#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৪০
#নিশাত_জাহান_নিশি
আপনাকে দেখাটা আমার কাছে কঠিন কিছু নয়! যাই হোক, ক্লাসে বসে বসে ঘুমুচ্ছিলেন কেন? রাতে কী চোর পাহারা দিয়েছিলেন?”
রূপলের কথায় নীহারিকারি ভীমড়ি খেয়ে উঠল। কোমরে হাত গুজে সে রূপলের অনেকটা কাছে চলে এলো! ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ ওঠা নামা করিয়ে সে রূপলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“তার মানে আপনি আমাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন তাইনা? যাকে বলে সূক্ষ্ণ দৃষ্টি! আমাকে ওভাবে কেন দেখছিলেন বলুন?”
পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টা করল রূপল! প্রসঙ্গ পাল্টাতে তৎপর হয়ে উঠল। থতমতানো অবস্থা থেকে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। নীহারিকাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে সে ব্যগ্র হেসে নীহারিকার নাকের ডগায় একটু করে তার ডান হাতের তর্জনী আঙুলটি ছুঁয়ালো! ধীর গলায় বলল,
“লিসেন মিস নীহারিকা? আমার এত ফা’ল’তু সময় নেই কারো দিকে ওভাবে সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকানোর! নেহাতই কোনোভাবে ঐদিকে আমার নজর পরে গিয়েছিল। দেট’স ইট।”
নীহারিকার নাক থেকে আঙুলটি সরিয়ে রূপল আঙুলটি তার শার্টের কাপড়ে বেশ ভালোভাবে মুছল! মনে হলো যেন আঙুলটি নোংরা হয়ে গেল তার! রূপলের এসব অস্বাভাবিক কাণ্ডকারখানা দেখে নীহারিকা নাক ফুলিয়ে রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল! নীহারিকার রাগকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রূপল ভাবশূণ্য গলায় নীহারিকার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
“বাই দ্যা ওয়ে। আপনি ক্লাসে থেকে আমাকে ওভাবে টুকুর টুকুর দেখছিলেন কেন? ক্লাস বাঙ করেও আবার বের হয়ে এলেন। কাহিনী কী?”
রূপলের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে নীহারিকা পাল্টা রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“আগে আপনি বলুন মেয়েটি কে ছিল?”
“আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন!”
“নাহ্! আপনি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিবেন!”
“আমি আপনার সাথে ঝগড়া করতে এখানে আসিনি!”
“ঝগড়া তো আপনি বাড়াচ্ছেন। সোজাসাপটা বলে দিলেই তো হয় মেয়েটি কে হয় আপনার।”
“কেন? মেয়েটিকে নিয়ে আপনার এত কিউরিসিটি কেন?”
মিথ্যের আশ্রয় নিলো নীহারিকা! বেশ ভাবসাব নিয়ে বুকের উপর হাত গুজে দাড়ালো। নাক টেনে বলল,
“আমার ফ্রেন্ড জিজ্ঞেস করল তাই!”
বোকা বনে গেল রূপল! নির্বোধ গলায় বলল,
“আপনার ফ্রেন্ড? কী জিজ্ঞেস করল?”
“জিজ্ঞেস করল আপনি সিঙেল কী-না! মেয়েটি কে হয় আপনার! হয়ত আপনাকে লাইন টাইন মারতে চায়।”
হু হা করে হেসে দিলো রূপল! নীহারিকার বানোয়াট কথায় একরত্তিও বিশ্বাস করলনা সে! শার্টের কলারটা ঠিক করে সে নীহারিকার দিকে আচ্ছন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। প্রশ্ন ছুড়ল,
“ওহ্ রিয়েলি? এরপর আপনি কী বললেন?”
রূপলের হাসি দেখে রাগে নীহারিকার রাগে গাঁ রি রি করে উঠল! ক্ষেপে গিয়ে সে তটস্থ গলায় রূপলকে বলল,
“আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা আপনার?”
