ফেরারি প্রেম পর্ব-৫২

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৫২
#নিশাত_জাহান_নিশি

নীহারিকা যখন বুঝতে পারল রূপল তাকে ব্লক লিস্টে ফেলে দিয়েছে তখন অজান্তেই তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরল! লেহেঙ্গাটি গাঁ থেকে খুলে ফেলল সে। রূপলকে দেখানোর জন্যই সে লেহেঙ্গাটি পরেছিল! ভেবেছিল কলটি রিসিভ সে রূপলকে বলবে ভিডিও কলে আসতে। লেহেঙ্গাটি তাকে কেমন মানিয়েছে রূপলের কাছ থেকে জানতে চাইবে!

মাঝখানে কেটে গেল প্রায় চারদিন। নিয়ম অনুযায়ী আজ নিহাল ও পিয়াসার বৌভাত। গতকাল থেকেই নীহারিকাদের বাড়িতে বৌভাতের তোরজোড় শুরু হয়ে গেছে। আত্নীয়-স্বজনদের হৈ-হট্টগোল, হাসি ঠাট্টা, জমকালো অনুষ্ঠান। সব মিলিয়ে জমজমাট পরিবেশ। বাড়ির মেইন গেইট থেকে শুরু করে পুরো বাড়ি আজ তাজা ও সুগন্ধি ফুলে সেজে উঠেছে। ঘ্রাণে ম ম করছে পুরো বাড়ি। নানা রঙের লাইটিংয়েরও ব্যবস্থা রয়েছে। রাতের বেলায় বৌভাতের অনুষ্ঠান রেখেছে নিহাল। ব্যস্ততা কাটিয়ে যেন তার অফিসের কলিগরাও এটেন্ড করতে পারে সেইজন্যে।

বিকেল পাঁচটা বাজতেই মেকাপ আর্টিস্ট পিয়াসাকে সাজাতে চলে এসেছেন। গাঢ় নীল রঙের একটি লেহেঙ্গা পরেছে পিয়াসা! পুরো লেহেঙ্গাটিতে সাদা পাথরের কাজ করা। তার চকচকে ফর্সা গাঁয়ের রঙের উপর সুনিপুণভাবে ফুটে উঠছে লেহেঙ্গাটি। সাজগোজ ছাড়াই পিয়াসাকে দেখতে খুব প্রিটি দেখাচ্ছে। সাজলে যে কী পরিমাণ প্রিটি দেখাবে তা নিয়েই ভাবনায় পড়ে গেছেন মেকাপ আর্টিস্ট!

নীহারিকা এতক্ষণ যাবত পিয়াসার রুমেই ছিল। শরীরটা একটু ম্যাচম্যাচ করে উঠতেই সে তার রুমে চলে এলো। গতকাল থেকেই তার উপর দিয়ে বেশ ধকল যাচ্ছে। মেহমানদের আদর, অ্যাপায়ন, ঘর দোর গুছিয়ে রাখা সবদিকই তাকে একা সামলাতে হয়েছে। এখন রুমটা একটু খালি পেতেই সে তার রুমের দরজা আটকে চিৎপটাং হয়ে বিছানায় শুয়ে পরল। বালিশের তলা থেকে ফোনটি হাতে নিতেই দেখল রূপলের নতুন সিম থেকে প্রায় ১০০+ মিসড কল! কোনোরূপ ভাবান্তর ছাড়াই নীহারিকা এই নাম্বারটিও ব্লকলিস্টে ফেলে দিলো! নাক ফুলিয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলল,

“বেহায়া, নির্লজ্জ পুরুষ মানুষ কোথাকার! পাঁচ পাঁচটা নাম্বার থেকে ব্লক করলাম এরপরেও একের পর এক কল করেই চলছে! কোনো বিরতি টিরতি নেই তার। আমার সাথে কথা না বলে যেহেতু থাকতেই পারবিনা তাহলে আমাকে ব্লক করলি কেন? হোয়াই ম্যান হোয়াই? তখন খুউউব ভাব দেখিয়ে এখন আবার হ্যাংলামো করা হচ্ছে? এভাবেই ঝুলে থাকবি তুই! না তোকে ফেসবুকে অ্যাড করব না তোর সিমের ব্লক খুলব!”

