#ফিঙের_ডানা
পর্ব-২০
ঘুরে আসার পর পেরিয়ে গেছে তিন মাস। ফেসবুকে একটা জনপ্রিয় কথা আছে, কোনো ভিডিও বা ছবি মজার হলেই সেটাতে মন্তব্য আসে, ‘এটা দেখার পর তিনদিন পাগল ছিলাম’। আমার অবস্থা আক্ষরিক অর্থেই তাই। ঘুরে আসার তিন মাস হয়ে গেছে, তবু আমি পাগল হয়ে আছি। কত রাত সেই রিসোর্টের দৃশ্য স্বপ্নে দেখেছি ইয়ত্তা নেই। একদিন তো দেখলাম সেখানে ঘরবাড়ি করে সংসার করছি। এদিকে পরীক্ষা চলে এসেছে, পড়ার নামগন্ধ নেই। ইচ্ছেই করে না পড়তে। কত কিছু বলে নিজেকে মোটিভেট করি, আবার ভুলে যাই। বই সামনে নিয়ে বসলে মনে হয় অক্ষরগুলো আমায় গিলে খেতে আসছে। পুরোপুরি বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা!
এদিকে আরেক চিন্তা মাকে নিয়ে। শফীক আঙ্কেল এর মাঝে দু’বার আমাদের বাসায় এসেছেন। সাথে একগাদা মিষ্টি। আমি মিষ্টি পছন্দ করি বলে এনেছেন৷ যে দু’বার এসেছেন, আমার সাথেই গল্প করে গেছেন। মায়ের সাথে তেমন কথা বলেননি। মানুষটাকে ক্রমশ ভালো লাগছে। মাকে তারপর কয়েকবার বলেছি, বিয়ে করে নাও। মা রাজিই নয়।
এক ছুটির দিনে পেছনের বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে বসে আছি। পড়ন্ত বিকেল তখন। ভীষণ গরমের দিন শেষে একটা শান্তির রাত হাতছানি দিচ্ছে। লেবু ফুলের মিষ্টি সুবাস আসছে। চারপাশটা শান্ত, মাঝে মাঝে পাখিরা ডাকছে। মা আমার মাথাটা তার কোলে নিয়ে বলল, “তুই যে আমাকে বিয়ে করতে বলিস, তুই জানিস এখন বিয়ে করলে সমাজের মানুষ কী বলবে?”
“কিছুই বলবে না। কেউ কি দুটো বিয়ে করে না?”
“তোর শশুরবাড়িতে ঝামেলা হবে রে মা। ওরা এখনো তোকে তুলে নেয়নি৷ এমনি আমরা সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক দিক থেকে ওদের চেয়ে অনেক ছোট।”
আমি উঠে বসলাম। আগে অনেক কথা বুঝতাম না, এখন একা একা থেকে অনেক কিছু ভাবি। সমাজ, সংসার, মানুষজন নিয়ে। বললাম, “তোমার কি মনে হয় ওদের বাড়িতে আমাকে বউ করে নিয়ে ওরা করুণা করেছে? বিয়ের সম্বন্ধ ওদের দিক থেকে এসেছিল। তাছাড়া যদি তোমার দ্বিতীয় বিয়েতে তাদের এত সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে সেই সমাস্যাযুক্ত মানুষদের সাথে আমি থাকব না। আর আমার মনে হয় না তারা এত ছোটলোক।”
“মেয়েদের জীবন এত সহজ না রে।”
“না হোক, জীবন একভাবে কাটাতে পারলেই হলো। তবু সম্মানের সাথে বাঁচব।”
“এইতো বললি জীবন একভাবে কাটাতে পারলেই হয়৷ আমিও সেভাবেই নাহয় কাটাই। আমার মন সায় দেয় না বিয়েতে..”
আমি বলতে চেয়েও পারলাম না, গলায় আটকে গেল কথাটা, “মা তুমি শফীক আঙ্কেলকে পছন্দ করো। হয়তো ভালোও বাসো। দ্বিতীয়বার ভালোবাসা কোনো অপরাধ না। তুমি কেন আমার কথা ভেবে নিজের সুখ বিসর্জন দেবে? এমন হলে আমি কি সুখী হব?”
মা কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রয়ে বলল, “কিছু বলবি?”
“তুমি বিয়ে না করলে আমিও সোহানদের বাড়িতে যাব না। তোমার সাথেই থাকব।”
“পাগল মেয়ে!”