“বিশ্বাস হবেনা কেন? অবশ্যই হয়েছে! আমার ফোন নাম্বারটা তাকে দিয়ে এলেন না কেন? আপনি কী চান না আমার প্রেম হোক?”
“আর কয়টার সাথে প্রেম করবেন আপনি? একটু আগেও তো একটার সাথে এখানে দাড়িয়ে প্রেম করছিলেন! বেডা মানুষ!”
রূপলের উপর বেশ তেজ দেখিয়ে নীহারিকা জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! মিচকে হেসে রূপল নীহারিকার পিছু নিলো! নীহারিকার পাশাপাশি হেঁটে সে মজার ছলে নীহারিকাকে বলল,
“এই বি’য়া’দ’ব বেডি? কথা না শুনেই কোথায় যাচ্ছেন?”
“ক্লাস আছে আমি ক্লাসে যাব। খবরদার আমার পিছু নিবেন না!”
“আপনার পিছু নেওয়ার কোনো ইন্টারেস্ট নেই আমার! এমনিতেও আমার অনেকটা দেরি হয়ে যাচ্ছে। হৃদিকে স্কুল থেকে পিক করতে হবে। বাই দ্যা ওয়ে, ঐ মেয়েটি আমার ছোটো বোনের মত। ফোর্থ ইয়ারে ভর্তি সম্পর্কিত ব্যাপারে তাকে কিছু সমস্যার মুখে পরতে হয়েছে। সেই জন্যই আমার কাছে তার হেল্প চাওয়া। আমিও কলেজে একটা দরকারে এসেছিলাম। ভাবলাম কলেজেই যেহেতু এসেছি মেয়েটার সমস্যাগুলোও শুনে যাই।”
স্বস্তি পেল নীহারিকা। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল রূপল তার পাশে নেই! হতভম্ব হয়ে নীহারিকা পেছনে তাকাতেই দেখল রূপল অলরেডি কলেজ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। নিজের প্রতি বিরক্ত হলো নীহারিকা। হাপিত্যেশ করে বলল,
“ধ্যাত! আমার কথায় কী কষ্ট পেল লোকটা? বিদায় না নিয়েই হুট করে চলে গেল। আমার হয়ত উনাকে এভাবে জেরা করাটা ঠিক হয়নি! বাড়াবাড়ি করে ফেললাম আমি।”
বিষণ্ন মন নিয়ে নীহারিকা ক্লাস চলাকালীন সময়ে ক্লাসের ভেতর ঢুকে গেল। ক্লাসও প্রায় শেষ হওয়ার পথে। দশ কী পনেরো মিনিট বাকী আছে। তুলির পাশে চুপটি করে বসল নীহারিকা। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তুলি নীহারিকার দিকে তাকালো। ক্লাসে থাকা ম্যামকে আড়াল করে সে নীহারিকাকে মৃদু ধাক্কা দিলো। মিনমিনে গলায় বলল,
“কী রে? চলে এলি যে?”
“তো কী করব ওখানে দাড়িয়ে থেকে? রোদে শুকিয়ে কাঠ হব?”
“এভাবে কথা বলছিস কেন? মনে হচ্ছে রেগে আছিস?”
“না। হঠাৎ রাগ করব কেন?”
“আচ্ছা একটা সত্যি কথা বল তো?”
“কী সত্যি?”
“তুই কী তোর বেয়াইকে পছন্দ করিস?”
ঝট করে তুলির দিকে শিথিল দৃষ্টিতে তাকালো নীহারিকা। পরক্ষণে কী ভেবে যেন সেই শিথিল দৃষ্টিতে রুক্ষতা নেমে এলো! তুলির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে ক্লাসে মনোযোগ দিলো। অকপটে গলায় বলল,
“এসব ফা’ল’তু কথা বাদ দিয়ে ক্লাসে মনোযোগ দে!”
