#ফিঙের_ডানা
পর্ব-২৪
বাড়ি ফিরে দেখি সোহান বসে আছে উঠানে। সাথে তিতলী। তিতলী এই বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য। দেখতে ভারী মিষ্টি। সোহানের সাথে ওর খুব ভাব। পারলে গলা জড়িয়ে বসে থাকে সারাক্ষণ। সোহানেরও ওর সাথে থাকলে মনটা ভালো থাকে। আজ কিসব যেন গল্প করছে দু’জন। তিতলী রোজ মাপে সোহানের ছোট চুলগুলো একদিনে কতটুকু বড় হয়৷ আমি যেতেই গল্প থামিয়ে আমার দিকে চাইল দু’জন। তিতলী হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “মামা তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো বলোতো? আমাকে নাকি মামীকে?”
সোহান কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দুজনের দিকেই তাকাল৷ তারপর তিতলীর গালে চুমু খেয়ে বলল, “তোমাকে। তোমাকে মামীকে কে ভালোবাসবে! দেখো না কেমন পাগল পাগল দেখতে।”
তিতলী ভীষণ খুশি হয়ে মামাকে জড়িয়ে ধরল। পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে দৌড় লাগাল ভেতরে, সবাইকে খবরটা জানাতে হবে। আমি আর সোহানকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। মন খারাপ হয়ে যাবে খুনের প্রসঙ্গ তুললেই।
সেদিনের পর আরও একদিন পেরিয়ে গেল, কথা তুলতে পারলাম না। মামা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে নিয়ে বাড়ির লোকের ছুটোছুটি। খারাপ অবস্থা। তৃতীয় দিন মামা ফেরার পর বিকেলে সোহানকে বললাম, “আমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে যাবে?”
সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায়?”
“গ্রামেই। একটু ঘুরে আসি। বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছে না।”
আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সোহানের ডান হাতটা চেপে ধরে রাখলাম আমি৷ হাঁটতে হাঁটতে কেমন গায়ে গা লেগে যাচ্ছে। সোহান বলল, “বিয়ের আগে তো রিকশায়ও চড়তে চাইতে না আমার সাথে।”
“সেটা তো আগে।”
“তোমার খারাপ লাগে না আমার সাথে থাকতে? ভয় লাগে না?”
“ভয় লাগবে কেন? আজব!”
“লাগার তো কথা। আমার নামে মার্ডার কেস আছে!”
“থাকলেই কি তুমি খুন করে ফেললে নাকি?”
সে উদাস চোখে আকাশের দিকে চাইল। আমার হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল, আমি ছাড়লাম না। সে অগত্যা হাঁটতে শুরু করল চুপচাপ। বুঝলাম মন মেজাজ দুটোই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ওর অবস্থার এই অবনতি চোখে দেখার মতো না। আমার ভীষণ কান্না পায়। মানুষটার ওজন কত হবে এখন? কত শুকিয়ে গেছে! খাবার খায় বাচ্চাদের সমান৷ ওটুকু খেয়ে খিদের কষ্টে ভুগে কি নিজেকে শাস্তি দেয়? আমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সে আমার দিকে তাকিয়ে নেই, তবু জেনে গেল কেমন করে যেন। বলল, “চোখের পানি মোছ। এখন সব কেঁদে ফেললে আমি মরার পর আর কান্না পাবে না।”
“এসব বলো কেন! খারাপ লোক!”
আমি নিজেই ওর হাত ছেঁড়ে হাঁটতে শুরু করলাম। এবার সোহান এসে আমার হাত ধরল। কিছুক্ষণ নিরবতার পর বলল, “শিফা জানো, তোমাকে আমার অনেক বড় সারপ্রাইজ দেয়ার কথা ছিল। দিতে যখন পারিনি তাই বলে দিলাম।”
অবাক হয়ে বললাম, “কিসের সারপ্রাইজ?”
সে হেসে বলল, “আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীকে দিতে চেয়েছিলাম। একটা পার্টি রাখতাম, তোমাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে উঠতাম আর অনেক কথা আছে তোমার সাথে সেসব বলতাম।”
আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমাদের বিবাহবার্ষিকী এই মাসেই। এক বছর কেমন করে হয়ে গেল! আমি ওর হাত চেপে বললাম, “বলো না কী কী বলতে!”