“শোনো, তুমি বিয়ে না করতে চাইলে জোর করে বিয়ে দেব। বিয়ের পর তুমি এখানেই থাকবে। আমাকে যখন ওরা নিয়ে যাবে, তখন তুমি চলে যেও। আমাকে ছেড়ে যেতে হবে না। আর আমাকে নিয়ে শফীক আঙ্কেলের বাড়িতেও উঠতে হবে না। ঠিক আছে? আমি সোহানকে আজ বলব এ ব্যাপারে।”
মা আমার হাত চেপে ধরে বলল, “তুই কিচ্ছু বলবি না ওকে।”
“ছাড়ো তো!”
একপ্রকার জোর করেই উঠে গেলাম। মাগরিবের আজান হচ্ছে। পাশেই মসজিদ। এই মসজিদের মুয়াজ্জিন কী মধুর সুরে যে আজান দেয়! বিশেষ করে গোধুলি লগ্নে স্নিগ্ধ পরিবেশে আজানের ধ্বনি হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছুতে থাকে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাই।
নামাজ পড়ে নিলাম। তারপরেই ফোন করলাম সোহানকে। আজকে রোখ চেপে গেছে। যা হওয়ার হবে। এই এক জিনিস আর ভালো লাগছে না।
সোহানকে ফোনে পাওয়া গেল না। মেসেজ দিয়ে রাখলাম৷ আজকাল একটু বেশিই ব্যস্ত থাকে। সেদিনের পর থেকে স্নেহার সাথে ফেসবুকে কথা হয়। ওর কাছেই জেনেছি, এখন নাকি ইউনিভার্সিটিতে ইলেকশন হচ্ছে। সেটা নিয়েই ব্যস্ত সোহান। সোহানকে এটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে হাসে, এড়িয়ে যায়। ছোটবেলায় ঠিক ছিল, এখন বড় হচ্ছি। ও যে আমাকে কখনো সিরিয়াসলি নেয় না, গুরুত্ব দিয়ে কথা বলে না, ব্যাপারটা আমাকে কষ্ট দেয়। ওর চরিত্রটা আমি বুঝতেই পারি না কখনো। কে জানে সারাজীবন এমন থাকবে কি না! নাকি আমি আরেকটু বড় হয়ে গেলে গল্পটা বদলে যাবে?
রাতে সোহান মেসেজের উত্তর দিল। মেসেজেই পুরো কথপোকথন হলো। খুশিই হলাম। এসব কথা ফোনে বলতে অস্বস্তি হতো। সোহান খুব সুন্দর উত্তর দিল, “একটা মানুষ নতুন জীবন শুরু করতে চাইলে যারা বাঁধা দেবে তারা অমানুষের পর্যায়ে পড়ে। আমরা কেউ তেমন নই৷ মায়ের জন্য শুভকামনা রইল।”
আমার মনে দ্বিধা রইল না আর। মাকেও দেখালাম৷ মা কথা বলল না। মৌনতা সম্মতির লক্ষন ধরে নিয়ে আমি লিলির মায়ের সাথে কথা বললাম। নিজে তো আর বলা যায় না, তাকে দিয়েই শফীক আঙ্কেলের সাথে কথা বললামা। উনিই সব ঠিকঠাক করে দিলেন। আমার দাদার বাড়িতেও খবর পাঠানো হলো।
বিয়ে যেদিন হলো, সেদিন ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। পাঁচজন লোক এলো মাত্র। বিয়ে হয়ে গেল খুব দ্রুত৷ বড়চাচা এলেন বৃষ্টি মাথায় করেই। অনেক দোয়া করে গেলেন মাকে। মায়ের বাপের বাড়ির এক দূর সম্পর্কের মামা ছাড়া কেউ নেই। তাকে খবর দেয়া হয়েছিল, তিনি আসেননি। সোহান এসেছে। সে শফীক আঙ্কেলের সাথে কিছু কথাবার্তা বলে খেয়ে সবার আগে বেরিয়ে গেল।
রান্নাবান্না করলেন লিলির মা। সব কাজ শেষে শফীক আঙ্কেল ছাড়া বাকিরা চলে গেল। সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি বাড়ল। মা তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে। আমি অনেক কষ্টে কান্না আটকে রেখেছি। কতক্ষণ পারব জানি না। সন্ধ্যা পার হয়ে যাচ্ছে, আমি মাকে বললাম শফীক আঙ্কেলের জন্য চা নাস্তার ব্যবস্থা করতে। এতক্ষণে তার হুশ হলো। চোখ মুছে রান্নাঘরের দিকে গেল।