নীহারিকার অস্বাভাবিক আচরণে অবাক হলো তুলি। তবে এই মুহূর্তে নীহারিকাকে ঘাটাতে চাইল না সে। নীহারিকার কথামত ক্লাসে মনোযোগ দিলো।
___________________________________
হৃদিকে স্কুল থেকে পিক করল রূপল। দু’হাত দ্বারা হৃদি শক্ত বাঁধনে রূপলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখল। বাইক মোটামুটি ধীর গতিতেই চালাচ্ছে রূপল। তবুও যেন হৃদির ভয় কমছেনা। বুক কাঁপছে তার। বিষয়টায় বেশ অবাক হলো রূপল। বিশেষ করে হৃদির হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে যাওয়াটা। ইদানিং হৃদি বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। আর এই বিষয়টাই রূপলকে বেশ ভাবাচ্ছে। হৃদি তো আগে এমন ছিলনা। খুব দুষ্টু, চঞ্চল, বাচাল প্রকৃতির ছিল। তবে হুট করেই তার এত পরিবর্তন কেন? তাই বিষয়টাকে এবার রূপল সিরিয়াসলি নিতে বাধ্য হলো। হৃদির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সে গলা ঝাকালো। ধীর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“হেই হৃদি? তুমি কী কোনো কারণে আপসেট?”
“না তো বাবা। কেন?”
“বাবাদের সাথে মিথ্যে বলতে নেই তুমি জানো না?”
“সত্যি বলছি বাবা। আমার মন একটুও খারাপ না।”
“তাহলে মনমরা হয়ে বসে আছো যে? বাবার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছ তুমি?”
“কী লুকাবো বাবা?”
“আচ্ছা বাদ দাও। গত দুইদিন ধরে তুমি স্কুলে যাওনি কেন? তোমার মাকে অনেকবার কল করেছিলাম তোমার মা ও কলটা তুলছিল না। সময়ের অভাবে আমিও তোমাদের বাড়িতে যেতে পারিনি। তোমার মা ঠিক আছে তো?”
“ঠিক আছে বাবা। তবে আমি কিছুটা অসুস্থ ছিলাম।”
“সরি মা। ব্যস্ততার জন্য বাবা তোমার সাথে দেখা করতে যেতে পারিনি।”
“ইট’স ওকে বাবা। তুমিতো আমার আপন বাবা নও যে সবসময় আমার খোঁজ খবর রাখবে! আমার আপন বাবা তো আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে! এখন পৃথিবীতে আমার মা ছাড়া আর কেউ নেই!”
সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তার পাশ ঘেঁষে বাইকটি থামিয়ে দিলো রূপল! বাইক থেকে নেমে সে ঝট করে হৃদিকে কোলে তুলে নিলো। হৃদির প্রতি রক্তের টান অনুভব হলো তার। আবেগপ্রবণ হয়ে সে হৃদির মাথায় চুমু খেলো। ভরাট গলায় বলল,
“কে বলল তোমার বাবা নেই? তোমার বাবা তো জীবিত আছে মা। তোমার শুধু একটা বাবা নয় মা। দুই দুইটা বাবা! প্রথম জন হলো তোমার জন্মদাতা। দ্বিতীয় জন তোমার রূপল বাবা।”
রূপলের আদর পেয়ে অঝরে কেঁদে দিলো হৃদি! রূপলকে শক্তভাবে আলিঙ্গন করে বলল,
“কতদিন হলো বাবাকে দেখিনা। বাবা কেন আমার কাছে আসছেনা? মাকে জিজ্ঞেস করলে মা বলে তোর বাপ ম’রে গেছে! মা কেন বলে আমার বাবা ম’রে গেছে?”
সবিতার প্রতি রূপলের বেশ রাগ জন্ম নিলেও হৃদির সামনে তা প্রকাশ করলনা। হৃদিকে শান্তনা দিয়ে সে কোমল গলায় হৃদিকে বলল,
“সবিতা কী তোমাকে মারধর করে মা?”
