ফেরারি প্রেম পর্ব -৩২

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৩২
#নিশাত_জাহান_নিশি

“তাহলে কী সে লজ্জা পেল? কিন্তু লজ্জা পেলে তো মেয়েরা ন্যাকামো করে! তার মত চিৎকার কে করে?”

সদর দরজাটা খুলে রূপল ড্রইংরুমে প্রবেশ করল। রূপলের পিছু পিছু পিয়াসাও মাথা নুইয়ে ড্রইংরুমে ঢুকল। অমনি বাড়িতে কেউ আসার আভাস পেয়ে হাসি মুখে ড্রইংরুমে এলেন মারজিনা বেগম। রূপলের সাথে পিয়াসাকে দেখামাত্রই তিনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন। পিয়াসার প্রতি জমতে থাকা রাগ, অভিমান তিনি নিমিষেই ভুলে গেলেন! কিছু মানুষের মুখে বিষ থাকলেও অন্তর তাদের মধুর মতন মিষ্টি থাকে। মারজিনা বেগমও তার অন্যথায় নন। উচ্ছ্বাস বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। অপ্রত্যাশিতভাবেই পিয়াসাকে জড়িয়ে ধরলেন! উচ্ছ্বল গলায় বললেন,

“তুমি এসেছ মা? যদিও সকালে নিহাল বলেছিল তুমি আসবে, কিন্তু আমি পাত্তা দিইনি। ভাবলাম আমার মন রাখার জন্য নিহাল কথাটা বলেছিল। এখন দেখি তুমি সত্যিই এসেছ মা।”

অন্তরে বিষ থাকলেও উপরে উপরে জোরপূর্বক হাসল পিয়াসা! কারণ রূপল তার দিকে পেঁচার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! ব্যবহার আচরণের একটু টের বেটের হবে তো আজ পিয়াসার খবর আছে। সেই ভয়ে পিয়াসা তার শ্বাশুড়ি মায়ের মন রক্ষা করার জন্য উনাকে একটুখানি জড়িয়ে ধরল! স্বাভাবিক স্বরে বলল,

“ভেবেছিলাম আসার আগে আপনাকে ফোন করে আসব। কিন্তু পরে ভাবলাম সারপ্রাইজ দিই!”

“আমি সত্যিই সারপ্রাইজড হয়েছি মা। আজ আমার বাড়িটা যেন প্রাণ খুঁজে পেল। আমি সত্যিই ভীষণ খুশি হয়েছি। এই খুশি বুঝাবার মত নয়।”

পিয়াসাকে ছেড়ে মারজিনা বেগম এবার হাসিমুখে রূপলের দিকে তাকালেন। নম্র স্বরে রূপলকে সেঁধে বললেন,

“বসো বাবা। আজ রাতে কিন্তু ডিনার করেই তুমি বাড়ি ফিরবে। আর কোনো কথা শুনছিনা আমি।”

ব্যস্ততা দেখালো রূপল। জোরপূর্বক হাসল সে। কাজের অযুহাত দেখিয়ে হুমড়ি খেয়ে বলল,

“না আন্টি আজ না। থানায় কিছু জরুরী কাজ বাকী আছে। সেগুলো আজকের মধ্যেই সারতে হবে। অন্যদিন এসে খেয়ে যাব আন্টি। আপনাদের সাথে সময়ও কাটিয়ে যাব।”

“বিয়ের পর থেকে তো এই অবধি তোমাকে কিছু খাওয়াতে পারলাম না বাবা। পানি ছাড়া আর কিছুই মুখে তুললে না। তা কী হয় বলো বাবা?”

“আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি। পিয়াসার রিসিপশন তো এখনও বাকী আছে! তখন না হয় একেবারে খেয়েদেয়ে আপনার মনস্কামনা পূরণ করা যাবে।”

“তখন তো অনুষ্ঠান বাড়ি বাবা। বাধ্য হয়ে খেতেই হবে। আচ্ছা আজ না হয় ডিনার না করো। অন্তত চা-বিস্কুট তো খেয়ে যাও।”

“হ্যাঁ অভেয়েসলি আন্টি। চা তো খাওয়াই যায়।”

“ঠিক আছে বাবা। তুমি বসো। আমার হাতের স্পেশাল চা আজ আমি তোমাকে খাওয়াব।”

খুশি হয়ে গেলেন মারজিনা বেগম। রূপলকে বসিয়ে তিনি রান্নাঘরে ছুটলেন চা বানাতে। যাওয়ার সময় তিনি নীহারিকার রুমের দরজায় ধাক্কা মেরে গেলেন। তাকে ডেকে বললেন জলদি করে ড্রয়িংরুমে যেতে। রূপল এবং পিয়াসা একা ড্রয়িংরুমে বসে বিরক্ত হবে তাই তাদের সঙ্গ দিতে। এদিকে নীহারিকা পড়েছে ভেজায় মুশকিলে। রূপচর্চার জন্য সে মুখে মাস্ক লাগিয়েছিল। এমনিতেই সে কালো। তার উপর ইদানিং তার মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। আয়নার সামনে দাড়ালে তা সে ভালোভাবেই টের পাচ্ছে। চেহারায় আগের মত লাবণ্যতা আর খুঁজে পাচ্ছে না। তাই তার মা এক প্রকার জোর করেই তাকে মাস্কটা পরতে বাধ্য করল। দশ মিনিটও হয়নি মাস্কটা পড়েছে সে। এরমধ্যেই রূপলের আগমন!

মুখটা কালো করে আয়নার সামনে দাড়ালো নীহারিকা। মাস্কটা খুলতে গিয়েও সে থেমে গেল। গভীর চিন্তায় ডুব দিলো। কোমরে হাত গুজে সে বিড়বিড় করে বলল,

“আচ্ছা এতগুলো টাকার মাস্ক আমি কাজে না লাগিয়েই নষ্ট করে ফেলব? যদি নষ্ট করারই ছিল তবে এতগুলো টাকা ওয়েস্ট করে মাস্কটা কিনলাম কেন? এরচেয়ে তো ভালো ছিল এই টাকা দিয়ে আমার ফুচকা, চটপটি, আইসক্রীম কিনে খাওয়া! এতে অন্তত রুহটা শান্তি হত! টাকাটাও উসুল হত।”

তীব্র আফসোস নিয়ে নীহারিকা মাস্কটা খুলতে গিয়েও আর খুলল না! আয়নায় তাকিয়ে সে ভ্রু কুঁচকালো। ভাবশূণ্য গলায় বলল,

“মাস্ক পড়েই ঐ রাগী ভীমরুলটার সামনে যাব! এখানে এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? এখনকার যুগে মেয়েরা এসব ইউজ করে এটা কমন। দেখতে বিশ্রী দেখালেও কিছু করার নেই। কারণ আমি দেখতে এমনিতেও বিশ্রী!”

দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে গেল নীহারিকা। সোজা ড্রয়িংরুমে গিয়ে তার হাঁটার গতি থামালো। সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে রূপল। ভীষণভাবে ব্যস্ত সে ফোন ঘাঁটতে। ডানে বায়ে কোনো দিকেই তেমন কোনো নজর নেই তার। দেখতে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। চোখেমুখে দ্বিগুন ব্যস্ততার ছাপ। পাখার নিচে থেকেও কেমন যেন ঘামছে সে।গরমটা অতিরিক্তই তার। নয়ত পাখার নিচে থেকেও কেউ এভাবে ঘামে? চুল-দাড়ি কিছুই এখনও কাটেনি লোকটা! তাইতো এত ভবঘুরে ভাব তার মধ্যে বিদ্যমান। এভাবে কী জীবন চলে? একটু আধটু করে নিজের যত্ন নেওয়া শিখতে হয়না?

ড্রয়িংরুমে এখন রূপল এবং নীহারিকা ছাড়া আর কেউ নেই। পিয়াসাও খানিক পূর্বে তার রুমে চলে গেছে। জামা কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হতে। এই বাড়িতে কিছুতেই ভালো লাগছেনা তার! কেমন যেন দম বন্ধ লাগছে। কারো সাথেই ঠিকভাবে মিশে উঠতে পারছেনা সে! মন থেকে কাউকে মানতেও পারছে না তেমন! তবে এই কথা রূপলকে কিছুতেই বলা যাবেনা। এতে আবারও উত্তম মধ্যম খেতে হবে তাকে!

