ফিঙের_ডানা
পর্ব-১৩
সকাল হতেই নাচতে নাচতে উপস্থিত হলাম সোহানদের বাড়িতে। গিয়ে দেখি সোহান খিচুড়ি বসিয়েছে। রান্না করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। ও আবার রান্নাও জানে! দরজা খোলা ছিল বলে সোজা ঢুকে পড়েছি, সে দেখেনি আমি এসেছি। একমনে রান্না করছে। ভাবছি কেমন করে চমকে দেব। তার আগেই সে উল্টে আমায় চমকে দিয়ে বলল, “নাম পেলে?”
“আপনি বুঝলেন কেমন করে আমি এসেছি? আমি তো শব্দ করে আসিনি!”
সোহান হাসল। উত্তর দিল না৷
“কাল কী দেখলেন? ওরা কেমন আছে?”
“মোটামুটি ভালো সবাই। আরও কিছুদিন থাকতে হবে ওখানে।”
“আপনি রান্না জানেন?”
“না জানলে রাঁধছি কীভাবে?”
“ঠেকায় পড়ে!”
“খেয়ে দেখো বিশ্বাস না হলে। এখন বলো নাম পেলে?”
“হুম।”
“কী নাম?”
“নবনী।”
সোহান আমার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার চোখ পিটপিট করে বলল, “হুমায়ূন খুব পড়া হচ্ছে বুঝি?”
কথা সত্য। হুমায়ূন বেশি পড়ছি। কিন্তু এই নাম তো পেয়েছি স্বপ্নে। সোহান অন্য বাচ্চারটাকে ডাকছিল অবনী বলে। ধুর!
“আপনি কী রেখেছেন?”
“রাখিনি এখনো, ঠিক করেছি।”
“ওই তো! কী ঠিক করলেন?”
“তাপ্তি।”
“এর মানে কী?”
“এটা ভারতের একটা নদীর নাম। আমার খুব পছন্দ নামটা।”
“আমার নামের সাথে একটুও মিলল না তাহলে।”
খিচুড়ি প্রায় হয়ে এসেছে। সে আরেকবার নেড়ে ঢেকে দিয়ে আমার দিকে ঘুরে আমার নাক টিপে দিয়ে বলল, “নাহ!”
আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বললাম, “আরেকটা বলি?”
“উহু, একটাই সুযোগ ছিল।”
“আরেকটা সুযোগ দিলে কিচ্ছু হবে না। আমি দিলাম সুক্তি।”
“সুক্তি মানে ঝিনুক?”
“হ্যাঁ।”
“এটা ভালো আছে। কিন্তু যেহেতু প্রথমবার মেলেনি, তার মানে আর হবে না।”
“তাহলে তাপ্তির সাথে কী রাখা হবে?”
“তাপ্তিই তো রাখব না। তোমারটার সাথে মিললে রাখতাম। এখন মা যা রাখবে তাই!”
“আপনি পুরোপুরি একটা বাচ্চা!”
“ওকে! নাও খেয়ে দেখো।”
প্লেটে করে খিচুড়ি দিল সে আমাকে। এত গরম খেতেই পারছি না। রেখে দিলাম একটু পর খাব বলে। এর মধ্যে সে সুন্দর করে দক্ষ হাতে টিফিন বক্সে খাবার ভরে ফেলল। নিজের জন্য রাখল একটু। তারপর আমার প্লেটের খাবারটুকু তার প্লেটে ঢেলে নিয়ে বলল, “এসো।”
পেছন পেছন গেলাম৷ খাবার টেবিলে বসে এক লোকমা মুখের সামনে ধরে বলল, “খাও।”
এত অবাক আমি জীবনে হইনি। ওর হাতে খাব? এত পাগল কেন ছেলেটা? আমার চোখে পানি চলে এলো।
সে বলল, “কাঁদো কেন? মেরেছি?”
“না।”
“আমার হাতে খেলে সমস্যা?”