রূপলের উপর ক্ষোভ ঝেরে সে ফোনটা আবারও বালিশের তলায় রেখে নাক টেনে লম্বা এক ঘুম দিলো! সেই ঘুম ভাঙল তার দরজার খটখটানির শব্দে। কেউ বিরামহীনভাবে তার রুমের দরজায় টোকা মারছে। বিরক্ত হয়ে নীহারিকা ঘুম জড়ানো চোখে দরজার দিকে আলুথালু পায়ে এগিয়ে এলো। দরজা খুলতে খুলতে বিব্রতকর গলায় বলল,

“এই কে রে? কোনো হাক ডাক ছাড়াই দরজা ধাক্কাচ্ছে কে?”

শক্ত হাতে নীহারিকা দরজার খিলটা খুলে দিতেই ঝড়ের বেগে কেউ যেন তার রুমে প্রবেশ করে রুমের দরজাটি ভেতর থেকে আটকে দিলো! বেকুব হয়ে নীহারিকা মুখটা হা করে দাড়িয়ে রইল। কী হলো না হলো সব তার মাথার দুই ফুট উপর দিয়ে গেল। তখনি অপ্রত্যাশিতভাবে পিছু ফিরে তাকালো রূপল। পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে সে রুদ্রাক্ষ রূপ নিয়ে নীহারিকার দিকে এগিয়ে এলো। কোনো রূপ কথাবার্তা ছাড়াই সে ধাক্কা মেরে নীহারিকাকে সোজা বিছানার উপর বসিয়ে দিলো! স্নিগ্ধতায় নীহারিকার চোখ দুটি শিথিল হয়ে এলো! মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পরেছে আজ রূপল! নীহারিকার লেহেঙ্গার রঙের সাথে মিলে গেছে সেই রঙ! রূপলের গাঁয়ের রঙের সাথে পাঞ্জাবির রঙটা যেন তার বাহ্যিক সৌন্দর্য আরও দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে৷ মন্ত্রমুগ্ধের মত টানছিল রূপল তাকে।

নীহারিকার বেপরোয়া চাহনির দিকে তাকানোর সময় নেই রূপলের। মাত্রাতিরিক্ত রাগে হাত-পা কাঁপছে রূপলের। শীঘ্রই নীহারিকার ডান হাতটি বিছানার সাথে চেপে ধরল সে। চোয়াল উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ফোন কোথায় রাখছ?”

এই পর্যায়ে এসে নীহারিকার স্নিগ্ধ দৃষ্টি ভয়ে পরিণত হলো। ভীতিকর দৃষ্টিতে সে রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল। শুকনো ঢোঁক গিলে কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কেকেকেন?”

“কথা না বাড়িয়ে আমার কোয়েশ্চনের আনসার দাও। বেশিক্ষণ আমি এখানে থাকতে পারবনা। রিস্ক আছে। ফোন কোথায় বলো?”

“তাহলে এত রিস্ক নিয়ে আমার রুমে আসার দরকারটা ছিল কী?”

“আমার রাতের ঘুম হারাম করে এখন আমার রিস্কের কথা চিন্তা করছ? চারদিন ধরে চোখে ঘুম নেই আমার। গলা দিয়ে খাবারও নামছেনা। একটা বার খোঁজ নিয়েছ আমার? এখন তাড়াতাড়ি ফোনটা বের করে দাও। হারি আপ।”

“না দিব না! আমি বুঝছি তো কেন আপনি আমার ফোন খুঁজতেছেন!”

“দিবা না তাই তো?”

“নাহ্!”

“ওকে ফাইন। এবার যা হবে তার জন্য তুমি আমাকে দায়ী করতে পারবা না!”

“কীকীকী করবেন?”

