প্রেম_তুমি পর্ব ৯

#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৯

অসময়ে বৃষ্টি পড়ছে। সে অসময়টা হচ্ছে দুপুর বারোটা। রোদের প্রখরতা শহরকে ঝলসে দিচ্ছে এরই মধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি। আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে প্রকাণ্ড শব্দ করে বিনা নোটিশে আকস্মিক ঝুম বৃষ্টি নেমে গেল। ফুটপাতের বিক্রেতারা তাদের মালামাল গুছানোরও সময় পায়নি। ওরা মালপত্র সরানোর জন্য দৌড়াদৌড়ি করছে। অর্ষা জানালার পর্দা সরিয়ে আনমনে চেয়ে আছে। বৃষ্টির ফোটা তীব্রভাবে আঘাত করছে কাঁচটাকে। অর্ষা সেদিকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। বৃষ্টি আর কাচের খেলা। বৃষ্টির ফোটা আঘাত করতে গিয়ে নিজেই কাচ বেয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
তারপর ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
“আমাকে যারা আঘাতে আঘাতে ভাঙতে চাইবে তারা নিজেরাই ভেঙে যাবে ওই বৃষ্টির ফোটার মত।”
ঠোঁটে নাড়িয়ে ফিসফিস করে বললছে,
“আমার সারাটি দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।”

ক্লাসের সময়টা আলসেমি লাগছে। বাইরে কেমন ঝুম বৃষ্টি সাথে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুৎ চলে গেছে। কলেজের জেনারেটর অন করে দেওয়া হয়েছে। তবুও সবকিছু অন্ধকার মনে হচ্ছে। দর্শন জানালা দিয়ে দেখল বারান্দায় স্যারকে দেখা যাচ্ছে। তিনি ছাতা হাতে। শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে ক্লাসের দিকে আসছেন। দর্শন মনে মনে বেশ বিরক্ত হলো। মাথায় বৃষ্টি বয়ে ক্লাসে আসার কী দরকার ছিল। মনটা ওর ভীষণ খারাপ। গতকাল অর্ষার সাথে জঘন্য ব্যবহার করে ফেলেছে। এতটা জঘন্য ব্যবহার না করলেও পারত। এর জন্য অনুতপ্ত ও৷ গতকাল থেকেই মনটা অশান্ত হয়ে রয়েছে। ঘুম আসেনি ঠিকমতো। ভালো লাগছে না কিছুই৷ অর্ষাকে এতগুলো কথা শুনানোর অধিকার ওর নেই। অর্ষা যা খুশি করতে পারে, যেখানে খুশি যেতে পারে যার সাথে ইচ্ছে কথা বলতে পারে। এখানে ওর হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। শুধুমাত্র অর্ষা ওকে পছন্দ করে এই কারণে ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারে না। নাকি দর্শন ওকে পছন্দ করে তাই এ ব্যবহার? দর্শন আর কিছু ভাবার সুযোগ পেল না স্যার ক্লাসে চলে এসেছে।

~পরের দিন ~
মন খারাপ ঝেরে ফেলে অর্ষা ফুরফুরে মনে কলেজে এসেছে। গতকাল মন খারাপ থাকায় কলেজে আসেনি। নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছিল। পেছনে থেকে প্রিয়া ওকে ডাকছে। প্রিয়ার ডাক শুনে অর্ষা দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে ঘুরে ওর দিকে হাসি মুখ করে দাঁড়াল।
আলিশাও ক্লাসে যাচ্ছিল। অর্ষাকে দেখে ওর বান্ধবী রুপাকে বলছে,
“ওই মেয়েটাকে দেখেছিস? অর্ষা চিনিস ওকে?”
রুপা অর্ষাকে দেখে বলল,
“হ্যাঁ, চিনবো না কেন? চিনি তো। ফার্স্ট ইয়ার। আমাদের স্কুলেই তো ছিল। সব প্রোগ্রামে নাচ-গান করত।”
“হ্যা, যোগ্যতা ওইটুকুই আছে। পড়াশোনায় ডাব্বা। কোনমতে পাস করে যায়। ওর মধ্যে মেয়েলি কোন ভাব নেই। জিন্স,টপ্স,লেডিস্ শার্ট, টি-শার্ট, জ্যাকেট ছাড়া কখনো নরমাল ড্রেসে দেখেছিস? আমরা বিভিন্ন প্রোগ্রামের সাথে মানানসই পোশাক পরি। আর ও সব জায়গায় এক। আর হাতে সব সময় ঘড়ি। আমরা ব্রেসলেট, ঘড়ি, চুড়ি কত কি পরি। আর পায়ে কখনো মেয়েদের জুতা দেখিনি। সব সময় ছেলেদের জুতা পরে। কানে, গলায় আজ পর্যন্ত কিছু পরতে দেখিনি। ঠোঁটে লিপস্টিক আর চোখে কাজল? হাহা? কখনো না৷ চুলগুলো খোলা রাখবে নয়তো ঝুঁটি করে রাখবে। উফফ! কী বিশ্রী মেয়ে! সে আবার এসেছে প্রিন্স চার্মিংকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে।”

