বদ্ধ হৃদয়ের অনুভুতি পর্বঃ২৪

0
3291

#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ২৪
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

জানালার পর্দা উড়িয়ে ফিনফিনে বাতাস বইছে।তার পাশেই ডিবানে বসে আছে আম্বের।আম্বের কে খাইয়ে দিচ্ছে মাহাদ।
আম্বের একদম চুপচাপ হয়ে গেছে।নিথর,নিস্তব্ধ।কেনো যেনো সবকিছুই তার কাছে অতিষ্ঠ লাগে।ইলহাম এর সে অযাচিত ছোঁয়া আজও ভুলতে পারে না আম্বের।পারে না ভুলতে তার জীবনের কঠিন ঘটনা গুলো যা একের পর এক তোলপাড় করে তুলছে তার জীবন।

বাবার মৃত্য,মাহাদ এর সাথে তার সম্পর্ক,সেই অদ্ভুত অ্যাকসিডেন্ট এরপর ইলহাম এর বৈরি আচরণ।সব কিছুই যেনো বিভৎষ,বিদঘুটে,বিস্বাদ।আম্বের মুখ বন্ধ করে আছে।মাহাদ এর ডাক তার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না।সে নিরন্তর তার ভাবনায় বিচরণ করছে।মাহাদ গলার স্বর হালকা চড়িয়ে ডেকে উঠলো–

“প্রজাপতি!
খেয়ে নিন প্লিজ।আর কতোক্ষন বসে থাকবো!

আম্বের নরম গলায় বলল–

“আমি আর খাবো না।”

মাহাদ আরেকটু জোর দিয়ে বললো—

“আরেকটু খেয়ে নিন।”

“উঁহু।”

মাহাদ নিরাশ হয়ে হাত থেকে প্লেট নামিয়ে রাখে।আম্বের এর মুখ ধুয়ে তা টিস্যু দিয়ে মুছে দেয়।আম্বের এর চোখের নিচে কালচে হয়ে আছে।আজকাল ঠিকমতো ঘুমায় না সে।মাহাদ প্রায়ই রাতে আম্বের এর কান্নার শব্দ শুনতে পায়।
আম্বের এর চুলগুলো তার গালের উপর থেকে সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দেয় মাহাদ।আম্বের নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে।নির্লিপ্ত গলায় বললো—

“অভির সাথে কথা হয়েছে আপনার?

মাহাদ স্বাভাবিক গলায় বললো–

“নাহ।
আপনি কথা বলবেন?

“নাহ।”

মাহাদ ছোট্ট করে দম ফেললো।অষ্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে অভি এসেছিলো মাহাদ এর সাথে দেখা করতে।আম্বের এর জন্য একটা গিফ্ট বক্স দিয়েছিলো আর বলেছিলো,,,”আপনি আমার আইডল।আমার প্রিয় একজন মানুষ।
আর আজ আমি আমার জীবনের সবচেয়ে অমূল্য জিনিস আপনাকে দিয়ে যাচ্ছি।আমার প্রথম অনুভূতি।”
মাহাদ সেই বক্সটা খুলে দেখেনি।আর আম্বের কেও বক্স এর কথা বলেনি।

আম্বের শান্ত গলায় বললো–

“ইমু কে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।আমাকে একটু নিয়ে যাবেন ওর কাছে?

মাহাদ স্মিত হাসলো।দৃঢ় গলায় বললো—

“যান রেডি হয়ে আসেন।
কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”

আম্বের মাহাদ এর দিকে ফিরে তাকায়।নির্বিকার,নিশ্চল তার দৃষ্টি।কোনো কিছুই যেনো আজকাল তার মনে কোনো সাড়া ফেলে না।সবকিছুই মরিচিকা মনে হয়।মাহাদ বিগলিত হাসে।আম্বের এর বিউটি বোন এ চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বললো—

“আজকের রাতটা আপনাকে আমায় দিতে হবে।”

আম্বের কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।সে এখনো মাহাদ এর দিকে তাকিয়ে আছে।মাহাদ সরে আসতেই আম্বের ধীর পায়ে উঠে ঘরে চলে যায়।
আম্বের এখন শান্ত।মাহাদ তাকে কাছে টানলেও কোনো রেসপন্স সে করে না।তাই মাহাদও এ নিয়ে তেমন আর কোনো প্রতিক্রিয়া করে না।আম্বের এর সাথে যা হয়েছে বা হচ্ছে তার অনেক খারাপ প্রভাব পড়ছে তার মস্তিষ্কের উপর।

