#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৭
#নিশাত_জাহান_নিশি
“আচ্ছা রাখো। রা’ক্ষ’সটাকে সামলাও।”
ফট করে মিস চারুলতা সেন কলটি কেটে দিলেন। এদিকে দরজা ধাক্কানোর মাত্রা বেগতিক বাড়ছিল। অতিরিক্ত শব্দ দূষণে ছোট্টো হৃদি ঘুম থেকে প্রায় উঠি উঠি করছিল! ঘ্যানঘ্যান করে আবারও হৃদিকে ঘুম পাড়ানোর ভয়ে সবিতা তাড়াহুড়ো করে ছুটে গিয়ে বাড়ির সদর দরজাটি খুলে দিলো। অমনি সাফোয়ান মাতাল অবস্থায় রুমে ঢুকল! সবিতাকে তার ভারি হাতের কনুই দ্বারা ধাক্কা মেরে কিছুটা দূরে ছিটকে ফেলল। ধাক্কা খেয়ে রেগে গেল সবিতা। উঁচু গলায় বলল,
“মাতালের ঘরে মাতাল। তুই আবারও নেশা করে এসেছিস?”
টালমাটাল শরীর নিয়ে সাফোয়ান সবিতার দিকে এক পা দু’পা করে এগিয়ে এলো। মুখে এক আঙুল চেপে ধরে সে নিম্ন আওয়াজে বলল,
“চুপ। আমার মেয়ে ওঠে যাবে।”
“মেয়ের জন্য খুব দরদ উতলে পড়ছে তাইনা? তুই প্রতিদিন নেশা করে আসবি আর আমি চুপ করে থাকব?”
“হ্যাঁ থাকবি। কারণ তুই বাধ্য।”
“মেয়েটার কথা তো অন্তত একটা বার চিন্তা কর। ছোটো বলে মেয়েটা এখনও বুঝছে না তার বাবা একটা নেশাখোর, একটা মাতাল। যখন মেয়েটা আমার বড়ো হবে তখন কী হবে? মেয়েটাকে তখন কী বুঝাব আমি? কী ভাববে সে তার বাবাকে?”
“তোর মেয়ে যা খুশি বুঝা, তাতে আমার কী?”
“মেয়েটা কী শুধু আমার? তোর না?”
“না! তোরা দুই বোন মিলে আমাকে ঠকিয়েছিস! দুজনই ফ্লড।”
অমনি বিষম খেয়ে গেল সবিতা! ঘাবড়ে ওঠা গলায় বলল,
“মানে? কী বলতে চাইছিস তুই?”
“মেয়েটাকে তুই দত্তক নিয়েছিলি! দেশে আসার পর আমাকে বুঝিয়েছিস মেয়েটা আমাদের! একটা নাজায়েজ সন্তানকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিস তোরা! আর এই প্ল্যানের মাস্টার মাইন্ড ছিল তোর বোন নিজে! তাইতো তোর বোনকে আমি…
কথা সম্পূর্ণ না করেই সাফোয়ান পাশবিক হাসিতে মত্ত হয়ে গেল! সবিতাকে পাশ কাটিয়ে হেলতে দুলতে তাদের বেডরুমে ঢুকে পড়ল। ডুকরে কেঁদে উঠল সবিতা। আর্ত গলায় সাফোয়ানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে বলল,
“মেয়েটা আমাদের সাফোয়ান। তুমি অযথা আমাকে এবং আমার বোনকে ভুল বুঝছ। তোমার এই ভুলের জন্য আজ আমার বোনের এই অবস্থা। শুধুমাত্র মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমার বোন চুপ করে আছে! তার সাথে করা অবিচারও সে মুখ বুজে মেনে নিয়েছে।”
কান্নায় ভেঙে পড়ল সবিতা। ছোট্টো হৃদির পাশে সাফোয়ান চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়ল। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত লোকটি সে। কান্নাকাটির এক পর্যায়ে সবিতার মাথাটা কেমন যেন ধরে এলো! ব্যথায় কুকিয়ে ওঠে সে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটি ঔষধের পাতা বের করল। কোনো রকমে ঔষধটা খেয়ে সে ড্রইংরুমের সোফাতেই শুয়ে পড়ল। মাথাব্যথা পূর্বের তুলনায় কিছুটা কমে আসতেই সবিতা গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল।
