ফিঙের_ডানা
পর্ব-১
আমরা সবচেয়ে উত্তরের ঘরদুটো ভাড়া নিয়েছি। এদিকে উঁচু করে পাঁচিল তোলা। পাঁচিলের গা ঘেষে দুটো সেগুন গাছ অনেক ওপরে উঠে গেছে। সারাদিন বড় বড় পাতা পড়ে ঢেকে থাকে নিচটা। বাড়ির অন্য চারদিক কিন্তু খোলা। শুধু এদিকেই এত লম্বা দেয়াল কেন সেই ব্যাখ্যা জানতে ইচ্ছে করছে শুরু থেকেই। কিন্তু ভাড়াটেরা কেউ জানে না। এই প্রশ্ন করতে তো বাড়িওয়ালার বাড়িতে যাওয়া যায় না!
মাত্র চারদিন হলো নতুন বাসায় ভাড়া এসেছি। সব গুছিয়ে উঠতে পারিনি এখনো। নিজেদের বাড়ির জন্য সবসময় মন কেমন করছে। ঘর গোছাতে ইচ্ছে করে না, শুয়ে, বসে কোনোভাবেই শান্তি পাই না৷ যেন জীবনটা মন খারাপের মেঘে ঢেকে গেছে। মেঘ কেটে এক পশলা বৃষ্টিও হচ্ছে না! যাচ্ছেতাই অবস্থা!
এই জায়গাটা সুন্দর। পেছনের জানালা খুললেই ঘাসে ঢাকা জমি। খানিকটা গাছপালা ঘেরা জঙ্গল মতো জায়গা। তারপর পুকুর। পুকুরের ওপাড়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। শীতকাল বলে দিনগুলো কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে থাকে৷ পুকুরের ওপর ঝুলতে থাকে কুয়াশার মেঘ। মাঝে মাঝে জানালার সামনে বসে বড় করে নিঃশ্বাস নিলে বুকের ভেতরটা জুড়িয়ে যায়।
না, অন্যদের মতো বাবার বদলির সুবাদে আমাদের বাড়ি বা শহর বদল হয়নি। আমার বাবা নেই। মায়ের একটা কিছু করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। নইলে যে সংসার চলছিল না। এই মা-মেয়ের ছোট্ট দুটো পেট ভরাতেও চাচাদের কত কথা! চাচীদের কত না যন্ত্রণা! অবশেষে এক বান্ধবীর খাতিরে চাকরিটা পেল মা। আমার সেরকম যোগ্যতা থাকলে কাজ আমিই করতাম। কিন্তু ইন্টার পাশ মেয়েকে কে ই বা চাকরি দেবে এই দুর্মুল্যের বাজারে!
বাড়িটার দুটো অংশ। একপাশে ভাড়াটিয়ারা থাকে। অন্যপাশে বাড়িওয়ালারা৷ দু’পাশের মাঝে বাউন্ডারি নেই কোনো। আছে ফুলের বাগান। পাতাবাহার, গোলাপ, বেলী, টগর, আর সন্ধ্যামালতির ঝাড়। পেছনে গাছপালা থাকায় পাখির কিচিরমিচির কম শোনা যায় না। ঠিক দুপুরবেলা যখন বাড়িটা কোলাহলমুক্ত থাকে, তখন একজোড়া ঘুঘু ঠিক আমার জানালার পাশের গাছটাতে বসে ডাকতে থাকে। এই চারদিনেই যেন ওরা আপন হয়ে গেছে।
বিকেলে কাজকর্ম নেই। একা আর কী করব! ঘর থেকে বের হয়ে বড় বড় সেগুনের পাতা মাড়িয়ে বাড়ির পেছনে চলে গেলাম৷ ঘাস জমি পেরিয়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম পুকুটের কাছে। আজ কুয়াশা বেশি৷ চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন! এজন্যই ছেলেটাকে আগে দেখতে পাইনি। হঠাৎ পাশে তাকাতেই আমি চমকে লাফিয়ে উঠলাম। সে মুচকি হেসে বলল, “ভয় পেয়েছ? সরি।”
এই ছেলে আমাদের বাড়িওয়ালার আত্মীয়। প্রথমদিন এসেই দেখেছি। এখানে থেকে নাকি পড়াশোনা করে। মাথার চুলগুলো কাকের বাসার মতো। এত কোঁকড়ানো চুল আমি জীবনে দেখিনি। সেই চুল বড় বড় আর এলোমেলো। দেখলেই মনে হয় এক্ষুনি কাক এসে মাথায় বসে কা কা ডাকতে শুরু করবে। সেজন্যই এই ছেলেকে দেখলে আমার মাথার ভেতর কাকের ডাক শুনতে পাই। এর মধ্যে কয়েকবার চোখাচোখি হলেও কথা হয়নি কখনো। উনার সরির উত্তরে কিছু বলতে হয়। তাই বললাম, “ইটস ওকে! আমি আপনাকে দেখতে পাইনি।”
ছেলেটা হেসে বলল, “বুঝেছি। তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?”