আমি উত্তর না দিয়ে বাড়িয়ে রাখা লোকমাটা খেয়ে নিলাম৷ খিচুড়ি ভালো না খারাপ জানি না, আমার মনে হলো এত ভালো খাবার আমি অনেকদিন খাইনি।
আজও আকাশ মেঘলা। ঠান্ডা সতেজ বাতাস আসছে খোলা জানালা দিয়ে। পুরো বাড়িটা নীরব। মৃদু আলোতে স্বপ্নের মতো একটা মানুষ হাসি হাসি মুখ করে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে। আমি বুঝি এত সুন্দর দৃশ্য স্বপ্নেও কোনোদিন দেখিনি। পুরোটা সময় আমার চোখ দিয়ে পানি গড়াল। সোহান আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। খাওয়ার পর আমি তাকে খানিকটা সাহায্য করলাম রান্নাঘর পরিষ্কার করতে। তারপর সে বাড়ি তালা দিয়ে বের হলো। যাওয়ার আগে হঠাৎ থেমে বলল, “হাসপাতালে যাবে? মা তোমার কথা বলছিল কাল।”
“কী বলছিলেন?”
“মেয়েটা ভালো, সেদিন সারারাত থেকেছে, রিশানের কত যত্ন নিয়েছে এসব।”
আমার কী যে ভালো লাগল শুনে! বললাম, “যাব।”
“তাহলে দৌড়ে রেডি হয়ে এসো। আমি দশ মিনিট দাঁড়াব।
এর মধ্যে না এলে চলে যাব।”
আমি দিলাম দৌড়৷ সাত মিনিটের মাথায় তৈরি হয়ে এলাম। দ্রুত করায় বেনীটা পুরো এলোমেলো। রিকশায় উঠে বসার পর সে টিফিনবাটি আমার হাতে দিয়ে আমার চুলের বিনুনি পুরোটা খুলে ফেলল।
“এটা কী হলো?”
“অন্যভাবে বাঁধো। চুড়ো করে বাঁধে যেভাবে সেভাবে।”
“খোঁপা?”
“হুম।”
আমি হাত দিয়ে কোনোরকম খোঁপা করে নিলাম। রিকশার ঝাঁকুনিতে সেটা দু’বার খুলল। হাসপাতালে ঢোকার আগে আবারও করলাম।
গিয়ে দেখি বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে রোকন ভাই। আরেকটা বাচ্চা মায়ের কোলে। তান্নি আপু আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল, “বলো তো শিফা ওরা কার মতো হয়েছে? তোমার ভাই তো ঝগড়া করেই যাচ্ছে আমার মতো হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে ওরা তোমার ভাইয়ার মতো হয়েছে। নাকটা, চোখটা দেখো!”
আমি ভালো করে দেখলাম। আশ্চর্য হলেও সত্যি, আমার মনে হলো বাচ্চাদুটো সোহানের মতো হয়েছে। বলতে গিয়েও বললাম না। কেমন কেমন যেন হয়ে যায় কথাটা। মানে যার যাকে পছন্দ তার মতো লাগাটা…উফ!
তান্নি আপু অন্য কথায় চলে গেল। আজ নাকি অনেকে আসবে। তার দেবর, জা, ননদ, ননাস, শাশুড়িরা। সেই সাতক্ষীরায় থাকে তারা৷ তাই আসতে এত দেরি।
আরও অনেক কথা হলো। তান্নি আপুকে যতই ভুলিয়ে রাখা হোক না কেন সে ঘুরেফিরে রিশানের কথা তুলছে। তান্নি আপুকে এখনো রিশানের কথা বলা হয়নি। সেদিন চিৎকার চেঁচামেচি শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। কী হয়েছে জানতে পারেনি। বার বার বলছে ছেলেটা আসে না কেন? বোনদের দেখবে না সে?
