প্রেম_তুমি পর্ব ৪

#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৪

বেলায় বেলায় অনেকগুলো দিন পাড় হয়ে গেল। বিষাদের রাত কাটল নতুন দিন এলো। নতুন স্বপ্ন নিয়ে। অর্ষা কলেজে যাচ্ছে গাড়ি ছাড়া। আজ ওর বাবা দরকারী কাজে আগেই বের হয়ে গেছে তাই ও বাসা থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে রিকশার জন্য। কিন্তু রিকশা আসছে না। ওর বাবা বলেছিল একটা ক্যাব বুক করে দিবে। কিন্তু অর্ষা জানায় ও রিকশা করে যাবে। আর রিকশা নিজেই ঠিক করে নিবে সমস্যা হবে না। রোজ কলেজে যাওয়ার সময় অনেক রিকশা দেখে ও। কিন্তু এখন ওর বিরক্ত লাগছে। একটাও রিকশা নেই। এই রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘেমে যাচ্ছে। অর্ষা সামনের দিকে আরেকটু এগিয়ে গেল। ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে কপাল আর নাকের ঘাম মুছে নিল। টিস্যুটা ফেলে ডানে বামে চেয়ে রিকশা খুঁজছে। হঠাৎ সামনের দিকে একটা রিকশা থেমে গেল। রিকশা থেকে একটা মেয়ে বলছে,
“এই, আমার রিকশায় আসো। রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার লেট হয়ে যাবে।”
অর্ষা পেছনে, ডানে-বামে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ওকে বলছে কি-না। অর্ষা আশেপাশে রিকশায় যাওয়ার মতো কাউকে দেখতে পেল না।

অর্ষা বুঝতে পারল ওকে ডাকছে। তবুও ফর্মালিটি পালন করার জন্য প্রশ্ন করল,
“আমাকে বলছেন?”

“হ্যা, তোমাকেই। আমি কলেজে যাচ্ছি। আমার সাথে চলে এসো। ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে।”

অর্ষা খেয়াল করল মেয়েটার গায়ে ওদের কলেজের ড্রেস। কিন্তু অপরিচিত কারো সাথে যেতে ইচ্ছে করছে না। হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। যথেষ্ট সময় আছে। কিন্তু রিকশার জন্য অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য ওর নেই। তবুও বলল,
“ঠিক আছে, আপনি যান। আপনার অসুবিধা করতে চাই না। আমি আরেকটু অপেক্ষা করি।”

মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলল,
“কোন অসুবিধা নেই। চলে এসো।”

অর্ষা অগত্যা উপায় না পেয়ে রিকশায় উঠে বসে। আলাপচারিতার এক সময়ে জানতে পারল মেয়েটা সেকেন্ড ইয়ারের বিজ্ঞানের ছাত্রী। ওর নাম অর্পা। পড়াশোনায় দুর্দান্ত। কলেজের পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে ওর অবস্থান। তার মানে দর্শনের কাছাকাছি স্টুডেন্ট। অর্ষা মনে মনে প্লান করে ফেলেছে। এই মেয়ের সাথে ভাব জমাবে। গভীর ভাব। জমে খির হয়ে যাওয়ার মতো ভাব। ওর কাছ থেকে দর্শনের সম্পর্কে জানবে তারপর দর্শনের কাছাকাছি যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। রাস্তায় এটুকু সময়ের মধ্যে অর্ষা মেয়েটার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলল।
কলেজে এসে হাত ঘড়িতে সময় দেখল অর্ষা। এখনো দশ মিনিট সময় আছে। তবুও ফুলানোর জন্য বলল,
“ধন্যবাদ আপু, তোমার জন্য সময় মতো আসতে পেরেছি। অনেক ধন্যবাদ।”

“এত ধন্যবাদ দিতে হবে না। ক্লাসে যাও। ভালো করে পড়াশোনা করো।”

অর্ষা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললেও মনে মনে বলল,
“দূর! পড়াশোনা, এই টপিকটা নিয়ে যে পারে ফ্রিতে জ্ঞান দিয়ে যায়। বিরক্তিকর!”