রুপা বুঝতে পারছে না আলিশা ওকে নিয়ে এত নিন্দে কেন করছে। অর্ষা দেখতে মোটেও খারাপ না। শুধু ওর পোশাক পরিচ্ছেদে একটু সমস্যা সেটা সলভ করতে সময় লাগবে না। তবে এটুকু বুঝতে পারছে ওর প্রতি কোন কারণে ক্ষেপে আছে। নিশ্চয়ই ওর স্বার্থে হানা দিয়েছে।
কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“দোস্ত, ঘটনা কী বল তো?”
আলিশা দাঁত খিচে বলল,
“ও না-কি দর্শনকে ভালোবাসে। বামুন হয়ে চাঁদের দিকে হাত দিয়েছে৷ কী যোগ্যতা আছে ওর বল তো?”
রুপা ওর কথা শুনে বলল,
“ওকে মোটেও আমার চাঁদ মনে হয় না। সহজ সাধারণ একটা ছেলে দর্শন।”
“বাট ওকে আমার অসাধারণ লাগে। এই মেয়েটা ওকে কিছুতেই পেতে পারে না। দর্শনও ওকে পাত্তা দেয় না।”
“তাহলে তুই এত হাইপার কেন হচ্ছিস? দর্শন ওকে যেহেতু পছন্দ করে না সেহেতু ভাবনার কিছু নেই।”
“আছে রে, ওর বন্ধুরা ওদের এক করার জন্য ট্রাই করছে। অর্পার পার্টিতে না গেলে এটা আমার অজানা রয়ে যেত। রুশান আর অর্পা ওদের জন্য অনেক কিছু প্লান করেছে আর কিছু কিছু প্লান সাকসেস। বুঝতে পারছিস সিচুয়েশনটা?”
“ওহ! তাই তুই এত হাইপার? ছেড়ে দে ওর চেয়ে ভালো ছেলে পেয়ে যাবি।”
“অবশ্যই পাব। আমি দেখতে সুন্দর, পড়াশোনায় ভালো, কোটিপতি বাবার একমাত্র মেয়ে। তবে আমার ইগো হার্ট হচ্ছে। দর্শন আমাকে ইগনোর করে অর্ষার মতো মেয়ের কাছে হার মানবে, ইম্পসিবল!”
আলিশা, অর্ষাকে দেখতে দেখতে কথাগুলো বলল। তারপর ওকে ডাকল।
“এই মেয়ে দাঁড়াও।”

অর্ষা দাঁড়াল। তারপর ডান ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“অন্বেষা হাসান।”
“সে যাইহোক, তোমাকে একটা ওয়ার্নিং দিচ্ছি, স্টে এওয়ে ফ্রম দর্শন।”
অর্ষা চমকে উঠে। ওর বুক ধুকপুক করছে। এ মেয়ে কী করে জানল? বিস্ময়ে ওর চোখ বড়বড় হয়ে গেল।
প্রিয়া ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“কেন? তুমি ওয়ার্নিং দেওয়ার কে?”
অর্ষা ওকে থামিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
“আমি ওর সাথে ঘেঁষে থাকি কখন যে ওর কাছ থেকে দূরে থাকব?”
“আমি বলতে চাইছি ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো।”
“আমার স্বপ্ন তোমার ব্যক্তিগত প্রতিপত্তি নয়। আমার স্বপ্ন আমার সম্পত্তি। তাই এ ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ আমি টলারেট করব না। তাই বাজে বকা বন্ধ করো।”
“ডূ ইউ নো হু আই এম?”
“নট ইন্টারেস্টেড। বাই।”
অর্ষা মুচকি হেসে জবাব দিল।
“তোমার যে শ্রী, তোমার মত মেয়েকে দর্শন পাত্তা দেয় না আর দেবেও না।”
“সেটা দর্শন ভাববে। তুমি কষ্ট করে ভাবতে যেও না।”
“হ্যাঁ, কারণ দর্শনকে ফাঁদে ফেলার প্রি প্লান তো করে রেখেছে। আর তোমার ক্রাইম পার্টনার কারা তাও জানি।”
অর্ষা কপাল কুঁচকালো। ওর ক্রাইম পার্টনার মানে কী? অর্ষা তো কাউকে বলেনি পর্যন্ত আর সেখানে পার্টনার, প্রি-প্লান মানে কী? সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে চোখের পলক ফেলে বোঝার চেষ্টা করছে।
আলিশা তাচ্ছিল্য হাসল। তারপর বলল,
“এখন না বোঝার ভান করছো তাই না? দর্শন যেদিন সত্যটা জানবে সেদিন অনেকগুলো সম্পর্ক ভাঙবে।”
“এই তুমি কী বলছো? সরাসরি বলো। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“কেন অর্পা আর রুশান। মনে পড়ছে?”
অর্ষার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এই মেয়ে কী বলছে? ওরা তো ওর ফিলিংয়ের কথা জানেই না। আর ওরা কেন নিজেদের বন্ধুকে রেখে ওকে কেন সাপোর্ট দিবে?
“অদ্ভুত কথাবার্তা। একদম ভিত্তিহীন কথা বলবে না।”
“তাহলে চলো, ওদের সামনে কথাটা বলো। সব প্রমাণ হয়ে যাক।”
ওরা এসব ব্যাপারে জানেই না তাই অর্ষা যেতে রাজি হচ্ছে না। একটা সিনক্রিয়েট হবে শুধু শুধু।
“কী হাওয়া বের হয়ে গেল? সব ফাঁস করে দেব দর্শনের কাছে?”
দর্শনকে গিয়ে কী উলটা পালটা কথা বলবে কে জানে।

