#ফিঙের_ডানা
পর্ব-৩২ (শেষ পর্ব)
সাত বছর পর….
কালো রঙের চকচকে সৈকতটা ভারী সুন্দর। আয়নার মতো মসৃন বালির ওপর সাগরের ঢেউ বার বার গড়িয়ে আসছে। সাথে নিয়ে আসছে সাদা ধবধবে ফেনা। সৈকতের ধার দিয়ে নানা রঙের ঝিনুকের সমাহার। সেদিকে চাইলে একটা কথাই বারংবার মনে হয়, পৃথিবীটা এত সুন্দর কেন?
সোহান বলল, “যাবে এখানে?”
“কবে যাচ্ছি?”
“আর কয়েকটা মাত্র দিন। তুমি ফাইনাল করো এখানেই কি না!”
“আচ্ছা এখানেই যাব। পছন্দ হয়েছে খুব।”
“ডান!”
মোবাইলে ভিডিওটা দেখাচ্ছিল সে। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে কোনো এক সৈকতের দৃশ্য। বহুদিন আগে নৌকায় বসে সোহান বলেছিল, আমাকে পৃথিবীর সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে দেখাবে। বিয়ের পর নানা ঝড়ঝাপটায় সেই সুযোগটাই হয়ে ওঠেনি। গত দু’বছর ধরে সে প্ল্যান করে ঘুরতে যাওয়ার, তারপর কেন যেন আর হয়ে ওঠে না। ব্যস্ত সংসারে এটা ওটা কাজ পড়েই যায়। ফুরসত মেলে না। আবার টাকারও ব্যাপার আছে। দেশে ঘুরতে গেলে খরচ কম, কিন্তু বিদেশভ্রমণের শখ জেগেছে জনাবের। এদিকে আমার ভয় করে। ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে দূরদেশে গিয়ে পরে যদি অসুখবিসুখ বাঁধিয়ে ফেলে?
পৃথী হাত পা ছুঁড়ে বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। দাঁতহীন মাড়ি বের করে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে জানান দিল, বাবা যা বলবে সে তাতেই রাজি। কেমন করে যেন এই পুঁচকে বয়সেই বাবার ন্যাওটা হয়ে গেছে। বাবা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না।
সোহান বলল, “শিফা! তুমি কিন্তু এবার কোনো বাগড়া দিতে পারবে না। নইলে তোমাকে রেখে আমরা চলে যাব।”
“তাই যেও। দু’জন আমাকে ছেড়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেয়ে দেখাও।”
সোহান অসহায় চোখে পৃথীর দিকে তাকাল। পৃথী আরও সুন্দর হাসি দিয়ে বলতে চাইল, মা যাবে না তো কী হয়েছে? আমি তো আছি!
_________
আমরা যেমন ভেবেছিলাম আমাদের জীবনে কোনোকিছুই তেমন হয়নি। সোহান মাস্টার্সের জন্য যখন ভর্তি হলো, তার কিছুদিন পরেই শাশুড়ী মায়ের কিডনিতে সমস্যা ধরা পড়ল। তার চিকিৎসা করানোর জন্য কতকিছুই না করল সোহান! বাংলাদেশের সেরা ডাক্তার দেখানোর পর ভারতেও নিয়ে গেছে দু’বার৷ দিনরাত সেবা করেছে। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টও হয়েছিল। মাত্র ক’টা দিনের জন্য খানিক সুস্থ হয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু একদিন সব চেষ্টা বৃথা করে দিয়ে পরোপারে পাড়ি জমান।
তিনি মারা যাওয়ার পর খেয়াল করলাম সোহানের বলতে কিছুই এখন আর নেই। গ্রামের সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে হয়েছে, বসতবাড়িটা শুধু রয়েছে। ওর পড়াশোনা তখন শেষ হয়েছিল, হন্য হয়ে একটা চাকরি খুঁজে বের করেছে। বড় বাসা থেকে ছোট একটা বাসা নিয়ে আমরা থাকতে শুরু করেছি ততদিনে।
