ফেরারি প্রেম পর্ব -১৪

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_১৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

“শুধু দেখুন আজ আমি শাফকাতের কী অবস্থা করি!”

স্তম্ভিত হয়ে গেল নীহারিকা। দেহ যেন চলছেনা তার। তবুও রূপলের গাঁয়ের জোরে সে ক্রমশ দৌড়চ্ছে! বাড়ির লোকজন সবাই পেছন থেকে রূপল এবং নীহারিকাকে হাঁকডাক ছেড়ে ডাকছে। কী হয়েছে জানতে চাইছে। সেদিকে যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। রূপলের আ’ক্র’ম’না’ত্ন’ক ভাবকে কিঞ্চিৎ শিথিল করার জন্য নীহারিকা স্পষ্ট গলায় রূপলকে বলল,

“দেখুন রূপল। আমি কোনো ঝামেলা চাইছিনা। যা সত্যি শাফকাত ভাই তাই বলেছে! হ্যাঁ, মুখের উপর সত্যি কথা বলাটা কেউ-ই মেনে নিতে পারেনা। তেমনি আমিও প্রথমে মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু এখন সব মেনে নিয়েছি। প্লিজ আপনিও এবার থামুন।”

বাড়ির গ্রাউন্ডে পার্ক করে রাখা বাইকটির সামনে এসে রূপল হাঁটা থামালো। নীহারিকার হাতটাও ফট করে ছেড়ে দিলো। রাগী ভাব নিয়ে নীহারিকার মুখোমুখি দাড়ালো। উগ্র মেজাজে নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“তার মানে আপনিও শাফকাতকে পছন্দ করেন? তাই তাকে প্রশ্রয় দিতে চাইছেন?”

নীহারিকা অধৈর্য্য হয়ে উঠল। ধৈর্য্যহারা গলায় বলল,

“বিষয়টা আপনি কেন বুঝতে পারছেননা রূপল? শাফকাত ভাই মানুষ ভালো না। আজ না হয় আপনি আছেন বলে তার সাথে ঝামেলা করে আমি পার পেয়ে যাব। কিন্তু কাল? কাল যদি সে আমার কোনো ক্ষতি করে বসে? তখন? তখন কী হবে বলুন? দুইদিন পর তো আমাকে ভার্সিটিতে যেতে হবে। তখন কে আমাকে প্রটেক্ট করবে?”

মেজাজ যেন আরও তুঙ্গে ওঠে গেল রূপলের! খরতর গলায় সে নীহারিকাকে বলল,

“এই? আপনি এত ভীতু কেন? দুইদিন আগেও তো আমি আপনাকে অনেক সাহসী ভাবতাম! নিজের স্বার্থের জন্য সে সব করতে পারে। আজ হঠাৎ এত পরিবর্তন কেন?”

হেয়ো হেসে মাথা নুইয়ে নিলো নীহারিকা! গাঁয়ে থাকা ওড়নাটিকে সে হাতের আঙুল দ্বারা প্যাচাতে লাগল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

“আমি আমার পরিবারের জন্য ষোলো আনা ভাবলেও নিজের জন্য এক আনাও ভাবতে পারিনা রূপল! পরিবারের কোনো ক্ষতি হবার আগেই আমি যতটুকুনি সম্ভব রুখে দাড়াই। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে কেন যেন পারিনা!”

“আগে নিজেরটা ভাবতে শিখুন। এরপর বাকীদেরটা।”

অমনি নীহারিকা গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,

“কার মুখে কী শুনতে হচ্ছে!”

কান খাঁড়া করে রূপল বাঁ পাশের ভ্রুটা উঁচিয়ে নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কিছু বললেন?”

থতমত খেয়ে গেল নীহারিকা! রূপলের দিকে শঙ্কিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আমতা আমতা গলায় বলল,

“না না কিছুনা। আপনি এখন বরং হসপিটালে যান। আমরাও কিছুক্ষণ পরে হসপিটালে আসছি।”

“প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলছেন আপনি তাইনা? শাফাকাতকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন?”