রূপলের একদম মুখোমুখি দাড়িয়েও রূপলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলনা নীহারিকা! রূপলের নজর কিছুতেই যেন নীহারিকার দিকে পরছিলনা। এতে না রেগে নীহারিকা বরং খুশি হয়ে গেল! কিছু একটা ভেবে দেঁতো হাসল সে! আপন মনে গুনগুন করে বলল,

“যাক বাবা ভালোই হলো। রাগী ভীমরুলটা এখনও আমার উপস্থিতি টের পায়নি! আমাকে দেখার আগেই বরং আমি এখান থেকে কেটে পড়ি। পরে মা আমাকে বকতে আসলে অন্তত এটাতো বলতে পারব যে আমি ড্রইংরুমে এসেছিলাম। কিন্তু এই রাগী ভীমরুলটাই আমাকে পাত্তা দেয়নি!”

যেই ভাবা সেই কাজ! একছুটে নীহারিকা জায়গা থেকে প্রস্থান নেওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই রূপল গলা ঝাকালো। নীহারিকার যাওয়ার পথে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। উঁচু গলায় হুট করে প্রশ্ন ছুড়ল,

“এই? মুখে ওটা কী মেখেছেন আপনি?”

অমনি থমকালো নীহারিকা। তাজ্জব হয়ে পিছু ঘুরে রূপলের দিকে তাকালো। অবিশ্বাস্য গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,

“আপনি টের পেয়েছিলেন আমি এতক্ষণ ওখানে ছিলাম?”

শার্টের কলারটা ঝাড়ল রূপল। বেশ ভাবসাব নিয়ে ডান পাশের ভ্রুটা উঁচালো। স্বাভাবিকভাবেই বলল,

“হ্যাঁ তো?”

“তাহলে এতক্ষণ আমাকে দেখেও না দেখার ভান করছিলেন আপনি?”

“কেন? বুঝতে পারেননি?”

“না পারিনি। এত অভিনয় করার কী ছিল এখানে?”

“কারণ, আপনাকে দেখতে কিছুটা শাঁকচুন্নির মত লাগছে! তাই তাকাতে ইচ্ছে করছিলনা আমার!”

ঝগড়া করার উদ্দেশ্য নিয়ে রূপলের দিকে এগিয়ে এলো নীহারিকা! হনহনিয়ে হেঁটে সে রূপলের সামনে দাড়ালো। তেজী চোখে রূপলের আগ্রাসী দৃষ্টিতে তাকালো। খরতর গলায় প্রশ্ন

“মেয়েদের রূপচর্চার বিষয়ে কিছু বুঝেন আপনি? না বুঝেই যে আমাকে শাঁকচুন্নি বললেন? এই জন্যই বেডামানুষদের পছন্দ না আমার! কিছু না বুঝেই হুটহাট মেয়েদেরকে কমেন্টস করে বসে।”

জায়গা থেকে ওঠে দাড়ালো রূপল। নীহারিকার দিকে ত্যাড়া দৃষ্টিতে তাকালো। প্যান্টের পকেটে হাত গুজে সে নীহারিকার বরাবর সোজা হয়ে দাড়ালো। নীহারিকার দিকে খানিক ঝুকে এসে ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী বললেন আপনি? আমাকে আপনার পছন্দ নয়?”

নীহারিকাও বড্ড জেদী। চোখ উঠিয়ে সে তারচেয়ে উঁচু এবং লম্বা দেখতে রূপলের দিকে উঁকি দিয়ে তাকালো। একরোখা গলায় বলল,

“না পছন্দ নয়! আপনার চেয়ে সুদর্শন ছেলেও আমি অনেক দেখেছি। আপনি আবার তাদের কাছে কী জিনিস!”