সত্যি বলতে অল্প টাকায় হিসেব করে চলতে আমি ছোটবেলা থেকেই শিখেছিলাম। তাই কষ্ট হয়নি আমার। সোহানের হতো, সবসময় দামি শার্ট, ব্র্যান্ডের ঘড়ি, দামি পারফিউম ছাড়া তো চলেনি, তাই সেগুলো যখন সস্তার ব্যবহার করতে হতো তখন খুব ইতস্তত করত। পুরানো ভালো ঘড়িটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আর ঘড়িই কেনেনি! তান্নি আপু অবশ্য প্রতি ঈদে, জন্মদিনে যতটা পেরেছে গিফট দিয়েছে, কিন্তু ওগুলো পরতেও সোহানকে কেমন অস্বস্তিতে পড়তে দেখেছি।
তবু আমাদের জীবনটা এতটাও কষ্টের ছিল না। ছোট হলেও সুখের কমতি হয়নি একদিনের জন্যও। যতই প্রেম থাকুক না কেন আমি কখনো ভাবিনি সোহান এত ভালো স্বামী হতে পারবে। বিয়ের পর, বিশেষ করে ওর মা মারা যাওয়ার পর ও আমাকে যতটা যত্ন নিয়ে আগলে রেখেছে, ততটা আর কেউ কখনো করেনি আমার জন্য।
অভাব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, সোহান ভালো চাকরি পেয়ে গেছে কিছুদিন পরেই। তারপর আর পেছন ফিরে দেখতে হয়নি৷ আমিও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে একটা ছোটখাটো চাকরি শুরু করেছিলাম, তখনই পৃথী জানান দিলো, সে আসছে।
সোহান তারপর আর চাকরি করতে দেয়নি। ছোট মানুষের মতো খেয়াল রেখেছে। ওর হাবভাব দেখলে মনে হতো আমার একটা টোকা লাগলেও না জানি কী হয়ে যাবে! ওর খুব ইচ্ছে ছিলো মেয়ের। ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। মায়ের নামে নাম রেখেছে সে। আর ডাকনাম পৃথী।
পৃথিবীতে প্রতিটা ঘটনাই হিসেব করে হয়। একদিকে ভাঙে, অন্যদিকে গড়ে। সোহানের ইচ্ছে ছিল বিদেশ গিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার, স্রষ্টা সেই স্বপ্ন ভেঙে ওর সংসার গড়ে দিয়েছেন। আমার কখনো মনে হয়, ওর কি মনমতো ক্যারিয়ার গড়তে না পারার আফসোস রয়ে গেছে এখনো? তারপরেই পৃথীর সাথে ওকে সময় কাটাতে দেখে ওর চোখমুখে যে জ্যোতি দেখতে পাই সেটাই বলে দেয় সে খুব ভালো আছে। এই পর্যন্ত যত বিপদই এসেছে, সবই আমাদের সম্পর্কের বাঁধন শক্ত করেছে।
আমি মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যাই। মা বেশ গুছিয়ে সংসার করছে। অভাব আর বড় পরিবারের কারনে তার কত শখ জীবনে অপূর্ন থেকে গেছিল! সেসবের যতটা এখনো অবশিষ্ট আছে ততটা পূরণ করছে। তার বর্তমান জীবনসঙ্গী হয়েছে তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তাদের দেখলে মনেই হয় না তারা মাত্র কয়টা বছর একসাথে আছে, বরং মনে হয় যুগ যুগ ধরে তাদের একসাথে পথ চলা। সবকিছু হয়তো ঠিক নেই, শফীক আঙ্কেলের ছেলেমেয়েরা মাকে মা হিসেবে মানতে পারেনি। তাদের থেকে অনেকটাই অবহেলা আর নির্লিপ্ততা পেতে হয়েছে। সেসব পূরণ করে দিয়েছে শফীক আঙ্কেল নিজেই। কেমন করে যেন ছেলেমেয়ের চিন্তা একপাশে রেখে নিজেরা নিজেদের মতো সুখী হয়ে উঠতে পেরেছে।
