ফিঙের_ডানা পর্ব-২৫

#ফিঙের_ডানা
পর্ব-২৫

পরদিন সন্ধ্যায় তান্নি আপু ফোন করল। একজন গোয়েন্দা নাকি পেয়েছে। তাও আবার কলেজের কেমিস্ট্রি টিচার! সেই লোক নিজেই নাকি খুব রহস্যময়। আরও হাবিজাবি বলল। মনে হলো তান্নি আপু নিজেও লোকটার ওপর অতটা ভরসা করতে পারছে না। আমারও চিন্তা হতে লাগল কী হবে তাই নিয়ে। আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, “পুলিশ কি আর কোনো নতুন খবর পেয়েছে?”

আপু বলল, “না তো। আর কিছু হয়নি এর মধ্যে।”

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। স্নেহাকে মেসেজ দিয়ে তাহলে ভুল করে ফেলিনি!

আজ সারাদিন সোহান আঁকাআকি নিয়ে ছিল৷ রাতে খেয়েদেয়ে আরও ঘন্টাখানেক ব্যয় করে আঁকা শেষ করল। মোট পাঁচটা ছবি এঁকেছে। ছবিগুলো আমার হাতে দিয়ে বলল, “দেখতে থাকো, আমি শাওয়ার নিয়ে আসি।”

হেসে ফেলে বললাম, “যাও। চাপকলের শাওয়ার!”

ও কিছু না বলে চলে গেল।

আমি ছবি দেখতে শুরু করলাম। প্রথম ছবিটা মনে হলো না পাওয়ার গল্প। দুটো হাত। হাতের গড়ন দেখে বোঝা যায় হাত দুটো আলাদা দুটো মানুষের। একটা হাতে লাভ শেইপের বেলুন ধরা৷ অপর হাতটাও বেলুনের দিকে বাড়ানো, তবে সে ধরতে পারেনি।

দ্বিতীয় ছবিতেও দুটো হাত। দুটোই বেলুনের দিকে চেয়ে আছে, বেলুনটা উড়ে যাচ্ছে।

তৃতীয় ছবিতেও যথারীতি দুটো হাত। দুটো পাঞ্জা লড়ছে।

চতুর্থ ছবিতে হাতদুটো দুটো কাচের গ্লাস ধরে চিয়ার্স করছে। গ্লাসে পানীয়।

পঞ্চম ছবিটা ভয়ানক! একটা হাত অন্য হাতে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে।

আমি ঘামতে শুরু করলাম। বুকটা কাঁপছে। হাতদুটোর একটা কি কোনোভাবে সোহানের? আর অন্যটা যে খুন হয়েছে তার? রাকিবের? এই ছবিগুলোর মানে কী দাঁড়ায়? সোহানই রাকিবকে খুন করেছে! কিন্তু কেন? লাভ শেইপের বেলুনটা দিয়ে আসলে কী বোঝাতে চাচ্ছে সোহান? সে কি তবে আমাকে সব জানানোর জন্য ছবি আঁকল? আমার মাথা ঘুরতে শুরু করল।

সোহান ফিরে আমার অবস্থা দেখে বলল, “কেমন এঁকেছি?”

“এগুলো কি সত্যি?”

“ছবি তো সত্যি হয় না, ছবির ভেতরের গল্পটা সত্যি!”

আমি আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললাম৷ এতদিনের বিশ্বাসের কাচের বলটা গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল। তাও আবার যাকে বিশ্বাস করেছিলাম তার হাতেই।

************
শৌভিক কয়েকটা ছোট ছোট চিরকুটে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো লিখে সামনে নিয়ে বসেছে।

১| রাকিবের সাথে সোহানের পূর্বশত্রুতা ছিল কী নিয়ে?

২| রাকিবের সাথে সোহানের কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল?

৩| ঝগড়ার পরেও রাকিব কেন সোহানকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিল?

৪| খুনের আসল মোটিভ কী?

৫| রাকিবের চরিত্র কেমন ছিল?

৬| রাকিবের মৃত্যুতে কার কী লাভ হতে পারে?

প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে গেলে হয়তো কেসটা সলভ হয়ে যাবে। আপাতদৃষ্টিতে কেস যত সহজ মনে হচ্ছে তত মোটেও না। সবার আগে ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিতে হবে। শৌভিকের মনে পড়ল ওর এক স্টুডেন্ট সেখানেই পড়ে। নাম জিকো। সে জিকোকে ফোন করল।

“আসসালামু আলাইকুম স্যার৷”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম৷ কেমন আছ জিকো?”

“স্যার ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

“এইতো আছি। তোমাকে একটা প্রয়োজনে ফোন করেছি।”

জিকো হেসে বলল, “স্যার আপনি কি আর প্রয়োজন ছাড়া অধমকে ফোন করবেন! বলুন স্যার। আপনার জন্য কিছু করতে পারলে খুব খুশি হব।”

“তোমাদের ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রকে কিছুদিন আগে আরেক ছাত্র খুন করেছে। এই ব্যাপারে তুমি কতটা জানো?”