ব্যগ্র হাসল রূপল! রক্তিম মুখশ্রীতে তার দুষ্টু ভাব ফুটে উঠল। রূপ বদলাতে সময় লাগলনা তার। উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য সে সব করতে পারে। ভয়ে কাঁপতে থাকা নীহারিকার দুই ঠোঁটের দিকে তাকালো সে। ডানপিটে গলায় বলল,

“করার পর বলছি! মাঝপথে থামাতে গেলে কিন্তু তোমারই কষ্ট হবে!”

মিছেমিছি নীহারিকার ঠোঁটের দিকে রূপল ঝুঁকে আসতেই নীহারিকা তার ডান হাত দিয়ে রূপলের ঘাড়টা চেপে ধরল! ঝট করে রূপলকে তার থেকে সরিয়ে নিলো। তাড়াহুড়ো করে বালিশের তলা থেকে তার ফোনটি বের করে রূপলের হাতে ধরিয়ে দিলো! ঠোঁট দুটো চেপে ধরে অস্ফুটে গলায় বলল,

“ফোন!”

ক্রুর হাসল রূপল! নাক ঘঁষে সে ফোনটি হাতে নিলো। কোনো লক নেই নীহারিকার ফোনে। তাই সে অনায়াসেই কললিস্টে গিয়ে পুনরায় ফোনটি নীহারিকার হাতে তুলে দিলো! রাগী রূপে ফিরে এসে নীহারিকাকে বলল,

“নাও। সবগুলা সিমের ব্লক খুলে দাও!”

অমনি নীহারিকা বসা থেকে দাড়িয়ে গেল। রূপলের মুখোমুখি দাড়ালো সে। এক রোখা গলায় তেতে ওঠে বলল,

“মানে কী? আমি কী ব্লক করছি ব্লক খোলার জন্য?”

তিরিক্ষিপূর্ণ ভাব নিলো রূপল। বেশ তাড়না দেখিয়ে বলল,

“ব্লক তো আমিও করেছিলাম তাইনা? কিছুক্ষণ পরেই কিন্তু ব্লকটা আবার খুলে দিয়েছিলাম! আমি খুলতে পারলে তুমি পারবা না কেন? কুইকলি ব্লকগুলো খোলো বলছি।”

“না খুললে কী করবেন?”

ক্রুর হাসল রূপল। নীহারিকার দিকে এক কদম এগিয়ে এলো সে। হুট করে নীহারিকার কোমর জড়িয়ে ধরল! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাড়িয়ে থাকা নীহারিকার ঠোঁটের দিকে বেশরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“তার মানে তুমি চাইছ আমি ভুল করি? ইনডিরেক্টলি বুঝানোর কী দরকার বলো? ডিরেক্টলি বললেই তো হয়!”

এবার আর ভয় পেলো না নীহারিকা! ধাক্কা মেরে রূপলকে তার থেকে ছাড়িয়ে নিলো সে। এই ধাক্কাটির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা রূপল! ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা দূরে ছিটকে গেল সে। তেজী ভাব নিয়ে নীহারিকা রূপলের দিকে এগিয়ে এলো! রূপলের শার্টের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“ব্লক খুলব না আমি কিছুতেই! আমাকে মেরে ফেললেও না। কী পেয়েছেন আপনি আমাকে? যখন যা ইচ্ছে হবে তাই আমার উপর চাপিয়ে দিবেন? এতই সোজা সব?”

নীহারিকার রাগকে প্রশ্রয় দিলোনা রূপল। রাগ বেশিদিন জমিয়ে রাখলে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিছুতেই নীহারিকার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়না রূপল৷ নীহারিকাকে ছেড়ে থাকা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব! এই কয়েকদিনে তা বেশ ভালোভাবেই টের পেয়ে গেছে সে। কিছু ব্যক্তিগত ও বিশেষ মানুষদের সাথে চাইলেও রাগ দেখানো যায়না। তাদের ছেড়ে থাকাও যায়না। পাষাণ হৃদয়ের মানুষরাও তখন নত হতে বাধ্য হয়! দুর্বলতা গ্রাস করে তাদের। একটুখানি ভালো থাকার লোভে মানুষ নিজের স্বভাব বদলাতেও দু’বার ভাবেনা। রূপলের ক্ষেত্রেও ঘটল ঠিক তাই!

