#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ২৬
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি
মিইয়ে যাওয়া সূর্যকে ধীরে ধীরে গোধূলির লগ্ন জড়িয়ে নিচ্ছে তাকে।নীলাভ আকাশ তার নীলচে রঙের পরিবর্তে জায়গা করে দিচ্ছে কমলার রঙের আভা কে।পাশ দিয়ে শোঁ শোঁ আওয়াজ চলে যাচ্ছে বিরতিহীন যাত্রীবাহি গাড়ি।
শান্ত,স্থির দৃষ্টিতে সামনে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে আম্বের।ঘন ঘন চোখের পলক পড়ছে তার।রিমেল স্মিত হেসে বললো—
“এক্সকিউজ মি!
কী নাম আপনার?
আম্বের ধীর গলায় বললো—
“আম্বের।”
রিমেল কপাল কুঁচকালো।তাকে দেখে মনে হলো নামটা তার পছন্দ হয়নি।রিমেল স্বাভাবিক গলায় বললো—
“তা কোথায় যাচ্ছিলেন এভাবে!হর্ন দিলাম শুনলেন ই না।”
আম্বের চোখের পলক ফেলে আবার তাকায়।হর্ণ!সে তো কোন হর্ণ শুনতে পায়নি।আম্বের এর মুখভঙ্গি বুঝতে পেরে রিমেল ফিক করে হেসে ফেললো।রসালো গলায় বললো–
“আসলে ক্লাস ফোরে থাকতে আমি একটা ছ্যাকা খেয়েছি।টানা একমাস আমার এক ক্লাসমেট কে টিফিনের টাকা দিয়ে চকলেট কিনে খাইয়েছি।কিন্তু একদিন আমার এক সিনিয়র ওকে কিটক্যাট কিনে দিলো আর পটে গেলো!
সেই থেকে এই গানটা আমার খুব প্রিয়।”
রিমেল তার বাইকের সামনে ইলেকট্রিক সিস্টেম করে লাগানো সাউন্ড বক্স অন করতেই সেই গান বেজে উঠে।
“প্রেমের নামের অভিনয় তুই ভালোই জানোস রে
নিঃস্ব করলি আমারে তুই এক নিমিশেই।”
রিমেল ঝলমলে গলায় আবার বললো–
“আপনিই বলেন যেই মেয়ে একটা কিটক্যাট এর জন্য আমাকে ছেড়ে যেতে পারে সে তো টাকা পয়সার জন্য আমাকে মেরে বুড়ি গঙ্গায় ভাসাতে পারবে না তার কী গ্যারান্টি!
এরপর থেকে মেয়েদের উপর আমার বিশ্বাসই উঠে গেছে।”
আম্বের নিষ্প্রাণ গলায় স্থির হয়ে বললো—
“পৃথিবীর সবমেয়ে এক নয়।”
“তা অবশ্য ঠিক বলেছেন।আচ্ছা যাক গে সে কথা।আপনি এভাবে যাচ্ছিলেন কোথায় বলেন তো!আরেকটু হলেই তো অ্যাকসিডেন্ট হতো।”
আম্বের ধীর গলায় উন্মনা হয়ে বললো–
“মরে গেলেই ভালো হতো।”
“মৃত্যু এতো সোজা নয় মিস আম্বের।”
আম্বের আপত্তির সুরে বললো—
“শুধু আম্বের।”
রিমেল গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আম্বের এর দিকে।সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।দিনের আলো ধীরে ধীরে প্রলীণ হয়ে রাতের আঁধারে জড়াচ্ছে চারপাশ।স্থিমিত এই আলোতে আম্বের এর নিষ্প্রভ মু্খটা ভাবাচ্ছে রিমেল কে।আম্বের কে আপাদমস্তক দেখে সপ্রতিভ হয়ে বললো—-
“আপনাকে দেখে বিয়ের আসর থেকে পালানো কনে বলে তো মনে হচ্ছে না!আবার এই ভর সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি থেকে পালিয়েছেন বলেও মনে হচ্ছে না।দেখে যা মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।”
বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কথা শুনে ডুঁকরে কেঁদে ফেলে আম্বের।রিমেল ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো—
“আরে আরে করছেন কী!কাঁদছেন কেন!এখন তো রাস্তার মানুষ আমাকে ইভটিজার বলে উদোম কেলানি দিবে।প্লিজ আম্বের থামেন।”
আম্বের তার কান্না থামায়।চোখ মুখ মুছে রিমেল এর দিকে তাকায় আর তখনই মাহাদ এর কথা গুলো মনে পড়ে।আসলেই কী সে খারাপ মেয়ে!
