#ফিঙের_ডানা
পর্ব-২৭
রাকিবের কেসটা রয়েছে ইন্সপেক্টর রবিউজ্জামানের হাতে। শৌভিকের সাথে তার তেমন পরিচয় না থাকলেও তার কথা আগে শুনেছেন৷ তাই সে যেতেই খাতির করে বসালেন। “কী খাবেন? চা? কফি? শরবত?”
শৌভিক মাথা নেড়ে বলল, “ওসব লাগবে না। রাকিবের কেসটার ব্যাপারে কিছু তথ্য দিলেই হবে।”
রবিউজ্জামান হেসে বললেন, “তা কী করে হয়? চা অর্ডার করি। খেতে খেতে আলাপ করা যাক।”
বলতে বলতে লোকটা চা সিঙাড়া অর্ডার করে দিল। তারপর হাত গুটিয়ে বলল, “এবার বলুন। ঠিক কী কী জানতে চান। কেসটা পানির মতো সরল৷ ঝগড়া থেকে খুন। খুনী গায়েব। নতুন করে তদন্তের কী আছে তাই তো বুঝতে পারছি না।”
“দেখুন, আমাকে বিশেষ একজন এই খুনের তদন্ত করতে বলেছে। তার ধারণা যাকে খুনী বলে সাব্যস্ত করা হচ্ছে সে খুনী হয়। এটা অন্য কারো কাজ।”
“কিন্তু সব প্রমান উল্টো কথা বলে। এই কেস নিয়ে ভুল করলেন জনাব। হারার সম্ভাবনাই বেশি।”
“তা হোক। আমি সত্যিটা বের করতে চাই। আপনাদের তদন্তের অনেক বিষয়ই ধোঁয়াটে।”
“যেমন?” রবিউজ্জামান রাগ করলেন না। বরং মনে হলো বেশ কৌতুক বোধ করছেন।
শৌভিক মৃদু হেসে বলল, “খুনী কখনো এত আনাড়িভাবে খুন করে? মারল, চাকুটা রেখে গেল৷ মারার প্ল্যান করে এলো ফোন করে৷ তার ওপর দুনিয়াশুদ্ধ মানুষ দেখল সে সেখানে আছে। তারপর খুন করে পালিয়ে রইল। একটা নিরেট মূর্খও যদি খুন করে সে চেষ্টা করবে ব্যাপারটা কিছুটা হলেও ধামাচাপা দিতে।”
“তাই নাকি? আপনি কি জানেন তারা সেদিন ড্রিঙ্ক করছিল। আর নেশার ঘোরে ওরকম উল্টোপাল্টা কাজ অসম্ভব নয়।”
“আচ্ছা? তাহলে নেশার ঘোরে ছেলেটা পালাল কেমন করে? আমি যতদূর জানি খুনের পরদিন সকালে সেই বাড়ির কলাপসিবল গেট তালা মারা ছিল। দোতলার বুড়ে নামাজ পড়তে বের হওয়ার সময় খুলেছে। সোহান খুন করে পালিয়ে গেল কোনদিন দিয়ে? রাকিবের কাছে গেটের যে চাবি ছিল সেটা ওর ঘরেই পাওয়া গেছিল তাই না?”
রবিউজ্জামান এবার একটু চিন্তিত সুরে বললেন, “হতে পারে ওর কাছে ডুপ্লিকেট চাবি ছিল।”
“তাহলে বলতে চাইছেন সোহান মারার প্ল্যান করে এসেছিল? কারন ওর সাথে রাকিবের ঝগড়া চলছিল। রাকিবের ফ্ল্যাটে সে এর আগে যায়নি। তার মানে আগে থেকে চাবি থাকার সম্ভাবনা শূন্য। আর প্ল্যান করে গেলে থাকতেই পারে সেক্ষেত্রে বাকি বিষয়গুলো মেলে না। সে ছুরি এমনিতেই রেখে গেল, কিন্তু গেটটা তালা দিতে ভুলল না৷ তার ওপর এখন একদম নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে! মিলছে কিছু?”
“আপনি তো ভাই আমাকে কনফিউজড করে দিচ্ছেন!”
“চাপ নেবেন না। আমি দেখছি এদিকটা। আপনি আমাকে সাহায্য করলেই হবে।”
“হ্যাঁ বলুন কী জানতে চান।”
চা সিঙাড়া চলে এলো। শৌভিক একটা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল, “রাকিবের ঘর থেকে ছুরি ছাড়া সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেছে?”