“বলব একসময়৷”
“উহু এখনই।”
“পরে শিফা!”
“ধুর!”
সে কথা না বলে এগিয়ে গেল। প্রথম বর্ষার সময়টাতেও বৃষ্টি নেই। চারদিক খরখরে শুকনো। হালকা বাতাস বইছে মাঝে মাঝে। কতগুলো ছেলেকে দেখা গেল স্কুল থেকে ফিরছে গল্প করতে করতে। হাসি ঠাট্টা মিলে সুন্দর নিশ্চিন্ত জীবন তাদের। সোহান বলল, “একটা মজার কথা মনে পড়ল ওদের দেখে।”
“কী কথা?”
“আমাদের স্কুলে একটা স্যার ছিলেন ভীষণ কড়া৷ আবেদ স্যার। অংক করাতেন৷ পড়া না পারলে বা স্কুল পালালে এত মারতেন যে ছাত্ররা তার ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকত সারাক্ষণ। একদিন স্যার অসুস্থ বলে স্কুলে আসেনি। সবাই খুব খুশি। আমি তখন পড়ি ক্লাস নাইনে। টিফিন পিরিয়ডের পর বন্ধুরা মিলে পালালাম৷ গেলাম সিনেমা দেখতে। হল থেকে বের হয়েই আবেদ স্যারের সামনে পড়লাম৷ আমাদের মুখ হা৷ হঠাৎ খেয়াল করে দেখলাম স্যারের পেছনে স্যারের বউ। স্যারও আমাদের দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেল, আমরাও! শেষে কেউ কারো সাথে কথা না বলে চুপচাপ চলে এলাম। সেদিনের কথা পরে স্যারও আর বলেনি, আমরাও না।”
আমি হেসে ফেললাম৷ “স্যারও তার মানে স্কুল পালিয়েছিল!”
“হ্যাঁ! তখন তো মনে মনে তাকে খুব বকেছিলাম নিজে ফাঁকিবাজি করে অন্যকে শাসন করতে আসে দেখে। এখন বুঝি স্যার হলে কী হবে, বউয়ের সাথে সিনেমা দেখতে যেতে ইচ্ছে তো করবেই।”
“হিহিহি।”
আমরা মেঠোপথ ধরে এগিয়ে গেলাম আরও দূরে। রাস্তার একপাশে ফসলের ক্ষেত। দূরে গাছপালায় ঘেরা অন্য গ্রাম উঁকি দিচ্ছে। রোদ তখনও আছে গাছের মাথায়। একটা মাঠের কাছাকাছি পৌঁছে দেখি কতগুলো ছেলে ক্রিকেট খেলছে। আমরা একটু দূরে ঘাসের ওপর বসলাম। সোহান বলল, “ক্রিকেট নিয়েও একটা মজার ঘটনা আছে।”
“শুনি?”
“আমরা যে মাঠে ক্রিকেট খেলতাম তার পাশে ছিল এক বুড়ো খিটখিটে লোকের বাড়ি। তার বাড়িতে কোনোভাবে বল চলে গেলে সেটা আর ফেরত পাওয়া যেত না৷ তো সেদিন মাত্রই নতুন বল নিয়ে খেলতে শুরু করেছি। একজন প্রথম বলেই ছক্কা মেরে বল উড়িয়ে দিল। সেটা সোজা গিয়ে সেই বুড়োর জানালার কাচ ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল। আমরা ভয়ে শেষ। লোকটা বের হয়ে এলো তক্ষুনি। আমার দলের ছেলেরাও ততক্ষণে উধাও! কিন্তু আমি আর সেদিন পালালাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। বুড়ো এসে আমাকে প্রায় খেয়ে ফেলে। আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে বললাম, আমি খেলছিলাম না। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। খেললে কি আর পালাতাম না বলুন? যে ব্যাট করেছে তাকে পালাতে দেখেছি, ওইযে গাছটার পেছনে। ফরসা লোকটা লাল হয়ে ব্যাটসম্যানকে খুঁজতে গেল। এদিকে তার বাড়ির দরজা খোলা। আমি চট করে ঢুকে বলটা খুঁজে নিয়ে এলাম৷ সে যখন গাছের পেছনে কাউকে না পেয়ে ফিরছে তখনই আমি বল হাতে বের হচ্ছি। বুড়োটার চেহারা দেখার মতো হয়েছিল তখন।”
আমি খুব হেসে বললাম, “কী বুদ্ধি বাপরে! তুমি ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসো?”
