#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ১৬
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি
ফুরফুরে বাতাসে খেলছে কিশলয়।শীতের আমেজ অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে পরিবেশ।সকাল হতেই আকাশ গুম মেরে আছে।নীলচে আকাশে হালকা কৃষ্ণবর্ণের মেঘের ছুটোছুটি।
আম্বের স্বপ্নমহল থেকে বেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে কোয়ার্টার এর দিকে।এখন তেমন আর এদিকে আসা হয় না।ঘরের সামনে অলস ভঙিতে বসে আছে রহিম।ইমু না থাকায় তার তেমন কাজও নেই।সারাদিন শুয়ে বসেই চলে।আম্বের কে কলেজে নেয়া আসা ছাড়া আর তেমন কোনো কাজ নেই তার।আম্বের রহিম এর সামনে আসতেই প্রানখোলা হাসিতে রাঙিয়ে উঠে রহিম এর ঠোঁট।স্মিত গলায় প্রশ্ন করলো রহিম—
“কিছু বলবি?
আম্বের মাথা ঝাঁকায়।শান্ত গলায় বললো–
“ইমুর বোর্ডিং স্কুলের নাম্বারটা একটু দিন।”
রহিম চুপ মেরে যায়।আম্বের ভ্রু কুঞ্চন করে আবার বললো–
“কী হলো আঙ্কেল দিন।”
রহিম অতি স্বাভাবিক গলায় বললো—
“মাহাদ স্যার বাড়ন করেছে।”
আম্বের আর কিছু জিঙ্গেস করলো না।জানে ওই অসভ্য লোকটা এমনই।তড়িৎ গতিতে বড়বড় পা ফেলে ঘরে ফিরে আম্বের।মাহাদ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ড্রেস আপ ঠিক করছিলো।আম্বের এর জ্বলন্ত চোখ আর ফুঁসলে উঠা চেহারা দেখে অধর বাঁকিয়ে হাসে মাহাদ।স্বাভাবিক গলায় বললো—
“কিছু বলবেন?
আম্বের তপ্ত গলায় বললো–
“আপনি আঙ্কেল কে ইমুর স্কুলের নাম্বার দিতে কেন মানা করেছেন।”
মাহাদ দৃঢ় গলায় বললো–
“যা করেছি আপনাদের ভালোর জন্যই করেছি।”
আম্বের ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো–
“কিসের ভালো করতে চান আপনি!
মাহাদ বিছানায় বসে।দু হাতে ভর দিয়ে পেছন দিকে একটু ঝুঁকে সহজভাবে বললো—
“আপনি বাচ্চা নন যে বুঝতে পারছেন না।”
আম্বের তাচ্ছিল্যের সাথে বললো–
“আপনি আপনার নিজের ভালোই করেছেন।ইমু থাকলে তো আর আমার সাথে নোংরামি করতে পারতেন না।”
মাহাদ ভাবুক চোখে তাকায়।সহজ ও স্বাভাবিক গলায় বললো—
“এইসব কথার কোনো মানে হয় না মিস সুগন্ধি।”
“কেন!কেন হয় না!কেন আটকে রেখেছেন আমাকে?কেন এইসব করছেন?
মাহাদ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।জানালার সামনে গিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।নীলচে আকাশ কৃষ্ণবর্ণে রেঙেছে।অদেখা একটা কাকের ডাক শোনা যাচ্ছে।বাইরের পরিবেশ একদম শান্ত।নেই কোনো কোলাহল,নেই ঝঞ্জাট।কিন্তু মাহাদের বুকের ভেতর চলছে একরাশ অনুতপ্ততা।মাহাদ নির্মল গলায় বললো—
“কোথায় যাবেন আপনি!বাইরের শিয়াল কুকুর ছিঁড়ে খাবে আপনাকে।”
আম্বের ফুঁসে উঠে উত্তপ্ত গলায় বললো—
“আপনি কী করেছেন!খুবলে খেয়েছেন আমাকে।আর করবেন ই তো।আমাকে তো কিনে নিয়েছেন আপনি।টাকার সদ্ব্যবহার তো করবেনই।”
মাহাদ নিষ্প্রভ চোখে তাকায়।আম্বের এর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনতা জলের প্রস্রবণ।মাহাদ বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস টেনে নেয়।শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় বললো—
“কী হয়েছে আপনার আজ!