রবিউজ্জামান রাকিবের কেস ফাইলটা বের করে দেখে নিয়ে বললেন, “পাওয়া যাওয়ার মধ্যে একটা প্যাকেটে আধখাওয়া পিজ্জা, চারটা শ্যাম্পেনের বোতল, ছুরি আর ভাঙা মোবাইল পাওয়া গেছে।”
শৌভিক উত্তেজিত হয়ে বলল, “কার মোবাইল?”
“রাকিবের। দেখে মনে হয় ইচ্ছে করে ভাঙা হয়েছে। আরেকটা বিষয় হলো ভেতরে মোমোরি কার্ড ছিল না।”
“হুম! হতে পারে মেমোরি কার্ড ব্যবহারই করত না। এখনকার মোবাইলে অনেক স্টোরেজ থাকে।”
“কিন্তু রাকিবের মোবাইলটা পুরানো মডেলের। তারপরেও না থাকতেই পারে। কিন্তু মোবাইল ভাঙার ব্যাপারটা খটকা লেগেছে। হতে পারে তাতে এমন কিছু ছিল যেটা খুনীর ক্ষতি করতে পারত।”
“তা ঠিক। আপনি কি জানতেন রাকিব ইদানীং খুব খরচা করছিল?”
“সে ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। ওর গ্রামের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে খবর নিয়ে জেনেছি ওর বাবা কৃষক। ওর জন্য সেখান থেকে কোনো টাকাই আসে না। ও মাঝে মধ্যে টাকা পাঠায়। কয়েক মাসের মধ্যে নাকি পাঠায়নি। এখানে সে চলত টিউশনির টাকায়। সেসবও বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু টাকার উৎস জানা যায়নি।”
শৌভিক বুঝতে পারল পুলিশ আসলে কেসটা নিয়ে অত মাথা ঘামাচ্ছে না। রাকিব যেহেতু তেমন জরুরি কোনো ব্যক্তিত্ব নয়, আর ওপর মহল থেকে কোনো চাপ আসছে না। তাই তারা একজনকে খুনী সাব্যস্ত করে বসে আছে। খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। শৌভিক উঠে পড়ল।
___________
জিকোর ফোন এলো রাত বারোটা পাঁচে। শৌভিক অবাকই হলো।
“হ্যাঁ জিকো বলো।”
“সরি স্যার এত রাতে ফোন করার জন্য। আসলে একটা বিষয় না জানিয়ে পারছিলাম না।”
“কী বিষয়?”
“স্যার রাকিবকে অনলাইন দেখাচ্ছে!”
“কী! কেমন করে সম্ভব?”
“হতে পারে আইডি হ্যাক হয়েছে। আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি স্যার। হঠাৎই দেখি ওর আইডির পাশে সবুজ সাইন জ্বলছে। আপনাকে জানানো দরকার মনে হলো।”
“খুব ভালো করেছে। মেসেজ-টেসেজ দিও না। দেখো কতক্ষণ থাকে।”
“জি স্যার।”
“আর যে কাজটা তোমায় দিয়েছিলাম সেটা হয়েছে?”
“প্রায়। কাল সকালে পেয়ে যাবেন।”
“ঠিক আছে।”
সকাল সকাল জিকোর মেইল এলো। শৌভিক এমনিতে দেরিতে ওঠে, আজ দ্রুতই উঠেছে। মেইলটা সে কয়েকবার পড়ল।
রাকিবের বন্ধুদের জানামতে গত তিন মাসে তার দিনের রুটিন-
নিয়মিত ক্লাসে আসত,
ক্লাস শেষে ওদের দলের মিটিং থাকত সেখানে সময় দিত,
বিকেল শেষে বের হয়ে যেত ক্যাম্পাস থেকে,
তারপর তাকে বেশিরভাগ সময় পাওয়া যেত ক্লাবে,
মাঝে মধ্যে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত তবে সেটা গত তিন মাসে হাতেগোনা করেকবারই হয়েছে। ক্লাবেই বেশি সময় কাটাতে শুরু করে। বড়লোকদের ক্লাব, গেলেই খরচা। তাই সবাই যেতে পারে না। ওর কাচা টাকা হয়েছিল তাই হাওয়া বদলাতে সেখানে যাওয়া হতো নিয়মিত।
এই জিকোটা আধখেঁচড়া কাজ করছে! অবশ্য ওর দোষ নয়। খুঁটিনাটির দিকে আজকালকের ছেলেমেয়েরা কম নজর দিচ্ছে। সে ফোন করল জিকোকে।
“তুমি এতকিছু লিখলে, ক্লাবের নাম লেখোনি কেন?”
