#ফিঙের_ডানা
পর্ব-৩১
সোহানকে সেদিন ছাড়ল না৷ আমি বিকেলে ওর সাথে দেখা করতে গেলাম৷ চোখদুটো বসে গেছে। শুয়েছিল, আমাকে দেখে উঠে এলো। সেলের ভেতর ওকে দেখতে পেয়ে এক মুহূর্তে বুকটা কেঁপে উঠল। শুকরিয়া জানালাম রবের কাছে, এই অবস্থা চিরস্থায়ী না হওয়ার জন্য। সোহান হেসে বলল, “এই ডিটেকটিভ ঠিক করার বুদ্ধি নাকি তোমার দেয়া?”
“হ্যাঁ।”
“কবে করলে এসব?”
“আমি কিছু করিনি। রোকন ভাই করেছে।”
“কলকাঠি তো তোমার ছিল। যাক! আমি তাহলে খুনটুন করিনি এটা ভেবেই ভালো লাগছে।”
“তোমাকে আমার ইচ্ছে করছে মারতে! তুমি এত বোকা কেন? কিছু না করেও এত কষ্ট পেলে?”
“তোমাকেও কষ্ট দিয়েছি!”
“কিন্তু তুমি বুঝতে পারলে না কেন?”
“আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম শিফা! ও আমার মাথায় এমন করে ভয় ঢুকিয়েছিল যে…”
“আচ্ছা পরে বলো এসব। কালকেই হয়তো ছাড়া পেয়ে যাবে তুমি।”
“হুম। জানো আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। বার বার মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি।”
“আমারও!”
সে স্বপ্নালু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “আমরা এখন থেকে একসাথে থাকব শিফা!”
আমার চোখে পানি চলে এলো।
***
পরদিন অভিযুক্ত হিসেবে অভি আর স্নেহাকে ধরা হলো। সোহানকে মুক্ত করে দেয়া হলো আর ওদের ব্যাপারে আরও তদন্ত করার নির্দেশ দেয়া হলো।
সোহানকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম দুপুরে। এসে সে খেয়েদেয়ে ঘুম। বিকেল পেরিয়ে তবে উঠল। শাশুড়ী মা এখন মোটামুটি সুস্থ হয়েছেন। ঘুমন্ত ছেলেকে একটু পরপর গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে আসছেন৷ সোহান ঘুম ভাঙলে হাতমুখ ধুয়ে এসে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইল। সন্ধ্যার নাশতা বানিয়েছে তান্নি আপু। পাস্তা, কলিজার সিঙাড়া, সাথে গরম চা। ঘরময় খাবারের ঘ্রাণ। রিশান এতদিন পর মামাকে পেয়ে খুশিতে অনেকগুলো ডিগবাজি দিয়ে ফেলেছে৷ এখন দু’হাত মাখিয়ে সস দিয়ে সিঙাড়া খাচ্ছে। একটু পরপর মামার মুখের কাছে আধখাওয়া সিঙাড়া ধরে বলছে, “মামা একটু খাও।”
তাপ্তি-সুক্তি এখনও তেমন কিছু বোঝে না। তবে শোকাবহ পরিবেশ থেকে বের হয়ে বাড়িতে যে আনন্দের জোয়ার এসেছে সেটা ঠিকই ধরতে পেরেছে। খিলখিল করে হাসছে, হাত পা ছুড়ে খেলছে আর খানিক বাদে বাদে তারস্বরে চিৎকার করে উঠছে একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে।
খেতে খেতে রোকন ভাই জিজ্ঞেস করলেন, “এবার একটু খুলে বলো তো সোহান কী হয়েছিল?”
সোহান গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে টেবিলে রেখে পা তুলে বসে বলতে শুরু করল, “রাকিবের সাথে আমার ঝামেলা অনেক আগে থেকে, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে। সেসব পুরানো কথা অনেক আগে ভুলে গেলেও রাকিবের সাথে বন্ধুত্ব ঠিক হয়নি। খুনের আগের দিন পোস্টার লাগানো নিয়ে ওর সাথে তুমুল ঝগড়া হয়, ঝগড়ার মধ্যে আমি রেগে গিয়ে উল্টোপাল্টা কথাও বলে ফেলি। তখন তো আর জানতাম না সেটার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।
সেদিন ঝগড়ার পর পুরানো কথা মনে করে, রাকিবের সাথে বন্ধুত্বের কথা মনে করে বেশ মন খারাপ ছিল৷ ব্যাপারটা আমি অভির সাথে শেয়ার করি। অভি, স্নেহা দুজনেই আমার ভালো বন্ধু ছিল। বন্ধুরাই শেষ পর্যন্ত ধোঁকা দিল!
