ফেরারি প্রেম পর্ব -১৭

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_১৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

“সাফোয়ানের খু/ন হয়েছে!”

তৎক্ষণাৎ স্তব্ধিত হয়ে দাড়িয়ে পড়ল নীহারিকা। বিস্ময়ে এবং আতঙ্কে তার চোখ দুটি বৃহৎ আকার ধারণ করল। উদগ্রীব হয়ে সে অধিক চিন্তাগ্রস্থ রূপলের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলল। শঙ্কিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কীভাবে খু/ন হলো?”

পেরেশান হয়ে রূপল তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে ফেলল! আগ্রাসী গলায় প্রত্যত্তুরে বলল,

“ছু/রির আঘাতে তাকে খু/ন করা হয়েছে। এখনি আমাকে একবার হসপিটালে যেতে হবে।”

“আমিও যাব প্লিজ!”

“ওখানে গিয়ে আপনার কোনো কাজ নেই। আপনি বরং বাসাতেই থাকুন।”

নীহারিকাকে ডিঙিয়ে রূপল হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। যাত্রাপথে রূপলকে বাঁধা দিতে চাইলনা নীহারিকা। মন খারাপ করে সে একই জায়গায় দাড়িয়ে রইল। মনে মনে চিন্তাভাবনা করে নিলো বাড়ি থেকে বের হলেই রূপলের পিছু নিবে সে! সুহাসিনীর মৃত্যু থেকে শুরু করে সাফোয়ানের খু/ন কোনোটাই তার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছেনা! এর পেছনে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে অনেক রহস্য এবং ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। সেদিনের ছায়াটি এখনও তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে! এই ছায়াটির রহস্য ভেদ করতে পারলেই তবে সব ষড়যন্ত্র তার কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যাবে।

এসব অসংখ্য ভাবনাচিন্তার মাঝখানে নীহারিকা হঠাৎ খেয়াল করল তার পেছনে কেউ দাড়িয়ে আছে! অমনি নীহারিকা ঝট করে পিছু ঘুরে তাকালো। মিচকে হাসি দিয়ে দাড়িয়ে থাকা রাতুলকে দেখামাত্রই নীহারিকা থতমত খেয়ে গেল! বুকে থুথু ছিটিয়ে সে রূঢ় গলায় বলল,

“আপনি এখানে?”

হাত দুটো ঝেড়ে রাতুল প্যান্টের পকেটে হাত রাখল! বেশ ভাবসাব নিয়ে সে নীহারিকার দিকে খানিক অগ্রসর হয়ে বলল,

“কেন? এক্সপেক্ট করেননি?”

“এক্সপেক্ট করার কথা ছিল কী?”

“হয়ত ছিল!”

“সামনে থেকে সরুন।”

“বেয়াইন সাহেবার দেখছি খুব রাগ! এত রাগী হলে উপস্থিত বুদ্ধি কাজ করবে কীভাবে? ব্রেন সচল থাকবে কীভাবে?”

ভ্রু দুটি নাচিয়ে রাতুল প্রশ্ন ছুড়ল নীহারিকার দিকে। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে নীহারিকা রাতুলের দিকে তাকালো! তার কথাবার্তায় যেন বিশেষ কিছুর আভাস পাচ্ছে নীহারিকা। তবে রাতুলের প্রতি সন্দেহটা নীহারিকা প্রকাশ করলনা। বরং সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে সে রাতুলের বিস্তীর্ণ দেহে দৃষ্টি বুলালো! মিনিট কয়েক সে রাতুলকে নিঁখুতভাবে প্রত্যক্ষণ করে ভাবশূণ্য গলায় বলল,

“নাইস ওয়াচ।”

বলেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাতুলকে উপেক্ষা করে সে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। হন্ন হয়ে রাতুল নীহারিকার পিছু নিয়ে বলল,

“কেন? ওয়াচটা আপনার পছন্দ হয়েছে?”

খাবার টেবিলে বসে নীহারিকা আপেলে কামড় বসিয়ে বলল,

“কিন্তু এটাতো ছেলেদের ওয়াচ।”

নীহারিকার পাশের চেয়ারটি টেনে সেই চেয়ারটিতে বসে পড়ল রাতুল। ব্যস্ত গলায় নীহারিকাকে বলল,

“আপনি চাইলে সেইম ডিজাইনের লেডিস ওয়াচও আমি আপনার জন্য এনে দিতে পারি।”

“আরে না না। লাগবেনা। আমি জাস্ট এমনি বললাম।”

মৃদু হেসে রাতুল অন্য একটি আপেলে কামড় বসালো। নীহারিকার দিকে তাকিয়ে মিচকে হেসে বলল,

“পরীক্ষা নিলেন?”

রাতুলের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে নীহারিকা গভীর ধ্যানে ডুবে গেল। একদৃষ্টিতে সে রাতুলের হাসির দিকে তাকিয়ে রইল! বিষয়টায় বেশ মজা পেল রাতুল। দেঁতো হেসে সে টিটকারিপূর্ণ গলায় বলল,

“কী বেয়াইন সাহেবা? প্রেমে টেমে পড়ে গেলেন না-কী?”