________________________________
পরদিন সকাল ঠিক নয়টায় পিয়াসার জ্ঞান ফিরল। তাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পিয়াসার মা, বাবা, চাচা, চাচী, চাচাতো ভাইরা সবাই পিয়াসাকে দেখতে হসপিটালে চলে এলো। চিন্তা কেটে গেল সবার। নিহাল, রূপল এবং নীহারিকা সারারাত নির্ঘুম ছিল বলে বাড়ির লোকরা তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। তাদের রেস্ট নিতে বলল। তবে নিহাল পিয়াসার পাশ থেকে নড়লনা! বরং পিয়াসার পাশে ঠায় বসে রইল। তাকে কোনোমতেই বাড়ি পাঠানো গেল না। ঘুমের তাড়নায় নীহারিকা চোখ মেলে তাকাতেই পারছেনা। সে কখন বাড়ি ফিরে লম্বা একটা ঘুম দিবে সেই আশায় আনচান আনচান করছিল। অমনি কেবিন ভর্তি সবাইকে পাশ কাটিয়ে রূপল পিয়াসার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। শান্ত গলায় বলল,
“ভাইয়া আসছি কেমন? বাড়ির সবাই এখানে আছে। তোর কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে তাদের বলবি।”
মলিন হেসে পিয়াসা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। হনহনিয়ে হেঁটে রূপল কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। ঘুমু ঘুমু চোখে নীহারিকা তার ভাই নিহালকে বলল,
“ভাইয়া আমিও বাসায় যাব। প্লিজ একটা রিকশা ঠিক করে দে না।”
ব্যস্ত গলায় নিহাল বলল,
“ধ্যাত, আগে বলবিনা?”
হুড়মুড়িয়ে জায়গা থেকে ওঠে গিয়ে নিহাল রূপলকে পিছু ডাকল! উঁচু গলায় বলল,
“এই রূপল শোনো?”
সোজা দাঁড়িয়ে পড়ল রূপল। পিছু ঘুরে নিহালের দিকে তাকালো। যদিও এই মুহূর্তে সে নিহালকে পছন্দ করছেনা তবুও নরম স্বরে বলার চেষ্টা করল,
“হ্যাঁ বলুন?”
আবদারের স্বরে নিহাল বলল,
“নীহারিকাকে একটু আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিও।”
রেগেমেগে রূপল কিছু বলার আগেই নীহারিকা ছুটে এসে নিহালকে বলল,
“না না ভাইয়া। আমি উনার সাথে যাব না! তুই বরং আমাকে একটা রিকশা ঠিক করে দে প্লিজ৷ তাহলেই হবে।”
নীহারিকার কথায় রূপল সন্তুষ্ট হলো। রূপলও নীহারিকাকে সায় জানিয়ে তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় নিহালকে বলল,
“হ্যাঁ। আর আমারও অনেক কাজ আছে। আপনি বরং তাকে একটা রিকশা ঠিক করে দিন। তাহলেই হবে।”
কেবিনের ভেতর থেকে নাজনিন বেগম সব শুনছিলেন। কিছু একটা আঁচ করতে পেরে তিনি কেবিন থেকে ওঠে এসে রূপলকে শাসিয়ে বললেন,
“জামাই যা বলছে শোন। তুই যেহেতু ঐ রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিস তো নীহারিকাকে নামিয়ে দিলে এতে কোনো অসুবিধে হবেনা।”
তুখোর জেদ দেখিয়ে রূপল হাত-পা ছুড়ে বলল,
“মা তুমি বুঝতে পারছ না।”
নাজনিন বেগমও ধমকের স্বরে বললেন,
“আমি সব বুঝতে পারছি! তুই ঠিক কোথায় যাওয়ার জন্য নীহারিকাকে নিতে পারবি না বলছিস! এখন আমি যা বলছি শোন। নীহারিকাকে সাথে নিয়ে যা। হসপিটালে সিনক্রিয়েট করিস না।”
বাধ্য হয়ে রূপল নীহারিকাকে তার সাথে নিয়ে যেতে বাধ্য হলো! নীহারিকাও এক প্রকার বাধ্য হয়েই রূপলের বাইকের পেছনে উঠল। রাগে ফোঁস ফোঁস করে রূপল বাইক স্টার্ট দিতেই নীহারিকা খপ করে রূপলের শার্টের কলার চেপে ধরল! অমনি রূপল মেজাজ চড়া করে বলল,
“হাতটা সরান। হুটহাট গাঁয়ে হাত দেন কেন? বাইকে ওঠাও শিখেন নি?”