সঙ্গে সঙ্গেই নীহারিকাকে রূপল তার বুকের মাঝে চেপে ধরল! শক্ত করে বুকের বাঁ পাশে ধরে রাখল নীহারিকাকে। অশান্ত বুকটা তার শান্ত হয়ে এলো। প্রশান্তিতে চোখ জোড়া বুজে নিলো। নিবিড় গলায় নীহারিকাকে বলল,

“উজ্জ্বলের সাথে সেদিন তোমার ফ্রেন্ডলি বিহেভ আমি মানতে পারিনি নীহু! দেট’স হোয়াই একটু বেশিই রেগে গিয়েছিলাম সেদিন। আর রেগে গেলে আমার মাথা ঠিক থাকেনা। যা তা করে বসি।”

স্থির হয়ে এলো নীহারিকা! ভেতরটায় সুখ সুখ অনুভূত হলো তার। মন তো চাইছিল রূপলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে তবে কিছু প্রতিবন্ধকতার জন্য সে নিজেকে সামলে রেখে চুপচাপ দাড়িয়ে রইল। গম্ভীর গলায় বলল,

“তার মানে রেগে গেলে আপনি মানুষও খুন করতে পারেন? কোনো দয়ামায়া নেই আপনার মধ্যে? এতই পাষাণ পুরুষ আপনি?”

বিপরীতে রূপল মৌন রইল! নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরার মধ্যে যে সুখ নিহিত রয়েছে সেই সুখ সে সর্বাঙ্গে মাখতে লাগল! বেশিক্ষণ নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরার সেই সুখ উপলব্ধি করতে পারলনা রূপল! দরজার ঐ পাশ থেকে খটখট আওয়াজ ভেসে এলো। শাকিল মিনমিনে গলায় রূপলকে ডেকে বলল,

“ভাই শুনছ? কেউ আসছে এদিকে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে এসো।”

সঙ্গে সঙ্গেই রূপলকে গাঁ ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো নীহারিকা! রূপলকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে রুম থেকে বের করে দিলো। দ্রুত গলায় বলল,

“দাফা হয়ে যান এখান থেকে।”

পিছু হটতে হটতে রূপল উদাস গলায় বলল,

“ব্লক খুলবে না তাইতো?”

“খু’ন তো সেদিনই করে দিয়েছেন আমাকে! মৃত ব্যক্তির সাথে আবার কীসের কথা?”

রূপলের মুখের উপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো নীহারিকা! আহত মন নিয়ে পিছু ঘুরে গেল রূপল। অমনি মারজিনা বেগমের মুখোমুখি হয়ে গেল সে। তাড়াহুড়ো করে তিনি নীহারিকার রুমের দিকে এগিয়ে আসছিলেন। রূপলকে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। মৃদু হেসে বললেন,

“আরে রূপল যে। কখন এলে তুমি?”

ম্লান হেসে রূপল নিচু স্বরে বলল,

“এইতো আন্টি। কিছুক্ষণ আগে।”

“বেয়াই বেয়াইন কখন আসবে? তোমাদের ওখান থেকে তো এখনও কেউ এলো না বাবা।”

“আসছে আন্টি। এত ব্যস্ত হবেন না। কুল থাকুন।”

“ওকে বাবা ঠিক আছে৷ পিয়াসার সাথে দেখা হয়েছে?”

