দু কথা বলছে।
“তোরা থাম, আপাতত এ-সব বাদ। পরে ভেবে দেখা যাবে।”

রুশান তাচ্ছিল্য করে বলল,
“তুই পরেই ভাবিস। তখন দেখবি পাখি অন্য খাঁচায়।”

দর্শন গম্ভীরমুখে বলল,
“তাহলে তো বেঁচে যাই।”

অর্ষার ফার্স ক্লাসের পর বাইরে এসেছিল একটা দরকারে। স্যার ক্লাসে চলে যাবে তাই দ্রুত ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। তখনই পাশ থেকে একটা ছেলে টিচ করে বলল,
“আরে, আরে! পরে গিয়ে পা ভাঙবে।”

অর্ষার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ঘুরে নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে মাঠের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখতে। কিন্তু সে সময় নেই। কিন্তু কিছু একটা জবাব না দিয়ে যাওয়ার মেয়ে ও না। তাই চোখ ছোট ছোট করে পাশে ঘুরে বলল,
“পা ভাঙলে আপনার ঘাড়ে গিয়ে চাপব না। নিশ্চিত থাকুন।”

“কেন? আমাদের মধ্যে কাউকে পছন্দ হয় না?”

অর্ষা রাগে ওর দিকে ঘুরে ভালো করে না দেখে রাগী ফেস করে বলল,
“সিনিয়র হয়েছেন বলে কি ভেবেছেন যা খুশি বলবেন মাথায় তুলে নাচব? তাহলে ভুল ভেবেছেন। শ্রদ্ধায় যেমন মাথায় তুলতে পারি তেমনই প্রয়োজনে ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মেরে মাটিতে ফেলতি পারি। নেক্সট টাইম আমার সাথে ফাজলামো করতে আসবেন না।”
আঙুল তুলে রাগ ঝারতেই দর্শনকে দেখতে পেল। যে ছেলেটা এসব বলছে তার ঠিক দুজন ছেলের পরে দর্শন দাঁড়িয়ে। দর্শন কেমন কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে রুশানের দিকে চেয়ে। কি যেন বলতে চাইছে। হঠাৎ করেই ওর চোখ পড়ল অর্ষার সাথে। অর্ষা ভালো করে দেখল ওরা তো দর্শনের বন্ধুরা। অর্ষা চেহারার কাঠিন্য দূর করে মুখটা নরম করে তাকাল। চোখে যে আগুনের ফুলকি জ্বলছিল তা মুহুর্তেই নিভিয়ে মায়া মায়া চোখে তাকাল। রুশান সে দৃষ্টি লক্ষ্য করে মুখ চেপে হাসল।

রুশান গলা ঝেরে বলল,
“সরি সিস্টার। মজা করছিলাম। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আসলে আমার বন্ধুর মন খারাপ তো তাই মন ভালো করার চেষ্টা করছিলাম। সরি। ( দর্শনের কাঁধে হাত দিয়ে)”

অর্ষা ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করল,
“কেন? কী হয়েছে?”
তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“ইটস ওকে।”

রুশান রসিয়ে রসিয়ে বলল,
“এ বয়সে একটু একটু মন খারাপ হয়। সেটা ব্যাপার না। আসলে ও না…”

দর্শন দাঁতে দাঁত চেপে রুশানের কাঁধ চেপে ধরে বলল,
“রুশান!”

রুশান হাসি ও কথা বন্ধ করে বলল,
“ইউ ক্যান গো। সরি! সরি!”

অর্ষা ইনোসেন্ট মুখ করে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ঠিক আছে।”

অর্ষা দ্রুত ঘুরে গেল। কেমন লজ্জা লজ্জা অনুভূতি হচ্ছে। শরীর খারাপ লাগছে। বুকে হাত দিতেই অবাক হয়ে গেল। ওর হার্টবিট ফার্স্ট চলছে। আজকাল কী যে হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ কেন দর্শনের সামনে পড়ে যাই। আল্লাহ! আমি তো মরে যাব। বুক এত ধুকপুক করছে কেন?

অর্ষা যেতেই দর্শন কটমট করে রুশানের দিকে তাকায়। রুশান দাঁড় কেলিয়ে হেসে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়। দর্শন ওকে ধরার জন্য ওর পেছনে যাচ্ছে।
“আজ তোকে মেরেই ফেলব বেয়াদব।”

আগাম একটা করে বেশি পর্ব পড়তে চাইলে আমাকে ফ্লো করুন 🖐️✊
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here