মাহাদ উঠে দাঁড়ায়।জানালার পর্দা গলিয়ে বাইরের দিকে তাকায়।ঝলমলে আকাশ।সূর্য সবে মধ্য আকাশ থেকে ক্রমশ পশ্চিম দিকে হেলতে শুরু করেছে।তপ্ত রশ্মি ধীরে ধীরে তার দীপ্ততা কমাচ্ছে।মাহাদ দেখে দূরে একটা জায়গায় কিছু কালো মেঘ জমেছে।যেমনটা তার প্রজাপতির মনে জমেছে।কিন্তু এই মেঘ তো পুরো আকাশে কোনো প্রভাব ফেলছে না।তাহলে তার প্রজাপতি কেন রঙ ছড়াতে ভুলে গেলো!
রঙিন পাখা মেলে তার ভালোবাসার বাগানে উড়া বন্ধ করে দিলো!সূর্যের মতো করে কী সে পারবে তার সুগন্ধির মনের আকাশে জমে থাকা অন্ধকার ছায়া দূর করতে!
,
,
,
ইমুর স্কুলে এসে প্রায় একঘন্টা ওয়েটিং রুমে বসে ছিলো আম্বের আর মাহাদ।ইমু কিছুতেই দেখা করবে না।তখন বাধ্য হয়ে মাহাদ কেই যেতে হলো।

এখন ওরা একটা রেষ্টুরেন্টে বসে আছে।ইমু থম মেরে আছে।আম্বের কিছুক্ষন সরু চোখে তাকিয়ে স্মিত গলায় বললো—

“খাচ্ছিস না কেন ইমু?

ইমু শক্ত গলায় দৃঢ় হয়ে বললো—

“ইচ্ছে করছে না।”

মাহাদ ইমুর দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো।ইমুর রাগের কারণ তার জানা।ইমুর পাশেই বসে আছে ইমুর ক্লাসমেট।সে মাহাদ এর অনেক বড় ফ্যান।ইমুকে খোঁচা মেরে বললো—

“তুই কী এখনো আম্বের এর উপর রাগ করে আছিস?

মেয়েটির দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকায় ইমু।কিন্ত কোনো কথা বললো না।মাহাদ ঝরা হাসলো।আম্বের আগ্রহদীপ্ত গলায় বললো—

“কী নাম তোমার?

মেয়েটি ঝট করে বললো–

“পেখম।আমি ইমুর গার্লফ্রেন্ড।”

ইমু প্রতিবাদ করে বললো–

“কে বললো তুই আমার গার্লফ্রেন্ড !

“আরে আমি তো তোর ফ্রেন্ড।আর আমি তো গার্ল।তাই গার্লফ্রেন্ড বললাম।বুঝলে আম্বের।”

পেখম এর কথায় খলখলিয়ে হেসে উঠে আম্বের।মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহাদ।আজ অনেকদিন পর আম্বের এইভাবে হাসছে।আম্বের কে এইভাবে দেখে প্রসন্ন হাসে মাহাদ।পেখম তার ছোট্ট গোল গোল চোখ পাকিয়ে বললো—

“তোমরা দুজন বিয়ে করে ফেলেছো?

মাহাদ দুর্বোধ্য হাসলো।শান্ত গলায় বললো–

“নাহ।তবে করবো।”

মাহাদ এর কথায় বিষাদ ছেয়ে যায় ইমুর মুখে।পেখম ব্যস্ত হয়ে ওর ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে মাহাদ এর দিকে এগিয়ে দেয়।চটপটে গলায় বললো—-

“এখানে একটা অটোগ্রাফ দাও।আর তোমাদের বিয়েতে অবশ্যই আমাকে ইনভাইট করবে।আমি কিন্তু নাচতে পারি বুঝলে।”

আম্বের বিগলিত হাসে।পেখম এর কথায় কেমন যেনো উচ্ছলতার ছড়াছড়ি।এই টুকুন মেয়ে তবুও কতো সহজ,সাবলীল,প্রাণোদীপ্ত।