অমনি রূপলের শার্টের কলার থেকে হাত সরিয়ে নীহারিকা ও বেশ রাগী গলায় বলল,
“আমি বাইকে উঠতে ও জানি। এমনকি বাইক চড়তে ও জানি। চোখে অনেক ঘুম তাই সবকিছু দিশাহারা লাগছে। তাছাড়া আমার খারাপ কোনো ইন্টেনশন ছিল না আপনার শার্টের কলার চেপে ধরার। বাধ্য হয়েই ধরেছি।”
নীহারিকার সাথে কথা না বাড়িয়ে রূপল ফুল স্পিডে বাইক ছেড়ে দিলো। রূপলকে কোনো প্রকার স্পর্শ না করেই নীহারিকা চেষ্টা করছিল সেইফলি বাইকে চড়ার। তবে রূপল যা স্পিডে বাইকে ছেড়েছে তাতে মনে হচ্ছেনা রূপলকে না ধরেই সে সেইফলি বাইক চড়তে পারবে বলে! জান বাঁচানোর ভয়ে নীহারিকা হাঁসফাঁস করছিল। তবুও গাঁ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। ঘুমটা পুরো হোক, এরপর সেও বুঝিয়ে দিবে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করার ফল কতটা জঘন্য হয়! এভাবে প্রায় কিছুদূর যেতেই নীহারিকা খেয়াল করল রূপল তার বাইকটা নীহারিকাদের বাড়ির গলিতে না ঢুকিয়ে বরং অন্য একটা গলিতে ঢুকিয়ে নিলো! অমনি নীহারিকা নীরবতা ভেঙে মৃদু চিৎকার করে উঠল। কৌতূহল নিয়ে রূপলকে বলল,
“এই কোথায় যাচ্ছেন আপনি? এটা তো আমাদের বাড়ির রাস্তা না।”
“জাহান্নামের চৌ রাস্তায় যাচ্ছি! মুখটা একটু অফ রাখুন। রাস্তাঘাটের লোকজন শুনলে ভাববে আমি আপনাকে কি’ড’ন্যা’প করেছি।”
“না। আমি চুপ হবনা! আমি বাড়ি যাব। প্লিজ আমায় বাড়ি পৌঁছে দিন। ঐ জাহান্নামের চৌরাস্তায় আমি যাবনা।”
“এটা আপনার শাস্তি! তখন মায়ের কথায় কোনো প্রতিবাদ করলেন না কেন? কেন বারণ করলেন না যে আপনি আমার সাথে যাবেন না?”
“তখন তো আন্টি আপনার কথাই শুনছিলেন না। আমার কথা কী শুনবে? প্লিজ আপনি আমাকে এখানে নামিয়ে দিন। আমি এখানে নেমে যাব। এরপর এখান থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি চলে যাব।”
কিছুদূর যেতে অমনি রূপল রাস্তার পাশ ঘেঁষে বাইকটি থামিয়ে দিলো। তাড়াহুড়ো করে বাইক থেকে নেমে সে রাস্তার অপর পাশে চলে গেল। অবাক চোখে নীহারিকা রাস্তার অপর পাশে চোখ বুলাতেই দেখতে পেল সামনেই একটি এনজিও সংস্থা রয়েছে! বিশাল বড়ো একটি গেইট। গেইট থেকে একজন মাঝ বয়সী মহিলা বের হচ্ছে। রূপল সেই ভদ্র মহিলার পেছনে দৌঁড়াচ্ছে! সঙ্গে সঙ্গেই বাইক থেকে নেমে পড়ল নীহারিকা। সেও রূপলকে অনুসরণ করে রাস্তার অপর প্রান্তে চলে গেল। মহিলাটিও তখন রূপলের ডাকে সাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ছুটে গিয়ে রূপল মহিলাটির মুখোমুখি দাঁড়ালো। হাঁপিয়ে ওঠা গলায় বলল,
“ম্যাম প্লিজ আমার কথাটা তো একটিবার শুনুন?”