আম্বের কান্না জড়ানো গলায় বললো—
“মুক্তি দিন আমাকে।আমার কষ্ট হয় মাহাদ।আপনি না আমাকে ভালোবাসেন।ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দেওয়া যায়!
“আমি জানি আপনার কষ্ট হয়।আপনাকে কষ্ট দিয়ে আমি ভালো নেই।আপনার চেয়ে বেশি কষ্ট হয় আমার।”
আম্বের ঝট করে মুখ খুলে বললো—
“কিসের কষ্ট আপনার!
“দেখবেন কিসের কষ্ট!দেখেন তাহলে।”
মাহাদ জানালার পাশে শোকেস এর উপর থেকে একটা কাঁচের ফ্লাওয়ার ভাস নিয়ে তা ভেঙে নিজের হাতে চালিয়ে দেয়।ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে।আঁতকে উঠে আম্বের।ব্যস্ত গলায় বললো—
“মাহাদ!
“একদম কাছে আসবেন না আমার।চলে যান এখান থেকে।”
“মাহাদ আপনার হাত….।”
“বললাম তো চলে যান।আমার কষ্ট হচ্ছে না।যান আপনি।”
আম্বের তবুও দাঁড়িয়ে থাকে।ধমকে উঠে মাহাদ।একবুক অভিমান নিয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে আসে আম্বের।
বিছানায় বসে মাহাদ।তার হাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।ম্লান গলায় বললো—
“আপনার চোখের জলের দাম আমি আমার রক্ত দিয়ে দিলাম।আপনাকে কষ্ট দিয়ে আমি ভালো নেই।কিন্তু আমি নিরূপায়।আপনাকে আমি ছাড়তে পারবো না।আপনার বাবা কে আমি কথা দিয়েছি।”
মাহাদ এর বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘশ্বাস।
,
,
বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে।বৃষ্টির কারণে বায়ু ঘনীভূত হয়ে একদম শীতল হয়ে গেছে।পটপট করে পর্দা উড়িয়ে তা ভেতরে ঢুকছে।
ভাবতে ভাবতে কখন যে মাহাদ এর চোখ লেগে এসেছে তা সে জানে না।হাতের ব্যথা এখন ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছে।মাহাদ উঠে জানালা,বারান্দার থাই লাগিয়ে দেয়।ঘর থেকে বেরিয়ে আম্বের কে খোঁজে।কিন্তু দোতালার কোথাও পাওয়া যায় না।আলতাফ কে জিঙ্গেস করতেই বলে তিনি দেখেন নি।মাহাদ রূদ্ধশ্বাসে দৌঁড়ে আসে ছাদে।ছাদের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে আম্বের।ভিজে একদম আড়ষ্ট হয়ে আছে।কম্পন শুরু হয়েছে তার শরীরে।মাহাদ ব্যস্ত গলায় রাগমিশ্রন করে বললো—
“এইসব কী করেছেন আপনি!পাগল হয়ে গেছেন?
আম্বের এর ঠোঁট কাঁপছে।বৃষ্টিতে ভিজে চোখ লাল হয়ে আছে।কেঁদেছে তাই হয়তো।কম্পনরত গলায় ধীরভাবে আম্বের বললো—
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন মাহাদ?
“এইসব কী পাগলামো আপনার।”
আম্বের উন্মনা হয়ে হাসে।কিছুক্ষনের মধ্যে হেলে পড়ে মাহাদ এর গায়ের উপর।আম্বের কে কোলে করে ঘরে নিয়ে আসে মাহাদ।বিছানায় শুইয়ে দেয়।পুরো শরীর বরফখন্ড হয়ে আছে।মাহাদ সময় নষ্ট না করে আম্বের কে চেঞ্জ করিয়ে দেয়।পুরো শরীরে কমফোর্টার টেনে তার হাত পায়ে তেল মালিশ করতে থাকে।ডক্টর কে কল করে তার কন্ডিশন বলে মেডিসিন প্রেসক্রাইভ করে সেগুলো নিয়ে আসে।আম্বের এর শরীরে প্রচন্ড জ্বর।জ্বরের ঘোরে নিজের বাবাকে ডাকছে।
মাহাদ অনেক কষ্টে আম্বের কে মেডিসিন খাইয়ে ওকে রেষ্ট করতে দেয়।করিডোরে গিয়ে বসে মাহাদ।হাতের ব্যান্ডেজ রক্তে রঞ্জিত।সেইটা খুলতেই দেখে ভিজে কেমন দগদগে হয়ে আছে ক্ষতটা। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে তার।এইসব আদৌ হওয়ার ছিলো!
