#ফিঙের_ডানা
পর্ব-২১
অনেকদিন পর আবার তান্নি আপুদের বাড়িতে এসেছি। বাড়িটার প্রতি মায়া জন্মে গিয়েছে। গেট দিয়ে ঢুকেই বাগানটা চোখে পড়েছে। গোলাপে গোলাপে ছেয়ে আছে বাগান। মনটা ভরে গেল। ইচ্ছে করছিল ছুটে বাড়ির পেছনে চলে যাই৷ পুকুরটা দেখা হয় না কতদিন! এই বাড়ির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে সোহান থাকে। এই বাড়িতেই আমার বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি বলতে আমি এই বাড়িটাকেই চিনি৷ যদিও আজ কেন এসেছি জানি না। তান্নি আপু জরুরি ভিত্তিতে খবর দিয়েছে৷ সাথে টেনশনও হচ্ছে। খারাপ কিছু হয়নি তো? এদিকে সোহান গত দু’দিন ধরে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে।
বেল বাজাতেই খুলে দিল তান্নি আপু৷ তার মুখটা দেখেই বুক কেঁপে উঠল। শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে আপু?”
আপু বলল, “ভেতরে আসো।”
আমার বুক কাঁপতে শুরু করল। কোনোমতে ড্রইং রুমে গিয়ে বসলাম। “আপু সোহান ঠিক আছে?”
তান্নি আপু আমার পাশে বসে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইল। তারপর বলল, “তোমাকে কিছু কথা বলব। মন দিয়ে শুনবে। ভেঙে পড়বে না একদম। তারপর একটা কাজ করতে হবে।”
“বলুন আপু।”
তান্নি আপু আমার হাত ধরে বলল, “সোহানের ইউনিভার্সিটিতে গতকাল অনেক গ্যাঞ্জাম হয়েছিল। ও যে দল করে তার অপজিট পার্টির এক ছেলের মার্ডার হয়েছে। সবাই সন্দেহ করছে মার্ডারটা সোহান করেছে।”
আমি আঁতকে উঠলাম৷ সোহান মার্ডার করেছে! “এটাও সম্ভব?”
“সম্ভব অসম্ভব জানি না। তুমি নিউজ দেখোনি তাই না? গতকাল থেকেই টিভিতে দেখচ্ছে।”
“আমাদের বাসায় টিভি নেই।”
“ওহ।”
“এখন কী হবে আপু? সোহান কোথায়? ওকে কি পুলিশ..”
“না। তবে খুঁজছে।” আপু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কেসটা বেশ জোরালো। সোহানের সাথে ওই ছেলে মানে রাকিবের কথা কাটাকাটি হয়েছিল খুনের আগের দিন সকালবেলা। সোহান ওকে হুমকি ধামকি দিয়েছে। তারপর বিকেলে সোহান ওকে ফোনও করেছিল। তারপর থেকেই রাকিব নিঁখোজ হয়ে যায়৷ রাকিবের কললিস্টে শেষ কলটা ছিল সোহানের।”
“হায় খোদা! ও কোথায় এখন?”
“বাড়িতেই আছে৷ আধঘন্টা আগেই এসেছে, লুকিয়ে। পুলিশ আমাদের বাড়ির ওপর নজর রাখছে। তাই সামনে দিয়ে আসতে পারেনি। পেছনের পুকুর পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেছে।”
আমার মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল। এরকম মহাবিপদে জীবনে পড়িনি৷ কেন এমন হয়ে গেল?
“আমি ওর সাথে দেখা করব আপু।”
“সোহান ওর ঘরে আছে। শোনো, তোমাদের বিয়ের কথা পুলিশ জানে না৷ মানে বিয়েটা তো গোপনে হয়েছিল, কেউই জানে না৷ বাইরে বের হলে কেউ যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, বলবে আগে এই বাড়িতে ভাড়া থাকতে বলে দেখা করতে এসেছ।”
আমি উঠে দাঁড়ালাম। সোহানকে দেখে আসি৷ তান্নি আপু আমার হাত ধরে থামাল। টেনে বসিয়ে বলল, “আসল কথা বলা হয়নি।”
“কী কথা?”
“তোমাকে সোহানের সাথে যেতে হবে।”
“কোথায়?”