“উঁহু! তবে আপনার হাসিটা অনেক সুন্দর। আমার পরিচিত একজনের সাথে মিলে।”

“কে সে?”

“আপনি চিনবেন না।”

“বলেই দেখুন না চিনি কী-না।”

“সময় হলে বলব।”

জোরপূর্বকভাবে সকালের নাশতা খেয়ে নীহারিকা বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল। চলতি পথে সে হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে দিলো! কোনোভাবে সবিতার বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে সে ছুটে গেল সবিতার বাড়ির উদ্দেশ্যে! একতলা বাড়িটিতে ভাড়ায় থাকে সবিতা। যদিও এই মুহূর্তে সবিতার বাড়ি থাকার কথা নয় তবে বাড়িটির সদর দরজা খোলা! বাসার ভেতর থেকে ছোট্টো হৃদির কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। চিন্তিত হয়ে নীহারিকা দরজা খুলে বাড়ির ভেতর ঢুকল। বাড়ির ড্রইং রুম পার হয়ে নীহারিকা বেডরুমে ঢুকতেই দেখতে পেল বিছানার উপর বসে হৃদি মা মা বলে চিৎকার করে কাঁদছে। বুঝাই যাচ্ছে সবিতা হৃদিকে বাড়িতে একা ফেলেই সাফোয়ানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে হসপিটালে ছুটে গেছে! উদ্বিগ্ন হয়ে নীহারিকা হৃদির পাশে বসল। হৃদির মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে বলল,

“কেঁদো না হৃদি। তোমার মা চলে আসবে তো।”

কাঁদতে কাঁদতে হৃদি নীহারিকার বুকের সাথে মিশে বলল,

“আমার মা কোথায় আন্টি?”

“আছে তো তোমার মা। এক্ষণি চলে আসবে।”

“আমি আমার বাবার কাছে যাব আন্টি! বাবা কেন এখনও আসছেনা?”

আচমকাই নীহারিকার চোখে জল চিকচিক করে উঠল। এই মুহূর্তে হৃদিকে সে কীভাবে শান্তনা দিবে? তার বাবা তো পৃথিবীতে আর নেই! চাইলেও তার বাবা আর কখনও তার কাছে আসতে পারবেনা। হৃদিকে বুকের সাথে মিশিয়ে নীহারিকা ব্যথিত গলায় বলল,

“তোমার বাবা আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে হৃদি! ফিরতে অনেকটা সময় লাগবে! সেই সময় অবধি তুমি তোমার মায়ের কাছে লক্ষ্মী মেয়ের মত থাকবে কেমন?”

“আমার মাকেও তো খুঁজে পাচ্ছিনা আন্টি।”

“তোমার মা একটু দরকারে বের হয়েছে হৃদি। তুমি বরং এখন আমার সাথে আমার বাড়ি চলো। তোমার মা ফিরে আসলে আমি তোমাকে আবার তোমার মায়ের কাছে দিয়ে যাব। রাজি?”

নীহারিকার এক কথায় রাজি হয়ে গেল হৃদি। অবুঝ মন নিয়ে রেডি হয়ে গেল সে নীহারিকার সাথে নীহারিকাদের বাড়িতে যেতে! তক্ষুণি হঠাৎ নীহারিকা কিছু একটা ভেবে পাশের রুমটিতে গেল। রুমটি যে সুহাসিনীর ছিল তা রুমে ঢুকেই হাতের বাঁ পাশে থাকা বড়ো দেখতে সুহাসিনীর ছবির ফ্রেম দেখেই বুঝা গেল! সমস্ত ঘরে চোখ বুলিয়ে নীহারিকার দৃষ্টি পড়ল হঠাৎ খাটের পাশে থাকা ছোটো পড়ার টেবিলটির দিকে। টেবিলের উপর অনেকগুলো বইয়ের সাথে একটি ডায়েরী দেখতে পেল নীহারিকা! ডায়েরীটি দেখামাত্রই সে আগপাছ না ভেবে ডায়েরীটি প্রথমে হাতে তুলে নিলো! সাবধানে ডায়েরীটি হাতে রেখে সে শুড়শুড়িয়ে হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে গেল! আর এক মুহূর্ত কোথাও না দাঁড়িয়ে সে হৃদিকে কোলে নিয়ে সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল!

বাড়ি পৌঁছে হৃদিকে পিয়াসার কাছে রেখে নীহারিকা ডায়েরীটি তার ঘরে যত্নসহকারে রেখে দিলো। সময় পেলে ডায়েরীটি পড়বে সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। এদিকে হসপিটালে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা জানার আগ্রহ থেকে নীহারিকা হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কিছুক্ষণ পরই হসপিটালে পৌঁছে গেল নীহারিকা। রূপলের পাশে রাতুলকে দেখে অবাক হয়ে গেল নীহারিকা! দ্রুত পায়ে হেঁটে সে রূপল এবং রাতুলের মুখোমুখি দাড়ালো। নীহারিকাকে দেখে রূপল বিরক্তবোধ করল! কর্কশ গলায় বলল,

“আপনি এখানে কী করছেন?”