“হুম খুব!”
“তাহলে ওদের সাথে খেলো একটু।”
“যাব বলছ? আসলেই ইচ্ছে করছে।”
“হুম যাও।”
সে উঠে গেল। যেতেই ছেলেগুলো দলে নিয়ে নিল তাকে। প্রায় সন্ধ্যা হওয়ার আগ পর্যন্ত খেলা চলল। আমি প্রাণ ভরে সোহানের হাসিমুখটা দেখলাম৷ কতদিন পর সে সত্যিকার হাসিখুশি হয়ে একটা বিকেল কাটাল!
ফেরার সময় আবার বাজারের দিকে গেলাম। তখম সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। একটা আইসক্রিম কিনে ভাগ করে খেলাম দু’জন। বাড়ির বাচ্চাদের জন্য লজেন্স কিনে নিলাম। ফিরতি পথ ধরতেই হিম বাতাস ছাড়ল। বুঝলাম বৃষ্টি হবে। একটা অন্ধকার পথ পেরোনোর সময় ভয়ে সোহানের হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। সে হেসে বলল, “ভয় পেও না শিফা। তোমার কিচ্ছু হবে না।”
“জানি। তুমি সাথে থাকতে কিসের ভয়?”
সে বলল, “আমার ধারণা উল্টো। ইদানীং তোমাকে দেখলে মনে হয়, তুমি সাথে থাকলে কিসের ভয়?”
_____________________
বাজারে গিয়েছিলাম কাগজ পেন্সিল কিনতে। সোহানকে দিয়ে ছবি আঁকাব। যা খুশি আঁকুক, প্রকৃতি মানুষ কিংবা আমাকেই। তবু মন ভালো থাকুক ওর।
কাগজ পেন্সিল পেয়ে সে দেখলাম রাতেই আঁকতো বসল। কী আঁকল বুঝলাম না। বোধহয় পরে শেইপে আনবে। অনেক রাতে বাতি নিভিয়ে শুতে এলো সে। এসেই হাতটা ধরে কাছে টেনে নিল। বলল, “তোমাকে যত অবহেলা করেছি, সব শোধ করে দেব৷ শুধু আমাকে ছেড়ে চলে যেও না।”
“কে বলেছে চলে যাব?”
“যেও না ব্যাস। বলাবলির প্রয়োজন নেই।”
“আচ্ছা।”
ঝমঝমিয়ে যখন বৃষ্টি নামছে, তখন বহুকাল পর যেন আমাদের মনের ঘরে একটুখানি শান্তি নেমেছে।
******************
রোকন আর তান্নি বসে আছে একটা ছোট্ট কফিশপে। শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত জায়গা এটা৷ লোকজনে ভর্তি চারপাশে। রাস্তায় যানজট লেগে আছে, গাড়ির হর্ন, লোকের চেঁচামেচিতে কান পাতা যাচ্ছে না। শৌভিক আহসান নামক লোকটার আসার কথা চারটায়। এখন বাজে চারটা বিশ। তান্নি বলল, “লোকটা বোধহয় আসবে না। ভুয়া লোক। আমি আগেই জানতাম বাংলাদেশে ওসব প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর হয় না। কে না কে ফোন নাম্বার দিয়েছে আর তুমি বিশ্বাস করে চলে এসেছ!”
রোকন বিরক্ত চোখে তাকাল। উত্তর দিল না৷ আরও মিনিট দশেক পার হতেই তান্নির ধৈর্য বাঁধ ভাঙার উপক্রম। বলতে থাকল, “চলো চলে যাই৷ পরিবেশটা অসহ্য!”
রোকনও হতাশ হয়ে পড়েছে। তাকে যে শৌভিক আহসানের খবর দিয়েছে সে মোটেই ভুয়া কথা বলার লোক নয়। শৌভিকের সাথে কথাও হয়েছে। ভালো লোক। তাহলে এরকম করল কেন? ভাবতে ভাবতেই তাদের টেবিলের সামনে এক লোক উপস্থিত হলো। এক নজরেই বোঝা যায় এই লোক গোয়েন্দা না হয়ে যায় না। তীক্ষ্ণ চোখদুটো তাদের ভেতরটা যেন পড়ে নিচ্ছে। রোদেপোড়া মুখ, সিগারেট খেয়ে কালো করে ফেলা ঠোঁটেও ব্যক্তিত্ব আর আত্মবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। শৌভিক বলল, “দুঃখিত। আমার এক স্টুডেন্ট হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেজন্য দেরি।”
তান্নি অবাক হয়ে বলল, “আপনি স্টুডেন্ট পড়ান?”