….

দর্শন ক্লাসে যাওয়ার সময় অর্ষাকে দেখল। অর্ষা আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটছে। আর বারবার এদিক সেদিক দেখছে। পেছনে থেকে কে যেন ওকে ডাকছে। অর্ষা সেদিকে চেয়ে কি যেন বলল। তারপর আবার হেঁটে চলে যাচ্ছে। দর্শনকে অর্ষা দেখেনি। অর্ষাকে চুপিচুপি দর্শন দেখছে। কিন্তু সেটা আর চুপিচুপি রইল না। পেছনে থেকে রুশান ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“দোস্ত, কী করিস?”

দর্শন আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। কাচুমাচু মুখ করে বলল,
“এমনি দাঁড়িয়ে আছি। চল ক্লাসে যাই।”

“ক্লাসে যাওয়ার আগের গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস শেষ?”

“মানে?”

রুশান আলতো হেসে বলল,
“কিছু না। চল ক্লাসে যাই।”

দর্শন মনে মনে ওকে গালাগাল করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“চল।”

ব্রেক টাইমে অর্ষা আর প্রিয়া এক সাথে হাঁটছে। ওরা ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছে। তখনই অর্পা ওকে ডাকল। অর্ষা যেতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে ওর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। প্রিয়াকে বলল ক্যানটিনে গিয়ে ওর জন্য খাবার অর্ডার করতে। অর্ষা অর্পার কাছে গিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল,
“কেমন আছো আপু?”

অর্পা চুলের বিনুনি টানতে টানতে বলল,
“ভালো। তোমার কী খবর?”

“ভালো।”

“কই যাচ্ছিলে?”

“ক্যান্টিনে, খেতে। ক্ষুধা লাগছে খুব।”

“ওহ, আমিও তো যাচ্ছি। চল এক সাথে যাই।”

অর্ষা শুধু মনে মনে বলছে পড়াশোনার জ্ঞান যেন না দেয় বাকি সব ঠিক আছে। অর্পা আর অর্ষা নানান কথা বলতে বলতে ক্যানটিনে গেল। ক্যানটিনে গিয়ে অর্পা দাঁড়িয়ে গেল। তারপর হঠাৎ অর্ষার হাত চেপে ধরে বলল,
“চল, আমার ফ্রেন্ডদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।”

অর্ষা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের কাছে গেল। অর্ষা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। চারটা মেয়ে এক সাথে আড্ডা দিচ্ছে। তার পাশের টেবিলে কতগুলো ছেলে বসে আছে। অর্ষা প্রিয়াকে খুঁজছে। অর্পা ওর বান্ধবীদের দেখিয়ে বলল,
“ওরা আমার ফ্রেন্ড। আসো জয়েন করো।”

অর্ষা অনিচ্ছা প্রকাশ করে বলল,
“তোমরা এঞ্জয় করো সমস্যা নাই। আমার ফ্রে… ”

অর্ষা কথা থামিয়ে দিল যখন রুশানের কন্ঠ পেল।
“অর্পা, কে হয় তোমার?”
রুশান ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্ষা রুশানকে দেখে একটু সরে দাঁড়াল। অর্পা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেন? তোমার কী দরকার?”

রুশান আবারও ওদের পাসের টেবিলের একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল। সেদিকে চোখ যেতেই অর্ষা দর্শনকে দেখতে পেল। অর্ষার আবারও আনইজি লাগছে আবার দর্শনের কাছাকাছি থাকতেও ইচ্ছে করছে।
“জিজ্ঞেস করলাম। জিজ্ঞেস করতে পারি না?”