“স্যার কি এই কেসের তদন্ত করছেন নাকি? খুনি কে এটা তো জানাই। সোহান। ছেলেটা ভালো ছিল খুব। ফার্স্ট ইয়ারে এক টিমে ক্রিকেট খেলতাম। মন খুব ভালো। সেই ছেলে কেন খুনের মতো কাজ করল বুঝতে পারছি না।”

“তুমি, সোহান, রাকিব কি সেইম ব্যাচ?”

“জি স্যার।”

“তাহলে তো ভালোই হলো। এবার আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দাও।”

“বলুন স্যার।”

“সোহানের সাথে রাকিবের কোনো কারনে শত্রুতা ছিল?”

“স্যার ওইটা তো লম্বা কাহিনী। ওরা দুইজনেই ফার্স্ট ইয়ারে ভালো বন্ধু ছিল। একেবারে গলায় গলায় ভাব। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে বন্ধুত্বে ফাটল ধরালো এক মেয়ে। নাম প্রভা। তখন প্রভা জুনিয়র। খুবই সুন্দর দেখতে। দুইজনেই এক মেয়ের জন্য পাগল হয়ে গেল। প্রভা আবার পছন্দ করত সোহানকে। দুইজনের হালকা ভাব ভালোবাসাও হইছিল। মাঝে রোজার ছুটি পড়ল, সোহান চলে গেল গ্রামে। ফিরতে দেরি হলো ওর। ততদিনে রাকিব প্রভাকে পটিয়ে ফেলেছে। দুজন চুটিয়ে প্রেম করছে। সোহানের মন ভেঙে গেল। এটা নিয়ে দুজনের ঝগড়াও হয়েছিল একপ্রস্থ। তারপর আমার জানামতে সোহানই রাকিবের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়৷ দুজনের অনেকদিন পর্যন্ত মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল৷ তার অনেক পরে সোহানের সাথে এই ব্যাপারে কথা হয়েছিল। ও বলছিল, সুযোগ পেলে রাকিবকে দেখে নেবে। অবশ্য রাকিবের সাথে প্রভার সম্পর্কও বেশিদিন টেকেনি৷ ছয়-সাত মাস পর ব্রেকআপ হয়ে যায়। এরপর রাকিব সোহানের সাথে সম্পর্কটা ঝালাই করে নিতে চাইলেও সোহান আগ্রহ দেখায় নাই৷ এই হলো কাহিনী।”

“হুম!” গম্ভীর হয়ে গেল শৌভিক। “সোহান কি তারপর প্রভার সাথে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা করেছে?”

“আমার জানামতে না৷ প্রভা অত ভালো মেয়ে না। এর মাঝেই অনেক প্রেমিক বদল হয়ে গেছে। যতদূর জানি সোহান পরে ওকে খুবই অপছন্দ করত।”

“আচ্ছা তারপর খুনের আগের দিন ওদের কী নিয়ে ঝগড়া হয়?”

“স্যার দুইজনই রাজনীতি করত। তাও আলাদা আলাদা দলে। সেদিন ঝামেলা হইছিল নির্বাচনী পোস্টার নিয়ে। সোহানদের দলের পোস্টারের ওপর রাকিব পোস্টার লাগাচ্ছিল। এই নিয়ে হালকা ঝগড়া থেকে একেবারে মারামারি পর্যন্ত চলে যায় ব্যাপারটা।”

“ওহ! তারপর আর ওদের দুজনকে একসাথে দেখেছ?”

“না স্যার।”

“রাকিবের সম্পর্কে তুমি ঠিক কতটা জানো?”

“স্যার রাজনীতি করত, তাছাড়া একটু বখাটে স্বভাবের ছিল বলে ওর সাথে তেমন সম্পর্ক ছিল না। তাই বেশি কিছু জানিও না।”

“আচ্ছা জিকো ধন্যবাদ। আমি হয়তো তোমাদের ইউনিভার্সিটিতে যাব কাল পরশু। তোমাকে আবার ফোন করব।”

“অবশ্যই স্যার। যে কোনো সময় আমাকে পাবেন।”

ফোন রেখে শৌভিক এক আর দুই নং কাগজদুটো ছিঁড়ে ফেলল। এগুলোর উত্তর জানা হয়ে গেছে। এবার বাকিগুলো খুঁজতে যেতে হবে।

তবে সোহানই যদি খুন করে থাকে তাহলে মোটিভ শুধু এই ঝগড়া নয়। সোহানের প্রভার প্রতি পরে কোনো অনুভূতি ছিল না৷ তাছাড়া সোহান এখন বিবাহিত। সোহানের বোনের মতে বউয়ের সাথে তার ভালোবাসাও আছে। তাহলে পূর্বশত্রুতার জের ধরে খুনটা করার সম্ভাবনা কম। আবার পরের দিনের ঝগড়ার কারনটাও দুর্বল। এই কারনে কেউ কাউকে খুন করে না৷ তাছাড়া ঝগটা মিটে গিয়েছিল। তাহলে সোহান কেন পরদিন বিকেলে খুনের আগে রাকিবকে ফোন করতে গেল? আগামীকাল গেলে অনেকটা ক্লিয়ার হবে সব।