রূপলের প্রশ্নে মনোযোগ না দিয়ে নীহারিকা পাল্টা রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“সাফোয়ানের ড্যা/ড/ব/ডি কোথায়?”

“ফরেনসিক ল্যাবে। আপনি আবার এখানে আসতে গেলেন কেন?”

রাতুলও রূপলের সাথে তাল মিলিয়ে নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“হ্যাঁ। আপনি তো বাসায় গিয়েছিলেন তাইনা? এখানে আবার কী করছেন?”

খরখরে গলায় নীহারিকা প্রত্যত্তুরে রাতুলকে বলল,

“আমি আপনাকে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই!”

নীহারিকার রূঢ় জবাবে তেতে গেল রূপল! রাগী দৃষ্টিতে সে নীহারিকার দিকে তাকালো। তেজী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“আপনি কী এখানে সিনক্রিয়েট করতে এসেছেন?”

প্রত্যত্তুরে নীহারিকা সোজাসাপটা গলায় বলল,

“না। তবে আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা বলতে এসেছি!”

“বাসায় গিয়ে শুনব। এখন আপনি যেতে পারেন। এমনিতেই আছি টেনশানের মধ্যে। তার উপর এই অসময়ে আপনার এসব নাটুকে কথা।”

“নাটুকে কথা না। আপনি সাইডে আসুন। আপনার সাথে সত্যিই আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”

অমনি রাতুল রূপলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শান্ত গলায় নীহারিকাকে বলল,

“আচ্ছা যা বলার আমাকে বলুন। আমি পরে রূপলকে সব বুঝিয়ে বলছি।”

“না। যা বলার আমি মিস্টার রূপলকেই বলব।”

ঘাড়ত্যাড়ামো করে নীহারিকা ঝট করেই রূপলের হাত টেনে ধরল! রূপলকে টেনে এনে সে রাতুলের থেকে কিছুটা দূরে এসে দাড়ালো। অমনি রাগে গিজগিজ করে উঠল রূপল! নীহারিকা তার হাতে স্পর্শ করেছে তা তার মোটেও পছন্দ হয়নি! রাগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে সে আস্তে করে নীহারিকার গালে চড় বসিয়ে দিলো! মনে হলো মশা মারল! অমনি নীহারিকা গালে হাত দিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রূপলের দিকে তাকালো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে রূপল আঙুল তুলে নীহারিকাকে শাসিয়ে বলল,

“অকারণে আমার গাঁয়ে হাত দেওয়া আমি পছন্দ করিনা। সুহাসিনী ছাড়া এই অবধি কোনো মেয়ে আমার গাঁয়ে টাচ করতে পারিনি। আপনি এই নিয়ে দ্বিতীয় বার আমার গাঁয়ে টাচ করার সাহস দেখিয়েছেন! আশা করি তৃতীয় বারের বেলায় সতর্ক হয়ে যাবেন!”

হনহনিয়ে নীহারিকার সামনে থেকে প্রস্থান নিলো রূপল! মিটিমিটি হেসে রাতুল নীহারিকার দিকে এগিয়ে এলো। হাসি থামিয়ে সে নীহারিকার মুখোমুখি দাড়ালো। জোরপূর্বক উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ে বলল,

“চড়টা কী বেশী লেগেছে?”

লজ্জায় তৎক্ষনাৎ মাথা নুইয়ে নিলো নীহারিকা। চোখ থেকে তার টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল। নীহারিকা কাঁদছে তা বুঝতে পেরে রাতুল ব্যথিত স্বরে বলল,

“কাঁদবেন না প্লিজ। রূপল একটু ওরকমই। মেয়ে মানুষদের তেমন পছন্দ করেনা। যা বলার আপনি আমার কাছে বলুন। আই সোয়ার, আমি আপনার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনব!”

চোখ তুলে নীহারিকা রাগী দৃষ্টিতে রাতুলের দিকে তাকালো। না চাইতেও দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“আপনাকে প্রথম থেকেই আমার পছন্দ হচ্ছেনা! আপনি প্লিজ আমার সামনে থেকে যাবেন?”

“কেন? আমি কী আপনার কোনো ক্ষতি করেছি? আমাকে পছন্দ না হওয়ার কারণ কী?”

“কারণটা জানা থাকলে নিশ্চয়ই আপনি আমার সামনে দাড়িয়ে থাকতে পারতেন না!”

“কী করতেন শুনি?”

“খু/ন করতাম!”

বলেই নীহারিকা রাগে রি রি করে সামনের দিকে হাঁটা ধরল। অট্ট হেসে রাতুল পিছু ডেকে নীহারিকাকে বলল,

“এমন তেজী মেয়েই আমার খুব পছন্দ বেয়াইন সাহেবা! হবেন না-কী আমার জীবনের নাইকা?”

#চলবে…?

[রি-চেইক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here