“না আন্টি। এখনও তার সাজ কমপ্লিট হয়নি।”

“পার্লারের মেয়েরা কী যে সাজাচ্ছে তাকে আল্লাহ্ই জানে। এদিকে নীহারিকারও খোঁজ পাচ্ছিনা। বাড়িতে এত বড়ো অনুষ্ঠান অথচ মেয়েটার কোনো পাত্তাই নেই। তোমাদেরও এখনও নাশতা দেওয়া হলো না। মেয়েটা রেডি হলো কী-না তা ও তো জানতে পারলাম না।”

“নীহারিকা মেবি রুমে আছে আন্টি। প্লিজ গো।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা যাচ্ছি। তোমরা বরং নিচে গিয়ে একটু বসো। আমি নীহারিকাকে ডেকে আনছি।”

“ওকে আন্টি।”

শাকিল ও সজলকে নিয়ে রূপল নিচে চলে গেল। রূপলের গম্ভীরতা দেখে সজল ও শাকিল রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল। সন্দেহজনক গলায় সজল রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ভাই? তুমি কী এখনও অস্বীকার করবা যে নীহারিকা আপুকে তুমি ভালোবাসো না?”

প্রত্যত্তুরে রূপল অকপট গলায় সজলকে বলল,

“গম্ভাট কোথাকার! আপু বলছিস কেন? ভাবি বল ভাবি!”

টাশকি খেয়ে গেল সজল ও শাকিল! দুজনই তাজ্জব দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মানে এই কয়েকদিন যাবত এসবই চলছিল রূপলের মনে? যা তারা আন্দাজ করেছিল কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারেনি?

বাড়ির উঠোনে করা স্টেজের দিকে এগিয়ে যেতেই রূপল একটি মেয়ের সাথে ধাক্কা খেলো! ফুলের ডালা হাতে নিয়ে মেয়েটি বাড়ির ভেতরেই ঢুকছিল। এরমধ্যেই ঘটে গেল এই কাণ্ড। মেয়েটির দিকে না তাকিয়েই রূপল সরি সরি বলে স্টেজের ভেতরে ঢুকে গেল। তবে মেয়েটির চোখ যেন কিছুতেই সরছিলনা রূপলের দিক থেকে! নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে রূপলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। ঘোরে ডুবে থেকে বিড়বিড় করে বলল,

“হু ইজ হি? এত হ্যান্ডসাম ছেলে আমি পৃথিবীতে দুটো দেখেছি বলে তো মনে হয়না! খোঁজে বের করতে হবে সে কে।”

এই বলে মেয়েটি মনের খুশিতে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল! ফুলের ডালা হাতে নিয়ে সে সোজা হেঁটে দু’তলায় ওঠে গেল। নীহারিকার রুমে ঢুকে পরল সে। নীহারিকাকে রেডি হতে বলে মারজিনা বেগম তখন রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আর তখনি মেয়েটি নীহারিকার রুমে ঢুকল। লেহেঙ্গাটি মাত্র গাঁয়ে পরেছে নীহারিকা। এরমধ্যেই মেয়েটি ফুলের ডালাটি টেবিলের উপর রেখে অস্থির গলায় নীহারিকাকে বলল,

“এই নীহা শুনছিস? একটা ইনফরমেশন দিতে পারবি আমাকে?”

লেহেঙ্গার ফিতা গুলো ঠিক করতে করতে নীহারিকা বেশ ব্যস্ত স্বরে মেয়েটিকে বলল,

“কী ইনফরমেশন আপু?”

“খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি পরা একটি ছেলেকে দেখলাম তোদের বাড়িতে! ছেলেটি কে নীহা?”

অমনি নীহারিকা থতমত খেয়ে মেয়েটির দিকে তাকালো। মনে ভয় নিয়ে অস্থির গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কেন আপু? তাকে দিয়ে তুমি কী করবে?”

“আরে বল না ছেলেটি কে? প্লিজ প্লিজ প্লিজ!”

মেয়েটির বেহায়াপনা দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকালো নীহারিকা। সন্দেহের স্বরে বলল,

“কেন আপু? ছেলেটি কী কোনোভাবে তোমাকে ডিস্টার্ব করেছে?”