রিমেল নিরুদ্বেগ গলায় বললো–
“শুনেন পৃথিবী অনেক বড়।এক দরজা বন্ধ হলে অন্য দরজা খুলবে।আর সবচেয়ে বড় সত্য যে কোন দোষ করে না উপর ওয়ালা দেওয়া যেকোন ঘটনা তার কাছে আপাত দৃষ্টিতে খারাপ মনে হলেও তা তার ভালোর জন্যও হতে পারে।জানেন তো কারণবিহীন কোনো ঘটনা ঘটে না।
একটা ঘটনা শোনাই আপনাকে।ছোটবেলা বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করেছিলাম বলে বাবা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।কিন্তু সন্ধ্যে না হতে পুরো এলাকা জুড়ে মাইকিং করা শুরু করে আমার হারানো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে।আমিও কী কম নাকি!দুইদিন ঘাপটি মেরে বসে ছিলাম বন্ধুর বাড়িতে।তারপর রাজার বেশে ফিরে এলাম বাড়িতে।বাবা কে মিথ্যে বলেছি হাটতে হাটতে পাশের গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। এরপর থেকে বাবা আর যাই করুক বাড়ি থেকে বের করে দেয় না।”
হা হা করে হাসতে থাকে রিমেল।কিন্তু আম্বের এর ভালো লাগছে না।ভালো লাগছেনা এই পৃথিবী।ভালো লাগছে না এই সন্ধ্যা।ভালো লাগছে না কিছুই।সবকিছু দূর্বিষহ মনে হচ্ছে।রিমেল তার হাসি থামিয়ে স্মিত গলায় বললো—
“বিপদেই বন্ধুর পরিচয়।সেদিন আমার সেই বন্ধু না থাকলে কী হতো বলেন তো!
আম্বের এর চোখের সামনে তৎক্ষণাত ভেসে উঠলো সামান্তার চেহারা।সে কী একটু ঠাঁই পাবে সেখানে!আর তো কেউ নেই তার!
রিমেল চটপটে গলায় বললো–
“এখন বলেন তো কোথায় যাবেন?
একদম ফ্রি নিবো।পেট্রোল খরচ লাগবে না।কিন্তু আমাকে একটা হেল্প করতে হবে।”
আম্বের চোখের পাল্লা প্রশ্বস্ত করে।সে এখন কোনো পুরুষকেই বিশ্বাস করতে চায় না।রিমেল মুচকি হেসে বললো–
“ভয় পাবেন না তেমন কিছু নয়।আসলে আমাকে ভালোবাসা খুঁজে দিতে হবে।”
আম্বের তার ভ্রুযুগল ঈষৎ কুঞ্চি করে।রিমেল ঠাট্টার স্বরে বললো—
“আরে আরে ওই ভালোবাসা না।ভালো বাসা।আই মিন গুড হাউস।আসলে নতুন এসেছি শহরে।তাই একটা বাসা খুঁজছিলাম।আপনি যদি একটু হেল্প করতেন।তার বিনিময়ে আপনি যেখানে যেতে চাইবেন নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দিবো।নো টাকা পয়সা।”
আম্বের কিছুক্ষন চুপ করে ভাবলো।রাত হয়ে আসছে।এখন তার যাওয়ারও কোনো জায়গা নেই।তাই সামান্তার বাসার কথা বললো।রিমেল আপত্তি করলো না।বাইকে উঠে বসলো রিমেল।পেছনে বসতে ইতস্তত বোধ হচ্ছে আম্বের এর।রিমেল আশ্বস্ত গলায় বললো–
“ধরে বসেন।পৃথিবীর সব পুরুষ খারাপ নয়।”
আম্বের বাইকের পিছনের দিকটায় ধরে শক্ত হয়ে বসে।রিমেল এই শহরে নতুন নয়।কিন্তু পরিবার নিয়ে আসার কারণে তার একটা বাসা প্রয়োজন।
সামান্তাদের বাড়ির সামনে এসে বাইক থামায় রিমেল।আম্বের নেমে দাঁড়ায়।ফিকে গলায় বললো–
“আপনার বাসা!