_________
পরিকল্পনা মতো আমাদের ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার সব বন্দোবস্ত প্রায় হয়ে গেল। সোহান ভীষণ উত্তেজিত, গোছগাছ করছে, বারবার দেখছে সব ঠিক আছে কি না। আমারও দারুণ আনন্দ হচ্ছে।
যেদিন ফ্লাইট, সেদিন সকালে হঠাৎ পৃথীর জ্বর হলো। এত জ্বর যে সেটা নিয়ে বের হওয়া যায় না। সারাদিন মেয়ের পেছনে কাটিয়ে দিতে হলো, ফ্লাইট মিস! মনটা আঁধার হয়ে রইল আমাদের দু’জনার। এদিকে পৃথীরও জ্বর কমার নাম নেই।
ডাক্তার দেখানো হলো। জ্বর নামল চারদিন পর। মেয়েটা চারদিনে প্রায় কিছুই মুখে দেয়নি। এখনো খেতে চাইছে না৷ সোহান অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিল বলে বাসায়ই আছে।
রাতে পৃথীকে কোনোরকমে জোর করে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে সোহানকে নিয়ে বারান্দায় গেলাম৷ তখন এলাকায় লোডশেডিং। অন্ধকারের মাঝে আকাশের চাঁদের আলো ঝকঝকে দেখাচ্ছে। এ ক’দিন ওর সাথে ভালোমতো কথাই হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কি খুব মন খারাপ?”
সে হেসে বলল, “না। তোমার?”
“তোমার জন্য মন খারাপ।”
“জীবনটা এত অনিশ্চিত হয় কেন শিফা?”
“সেজন্যই সুন্দর হয়। তুমি যদি জানতে পরের মুহূর্তে কী হবে তাহলে কি জীবন একঘেয়ে হয়ে যেত না? সবকিছু হিসেবমতো হবে না এটাই তো স্বাভাবিক।”
“আমার জীবনটা বড্ড বেশি অস্বাভাবিক।”
“অসুন্দর কি?”
সে হেসে বলল, “নাহ।”
বলে আমাকে কাছে টেনে নিল। আজ সারাদিন গুমোট গরম ছিল, এখন ঠান্ডা বাতাস বইছে৷ সোহানকে বলেছিলাম বারান্দায় বাগান করব সেজন্য গাছ এনে নিতে। তার বেলীফুল পছন্দ বলে একগাদা বেলীর চারা এনে দিয়েছিল। অজস্র ফুল ফুটেছে সবগুলো মিলে। ঘ্রাণে ম ম করছে বারান্দা। কী স্নিগ্ধ পরিবেশ!
বললাম, “ঘুরতে গেলে আজকের এই মিষ্টি সময়টা তোমার আমার থাকত?”
“না, তবে এরচেয়ে সুন্দর সময় থাকতে পারত।”
“হয়তো তারচেয়েও সুন্দর সময় অপেক্ষা করে আছে..”
“হয়তো..”
মেয়ের কান্নার শব্দ শোনা গেল ভেতর থেকে। সোহানই আগে ছুটে গেল। মেয়েকে কোলে তুলে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে থাকল। বিদ্যুৎ চলে এলো একটু পরেই। পৃথীর কান্নাও থামল। এখন বাবা মেয়ে হাসছে। দু’জনের পৃথিবীর কোনোদিকে খেয়াল নেই। খুশিতে ঝলমল করছে একেবারে! আমারও কয়েকদিনের মন খারাপ ভাবটা কেটে গেল।
রাতে শোওয়ার সময় ও আমার ছড়ানো চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে বলল, “ভালোবাসি শিফা।”
আমি এই কথার উত্তরে কখনো কিছু বলি না। সেও আশা করে না৷ জানালার কাচ গলে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকে অদ্ভূত সব নকশা তৈরি করে। আমরা চেয়ে দেখি। নিঃশ্বাসের সাথে জীবনের দেয়া প্রশান্তিটুকু টেনে নেই।
জীবনটা কষ্ট-সুখ মিলে হলেও দিনশেষে কষ্টটা ফিঙের ডানায় ভর করে চলে যায়, সুখটুকু পড়ে থাকে।
(সমাপ্ত)