লজ্জায় রাঙা হয়ে মেয়েটি বলল,

“আরে না। একচুয়েলি প্রথম দেখাতেই তাকে আমার খুব ভালো লেগে গেছে!”

অমনি ঠাস করে মেয়েটির গালে সপাটে চড় বসিয়ে দিলো নীহারিকা! শুধু তাই নয় মেয়েটির চুলের মুঠি ধরে মেয়েটিকে আচ্ছেমত দেয়ালের সাথে বারি মারতে লাগল! তবে এসব নিছকই তার কল্পনা ছিল! যদি সম্ভব হত সে বাস্তবেও তাই করত। মনের জ্বালা মনে চেপে রেখে নীহারিকা জোরপূর্বক হাসল। নরম স্বরে মেয়েটিকে বলল,

“আপু এখন তুমি যাও! আমি রেডি হয়ে আসছি। ছেলেটির সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিব!”

নীহারিকার গাল টেনে মেয়েটি আহ্লাদি গলায় বলল,

“থ্যাংকস রে নীহা! একটু আর্লি রেডি হয়ে আয় প্লিজ।”

এই বলে মেয়েটি বেশ চনমনে ভাব নিয়ে নীহারিকার রুম থেকে বের হয়ে গেল। মেয়েটির যাওয়ার পথে তাকিয়ে নীহারিকা কোমরে হাত গুজে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। চোখের সামনে পরে থাকা বেসামাল চুল গুলো সে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলো। রাগ ঝেড়ে বলল,

“রূপলের বাচ্চা রূপল! বিয়ে কী তোর লাগছে না তোর বোনের লাগছে? কে বলেছিল তোকে আজ নায়ক সেজে আসতে? মেয়েদের বদনজর এখন তোর উপর পরবে! কীভাবে আড়াল রাখব তোকে আমি?”

রাগে রি রি করে নীহারিকা নিজের মত করে রেডি হতে লাগল! আধঘণ্টার মধ্যে কোনো রকমে রেডি হয়ে সে ভারি লেহেঙ্গাটি সামলাতে সামলাতে আলুথালু পায়ে হেঁটে স্টেজেের দিকে চলে এলো। পুরো স্টেজ নীহারিকা চোখ দ্বারা চুষে ফেলল রূপলকে খুঁজতে খুঁজতে। একটু হেঁটে স্টেজের পেছনের দিকে যেতেই মৃদু অন্ধকারে পেছন থেকে রূপলকে দেখতে পেল সে। লেহেঙ্গার জন্য দ্রুত পায়ে হাঁটতে পারছেনা সে। তবুও লেহেঙ্গার ওজন সামলে সে রূপলের দিকে এগুতে এগুতে বলল,

“রাগী ভীমরুলটা এখানে কী করছে? স্টেজ রেখে স্টেজের পেছনে কাকে খুঁজতে এসেছে?”

রূপলের ঠিক পেছনটায় দাড়ালো নীহারিকা। সিগারেটের গন্ধে তার হঠাৎ বমির উদ্বেগ হচ্ছিল! সকাল থেকেই অভুক্ত সে। যার কারণে সিগারেটের বিদঘুটে গন্ধে তার গাঁ গোলাচ্ছে। নাক টিপে ধরে নীহারিকাকে রূপলের পিঠে আলতো করে হাত ছুয়ালো। তিক্ত সুরে বলল,

“এই রূপল? আপনি এখানে কী করছেন?”

নীহারিকার গলার আওয়াজ পেয়ে রূপল তড়িঘড়ি করে পিছু ফিরে তাকালো। অজান্তেই হাত থেকে সিগারেটটি ফেলে দিলো সে। নাক মুখ থেকে ধোঁয়া বের করতে লাগল। সেই ধোঁয়া আবার হাত দিয়ে সরিয়ে ও দিলো। নীহারিকার দিকে এক পলক তাকাতেই রূপল সম্মোহিত হয়ে গেল!