ওরা আমাকে বার বার বুঝিয়েছে আমি যেন রাকিবের সাথে মিটমাট করে ফেলি। তাতে আমার মন ভালো হবে, তারচেয়ে বড় কথা সামনে নির্বাচন , এখন প্রতিপক্ষ দলের কারো সাথে ঝামেলা থাকলে সে সময় এটা বড় ইস্যু হতে পারে। ওদের কথাতেই ফোনটা করেছিলাম রাকিবকে। মিটমাট ফোনেই কিছুটা হয়েছিল, ও বলেছিল বাকি কথা ওর বাড়িতে গিয়ে বলতে। আমিও গেছি।
ড্রিংক করার কোনো ইচ্ছেই ছিল না৷” সোহান মাথা নিচু করে ফেলল বলতে গিয়ে।
“আমি ওসব খাইও না কখনো। রাকিব এত জোরাজুরি করছিল যে না করতে পরিনি৷ অল্প খেয়েই তাই অনেক নেশা হয়ে গিয়েছিল। কী হচ্ছিল কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মনে আছে মাঝে অভি এসেছিল পিজ্জা নিয়ে। ডেলিভারি বয় সেজে এসে সারপ্রাইজ দিয়েছিল। পিজ্জা খেলাম, তারপর আর কিছু মনে নেই। আসলে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।
ঘুম ভেঙেছে অভির ডাকে। উঠে দেখি ওর কপালে রক্ত৷ ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। রাত তখন আড়াইটা। নেশা ছুটেছে তখন অনেকটা। রাকিবের দিকে চেয়ে আমার আত্মা উড়ে যাওয়র জোগাড়। পুরো ফ্লোর রক্তে ভেসে আছে। ও মরে পড়ে আছে একপাশে।
অভিকে আমি অনেক বিশ্বাস করতাম, অনেক বেশি! এই বিশ্বাসই কাল হয়েছে। ও প্রথমেই বলেছে, ঠান্ডা হ প্লিজ। তুই ইচ্ছে করে করিসনি এসব। আমি তখন আরও ভয় পেয়ে যাই। ইচ্ছে করে মানে? আমি করেছি? ও বলে, হ্যাঁ তুই ওকে মেরেছিস, আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে কপাল ফাটিয়েছিল৷ কেন তোর কিছু মনে নেই?
আমার তখন মাথা আরও ঘুরে গেল। আসলেই আমার কিছু মনে নেই। তীব্র অপরাধবোধ জেকে ধরল। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা।
অভি আমাকে আস্তে আস্তে সুস্থ করে তুলল। বোঝাল আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি। কিন্তু এখানে থাকলে পুলিশ এসে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে৷ আমার উচিত পালিয়ে যাওয়া। ও নিজেই আমাকে নিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে এলো। আমরা গেলাম ওর বাড়িতে। সেখানেই পরদিন সকাল পর্যন্ত ছিলাম৷ রক্তমাখা জামাকাপড় ওর বাড়িতেই বদলেছিলাম। ও আমাকে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। জীবনে প্রথমবার মদ খেয়ে এত বেহুশ হয়ে ছিলাম যে কী করেছি, কী করিনি বুঝতেই পারিনি৷ আমি কি ভেবেছিলাম আমার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা হবে?”
থামল সোহান৷ শাশুড়ী মা ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ভুলে যা বাবা৷ এইগুলা মনে রাখিস না। আল্লাহ বাঁচিয়েছে, এখন এসব মনে রেখে লাভ নাই।”
“হ্যাঁ মা!”
রোকন ভাই বললেন, “আমাদের সব খুলে বলতে পারতে!”
“ভাইয়া আমি এতটা অপরাধবোধে ভুগছিলাম যে কিছু বলতেও ইচ্ছে করছিল না। মানুষ ইচ্ছে করে খুন করে, আমি করেছি অনিচ্ছায়, জ্ঞানহীন অবস্থায়। কী বলতাম সবাইকে?”