মহিলাটি মাথা নিচু করে মলিন গলায় বললেন,
“দয়া করে সুহাসিনীর ব্যাপারে কিছু জানতে চেয়ো না রূপল। আমি কিছু বলতে পারব না।”
“আমি শুধু একটি বারের জন্য সুহাসিনীর সাথে দেখা করতে চাই ম্যাম। এরচেয়ে বেশী কিছু আমি জানতে চাইনা!”
“পারবনা রূপল! সুহাসিনী তোমার সাথে দেখা করতে চায়না।”
“সুহাসিনী এই ব্যাপারে কিছু জানবে না ম্যাম। আমি জাস্ট তাকে দূরে থেকে একটিবার দেখে চলে আসব।”
“পসিবল না রূপল! আমি গীতা স্পর্শ করে বলেছি সুহাসিনীর সাথে তোমার এই জন্মে দেখা হবেনা!”
ব্যর্থ হয়ে রূপল হাত বাড়িয়ে মিস চারুলতা সেনকে সামনে হেঁটে যেতে বলল। বিষণ্ন মনে মিস চারুলতা সেন সামনে এগিয়ে যেতেই রূপল মৃদু আওয়াজে মিস চারুলতা সেনকে পিছু ডেকে বলল,
“সুহাসিনীকে বলে দিবেন ম্যাম। পিঠে আমি তার নামের ট্যাটু এঁকেছি! একদিন না একদিন সেই ট্যাটুটা আমি তাকে দেখাব! এই ট্যাটুটা দেখার জন্য হলেও তাকে আমার সাথে একবার দেখা করতে হবে!”
আঁচল চেপে কেঁদে মিস চারুলতা সেন জায়গা থেকে প্রস্থান নিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রূপল এলোমেলো হয়ে হেঁটে নীহারিকার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। চোখ দুটো অসম্ভব রকম লাল হয়ে আছে রূপলের। মনে হচ্ছে যেন এখনি চোখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়বে। রূপলের এই ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখে ভয়ে শিউরে উঠল নীহারিকা। শুকনো ঢোঁক গিলে সে বলল,
“আপনি কী অসুস্থ মিস্টার রূপল?”
ঝাঁজালো গলায় রূপল বলল,
“সামনে থেকে সরুন।”
থতমতিয়ে নীহারিকা রূপলের সামনে থেকে সরে যেতেই রূপল সামনের টং দোকানটিতে গিয়ে দাঁড়ালো। দোকানদারকে বলে গরম এক কাপ চা হাতে নিলো। অন্য হাতে একটি সিগারেট ধরিয়ে এক চুমুক চা সাথে সিগারেটটিও সমানে টানতে শুরু করল! রূপলের এই অদ্ভুত কার্যকলাপ দেখে তাজ্জব বনে গেল নীহারিকা। খানিকটা সাহস যুগিয়ে সে রূপলের পাশে দাঁড়ালো। থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“সুহাসিনী কে মিস্টার রূপল? আর ঐ মহিলাটিই বা কে ছিল?”
অমনি রূপল কিছু একটা ভেবে ভরাট গলায় নীহারিকাকে বলল,
“আচ্ছা আপনি আমার একটা হেল্প করতে পারবেন?”
“কী হেল্প?”
“পাশে যে এনজিওটা দেখছেন? কোনোভাবে ওখানে আমাকে একটু ঢুকানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?”
#চলবে…?
[আমার আম্মু অনেক অসুস্থ। তাই সম্ভব হচ্ছেনা নিয়ম করে প্রতিদিন গল্প দেওয়া। আশা করি আপনারা আমার সমস্যাটা বুঝবেন।]