রিমেল ব্যস্ত গলায় বললো–
“কাল।ঠিক এখানেই আমি আবার আসবো।আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে।আজ আসি।”
রিমেল চলে যায়।আম্বের এ নিয়ে আর ভাবতে চায় না।যা হবার হবে।এমনিতেও তার জীবনে কোনো কিছু ঠিক নেই।
আম্বের কে দেখে চকিত হয় সামান্তা।সব কিছু খুলে বললে ফুঁসে উঠে সামান্তা।আম্বের এর বোকামির জন্য তাকে অনেক কথা শোনায়।সামান্তার মা প্রথমে গড়িমসি করলেও পরে রাজি হয় আম্বের কে রাখতে।আম্বের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
কিন্তু সেই রাতে সে আর ঘুমাতে পারলো না।সারারাত মাহাদ কে ভেবেছে।পাশ ফিরে অবচেতন মনে তাকেই খুঁজেছে সে।নিজের অজান্তেই নেমেছে চোখ বেয়ে শ্রাবণের ঘন বর্ষা।
,
,
,
চলে যায় এক সপ্তাহ।আম্বের না থাকায় এখন অনেক সময় মাহাদ এর হাতে।নতুন একটা ফিল্ম হাতে নিয়েছে সে।এইসবের জন্যই তো একদিন সে তার সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েছে।এখন আর দূরে থেকে লাভ কী!
যে যাওয়ার সে তো যাবেই।মাহাদ ফিরে তার পুরোনো জগতে।
স্থির হয়ে বসে আছে মাহাদ।একটু আগেই শুটিং শেষ করে ইকরাম খান এর বাসায় এসেছে।আজ রাতে এখানেই থাকবে।বাসায় এখন আর তেমন যাওয়া হয় না।কেমন যেনো দম বন্ধ লাগে তার।কিছু একটা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
দু মগ কফি এনে মাহাদ এর সামনে রাখে ইকরাম।মুখে আলতো হাসি ফুটিয়ে প্রশ্ন করে মাহাদ কে–
“এনি থিংক রং মাহাদ?কয়েকদিন ধরেই দেখছি বেশ উন্মনা তুমি!
মাহাদ ঠোঁটের কোণ হালকা প্রসারিত করে তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসে।ফিকে গলায় বললো–
“মাই হোল লাইফ ইজ রং।”
মাহাদ এর কথায় স্পষ্ট বিষন্নতা প্রকাশ পাচ্ছে।ইকরাম কিছুটা আঁচ করতে পারলেন যে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে।তিনি ভালো করেই জানেন মাহাদ তাকে নিজ থেকে কিছু বলবে না।সে প্রফেশনালি কথা বলতে পছন্দ করে।তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে ইকরাম বললেন—
“মিশ্মিয়ার সাথে কথা হয় তোমার?
মাহাদ সোজা বললো–
“নাহ।”
ইকরাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে আক্ষেপের গলায় বললেন—
“কী এমন হতো তুমি ওকে বিয়ে করলে!তোমার সিদ্ধান্তে রাগ করে আমাকে ছেড়েই চলে গেলো।সেই যে গেলো আজ তিন বছর একবার কথাও বললো না।একবার খবর পেয়েছিলাম কোন গ্রামে যেনো ডক্টরি করে।তুমিই বলো এতো টাকা খরচ করে ওকে ডাক্তারি পড়ালাম গ্রামে গিয়ে ওই মানুষদের সেবা করার জন্য!