শফীক আঙ্কেলকে পেলাম পেছনের বারান্দায়। গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির ছাট এসে তাকে ভিজিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি আমাকে দেখে স্মিত হাসলেন। ছোটদের প্রবোধ দেয়ার মতো হাসি। আমার মাথায় একটা হাত রাখলেন। তখনই দমকা বাতাস বয়ে গেল। আমি চেয়ে রেখি আঙ্কেলের চোখে পানি। আমি দেখে ফেলার পরেও চোখ মুছলেন না। উল্টে আমার হাতদুটো চেপে ধরে বললেন, “জানো মা, আমি অনেক নিঃসঙ্গ একটা মানুষ। শুধু এখন না, সবসময়ই। প্রথম বিয়েটা হয়েছিল আমার বিগত স্ত্রীর অমতে। না কোনোদিন সে আমার সাথে সুখী হতে পেরেছে, না আমি তার সাথে। সন্তানরাও কাছে নেই। সারাজীবন একটা হাহাকার নিয়ে বেঁচে ছিলাম। কোনোদিন ভাবিনি তা থেকে মুক্তি পাব। সবসময় এমন একটা মানুষের সাথে বাঁচতে চেয়েছি যে আমাকে বুঝবে, আমার তীব্র একাকীত্ব ঘুচিয়ে দেবে চিরতরে। তোমার মায়ের সাথে পরিচয় হওয়ার পর, তার একাকীত্বের সাথে পরিচিত হওয়ার পর মনে হয়েছে, আমাদের মনের নদী দুটো মিলতেই পারে, হয়তো তাতে দু’জনের বাকি জীবনটা মরার মতো বাঁচতে হবে না। আজ মনে হচ্ছে, বহুদিনের বোঝা নেমে গেল। আমি ভেতরে জমিয়ে রাখা কথা, দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ সব ভাগ করে নেয়ার একটা জায়গা পেয়েছি। এত বড় একটা উপকারের জন্য তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেই বলোতো?”
আমি লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “ধন্যবাদ দিতে হবে না। আপনি তো এখন থেকে আমার বাবার জায়গা পেলেন।”
উনি মাথা নিচু করে হেসে বললেন, “আমাকে বাবা ডাকবে?”
আমি স্পষ্টভাবেই বললাম, “না।”
ভেবেছিলাম উনি কষ্ট পাবেন। কিন্তু দেখলাম খুশিই হলেন। বললেন, “আমাকে আঙ্কেলই ডেকো। বাবার সাথে সন্তানের কেমন সম্পর্ক তা আমি ভালোই জানি। যদি এমন ভাবি, আমি মারা যাওয়ার পর আমার মেয়েরা অন্য এক লোককে বাবা ডাকছে, আমি মানতে পারতাম না।”
মায়ের ডাক শোনা গেল তখন৷ আমরা ভেতরে গেলাম। সে রাতে শফীক আঙ্কেল চলে গেলেন। আমি থেকে যেতে বললেও থাকলেন না। আমার বলা শর্তটা মা তাকে বলেছে। তিনি খুশি হয়ে রাজি হয়েছেন। রাতে মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর সময় কান্না পেল ভীষণ। সেই সাথে আনন্দও হচ্ছে। মায়ের কষ্টের দিন বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর আমাকে নিয়ে তার যে অসহায় দিনগুলো কেটেছে সেটা এক পরশপাথরের ছোঁয়ায় উবে যেতে চলেছে। কে বলেছে জীবনটা শুধু কষ্টের? কোরআনে তো আছে, “নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।”
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল। সূর্য তখনো ওঠেনি। বৃষ্টি নেই। বাতাসে ভেজা মাটির সুগন্ধ। আমি আর মা নামাজ পড়ে চা খেয়ে নিলাম। মা কাজ করতে শুরু করল, আমি সূর্য ওঠা দেখতে দেখতে সোহানকে ফোন করলাম। কী যে ইচ্ছে করছে তার সাথে কথা বলতে!
সে ফোন ধরে ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “হ্যালো!”
“কেমন আছ?”
“ভালো না।”
“কেন?”
“তোমাকে মিস করছি।”
“সত্যি?”
“হুম। বউ থাকলে একা একা ঘুমাতে হয় নাকি? এই কোলবালিশটা এত ছোট! তুমি চলে আসো। ভালোমতো ঘুমিয়ে নেই, ঘুম শেষ হলে আবার চলে যেও।”
“বলো কী?”
“হুম।”
“তুমি জেগে আছ নাকি ঘুমিয়ে আছ?”
উত্তর এলো না। এতক্ষণ ঘুমে ঘুমে কথা বলেছে। আমি যে তাকে ‘তুমি’ করে বললাম সেটাও খেয়াল করেনি৷ অথচ কতবার বলেছে তুমি বলতে! আমি বলতে পারিনি। এতক্ষণ আবোল তাবোল বকল। পাগল একটা!
একটু পর সোহানের নাম্বার থেকে মেসেজ এলো, “দিনের বেলা তুমিটা যেন আবার আপনি না হয়ে যায়।”
কী বিচ্ছু ছেলে রে বাবা! জেনেই বুঝেই ওসব বলেছে!
(চলবে)