মোমের মতো বাচ্চাদুটো কোলে নিয়ে দেখি তুলতুল করছে। পাখির চেয়েও হালকা যেন! বেড়ালের বাচ্চার মতো গুটিগুটি হয়ে কাথায় জড়িয়ে আছে। কী যে আদুরে!
রিশানকে দেখতে গেলাম এরপর। সোহানের মা সেখানেই বসে আছে। দু’রাত ঠিকঠাক ঘুম হয়নি তার। সোহান গতরাতে অনেক জোড়াজুড়ি করেও নিতে পারেনি। রিশানটা শুকিয়ে গেছে দু’দিনেই। পা ফোলা। নড়তে পারে না। কথা বলে বলেও হয়তো ক্লান্ত। চোখদুটো সব ঘুরে ঘুরে দেখছে। আট বছরের বাচ্চা এত উঁচু ছাদ থেকে পড়েছিল ভাবলেই বুকটা কাঁপতে থাকে আমার। সে আমাকে বলল, “তুমি কি সারাক্ষণ মামার সাথেই থাকে?”
কী বেফাঁস কথা রে বাবা! আমি আঁড়চোখে সোহানের মায়ের দিকে তাকালম। কী ভাবছেন বোঝা যাচ্ছে না। সোহানও কিছু বলছে না৷ বললাম, “কালকে যে একা একা তোমার কাছে বসেছিলাম মনে নেই?”
“না তো!”
সে হেসে তার মামাকে কী যেন ইশারা করল। বুঝলাম না। সোহান দেখলাম মিটিমিটি হাসছে। আর তার মা কী ভাবছে কে জানে! হায় খোদা!
কিছুক্ষণ থাকার পর সোহান আমাকে আর তার মাকে বাসায় পাঠিয়ে দিল। নিজে রয়ে গেল হাসপাতালে। রাস্তায় উনি অনেক কথা বললেও সোহানের কথা তুললেন না। বাড়ি পৌঁছে তালা খুলে উনার জন্য গেস্টরুমের বিছানা গুছিয়ে দিলাম। মহিলা খুশি হলেন তাতে। বললেন একটু পর আরেকবার আসতে। উনাকে রান্নায় সাহায্য করতে।
মেহমানদের জন্য রান্না করা হলো। উনারা বিকেলে এসে খাবার খাবেন। আবার রাতের জন্য কিছু আলাদা আইটেম করা হলো। তান্নি আপুর জন্য আলাদা খাবার। সব মিলিয়ে অনেক রান্না। আমি যথাসাধ্য সাহায্য করলাম। ভাড়াটে চাচীরাও সাহায্য করতে এসেছিল, আন্টি দিলেন না।
দুপুরে সোহান এলো খাবার নিতে। আন্টিই বললেন তাদের সাথে আমাকেও খেতে। খেয়ে নিলাম সেখানেই। খেয়েই ফিরে এলাম।
বিকেলে মেহমানদের সাড়াশব্দ পেলাম। গেলাম না ওদিকে। রাতে আন্টি আমাকে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি বাড়িভর্তি মানুষ। বাড়ি ঝলমল করছে। সোহানও দেখলাম এসেছে। আন্টি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে। চিনিয়ে দিলেন সবাইকে৷ আমি আরও বেশি গুটিয়ে গেলাম। বরাবরই মুখচোরা আমি এত লোকের মধ্যে কী বলব বুঝতেই পারলাম না। আন্টি কেন ডেকেছেন তাও বুঝলাম না। ভেবেছিলাম কাজে সাহায্য করতে হয়তো। জিজ্ঞেস করতে বলল না কিছু করতে হবে না। ফিরে এলাম আমি। আমার অস্বস্তির সবচেয়ে বড় কারন তান্নি আপুর ছোট ননদ। ভীষণ সুন্দর আর স্মার্ট দেখতে। কানে বিশাল দুটো দুল পরেছে। সোহানের সাথে আলাদা দাঁড়িয়ে কী যেন গল্প করছে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে একেক বার।
(চলবে)