কী সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার। এই মায়াবতী মেয়েটা আজ আবার এত সুন্দর করে সেজেছে কেন? এত নিঁখুতভাবে চোখে কাজল পরতে কে বলেছে তাকে? কেনই বা ঠোঁটে এত গাঢ় করে লিপস্টিক পরল? নাকে কী নত পরেছে ওটা? হ্যাঁ এমনই তো মনে হচ্ছে। কপালের মাঝখানে ঘটা করে আবার টিপ? ভালোই হলো কেউ নজর লাগাতে পারবেনা তাকে! তবে চুলে খোঁপা কেন করল মেয়েটা আজ? খোলা চুলে তো বেশ মানাত তাকে। আমি সত্যিই দিন দিন আনরোমান্টিক হয়ে যাচ্ছি! হাতে করে একটা গোলাপ আনা প্রয়োজন ছিল আমার! কানের পেছনে গুজে দিতাম। আচ্ছা? আমার কী তাকে একটু ছুঁয়ে দেখা উচিৎ? আলতো করে তার পুরো মুখশ্রীটা ছুঁয়ে দিব একবার?

নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল রূপল। নীহারিকার গাঁয়ের সাথে ঘেঁষে দাড়ালো সে। হুট করে নীহারিকার চুলে হাত দিয়ে সে চুলের কাঠিটা ফেলে দিলো! সঙ্গে সঙ্গেই নীহারিকার দীঘল কালো চুলগুলো ছড়িয়ে পরল সমস্ত পিঠে। কোমর অবধি ছড়িয়ে গেল সেই চুল। নিবিষ্ট দৃষ্টিতে নীহারিকা রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুতেই রূপলকে থামাতে পারছিল না সে। নীহারিকার চুলের মাতাল করা ঘ্রাণ রূপলের নাকে ঠেঁকতেই রূপল বেপরোয়া হয়ে উঠল! আগ পাছ না ভেবে তাৎক্ষণিক নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরল সে! চোখ বুজে নীহারিকার চুলের ঘ্রাণ নিতে লাগল। ঘোর জড়ানো গলায় বলল,

“এই মায়াবী মেয়ে? এত মিষ্টি কেন তোমার চুলের ঘ্রাণ?”

লজ্জা পেয়ে গেল নীহারিকা! যদিও রূপলকে সরাতে ইচ্ছে করলনা তার তবুও সে রূপলকে সরানোর চেষ্টা করে বলল,

“ছাড়ুন। আপনার মুখ থেকে সিগারেটের বিশ্রী গন্ধ আসছে! বিয়ে বাড়িতে এসেও আপনার সিগারেট খেতে হবে?”

“খেতে তো চাইনি। তবে পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে!”

“কেন? কী হয়েছে?”

“উজ্জ্বল এসেছে!”

অবাক হলো নীহারিকা। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“সিরিয়াসলি? কই? তাকে তো কোথাও দেখলাম না!”

“দেখতে হবেনা! আমি চাই উজ্জ্বল কখনও তোমার চোখে না পরুক।”

“কেন কেন? এমন চাওয়ার কারণটা কী? উজ্জ্বলকে নিয়ে এত হিংসা কেন আপনার?”

“সত্যিই কিছু বুঝো না তুমি?”

“বুঝিয়ে বলুন না! শুনি?”

অমনি নীহারিকার কানের লতিতে আস্তে করে একটি কামড় বসিয়ে দিলো রূপল! নীহারিকাকে তার বশে এনে নীহারিকার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

“কারণ। কারণ আমি তোমাকে……

এতটুকু বলেই নীহারিকাকে ছেড়ে দিলো রূপল! নীহারিকাকে ধাঁধায় ফেলে দিয়ে সে হঠাৎই জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! যেতে যেতে আচ্ছন্ন গলায় বলল,

“আজই উজ্জ্বলের দ্যা ইন্ড হবে নীহু! উজ্জ্বলের দুর্বল জায়গা আমি পেয়ে গেছি। এরপর তুমি শুধু আমার হবে নীহু! শুধু আমার!”

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here