রূপলকে পুরোপুরি রাগিয়ে দিয়ে নীহারিকা বেশ রাগ এবং ভাব দেখিয়ে জায়গা পরিত্যাগ করলেও রূপলের থেকে দূরে সরে এসে সে মুখ টিপে হাসতে লাগল! রাগে রি রি করছিল রূপল! হিংস্র বাঘের মত ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলছিল। তুড়ি মেরে নীহারিকাকে পিছু ডেকে বলল,

“হেই লিসেন। আমার চেয়ে সুদর্শণ ছেলে আপনি অনেক দেখলেও আমার মত কাউকে পাবেন না! আমি এক পিসই আছি। কত মেয়েরা আমার প্রেমে পাগল আপনি জানেন?”

“কিন্তু আমিতো পাগল নই! আমি সবার চেয়ে ভিন্ন। অধিকাংশ মানুষ যা পছন্দ করে আমারও যে তা পছন্দ করতে হবে বিষয়টা কিন্তু এমন নয়!”

রূপলকে তুখোড় রাগিয়ে দিয়ে নীহারিকা দ্রুত কদমে হেঁটে ড্রয়িংরুম থেকে প্রস্থান নিলো। এদিকে রূপল রাগে বোম হয়ে কিছুক্ষণ চুল টানছে তো কিছুক্ষণ শার্টের কলার টানছে তো আবার শার্টের হাতা ফোল্ড করছে! ইতোমধ্যেই মারজিনা বেগম চা নাশতা নিয়ে এলেন। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল রূপল। হাসিমুখে পরিস্থিতি সামলে সে চা নাশতা করে পিয়াসা এবং মারজিনা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে থানার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

রাত তখন বারোটা কী একটা। থানার কাজকর্ম সেরে রূপল তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিল। বাড়ির রাস্তায় অতিরিক্ত জ্যাম থাকায় রূপল তার বাইকটা ঘুরিয়ে নীহারিকাদের বাড়ি হয়ে অনেক ঘুরানো প্যাঁচানো রাস্তা দিয়ে রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। নীহারিকাদের বাড়ি পাড় হয়ে রূপল দশ মিনিট পথ ভেতরে আসতেই হঠাৎ একটি লাল রঙের স্কুটি তার চোখে পড়ল!

নির্জন রাস্তা। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। কেউ কোথাও নেই। স্কুটিটির আশেপাশেও কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। কৌতূহলী হয়ে রূপল বাইক নিয়ে স্কুটিটির দিকে এগিয়ে এলো। তখনি তার চোখে পড়ল স্কুটিটিতে ইংরেজিতে নীহারিকার নাম খোঁদাই করে লিখা! বিষয়টায় বেশ অবাক হলো রূপল। এটা কী তার পরিচিত নীহারিকার স্কুটি? না-কী অন্য কোনো নীহারিকার স্কুটি? কঠিন এই প্রশ্ন নিয়ে রূপল আশেপাশটা সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রদর্শন করল। বরাবরের মত আবারও হতাশ হলো সে। তার ত্রিসীমানায় কেউ নেই।

কৌতূহল দূর করার জন্য রূপল একই জায়গায় দাঁড়িয়ে নীহারিকা নাম্বারে কল করল। ঘুম ঘুম চোখে নীহারিকা কলটি তুলল। আচ্ছন্ন গলায় নীহারিকা হ্যালো বলতেই রূপল দ্রুত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“আচ্ছা আপনি কী স্কুটি চালাতে পারেন?”

“হ্যা কেন?”

“আপনার লাল রঙের কোনো স্কুটি আছে?”

“আছে তো।”

রূপলের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এতক্ষণে টনক নড়ল নীহারিকার! চোখ থেকে ঘুম নিদ্রা উধাও হয়ে গেল তার। ধরফরিয়ে সে শোয়া থেকে ওঠে বসল। তীব্র অস্থিরতা নিয়ে সে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল,

“কোথায় আমার স্কুটি? আমাদের গ্যারেজে না?”

“না। আপনাদের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলো দূরে!”

“কিন্তু এত রাতে আমার স্কুটি ওখানে গেল কীভাবে?”

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here