এই ছেলে আমাকে তুমি করে বলছে কেন? আমি বয়সে ছোট হলেও গায়ে গতরে অতটা ছোট নই। দেখলে সমবয়সী অন্যদের চেয়ে বড় মনে হয়। বললাম, “অনার্সে ভর্তি হব।”
“কোন কলেজে?”
“এখনো জানি না। ফর্ম ছাড়ুক, তারপর দেখা যাবে।”
“পাবলিকে পরীক্ষা দেবে না?”
“না।”
“কেন?”
আমি উত্তর দিলাম না। ছেলেটাও আর জিজ্ঞাস করল না কিছু। একটু পর কী ভেবে বলল, “তোমার নামটা জানি না।”
“আমি শিফা।”
সে নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমি সোহান।”
আমি প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। হঠাৎ দেশী কায়দায় আলাপের মধ্যে বিদেশী কায়দায় হ্যান্ডশেক কেন বাপু! নাকি হাত ধরার ধান্দা? কিন্তু সোহানের দিলখোলা হাসি দেখে মনে হলো, নাহ! ছেলে হয়ত ভালোই। হাত মেলালাম। সে হাতটা ছেলে দিল দু’সেকেন্ডের মধ্যেই। হঠাৎ কী মনে করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই শীতে সোয়েটার পরোনি কেন?”
আমার তখন খেয়াল হলো আমি সোয়েটার বা চাদর কিছুই পরিনি। পাতলা ওড়নাটা চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে এসেছি৷ এজন্যই এত শীত করছে! এসব ব্যাপারে বড্ড ভুলোমনা আমি। বললাম, “শীত করছে না।”
সে হেসে বলল, “এজন্যই কাঁপছ।”
আমি উত্তর দিলাম না। সে তার পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ দিয়ে বলল, “নাও। আমি আর্কিটেকচারে পড়ি তো, তাই একটু আধটু আঁকাআঁকির শখ আছে। তোমাকে প্রথমদিন দেখে এঁকেছিলাম। পরে অবশ্য কয়েকবার নতুন করে টাচ দিতে হয়েছে।”
আমি ভীষণ অবাক হয়ে কাগজটা খুললাম। সত্যি বলতে, দারুণ সুন্দর হয়েছে। মুখটা একদম জীবন্ত বসিয়ে দিয়েছে যেন! সোহান বলল, “তোমাকে কাছ থেকে দেখিনি তো, তাই কপালের তিলটা দেইনি। এটা দিলে কমপ্লিট হবে। ওয়েট।”
সে কাগজটা ফিরিয়ে নিয়ে পকেট থেকে পেন্সিল বের করে ছোট্ট তিলটা এঁকে নিল। তারপর কাগজ ভাজ কটে আবার চালান করে দিল নিজের পকেটে। আমি আরও অবাক হলাম। এতক্ষণ কিছুই বলতে পারিনি। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন ছিল, কেন ছবি এঁকেছেন আমার? পারমিশন না নিয়ে ছবি আঁকলেন কেন? আবার নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন! ফাজলামো নাকি?
কিন্তু মুখ দিয়ে কিছুই বের হলো না। আমরা দু’জনেই সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। কথা হলো না কিছুই। আকাশটা যখন লালচে হয়ে সূর্য বিদয়ের প্রস্তুতি নিল, সে বলল, “ঘরে যাও। আঁধার নামবে।”
আমি গেলাম না। সে হেঁটে হেঁটে মিশে গেল কুয়াশার আড়ালে। নদীর পাড়ে ধোঁয়াশার আড়ালে ফ্যাক্টরির জানালাগুলোর সারিবদ্ধ আলো যেন নতুন একটা রাত নয়, দিনের ইঙ্গিত দিয়ে গেল আমায়।
(চলবে)