……

আলিশা ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অর্পার কাছে। অর্ষা, অর্পার কাছে গিয়ে বলল,
“আপু, এই মেয়েটা কী বলছে?”
অর্পা অবাক হয়ে বলল,
“কী বলছে?”
আলিশা বলল,
“আমি সব জানি।”
“কী জানিস?”
“এখন না বোঝার ভান করিস না। অর্ষা, তুই আর রুশান কী চাল চেলেছিস?”
অর্পা ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“কিসের চাল? কী বলছিস মাথা ঠিক আছে? ”
অর্ষা কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল,
“দেখো কলেজে আসতে না আসতে কিসব বলছে। আমি নাকি তোমার সাথে মিলে কিসের প্লান করেছি, কাকে ফাঁসাচ্ছি। মেজাজই খারাপ করে দিচ্ছে এক কথা বলে। আবার এখানে জোর করে নিয়ে এল।”
এরই মধ্যে অর্পা আর অর্ষার ফ্রেন্ড সার্কেল সবাই জড়ো হয়ে গেল।
আলিশা চেঁচিয়ে উঠল,
“আমি পার্টিতে সব শুনেছি। তোরা মিলে অর্ষা আর দর্শনকে এক করতে চাস। ওদের প্রেম করিয়ে দিতে চাস। এইজন্য অর্ষাকে সব সময় দর্শনের কাছাকাছি আনার চেষ্টা করিস। আর রুশানের সাথে মিথ্যা প্রেমের নাটক করছিস। রুশান আর অর্ষা ইচ্ছে করে নাটক করছে দর্শনকে জেলাস ফিল করাতে। এসব মিথ্যা?”

দর্শন আলিশার মুখে সব শুনে থ। অবিশ্বাসের চোখে রুশানের দিকে তাকাল। রুশান আমতা-আমতা করে বলল,
“হ্যাঁ সবটা সত্য। অর্ষা যে তোকে কতটা ভালোবাসে এটা তুইও জানিস। আর তুই ওকে ভালোবাসিস এটা ফিল করানোর জন্য একটু চেষ্টা করেছি। সেটা প্রথম দিকে তুইও জানতিস।”

দর্শন ফিসফিস করে বলল,
“অর্ষা জানতো যে আমি জানি? সব জেনে অভিনয় করেছিল? ও আমার সাথে অভিনয় করেছিল?”
রুশান ওর লাল ক্ষিপ্ত চোখ দেখে চুপসে গেল।
থমথমে মুখে বলল,
“না, ও অভিনয় করেনি। ট্রাস্ট মি।”
রুশানের কথায় নার্ভাসনেস কাজ করছিল তাই কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নি।
দর্শন চোখ গরম করে রুশানের দিকে তাকাল। রাগে ওর গা হিরহির করছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তোরা কাজটা ঠিক করিস নি।
দর্শন চলে যেতে নিলে আলিশা ডেকে বলল,
” ওকে তো বলে যাও কিছু।”
অর্ষা লজ্জা আর আতংকে মাথা নিচু করে রেখেছে। দর্শন ওর ফিলিংস জেনে গেছে আর ওকে অবিশ্বাসও করছে। দ্বিধা আর সংশয়ে মাথা তুলতে পারছে না।
দর্শন অর্ষার দিকে চেয়ে বলল,
“ওকে কী বলব? কেন বলব? ওকে আমি কিছু বলার কে? ওকে আমার কিছু বলার নাই।”
অর্ষা চোখ তুলে একবার তাকাল৷ ওর চোখে কিছু চাওয়া ছিল। চোখ তুলে তাকাতেই দর্শনের রাগে জ্বলতে থাকা লাল চোখে চোখ পড়ে। অর্ষা অপরাধীর মতো চোখ নামিয়ে নিল। অর্পা আর রুশান দর্শনের পেছনে ছুটল ওকে বোঝানোর জন্য।
দর্শন চলে যেতেই আলিশা হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে জোরে সবাইকে শুনিয়ে বলল,
“ও নিজের চেহারা আয়নায় দেখেছে? দর্শনের মতো ছেলে ওকে পাত্তা দিবে? কী বলে গেল শুনেছো অর্ষা? না-কি শুনোনি। তোমাকে ওর বলার কিছু নেই।”
আলিশা খোচা মেরে মেরে অনেক কথা বলল। উপস্থিত জনতা গুনগুন করে নিজেদের মধ্যে হাজার কথা বলতে লাগল। পাব্লিক প্লেসে এমন ভাবে রিজেক্ট হওয়া মেনে নিতে পারছে না অর্ষা।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here