ভালোই তো ছিলো সে।সব হারিয়ে নিঃস্ব।তবুও ভালো ছিলো।কিন্তু এখন!এখন সে একা নয়।কিন্তু তবুও সে একা।এই মেয়েটাকে পাওয়ার বড্ড লোভ জেগেছে তার।কিন্তু তার এই লোভের কারণে সে তার প্রেয়সীর জীবন সংকটে পড়তে দিতে পারে না।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর ঘরে আসে মাহাদ।আম্বের উঠে বসেছে।মাহাদ এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে এসেছে।আম্বের কে সব সময় জোর করেই খাওয়াতে হয়।কিন্তু এখন সে শর্ত দিয়েছে ইমুর সাথে কথা না বলে খাবে না।মাহাদ বাধ্য হয়ে নিজের মোবাইল দেয়।আম্বের এর গলায় আর কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর ছেড়ে দিয়েছে।আম্বের এক অদ্ভুত কান্ড করলো।মাহাদ এর মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়।মাহাদ হতভম্বের মতো বললো—
“এইটা কী করলেন!
“করেছি বেশ করেছি।এখন গিয়ে আঙ্কেলের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে আসেন।”
“তাই বলে…।”
“নাহলে আমি কিছুই খাবো না।”
মাহাদ ছোট্ট দম ফেললো।হতাশ গলায় বললো—
“আমি চাচাকে বলছি।”
“নাহ।আপনি নিজে গিয়ে নিয়ে আসেন।”
মাহাদ কিছুক্ষন গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।তারপর আর কিছু না বলে রহিম এর কাছ থেকে নাম্বার এনে দেয়।আম্বের নিজের মোবাইল দিয়ে কল করে।কিন্তু কিছুতেই কথা বলবে না ইমু।আম্বের এর মন বিষন্নতায় ভরে উঠে।মাহাদ শান্ত গলায় বললো—
“ওকে একটু সময় দিন।সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মাহাদ আম্বের এর পেটের উপর হাত রেখে তার একদম কাছে চলে যায়।স্মিত গলায় বললো—
“আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ভালো রাস্তা ধরেছেন আপনি।কিন্তু এইটা লাস্ট টাইম।এরপর যদি এই ধরনের কোনো কাজ করেন আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।”
মাহাদ আম্বের এর কানের কাছে গিয়ে বললো—
“এখন আমি বের হবো।রাতে ফিরবো।পালানোর একদম চেষ্টা করবেন না।প্রথমবার ক্ষমা করেছি এইবার কিন্তু করবো না।”
আম্বের নরম গলায় দৃঢ় হয়ে বললো—
“ক্ষমা করেছেন!শাস্তি দেন নি আমাকে!
“ওইটা ভালোবাসা ছিলো।”
“নোংরামি ছিলো।”
“ভালোবাসা নোংরা হয় না।”
“হয়।নোংরামি ভালোবাসা।”
মাহাদ বিগলিত হাতে।মাহাদ এর হাসিতে ঝনঝনিয়ে উঠে আম্বের এর শরীর।স্বাভাবিক গলায় মাহাদ বললো—
“আমাকে একটু সময় দিন।আমি সব পবিত্র করে দিবো।একটু ধৈর্য্য ধরেন।সেই পর্যন্ত না হয় একটু একটু ভালোবাসবেন।”
মাহাদ আম্বের এর গলায় চুমু খায়।বললো–
“চলেন খাবেন এখন।আমি গেলে তো ঠিক মতো খাওয়া দাওয়াও করেন না।”
,
,
বিকেলে বই নিয়ে বসে আম্বের।ছুটির দিন হওয়ার আজ সারাদিন বাসায়।এখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে।একটু পর পর ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে।বিছানায় থাকা মোবাইলটা বেজে উঠতেই তা রিসিভ করে আম্বের।
“হাই,কেমন আছো?