অর্পা বলল,
“ওর নাম অর্ষা। ফার্স্ট ইয়ার।”

“অর্ষা, অর্পা। তোমরা দুই বোন না-কি?”
রুশান ফাজলামো করে বলল।
অর্পা ওকে মেরে বলল,
“তুমি জানো না আমার কোন বোন নেই। একদিন রিকশায় লিফট দিয়েছিলাম তারপর পরিচয়।”

রুশান মার খেয়ে দাঁত কেলিয়ে হিহি করে হাসল।
তারপর বলল,
“অর্পা আর অর্ষা দুটোর মধ্যে গুলিয়ে ফেলব। একই মনে হচ্ছে।”

তামিম ওর পিঠে মেরে বলল,
“তোর কি মরার ইচ্ছে হয়েছে? অর্পার সাথে গুলিয়ে ফেলবি এটা আবার অর্পাকে বলছিস। অর্পা তোকে এখুনি গুলি মারবে।”
অর্পা তখনই চোখ পাকিয়ে তাকাল।

অর্ষা কিছু বুঝতে না পেরে বলল,
“আমার কলেজের নাম অন্বেষা হাসান। আপনি এই নামে ডাকতে পারেন।”

রুশান মাথা চুলকে বলল,
“তাহলে অর্ষাই ঠিক আছে।”

অর্পা সব বাদ দিয়ে অর্ষাকে বলল,
“ওরা সবাই আমার ফ্রেন্ড। ও বাদে। (রুশানকে দেখিয়ে)”

অর্ষা বোকার মতো বলল,
“ও কি তাহলে তোমার ভাই?”

পুরো বন্ধু মহলে হাসির রোল পড়ে গেল। সবাই ওর কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রুশানও মুখ টিপে হাসছে। অর্পা গোল গোল চোখ করে চেয়ে আছে। অর্ষা বোকা বনে গেল। সবাই কেন হাসছে বুঝতে পারছে না। মুখটা পেঁচার মতো করে রাখলেও ভেতরে রাগে ফুপাচ্ছে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারছে না।
অর্ষার বোকা বোকা চেহারা দেখে অর্পা চেঁচিয়ে বলল,
“স্টপ গাইজ! এত হাসির কিছু হয়নি। তোরা কিছু একটা পেলে চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে হো হো শুরু করে দিস৷ হাসির জন্য শুধু একটা টপিক খুঁজিস। জঘন্য।”

রুশান বলল,
“ইয়েস! গাইস, হাসি বন্ধ কর। অর্ষা, আমি ওর ভাই নই৷ আচ্ছা ভাই হলে কী করতে? আমার সাথে প্রেম করতে?”
দর্শন গোপনে রুশানকে ধাক্কা মারল।

অর্ষা ভ্রু কুঁচকালো। তারপর বলল,
“আমার এতটাও খারাপ দিন আসেনি। হুহ!”

অর্ষার কথায় আবার সবাই হেসে ফেলল। রুশান ইন্সাল্ট ফিল করার মতো ভাব করল। অর্পা বলল,
“ঠিক বলেছো। খারাপ দিন শুধু আমার এসেছে। তাই তো এক বছর ধরে ওকে সহ্য করছি।”

অর্ষা এইবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল। বুঝতে পেরে ভীষণ লজ্জা পেল৷ অর্পার সামনে রুশানকে এসব কথা বলায়। জিভ কেটে সরি বলল।

“আরে, বাদ দেও। ও যে একটা ঢেরশ সবাই জানে। তোমার কথা বলো। আসো, বসো।”

অর্ষা প্রিয়ার কথা ভুলে ওদের সাথে আড্ডা দিতে বসে গেল শুধুমাত্র দর্শনের খাতিরে৷ হয়তো এভাবেই একদিন ওরা কাছাকাছি আসবে।
অর্ষা বলতে লাগল,
“আমার কথা আর কী বলব। পড়াশোনায় প্রচন্ড ফাঁকি দেই। পড়তে একদমই ইচ্ছে করে না। আমি আড্ডা আর পার্টি প্রিয়। বন্ধুদের সাথে হৈ হুল্লোড় করতে ভীষণ ভালোবাসি। আমি অনেক দুষ্ট। কেউ উলটা পালটা বললে প্রচন্ড রেগে যাই। আমার রাগ আর জেদ দুটোই বেশি। আর হ্যাঁ, আমার মধ্যে মেয়েলি গুণ কম। অতিমাত্রায় কম।”
অর্ষা অকপটে স্বীকার করল নিজের সব কিছু। অর্ষা আলাপের অজুহাতে দর্শনকে নিজের অনেক কিছুই বলে দিল।