“ওফ সরি স্যার। মনে ছিল না। ক্লাবের নাম রিয়েল ক্লাব। ঠিকানা আমি আপনাকে মেসেজে দিচ্ছি। আপনি কি সেখানে যাবেন?”
“ভাবছি যাব।”
“আমিও কি যাব স্যার?”
“না তোমার সহপাঠীরা কেউ থাকলে চিনে ফেলবে। আমি একাই যাব।”
“আচ্ছা স্যার।”
ফোন রেখে মুচকি হাসল শৌভিক। জিকোর হয়তো ক্লাবে যাওয়ার খুব ইচ্ছে। বেচারার যাওয়া হলো না।
________
(শিফার কথা)
আমি আর খুনের ব্যাপারে সোহানের সামনে কোনো কথাই তুললাম না। এমনভাবে ব্যবহার করতে থাকলাম যেন ওই ঘটনা পৃথিবীতে ঘটেইনি। সোহানের সাথে ঘুরতে যাই, হাসিঠাট্টা করি, উল্টোপাল্টা কথা বলে রাগ করিয়ে দেবার চেষ্টা করি, বাড়ির বাচ্চাদের নিয়ে রোজ রাতে খেলতে বসি। সন্ধ্যায় পড়াশুনা শেষে সবাই মুখিয়ে থাকে খেলার সময়টার জন্য, সোহানও। মাঝে মাঝে বিকেলে ও গ্রামের ছেলেদের সাথে ক্রিকেটও খেলতে যায়। গতকাল অবশ্য সারাদিন বৃষ্টি হয়েছিল, ফুটবল খেলে এসেছে। ওর চেহারা আগের চেয়ে ভালো হচ্ছে। আমি ভরসা পাচ্ছি। যদিও মনে হয় রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে। ওটুকু ভুলিয়ে দিতে পারলেই হতো।
তবু কিন্তু থেকেই যায়। ভাবনারা জড়ো হতে থাকে নিত্যদিন। তারপর? তারপর কী হবে? কতদিন এভাবে—
আজ আবার গ্রামে পালাগানের আসর বসেছে। গ্রামের মাঝখানে মেলার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অনেকে দোকান দিয়েছে সেখানে। মুড়ি মুড়কি, বাতাসা ইত্যাদি সাজিয়ে বসেছে। গরম গরম জিলাপি, পিয়াজু ভাজা হচ্ছে। চটপটি ফুচকার দোকান দিয়েছে। বাড়ির সবার সাথে আমরাও এসেছি। গানের আসর নাকি একটু রাত হলে শুরু হয়। তার আগে সবাই ঘুরে-ফিরে। আমরাও হাঁটাহাঁটি করলাম। বাড়ির বাচ্চাদের খাবার কিনে দিলাম৷ গানের আসর শুরু হলো আটটার পর।
আমরা সামনের দিকে বসলাম। সোহান দেখলাম খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে। তার চুলগুলো বড় হয়ে গেছে। আগের মতো ঝাকড়া হয়ে কান বেয়ে নেমে যাচ্ছে। কাটতে বললে কাটে না। বাউলদের সাথে ওর চুলের মিল দেখে মজা লাগল। অনেকক্ষণ গান চলার পর সোহানকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি এমন গান পারো?”
“না তো।”
“মিথ্যা বলো কেন? ফেসবুকে কয়েকবার এরকম টাইপ কবিতা বা গান লিখে শেয়ার করেছিলে।”
“মনেও আছে! বাব্বাহ!”
“জি স্যার। প্লিজ বলোনা পারো?”
“একটু!”
“আচ্ছা।” বলে উঠে গেলাম৷ ওদের দলের একজনকে বললাম আমার স্বামী গান গাইতে চায়। তারা সুযোগ দেবে কি না। লোকটা খুশি হয়ে বলল, “অবশ্যই।”
সোহানকে জানাতেই সে রেগে গেল। “তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করে বলতে গেলে কেন? আমি যাব না৷ পারব না এসব।
“আরে পারবে। তোমার গলা ভালো। নিজের লেখা গান সুর করে গাইবে শুধু।”
“ইম্পসিবল!”