“জি আমি একটি প্রাইভেট কলেজের রসায়নের শিক্ষক।”
“তবে এই গোয়েন্দার ব্যাপারটা?”
শৌভিক হেসে বলল, “গোয়েন্দার কাজটা শখের। শখ দিয়ে পেট চলে না ম্যাডাম। বাদ দিন সেসব, কাজের কথা বলুন।”
রোকন তাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল। শৌভিক মনোযোগ দিয়ে শুনে গেল। রোকনের বলা শেষে প্রশ্ন শুরু করল।
“রাকিব মারা গেছে ছয় তারিখ রাতে, আর সোহান বাড়ি ফিরেছে আট তারিখ দুপুরে। তাহলে সাত তারিখে সে কোথায় ছিল?”
“সেটাই তো জানি না। সোহান কিছুতেই মুখ খুলছে না। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে একেবারে চুপ হয়ে আছে।”
“কেন বলুন তো?”
“জানি না। তবে আমার বিশ্বাস সে খুন করেনি।”
শৌভিক মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “হুম, আমারও তাই মনে হয়।”
তান্নি অবাক গলায় বলল, “আপনি তে সোহানকে দেখেনওনি। কেমন করে বুঝলেন? আমার নিজের ভাই তবু সন্দেহ হয় ও খুন করেনি তো?”
রোকন বিরক্ত হয়ে বলল, “এই তুমি চুপ। কী বলো এসব?”
তান্নি লজ্জা পেয়ে চুপ হয়ে গেল। শৌভিকের ঠোঁটে মুচকি হাসি। ঠোঁট টিপে রহস্য করে হাসে লোকটা। বলল, “আপনার ভাই ইউনিভার্সিটিতে পড়া ছেলে। যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সে কেন খুন করে সব প্রমান রেখে চলে যাবে?”
“মানে?”
“মানে রাকিবকে খুন করা হয়েছে ছুরি দিয়ে। ছুরিটা সেখানেই পড়া ছিল, তাতে সোহানের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। আবার সোহানের সাথে তার আগের দিনই রাকিবের ঝগড়া হয়। তার মানে এই খুন করা সেধে আত্মহত্যা করার মতো ব্যাপার৷ তার ওপর আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে ছেলেটা মোটেও আক্রমণাত্মক স্বভাবের নয়। তাহলে হুট করে এমন কিছু হওয়া কি সম্ভব?”
“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন সোহান নির্দোষ?” তান্নি খুব খুশি হয়ে বলল।
“জি না। সে দোষী হতেই পারে। আমি শুধু ধারণাটা বললাম।”
“ওহ।”
রোকন বলল, “আপনি কি তাহলে কেসটা নিচ্ছেন?”
“অবশ্যই। খুশি হয়ে নেব। তবে যে দোষী আমি কিন্তু তাকে শাস্তি পাইয়ে ছাড়ব।”
তান্নির গলাটা কেমন শুকিয়ে এলো। অনেকক্ষণ আগে আসা কফিটা সে এতক্ষণ খায়নি। এক চুমুকে পুরোটা খেয়ে নিল। খেয়েই গলাটা কেমন তিতকুটে হয়ে গেল। কী হতে যাচ্ছে কে জানে! কাজটা কি ভালো হলো নাকি খারাপ? অবশ্য সোহান কোথায় আছে সেটা এই লোক জানে না। তবে জানতে কতক্ষণ? তান্নি মনে মনে দোয়া করল, “আল্লাহ আমার ভাইটাকে বাঁচাও। সে দোষী হোক নির্দোষ হোক, তাকে তুমি এবারের মতো ক্ষমা করে রক্ষা করো।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
গল্প সম্পর্কে আপডেট পেতে আমার গ্রুপে জয়েন হতে পারেন
https://www.facebook.com/groups/893358244775252/?ref=share