“থাক বাদ দাও। এখন তো সব ঠিক।”
তান্নি আপু সোহানের কোঁকড়া চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুই সত্যি মার্ডার করেছিস৷ ছোটবেলায় যেভাবে আমাকে মারতি! দেখ এখনো হাতে দাগ আছে।”
সবাই হেসে ফেলল।
রাতে শুতে গেলাম। সেই বিয়ের রাতে আমরা এই ঘরটাতে একসাথে ছিলাম, আজ আবার একসাথে। গত পরশুও ভাবতে পারিনি এত দ্রুত ওর সাথে এখানে থাকা হবে। ও আমাকে নিয়ে ছাদে চলে গেল। আজ আকাশ ভর্তি জ্বলজ্বল করছে তারা। আমরা কোণায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “এখন কী করবে? ওই ইউনিভার্সিটিতেই পড়বে?”
“নাহ। গ্র্যাজুয়েশন তো শেষ। বাকিটা অন্য কোথাও করব।”
“বলেছিলে বিদেশ চলে যাবে।”
“এখন আর ইচ্ছে নেই তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার।”
“আমার জন্য ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে ফেলবে?”
সে হাসতে হাসতে বলল, “তোমার জন্যই ভবিষ্যতটা নিশ্চিত হয়েছে বুঝেছ! এখন তোমাকে ছাড়া থাকার কথা চিন্তাও করতে পারি না৷ যদি বিদেশ যাইও তোমাকে নিয়ে যাব।”
“আর আমার পড়াশোনা?”
“তোমার আর কতদিন বাকি? দুই বছর?”
“উহু, তিন।”
“হয়ে যাবে। এক্ষুনি তো আর যাচ্ছি না।”
“আমরা কি এই বাসায়ই থাকব?”
“নাহ। বউ নিয়ে বোনের বাড়িতে থাকব নাকি! এমনিতেই ওদের কাছে ঋণের শেষ নেই আমার।”
“তাহলে আগের মতো আমি মায়ের কাছে থাকি৷ তোমার একটা ব্যবস্থা হলে তারপর নাহয়…”
“মায়ের বিয়ে দিয়েছ, এখন সংসার করতে দাও। আমি দেখি একটা বাসা ভাড়া নেব৷ পার্ট টাইম জব পেলে করব৷ আর তাছাড়া গ্রাম থেকে তো টাকা আসছেই। মায়ের আর কত খরচ লাগে, জমিজমা থেকে যা আয় হয় আমাকেই পাঠায় বেশিরভাগ। চলে যাবে দুজনার।”
“আচ্ছা।”
“তোমার জন্য একটা জিনিস আছে, নিয়ে আসছি বসো।”
সে উঠে গিয়ে বড় একটা বই নিয়ে এলো। আমার হাতে দিল দেখার জন্য। পৃষ্ঠা ওল্টাতেই দেখি তার আঁকা আমার ছবিগুলো! একপাশে ক্যামেরায় তোলা ছবি, অন্যপাশে আঁকা ছবি৷ কী যে সুন্দর হয়েছে! এত ছবি কখন আঁকল? আমাকে তো মাত্র দু-তিনটে দেখিয়েছে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে বলল, “পেন্সিল হাতে থাকলেই কেমন করে যেন তোমার ছবি এঁকে ফেলেছি। অনেকগুলো ছবি জমা হওয়ার পর একসাথে বাঁধিয়ে ফেলেছি।”
“অনেক বেশি সুন্দর।”
সোহান আমার কাঁধে মাথা রেখে বলল, “তুমি তারচেয়েও সুন্দর শিফা!”
একটু পর নিজেই বলতে থাকল, “আমার জীবনে আগেও মেয়ে এসেছে, কিন্তু তোমার মতো করে কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। সেই শুরু থেকে তোমার সরলতা, একা একা কথা বলা, মিষ্টি ব্যবহার আর সুন্দর মনটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। সত্যিকারের ভালোবাসতাম বলেই হয়তো উল্টোপাল্টা ব্যবহার করেছি৷ আসলে ইচ্ছে করত সারাক্ষণ তোমার সাথে থাকতে। মা যখন তোমাকে বিয়ের কথা বলেছিল ইচ্ছে হচ্ছিল মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলি, মা তুমি জানো আমি কত খুশি হয়েছি? তোমাকে বড় করে অনুষ্ঠান করে বিয়ে করে ঘরে তুলতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু ভাগ্যে নেই। সে যাই হোক, যা হয়েছে তাতে ভালো একটাই হলো, তোমার আমার সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেল। তোমাকে এখন আরও বেশি ভালোবাসি। তোমার অন্ধের মতো আমার প্রতি ভালোবাসাকে আরও বেশি ভালোবাসি।”
আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারলাম না। কিছু কথার পিঠে কথা বলতে নেই। নীরবতাই সব বলে দিয়ে যায়।
(শেষ পর্ব রাতে বা কালকে)