শৌভিক জিনিসপত্র গুছিয়ে শুতে গেল।

****************
রাত দুটো বাজে। ঘর অন্ধকার। ঝিঁঝির একঘেয়ে ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সোহান চুপ করে বিছানায় পড়ে আছে। আমার আজকে শুতে যাওয়ার প্রবৃত্তি হয়নি। থেকে থেকে কান্না পাচ্ছে। অভিমানে বুক ভরে আসছে। সোহানই তবে খুন করেছে। আর ওই যে লাভের বেলুনটা! ওইটা কোনো মেয়ে! ও একটা মেয়ের জন্য খুন করল! ভাবলেই আমার গা গুলিয়ে আসছে।

খাটে শব্দ পাওয়া গেল। সোহান উঠে বসেছে। আমি বসে আছি ঘরের অন্য প্রান্তে মেঝেতে। একটু পর সে আমার পেছনে বসে কাঁধে হাত রাখল। আমি মুখ গোঁজ করে বসেই রইলাম। ও আমার ঘাড়ে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলল। দুই হাতে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল অনবরত। আস্তে আস্তে আমার রাগটা যেন কমে এলো। ওর হাত ধরে বললাম, “কী হয়েছে?”

সে ভাঙা গলায় বলল, “আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি শিফা। বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে করিনি।”

“তাহলে? কেউ জোর করে করিয়েছে?”

“না।”

“তবে?”

সে উত্তর দিল না৷ আমি আবার প্রশ্ন করলাম, “তুমি কি ওকে কোনো মেয়ের জন্য খুন করেছ?”

সোহান এবারও উত্তর দিল না৷ আমি ওকে ফেলে উঠে যেতে চাইলাম। সে ছাড়ল না। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বলল, “প্রভাকে আমি অনেক আগেই ভুলে গেছি শিফা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর কাউকে না। ওই মেয়ের জন্য আমি খুন করিনি।”

“কেন করেছ তাহলে?”

“আমি জানি না।”

“তুমি কেন আমার সাথে হেয়ালি করছ? কেন বলছ না পুরোটা?”

“বললে তুমি আমাকে অনেক ঘৃণা করবে শিফা। আমি তোমাকে হারাতে চাই না৷ আমি চাই না তুমি আমাকে ঘৃণা করো। আর কিছু জানতে চেও না প্লিজ!”

“তোমার কী মনে হয় যতটুকু জানলাম তারপর আমি তোমাকে খুব ভালোবাসবো?”

ও আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “তুমি আমাকে নতুন করে কষ্ট দিতে চাচ্ছ? তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না আমি অনুশোচনায় মরে যাচ্ছি?”

“জানি! কিন্তু আমি কী করব বলো?”

সোহান কিছুক্ষণ চুপ করে পড়ে রইল। তারপর চোখ মুছে বলল, “কাল সকালে তোমাকে ট্রেনে তুলে দেব। তুমি একা যেতে পারবে না?”

“আর তুমি?”

“আমার কথা ভাবতে হবে না।”

“এখানে থাকবে?”

“না।”

“তাহলে?”

“বললাম তো ভাবতে হবে না।”

সোহান কেমন মুষড়ে পড়ল হঠাৎ। ওর এই মুখটা দেখে এত মায়া হলো! আচ্ছা ও কি কোনো সুইসাইডাল চিন্তাভাবনা করছে? বুক কেঁপে উঠল আবার। যাই করে থাকুক না কেন ওর অনুশোচনা আমি নিজের চোখে দিনের পর দিন দেখেছি। আমার চেয়ে ভালো করে কেউ জানে না ও কতটা কষ্টে আছে। মনে হলো যা খুশি হয়ে যাক, ওকে আমি আগলে রাখব। ওর কাছে গিয়ে দু’হাতে ওর মুখটা তুলে বললাম, “তুমি ভেবো না। আমি আছি তোমার সাথে।”

সোহান একদম বাচ্চা ছেলেদের মতো করে বলল, “সত্যি?”

“হ্যাঁ।”

তারপর বাকি রাতটা একসাথে বসে কেঁদেই কাটল আমাদের। বুঝতে পারলাম, আমার হাত ধরলেই ও অনেকটা ভরসা পায়। ভোরের আজান কানে যেতে নামাজ পড়তে উঠলাম৷ সোহানকে বলতেই সেও ওযু করে এলো। নামাজে একটাই শুধু দোয়া করলাম, “সোহানকে ভালো রেখো আল্লাহ।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here