ততক্ষণে ওরা মাইকে বলছে শহরের ছেলে তাদের সাথে গান গাইতে চায়৷ সোহানকে ঠেলেঠুলে নিয়ে যাওয়া হলো ছোট্ট স্টেজে। দেখেই বোঝা গেল বেশ বিব্রত। প্রথমে মাইক হাতে কিছুই বলতে পারল না৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল৷ তারপর একটু একটু করে দুটো লাইন গাইল। সবাই হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিতে লাগল। তারপর আস্তে আস্তে অনেকখানি গেয়ে ফেলল। এবার করতালি পড়ল। সোহানও স্বস্তি পেল। একটার পর আরেকটা গান গাইল, তারপর আরও একটা৷ সবাই তখন প্রশংসা করতে শুরু করেছে।
সোহান বাকিটা সময় স্টেজ থেকে আর নামল না। বলা ভালো তাকে নামতে দেয়া হলো না। ওদের সাথে টুকটাক গাইল। আমি শুধু ওকে দেখে গেলাম৷ পুরোটা সময়। কী ভালো আছে মানুষটা! এমনই যদি থাকত বাকিটা জীবন! কোনো কালো মেঘ ওকে গ্রাস না করতে পারত!
অনুষ্ঠান শেষ হলো মধ্যরাতে। বাড়ির ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাকিরা আগেই চলে গেছে। আমি আর সোহান পেছনে পড়লাম৷ রাত শেষের দিকে তখন। গ্রামের মেঠোপথ পাড়ি দিতে দিতে তারাভরা আকাশের নিচে ওর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। নয়তো পৃথিবীটা স্বপ্নলোকে পরিণত হয়েছে। কী প্রশান্তি প্রতিটা নিঃশ্বাসে!
সোহান গুনগুন করে গান গাইছে তখনো, “চাতক প্রায় অহর্নিশি….”
একসময় গান থামিয়ে বলল, “একটা কথা বলব।”
“বলো।”
“আপুর বাড়িতে তোমারা যেদিন প্রথম এসেছিলে তোমাকে দূর থেকে দেখেছিলাম৷ প্রথমটায় তেমন কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু কেন যেন তোমার মুখটা মনে গেঁথে ছিল৷ পরপর দু’দিন স্বপ্নেও তোমাকে দেখে ফেললাম৷ স্বপ্নটা তখন বলার মতো ছিল না। এখন অবশ্য বলা যায়। একদিন দেখেছিলাম তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। অন্যদিন দেখেছি তোমার হাত ধরে হাঁটছি। তুমি বার বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছ, আমি তুলে দিচ্ছি। তারপর একসয়ম বিরক্ত হয়ে তোমাকে কোলে তুলে নিলাম।”
“তারপর?”
“এতটুকুই। এই স্বপ্নগুলো দেখার পর তোমাকে আর কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না। তাই ছবি আঁকতে বসে গিয়েছিলাম।”
আমি ভীষণ অবাক হলাম। বললাম, “আর তোমাকে আমি প্রথমবার দেখে কিছুই মনে হয়নি। যেদিন পুকুরপাড়ে আমাকে আমার ছবি দেখালে সেদিন অদ্ভূত লেগেছিল।”
“তুমি তখনই আমার সাথে জুড়ে গিয়েছিলে। বোধহয় ওটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেতেই হয়েছিল। তিনি তো জানতেন ফাইনালি তুমি আমার হবে।”
আমার বুকের ভেতর কেমন যেন করতে শুরু করল। ওর হাতটা আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলাম৷ অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিলাম, অবশ্য সোহানের হাত ধরে থাকাতে পড়লাম না। সে বাঁকা হেসে বলল, “এতক্ষণ পড়োনি, এখনই কেন পড়লে?”
“দ্যাখো এটা ইচ্ছাকৃত ছিল না।” বলতে বলতে আবারও পড়তে পড়তে বাঁচলাম। সে হো হো করে হেসে আমাকে কোলে তুলে নিল। আমার মনে হতে লাগল পৃথিবীর সব সুখ এই গ্রামে আমাদের কাছে জড়ো হয়েছে।
(চলবে)