সবাইকে অবাক হতে দেখে অর্ষা মিষ্টি হেসে বলল,
“আসলে আমি যেমন তেমনটাই সবার কাছে স্বীকার করি। ফেক মানুষ আমার একদম পছন্দ নয়।”
অর্পা জিজ্ঞেস করল,
“বয়ফ্রেন্ড?”
অর্ষা আবারও মিষ্টি হাসল। মিষ্টি হেসে বলল,
“নেই৷ আমি সিঙ্গেল। তবে একজনকে প্রচন্ড ভালোবাসি।”
অর্পা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“কাকে? কে সে?”
অর্ষা গভীর অনুভূতি নিয়ে প্রেমের রাজ্যে হারিয়ে আসক্তি নিয়ে বলল,
“সে আমার একতরফা অব্যক্ত ভালোবাসা।”

রুশান, দর্শনের কনুই দিয়ে বুকে আঘাত করে রহস্যময় হাসি দিল। দর্শনের ভেতরে একটা শিহরণ বয়ে গেল। ঠোঁটের কোনে ইষত হাসি ফুটল।

সবাই বুঝতে পারল অর্ষা তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। অর্পা তাই প্রসঙ্গ এড়াতে বলল,
“তোমার বাড়িতে কে কে আছে?”
অর্ষা চট করে উত্তর দিল,
“বাবা!”
“আর মা?”
“মা নেই,আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন। বাবাকে নিঃস্ব করে চলে গেছেন।”
অর্ষার সহজ উত্তর। অর্ষার এই সহজ উত্তরটা সবাইকে আহত আর বিমর্ষ করল বিশেষ করে দর্শনকে। দর্শনের বুকে গিয়ে লাগল কথাটা। অর্ষার চোখে যে ব্যথা দেখতে পারছে সেটা ওর বুকে ক্ষতের সৃষ্টি করল। সেই ক্ষত থেকে তাৎক্ষণিক রক্ত ঝড়তে লাগল। সেই রক্ত যেন কেউ দেখতে না পায় তাই দর্শন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“সময় হয়েছে। আমাদের যাওয়া উচিত। এই অসমাপ্ত আড্ডাটা আরেকদিন সমাপ্ত করা যাবে।”
অর্ষা দর্শনের দিকে তাকাল। দুজন দুজনার চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইল। তারপর অর্ষাও উঠে দাঁড়াল।
“আমার ফ্রেন্ড আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি যাই তাহলে।”
অর্ষা চেয়ার সরিয়ে ওর বেবি চুলগুলো কানের পেছনে গুজে আবারও মিষ্টি হাসল।সবার থেকে বিদায় নিল। দর্শন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।

….

দুদিন পরের কথা,,
রুশান কাঁদো কাঁদো মুখ করে দর্শনকে বলল,
“দোস্ত, আমার ব্রেকাপ হয়ে গেছে। অর্পা আমার সাথে ব্রেকাপ করেছে। নতুন বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছে।”

দর্শন ওকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“তাতে কী?”

রুশান অবাক হয়ে বলল,
“তাতে কী মানে? আমার ব্রেকাপ হয়েছে। আমাকে এই মুহুর্তে শান্তনা দিবি। বলবি মন খারাপ করিস না। ওর চেয়ে ভালো কাউকে পেয়ে যাবি। ও তোর যোগ্য না।”

“এই চুপ কর তো৷ তোর কী শান্তনা সত্যিই প্রয়োজন আছে? আমি কী কিছু বুঝি না? নতুন কাকে জুটিয়েছিস বল তো?”
নাক কুঁচকে ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞেস করল।

রুশান লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“অর্পার ছোট বোন ফার্স্ট ইয়ারের সেই মেয়েটা অর্ষা।”

রুশানের কথা শুনে দর্শনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কি রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারছে না। রুশান এসব কী বলছে!

আগাম একটা করে বেশি পর্ব পড়তে চাইলে আমাকে ফ্লো করুন 🖐️✊

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here