ওপাশ থেকে নম্র গলায় অভি বললো–
“ভালো।তুমি কেমন আছো?
“ভালো।হঠাৎ কী মনে করে!
অভি অনুরক্তির গলায় বললো—
“আসলে তুমি সেদিন নোটস এর কথা বললে না!সেগুলোর তোমার জন্য আমি রেখেছি।”
আম্বের বিস্মিত গলায় বললো—
“ওগুলো তো তোমার ভাইয়ের জন্য রেখেছিলে।”
“ও এখনো ছোট।এই পর্যন্ত আসতে আসতে টপিকস ই চেঞ্জ হয়ে যাবে।তার চেয়ে তুমি নিও।”
আম্বের উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো—
“আরে বাস।এইবার আর আমাকে টপ হতে ঠেকায় কে!টপের নোট কপি করে টপ করে ফেলবো।”
কথার ফাঁকে ফাঁকে আম্বের নাক টানতে থাকে।অভি তা স্পষ্ট শুনতে পায়।স্মিত গলায় বললো-
“ঠান্ডা লেগেছে তোমার?
“একটু।”
“মেডিসিন নিয়েছো?
“হুম।”
আম্বের দরজা খোলার শব্দ পায়।দেখে মাহাদ দাঁড়িয়ে আছে।বিছানায় বসে মাহাদ।আম্বের ব্যস্ত গলায় অভি কে বললো—
“আচ্ছা রাখছি।কলেজে গেলে দেখা হবে।”
“ওকে।বাই।টেক কেয়ার।”
আম্বের মোবাইল রাখতেই মাহাদ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো—
“কার সাথে কথা বলছিলেন?
আম্বের ঝট করে দুষ্টমির ছলে বললো–
“আমার জামাইর সাথে।”
মাহাদ আম্বের কে টান দিয়ে নিজের পায়ের উপর বসায়।দু হাত দিয়ে আম্বের এর কোমর জড়িয়ে ধরে।এখনো অনেকটা উষ্ণ আম্বের এর শরীর।গাঢ় গলায় মাহাদ বললো—
“ভুলেও আমার জায়গায় অন্য কাউকে ভাববেন না।”
“কী করবেন তাহলে!মেরে ফেলবেন?
মাহাদ আম্বের কে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে বিছানায় শোয়ায়।তার উপর উবু হয়ে আম্বের এর গলায় মুখ ডোবায়।নরম গলায় বললো—
“ভালোবাসবো।
আম্বের তটস্থ হয়ে বললো—
“মাহাদ ছাড়েন,ছাড়েন বলছি।”
আম্বের নিজের মাথাটা বিছানা থেকে একটু উঁচু করে মাহাদ এর কাঁধে এক সজোরে কামড় বসায়।হাতের বাঁধন শিথিল হতেই ব্যস্ত হয়ে উঠে আম্বের।মাহাদ উঠে বসে।আম্বের ভেঙচি কেটে বললো—
“শয়তান লোক কোথাকার!একদম ঠিক হয়েছে।”
আম্বের ঘর থেকে দোঁড়ে বের হয়।মাহাদ হাত ঝাঁকাতে থাকে।এমনিতেও হাতে ব্যান্ডেজ তার উপর সেই কাঁধেই কামড় বসিয়েছে আম্বের।মাহাদ আফসোস এর সুরে বললো—
“মেয়েদের এই দাঁতে আর নখে এতো শক্তি আসে কোথা থেকে!
মাহাদ তার শার্টের উপরের দিকের তিনটা বাটন খুলে কলার আলগা করে ঘাড় থেকে।আম্বের পুরো দাঁত বসিয়ে ফেলেছে।টিটেনাস তো পাক্কা লাগবে।
মাহাদ এর চোখ যায় তার বুকের মাঝে সেই নখের আঁচড়ে।গা ঘিনঘিন করে উঠে তার।এই নখের আঁচড় সে চাইলেও ভুলতে পারে না।এখান থেকেই তো শুরু তার বিভৎষ স্বপ্নের।
ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন।
চলবে,,,