“না। তবে বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই বলে তোর বাপ ম’রে গেছে!”
“মায়ের কথা কানে তুলতে হবেনা তোমার! রূপল বাবা যা বলছি তাই সত্যি। তোমার বাবা সত্যিই জীবিত আছে। সময় হলে একদিন তোমার বাবার সাথে তোমাকে দেখা করাতে নিয়ে যাব আমি। একদম কাঁদবেনা তুমি।”
হৃদির মন ভালো করার জন্য রূপল আজ সারাটা দিন হৃদিকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরে বেড়ালো। হৃদির পছন্দের জায়গাগুলোতেও ঘুরে বেড়ালো। হৃদির পছন্দের আইসক্রীম, চকলেট, বার্গার, হাওয়াই মিঠাই সব খাওয়ালো। বিকেলের দিকে সে হৃদিকে নিয়ে তার বাড়িতে উঠলো। সবিতা অনেকবার কল করার পরেও সে কলটি তুললনা! ইচ্ছে করেই সবিতাকে টেনশানে রাখল। সবিতা তার কথা না শুনেই হৃদিকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল! হৃদিকেও জোর করে রাখতে পারেনি রূপল। সবিতার পিছু পিছু চলে গিয়েছিল। সেই ক্ষোভ থেকে রূপল এখন সবিতার সাথে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে! কোনো কারণ ছাড়া সবিতার সাথে যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন মনে করেনা।
হৃদিকে নিয়ে রূপল বাড়ির ড্রইংরুমে ঢুকল। ক্লান্ত হয়ে রূপল এবং হৃদি সোফার উপর পিঠ ঠেকাতেই নাজনীন বেগম তরতরিয়ে হেঁটে এলেন রূপলের কাছে। হৃদিকে দেখে তিনি না চাইতেও মায়ায় পরে গেলেন! আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি হৃদিকে টেনে কোলে তুলে নিলেন। হৃদির কপালে কয়েকটা চুমু খেয়ে আহ্লাদি গলায় বললেন,
“ভালো আছো দাদু?”
উচ্ছ্বল হেসে হৃদি প্রত্যত্তুরে তার দাদিকে বলল,
“ভালো আছি দাদি। তুমি কেমন আছো?”
“ভালো আছি।”
“খেয়েছ দুপুরে?”
“হুম। আজ রূপল বাবা আমাকে আমার সব পছন্দের খাবার খাইয়েছে দাদি!”
“বাহ্। বেশ ভালো তো।”
হৃদির থেকে মনোযোগ সরিয়ে নাজনীন বেগম এবার রূপলের দিকে মনোযোগ দিলেন। রূপলের পাশে বসে তিনি চিন্তিত গলায় রূপলকে বললেন,
“জানিস তুই কাল কী হয়েছিল?”
ক্লান্ত গলায় রূপল তার মাকে বলল,
“না বললে জানব কীভাবে মা?”
“নিহাল পিয়াসার গাঁয়ে হাত তুলেছে!”
নাজনীন বেগম ভেবেছিলেন কথাটা শুনে রূপল হয়ত বেশ তেতে উঠবে! ক্ষিপ্ত হয়ে এখনি নিহালদের বাড়িতে ছুটে যাবে! আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে। কিন্তু না, তার কিছুই হলো না। বিষয়টাকে রূপল গাঁয়েই মাখল না। বরং সোফায় মাথা রেখে সে বেশ স্বাভাবিক গলায় তার মাকে বলল,
“তো এখানে এত হাইপার হওয়ার কী আছে মা? এটা তো নরমাল বিষয়। হাসবেন্ডই তো গাঁয়ে হাত তুলেছে অন্য কেউ তো তুলেনি!”
#চলবে…?
[বেশ তাড়াহুড়ো করে আজকের পর্ব লিখেছি। রি-চেইক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]