“আরে ছাড়ুন তো। বিরক্ত করতে করতে একদিন সে অধৈর্য্য হয়ে থেমে যাবে। তাকে আমি কখনও সিরিয়াসলি নিইনি।”

“ওকে। তাহলে আমি চললাম। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোটা আমার পছন্দ নয়।”

বাইকে ওঠে রূপল হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। রূপলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে নীহারিকা ভেতর থেকে চাপা এক রুদ্ধশ্বাস ফেলল। শূণ্য গলায় বলল,

“সুহাসিনী খুব লাকী জানেন? আপনার মত একজন ভালো মনের মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছে! বিনিময়ে আপনার থেকেও অজস্র ভালোবাসা পেয়েছে। এবার সে ম’রে গেলেও হয়ত তার কোনো আফসোস থাকবেনা!”

দুপুর দুটোর মধ্যেই পিয়াসাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হলো। নিহালের জোরাজুরিতে পিয়াসাকে তার শ্বশুড় বাড়িতেই উঠতে হলো! হসপিটালের সমস্ত ফর্মালিটিজ সম্পন্ন করে রূপল পিয়াসা এবং নিহালকে এ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিলো। সাথে রূপলের বাবা-মাকেও। যে যার মত করে নিজেদের বাড়িতে চলে গেল। রয়ে গেল শুধু নীহারিকা এবং রূপল। যদিও রূপল অনেকবার নীহারিকাকে জোর করেছিল সবার সাথে বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য। তবে নীহারিকা স্পষ্ট না বলে দিলো! বিষয়টায় বেশ অবাক হলো রূপল। নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“আপনি গেলেন না কেন?”

নীহারিকাও পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল,

“আগে বলুন আপনি কাঁদছেন কেন?”

“কোথায় কাঁদছি?”

“চোখে হাত দিয়ে দেখুন। চোখ থেকে পানি পরছে!”

সম্বিত ফিরে পেল রূপল। চোখের কোটরে হাত দিয়ে দেখল সত্যিই তার চোখদুটো জলে ভিজে আছে! ভেজা হাত নিয়ে রূপল নীহারিকার দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলল,

“বিলিভ মি আমি বুঝতেও পারছিনা আমি কাঁদছি। তবে বুকের ভেতরটা কেমন যেন তীব্র এক যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে!”

“আপনি কী সুহাসিনীর সাথে দেখা করতে চাইছেন?”

কাতর হয়ে গেল রূপল। হাহাকার নিয়ে বলল,

“প্লিজ একটা বার সুযোগ করে দিবেন?”

“চলুন। আজ আর কেউ আপনাকে আটকাতে পারবেনা!”

স্বস্তি খুঁজে পেল রূপল। দুজনই বাইকে ওঠে এনজিওর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। সময়ের মধ্যে দুজনই এনজিওর সামনে পৌঁছেও গেল। বাইক থেকে নেমে নীহারিকা স্থবির গলায় রূপলকে বলল,

“আপনি বরং এখানেই দাড়ান। পরিস্থিতি বুঝে আমি আপনাকে কল করব। সাথে সাথেই কিন্তু ভেতরে যেতে হবে।”

রূপল ব্যস্ত স্বরে বলল,

“ঠিক আছে আমি আপনার কলের অপেক্ষায় থাকব।”