ইমু আর পেখম কে স্কুলে দিয়ে নিজের গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাহাদ।আম্বের ওদের সাথে আরো কিছুক্ষন কথা বলে বেরিয়ে আসে।মাহাদ কে দেখে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে।মাহাদ এর কাছে এসে তার সামনে দাঁড়ায় আম্বের।নীরস গলায় বললো–

“চলেন।”

মাহাদ এক হাত দিয়ে আম্বের এর কোমর জড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নেয়।আম্বের অপ্রস্তুত হয়।অসহিষ্ণু গলায় বললো—

“এইসব কী করছেন!ছাড়েন আমাকে।”

মাহাদ তপ্ত নিশ্বাস ফেলে অনুরক্তির সুরে বললো—

“এমন কেন হয়ে গেলেন আপনি!না কথা বলেন না হাসেন।আপনার ঠোঁট দুটোও কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেলো।”

মাহাদ ধীরে আম্বের এর ঠোঁটের দিকে এগুতেই আম্বের নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।কাট কাট গলায় বললো—

“বাসায় যাবো আমি।”

“আপনার কিন্তু আজকের রাতটা আমাকে দেওয়ার কথা ছিলো!

আম্বের বিতৃষ্ণা গলায় বললো—

“আমার ভালো লাগছে না মাহাদ।”

মাহাদ উজ্জ্বল হাসে।ঝলমলে গলায় বললো—

“তাহলে চলেন আপনার ভালো লাগার জন্য কিছু করি।”

মাহাদ আর আম্বের গাড়িতে উঠে বসে।কেনো যেনো পার্থিব কোনো জিনিসে আম্বের এর মন টানে না।সে এখন মেঘ হতে চায়।সাদা শুভ্র মেঘ।যেনো পুরো আকাশজুড়ে তার বিচরণ।উড়ে বেড়াতে পারে নিজের ইচ্ছেমতো।জানালা দিয়ে আসা বাতাসে উড়ছে আম্বের এর ছোট ছোট সামনের দিকের অবাধ্য চুল।মাহাদ আড়চোখে কয়েকবার তাকায় আম্বের এর দিকে।কোনো ধরনের উত্তেজনা তার মধ্যে নেই।নিষ্প্রাণ,নিষ্প্রভ,নিথর।মাহাদ এর বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক সুদীর্ঘ হতাশার শ্বাস।
,
,
,
আম্বের কে নিয়ে মাহাদ একটা স্টডিুও তে আসে।অন্ধকার রুমে আসতেই আম্বের এর অস্বস্তিকর লাগে।মুহুর্তেই পুরো ফটো স্টুডিও আলোতে ঝলমল করে উঠে।
ফ্লোর জুড়ে ছড়ানো হার্টশেপ বেলুন আর গোলাপের পাঁপড়ি।দেয়াল জুড়েও ফুল লাগানো।বিভিন্ন রঙের লাইট এর আলোয় সবকিছু ঝিকিমিকি করছে।আম্বের উৎসুক গলায় বললো—

“এইসব কী মাহাদ!

“এইসব আমার বউ এর জন্য।”

মাহাদ এর মুখে বউ কথা শুনতেই ঝকমক করে উঠে আম্বের এর চোখ মুখ।মাহাদ আম্বের এর গালে হাত দিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে বললো—-

“প্লিজ এইবার তো এইসব ভুলে যান।প্লিজ।”

আম্বের তার মাথা গুঁজে মাহাদ এর আস্ত বুকে।স্মিত গলায় মাহাদ বললো—

“আপনি না মডেল হতে চেয়েছিলেন!
চলেন।”

আম্বের হকচকিয়ে বললো–

“মানে?

“মানে আজ এখানে ফটোশুট হবে।আসেন।”

মাহাদ আম্বের কে সেই রুমটার ভেতরে আরো বড় একটা হলরুম আছে সেখানে নিয়ে যায়।আম্বের অবাক হয়ে দেখে।একটা লোকও আছে সেখানে।চোখে কালো বড় সানগ্লাস।আম্বের ঠোঁট গুঁজ করে ভাবে,এইখানে সানগ্লাস পড়ার কী মানে!

মাহাদ আম্বের কে ফটো তোলার পজিশনে নিয়ে দাঁড় করায়।আম্বের একটা সাদা শাড়ি পড়েছে।তাকে অ্যাঙ্গেলে নিজের সাথে দাঁড় করিয়ে তার কোমর এর উপর থেকে শাড়ির আঁচল হালকা উপরে তুলে নিজের হাত চেপে ধরে সেখানে মাহাদ।আম্বের হতভম্ব হয়ে বললো–

“মাহাদ কী করছেন আপনি!