“গ্রামে। যশোরে বর্ডারের কাছে একটা গ্রামে আমার শ্বশুরবাড়ির আত্নীয় থাকে৷ সেখানে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে তোমাদের। সোহান একা যেয়ে থাকতে পারবে না৷ অনেক ভেঙে পড়েছে সে, দেখলেই বুঝবে৷ তোমাকে পুলিশ চেনে না৷ তাই তুমি সাথে থাকলে পথে যাওয়ার সময় পুলিশ সন্দেহও কম করবে। কিছুদিন পালিয়ে থাকো, তারপর সুযোগ বুঝে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এখন বলো যাবে কি যাবে না। সিদ্ধান্ত নিতে হবে খুব দ্রুত।”
“আমি যাব আপু।” বলে উঠে পড়লাম৷ সোহানের ঘরের দিকে ছুটে গেলাম।
দুপুরবেলা সে ঘর অন্ধকার করে বসে আছে। বাতি জ্বালাতেই বিরক্ত হয়ে তাকাল। আমাকে দেখে সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই শব্দ করে হেসে বলল, “খুনী দেখতে এসেছ? এমন মজা কোথায় পাবে? জেলখানায় না দেখে বাড়িতে খুনী দেখছ। আচ্ছা শিফা তুমি কি কখনো জেলখানায় গিয়েছ?”
ওর মুখটা দেখেই বুকটা হিম হয়ে এলো৷ একদিনেই চোখের নিচে কালির স্তর পড়ে গেছে। ফরসা মুখে একফোঁটা রক্ত নেই। চুলগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে৷ কথাবার্তা অসংলগ্ন। আমি ওর সামনে মেঝেতে বসে বললাম, “তুমি কি সত্যি..?”
সে আরও বিস্তৃত হেসে বলল, “তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে?”
“কেন করব না? তুমি বলো তুমি কিছু করোনি।”
“আমার ওপর তোমার বিশ্বাস থাকলে সেটা আগেই করে নিতে। আমার বলতে হতো না।”
“হেয়ালি করছ কেন?”
“তুমি খুনীর সাথে কথা বাড়াচ্ছ কেন অযথা? চলে যাও৷ আমার বোধহয় অনেকদিনের জেল হয়ে যাবে। ফাঁসিও হতে পারে। তুমি পড়াশোনা শেষ করে আরেকটা বিয়ে করে নিও। আর এখান থেকে চলে যাও এক্ষুনি। পুলিশ তোমার কথা জানলে জ্বালিয়ে মারবে।”
আমার চোখে পানি চলে এলো। ওর হাতদুটো ধরে বললাম, “তুমি এমন করছ কেন?”
সে হাত ছাড়িয়ে নিল জোর করে। অন্যদিকে ফিরে বলল, “তুমি তোমার জীবনটা নষ্ট করো না প্লিজ।”
“আমি তোমার সাথে যাব।”
“কোথায়?”
“যশোর।”
“আপু বলেছে?”
“হ্যাঁ।”
“যত্তসব ফালতু কথা। ধরতে পারলে আমাকেসহ তোমাকেও জেলে পুরে দেবে। তুমি গেলে ঝামেলা কমবে না, বাড়বে।”
আমি খুব শক্ত গলায় বললাম, “ঝামেলা কমুক আর বাড়ুক, আমি তোমার সাথে যাব।”
“নেব না তোমাকে।”
“তোমার সিদ্ধান্তে কিছু যায় আসে না৷ রোকন ভাই তোমার পালিয়ে থাকার ব্যবস্থা করছে না? তারই সিদ্ধান্ত আমাকে সাথে পাঠানোর। তুমি না চাইলেও আমাকে নিতে হবে।”
সে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে চেয়ে রইল। সুন্দর করে বললাম, “তুমি এমন করছ কেন? সত্যিটা খুলে বলো!”