শান্ত এবং স্থির হয়ে নীহারিকা এনজিওর ভেতরে ঢুকে পড়ল। দুপুর টাইম বলে হয়ত এনজিওর ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সেই সুযোগে নীহারিকা দ্রুত পায়ে হেঁটে সুহাসিনীর রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই মনে হলো তার পেছন দিয়ে কোনো একটা মানুষের ছায়া হেঁটে গেল! মনের ভুল বলে বিষয়টা নীহারিকা এড়িয়ে যেতে পারলনা! মাথাটা ঝাকিয়ে সে পেছনের দিকে তাকালো। তবে কারো কোনো অস্তিত্ব বিশেষ সে খুঁজে পেলনা! রীতিমতো অবাক এবং সন্দেহবাতিক হয়ে নীহারিকা সেই ছায়াটির উদ্দেশ্যে ছুটে যেতেই হঠাৎ সুহাসিনীর রুম থেকে উর্ধ্বগতিতে চলতে থাকা কারো শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ তার কানে এলো। মনে প্রবল ভয় নিয়ে নীহারিকা ছুটে গেল সুহাসিনীর রুমের দিকে। দৌঁড়ে এসে রুমের দরজায় দাঁড়াতেই তার ভয়টা যেন তিনগুন বেড়ে গেল। মুমূর্ষু রোগীদের মত সুহাসিনী জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে! মরণ বুঝি তার অতি সম্মুখে! অতিরিক্ত শ্বাস প্রশ্বাসের তাড়নায় তার চোখ দুটো যেন তার কোটর থেকে বের হয়ে আসছে। দেখতে বিভৎস লাগছে! ভয়ে চিৎকার করে উঠল নীহারিকা। এই পরিস্থিতিতে সে কী করবে উপায় বুদ্ধি খুঁজে পাচ্ছিলনা! অপ্রত্যাশিতভাবে সেখানে তখন রূপলও পৌঁছে গেল! আলাদা করে তাকে ডাকার প্রয়োজন পড়ল না।

রূপলের আর্বিভাবে সুহাসিনীর হৃদস্পন্দন যেন থমকে গেল! শ্বাস-নিশ্বাস নিতে ভুলে গেল সে। মাথাটা ঘুরিয়ে নিষ্প্রাণ দেহ নিয়ে সে কেবিনের দরজার দিকে তাকালো। মৃত পথযাত্রী সুহাসিনীকে এক পলক দেখামাত্রই রূপলের উত্তেজনা বেড়ে গেল। দিশেহারা হয়ে গেল সে। অস্থির হয়ে সে সুহাসিনীর দিকে এগিয়ে এলো। মরিয়া রূপলের দিকে হাত বাড়িয়ে সুহাসিনী রুদ্ধকর গলায় বলল,

“আমার হৃদিকে দেখে রেখো প্লিজ!”

আজীবনের জন্য সুহাসিনী চোখ দুটো বুজার আগে রূপলকে দু-চোখ ভরে দেখে নিলো! চোখ ভরা জল নিয়ে রূপল সুহাসিনীর হাতে আলতো করে স্পর্শ করতেই সুহাসিনী মন জুড়ানো এক হাসি দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই সে বড়ো এক শ্বাস ফেলে নিঃশ্বাস নেওয়া থামিয়ে দিলো। মায়ার এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো! পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রূপল! তার চোখের সামনেই সুহাসিনীর প্রাণবায়ু দেহ থেকে বেরিয়ে গেল তা যেন কিছুতেই মানতে পারছেনা। হিতাহিতজ্ঞানশূণ্য হয়ে সে সুহাসিনীর হাত ধরে রেখেই ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। নির্বিকার দৃষ্টিতে সুহাসিনীর দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের পলকও যেন পরছেনা তার। এই মুহূর্তে পুরো পৃথিবীর ভার যেন তার বুকে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে।

চক্ষুভরা আতঙ্ক হয়ে নীহারিকা ছুটে এলো সুহাসিনীর কাছে। কাঁদতে কাঁদতে সে সুহাসিনীকে দু’হাত দ্বারা ধাক্কাতে লাগল। ক্রন্দনরত গলায় বলল,

“এই সুহাসিনী চোখ খুলুন। কথা বলছেন না কেন আপনি?”

সুহাসিনীর কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে নীহারিকা রূপলকে ধাক্কাতে লাগল। চিৎকার করে বলল,

“এই রূপল? আপনি এভাবে বসে আছেন কেন? প্লিজ সুহাসিনীকে উঠতে বলুন!”

শোকে হতবিহ্বল হয়ে রূপল পাথর গলায় বলল,

“সুহাসিনী আর নেই! আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি আসতে বড্ড দেরী করে ফেলেছি।”

#চলবে..?🙂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here