“কথা বলবেন না।”

“মাহাদ আমার ভালো লাগছে না।”

মাহাদ রসালো গলায় বললো–

“আমার ভালো লাগছে।কতোদিন আপনি আমার কাছে আসেন না জানেন!

আম্বের নরম গলায় কৌতূহলদীপ্ত হয়ে বললো—

“আপনি না বলেছেন আমাকে এইভাবে আপনি ছাড়া আর কেউ দেখবে না!

মাহাদ তার অধর জোড়া ছড়িয়ে আম্বের এর কানের কাছে হিসহিসিয়ে বললো—

“বলেছিতো।”

“তাহলে!

“তাহলে কী!আপনি তো আমার ই।আমার ভালোবাসার সুগন্ধি প্রজাপতি।”

অনেকগুলো ছবি তোলা হলো ওদের দুইজনের।

রাতে যখন সেই ছবি গুলোই মাহাদ দেখছিলো আম্বের রুষ্ট কন্ঠে বললো—

“সমস্যা কী আপনার ! এমন কেন করলেন!আর এইসব কী ধরনের ছবি।”

মাহাদ ওদের দুইজনের কিছু ক্লোজ ফটো ক্লিক করিয়েছে।

মাহাদ ল্যাপটপের স্ক্রিনে সেগুলোকেই জুম করে দেখছিলো।আম্বের এর দিকে একবার তাকিয়ে আবার ল্যাপটপের দিকে চোখ রেখে শান্ত গলায় বললো—

“এখানে রেগে যাওয়ার কী আছে মিস সুগন্ধি !

“চুপ করেন।আপনি সবাইকে নিজের মতো অসামাজিক ভাবেন!

মাহাদ ল্যাপটপ রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।নাম না জানা ফুলের অদ্ভুত সুঘ্রাণ ভেসে আসছে।আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে।আশেপাশে তারারা আজ লুকোচুরি খেলছে না।মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে।হাওয়ার ভেতর যেনো কিছু একটা আছে।আম্বের আবারো জোর আওয়াজ তুলে বললো—

“কথা বলছেন না কেন আপনি?

মাহাদ নিরুদ্বেগ গলায় বললো—

“ছেলেটা চোখে দেখেনা।কয়েক মাস আগে একটা অ্যাকসিডেন্ট ও ওর চোখ হারায়।ও একজন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার ছিলো।তাই চোখ না থাকায়ও তেমন একটা সমস্যা হয় না ফটোগ্রাফিতে।আর এইসব তো কোনো মডেলেরও নয়।”

মাহাদ কথা শেষ করে নিরব দৃষ্টি রাখলো আম্বের এর দিকে।আম্বের স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মাহাদ আবার সম্মুখপানে তাকায়।ধীর গলায় বললো–

“এক সপ্তাহ পর ওর অপারেশন।তাই ভাবলাম আপনার কয়েকটা ছবি তুলে রাখি।আজকাল আপনাকে ছাড়া শ্বাস নিতেও কষ্ট হয় আমার।কী হয়েছে আমার বলেন তো!
তাই স্মৃতি হিসেবে রাখলাম।যদি কখনো হারিয়ে যান!

আম্বের অসহায় গলায় বলে উঠলো—

“মাহাদ!

মাহাদ এক ঝটকায় আম্বের কে নিজের বুকে টেনে নেয়।দুই হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে।কাতর গলায় বললো—

“মৃত মানুষের স্মৃতির চেয়ে জীবিত মানুষের স্মৃতি ভোলা বেশি কষ্টকর।হৃদয়টা পুড়ে সেই মানুষটার জন্য।না তাকে ভোলা যায় না তাকে ছাড়া বাঁচা যায়।”

মাহাদ এর কথায় বুকটা মোছড় দিয়ে উঠে আম্বের এর।শিউরে উঠে তার শরীর।বসন্তের পর গ্রীষ্মের তাবদাহের মতো খরা শুরু হয় তার হৃদয়ে।এ শুধু মাহাদ এর ভালোবাসায় তার প্রাণ ফিরে পাবে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here