সে বাঁকা হেসে অন্যদিকে চেয়ে রইল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ বলবে ও খুন করতে পারে? আমার বিশ্বাস হয় না। ওর চোখদুটো দেখে আমার বিশ্বাস দৃঢ় হলো। ও খুন করেনি। কিন্তু মুখ খুলছে না কেন? আমার হতাশ হয়ে ফিরে গেলাম নিচে।
***
সেদিন রাতেই আমি আর সোহান ট্রেনে চেপে যশোরের পথে রওনা হলাম। এই পর্যন্ত আসতেও মহা ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। সোহান বাড়ির পেছন দিয়ে লুকিয়ে এসেছে। রোকন ভাই ট্রিমার দিয়ে ওর মাথা কামিয়ে দিয়েছে। মাথাভর্তি চুলওয়ালা মানুষটাকে ন্যাড়া মাথায় পুরো অন্যরকম লাগছে। ফরসা হওয়ায় ওকে বৌদ্ধ সন্নাসীদের মতো দেখা যাচ্ছে। গায়ে গেরুয়া রঙের ফতুয়া। গলায় একটা কালো সুতো জড়ানো। আমার পরনে শাড়ি। তান্নি আপু একটা পুরানো লাল শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। আমি বাড়ি গিয়ে গোছগাছ করে বের হয়েছি। সোহান আলাদা স্টেশনে এসেছে। আসার আগে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কী কান্না! আমি একটুও কাঁদিনি। এখন আমাকে শক্ত থাকতে হবে যে করেই হোক। শফীক আঙ্কেলকে বলে এসেছি মাকে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে। মায়ের কষ্ট একটু কম হবে তাতে।
আমার নিজেরই মনে হলো, আমাদের দেখে বহুদিন সংসার করা পোড় খাওয়া দম্পতির মতো লাগছে, যারা দূরে কোথাও চলেছে ভাগ্যের খোঁজে। একে তো ভোল পাল্টানো হয়েছে, তার ওপর দুশ্চিন্তায় সোহানের চেহার পুরোপুরি বদলে গেছে। বয়স বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
আমরা চললাম একগাদা দুশ্চিন্তা সাথী করে। পথে কোথাও পুলিশ বা পুলিশের মতো পোশাক দেখলেই ভয়ে বুক কেঁপে উঠছে। রাতে একটুও ঘুমাতে পারলাম না। প্রতিটা স্টেশনে ট্রেন থামলেই দোয়া পড়তে শুরু করি৷ না জানি কেউ এসে ধরে নিয়ে যায়! কিন্তু কোথাও কিছু হলো না৷ আমাদের কেউ ধরল না, সন্দেহ করল না৷ নিরাপদেই যশোর পর্যন্ত পৌঁছুলাম৷ এদিকে সোহান অতি প্রয়োজন ছাড়া একটা শব্দও বলছে না। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে।
স্টেশনে আমাদের নিতে এসেছিল রোকন ভাইয়ার দূর সম্পর্কের মামা। একদম রোগা, হার জিরজিরে শরীর; পরনে সাদা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, থুতনিতে অল্প দাড়ি। দেখেই বোঝা যায়, দরিদ্র মানুষ। অনেক কষ্টে আমরা উনাকে আর উনি আমাদের খুঁজে পেলেন। আমাদের নিয়ে গেলেন উনার বাড়িতে।
বাড়িটা স্টেশন থেকেও অনেকখানি ভেতরে। ভ্যানগাড়িতে যেতে হয়৷ দুপুরের কড়া রোদ মাথায় নিয়ে আমরা পৌঁছুলাম তার বাড়িতে। টিনের চাল দেয়া দুটো আলাদা বাড়ি। বাড়ির চারধারে আম কাঁঠালের গাছ বাড়িটাকে ছায়া দিয়ে রেখেছে। আমাদের জায়গা হলো একটা ঘরে। ঘরটা আগেই পরিষ্কার করে রেখেছে। আমরা বাড়ির অন্যদের কৌতুহলী দৃষ্টি পেছনে ফেলে ঘরে ঢুকলাম। মামী এসে আমাদের সাথে কথা বলে গেলেন। সবাই বোধহয় জানে, শহর থেকে যারা এসেছে তারা অনাহুত অতিথি। তাই কেউ উচ্ছ্বাসিত নয়।
সোহান ঘরে ঢুকেই শুয়ে পড়ল। বলল, “আমাকে ডিসটার্ব করো না প্লিজ। আমি একটু ঘুমাব।”
আমি কিছু বললাম না। দরজা ভিরিয়ে বাইরে চলে এলাম। গোল উঠানের একপাশে শাড়ি পরা মহিলারা কাজ করছে। মামীর সাথেই একমাত্র পরিচয় হয়েছে। তিনি আমাকে অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ আমি হাতমুখ ধুতে চাইলে কলপাড় দেখিয়ে দিলেন। বেড়া দেয়া একটা জায়গা। ভেতরে চাপকল। প্রচন্ড ঠান্ডা পানি। আমি জামাকাপড় এনে গোসল করে নিলাম৷ খোলা জায়গায় অস্বস্তি হলেও ঠান্ডা পানিটার জন্য শান্তি লাগল অনেকটা। ঘরে ফেরার একটু পর মামী খাবার নিয়ে এলেন৷ সোহানকে জাগালাম না। আমি একাই খেয়ে নিলাম। ওর খাবার ঢাকা দিয়ে রাখলাম। ঘরে তিনটা ছোট ছোট জানালা। একটা জানালা খুললে দূরের মাঠ দেখা যায়। গরু চরছে। একাকী বিকেলে অজানা অচেনা জায়গায় বুকটা হু হু করে উঠল। চোখে পানি উপচে পড়তে থাকল। সামনের দিনগুলোতে কী আছে?
কাঁদতে কাঁদতেই একসময় চোখ তুলে সোহানের দিকে তাকালাম। দেখি সে উঠে বসে আছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
(চলবে)