মাহাদ গম্ভীর গলায় বললো–
“গ্রামের মানুষ কী মানুষ নয়!তাদের কী সুচিকিৎসা পাওয়ার অধিকার নেই!তাছাড়া প্রতি বছর কতো মেয়েরা মা হতে গিয়ে কতো ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে পড়ে।”
মাহাদ এর কথায় সহমত দিয়ে ইকরাম বললেন–
“মানুষের জন্য এতো মায়া নিজের বাবার জন্য একটুও মায়া নেই!
মাহাদ চোখ বাঁকিয়ে তাকালো।তবে কিছু বললো না।মিশ্মিয়া মাহাদ কে বিয়ে করতে চেয়েছিলো।কিন্তু সে না করে দেয়।মিশ্মিয়ার পাগলামি থেকে বাঁচার জন্য সে বলে মিডিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত কাউকে সে বিয়ে করবে না।তাই মিশ্মিয়ার সব রাগ গিয়ে পড়ে তার বাবা ইকরাম খান এর উপর।
দরজায় বেল বাজতেই ইকরাম এর একজন সার্ভেন্ট দরজা খুলে দেয়।ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে এনাম।এই লোকটাকে দেখলেই গায়ে জ্বালা ধরে মাহাদ এর।হাসতে হাসতে ওদের সামনের কাউচে এসে বসে।।ইকরাম খান তাকে বসিয়ে ভেতর ঘরে যান।এনাম তার সুযোগ পায়।দাঁত কেলিয়ে সন্দিহান গলায় বললো—
“শুনলাম মেয়েটাকে নাকি বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন!আমি তো ভেবেছি বিয়ে শাদি করবেন।”
মাহাদ এর নাকের নাটা ফুলতে থাকে।ইচ্ছে করছে পাশে থাকা ফ্লাওয়ার ভাসটা জাস্ট এই লোকটা আধা টাকু মাথায় ছুঁড়ে মারতে।কিন্তু তেমন কিছুই মাহাদ করলো না।শান্ত হয়ে বসে রইলো সে।
এনাম আবার হিসহিসিয়ে বললেন—
“তা মেয়েটা ভার্জিন তো নাকি!হাজার হোক এক বাড়িতেই তো ছিলেন।”
মাহাদ এর মস্তিষ্কের দুপাশের রগ গুলো জ্বলে উঠলো।থমথমে গলায় বললো—
“তাকে নিয়ে আর একটাও বাজে কথা বলবেন না।আমি আপনাকে আগেই বলেছি তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।আমি শুধু তাকে আমার ঘরে আশ্রয় দিয়েছি।আর কলেজের ঘটনাটা একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিলো।আপনি ভালো করেই জানেন কিছুদিন আগেই মাহতাব খান না বুঝেই ওই মেয়ের উপর অ্যাটাক করায়।আমি চাইনি দ্বিতীয়বার তা হোক।কিন্তু আপনাদের মতো কুকুর লেগেই থাকে আমার পিছনে কখন হাড্ডি ছুঁড়ে দিবো আমি আর তা গিলবেন।”
এনাম খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলো।রসালো গলায় বললেন–
“তা আপনি ভুল বলেন নি নায়ক সাহেব।আপনার শশুর কিন্তু আগামী সপ্তাহেই ফিরছে।অবশ্য মেয়েটাকে বের করে ভালোই করেছেন।বেঁচে গেলো।কিন্তু আমার কাজটাও একটু করে দিলে ভালো হতো।আমি তো বলেছি শুধু ক্রপ করে আপনার চেহারাটা বসাবো।কিন্তু আপনিই তো….।”
এনাম কথা শেষ করার আগেই মাহাদ সেন্টার টেবিল থেকে একটা কাঁটা চামচ তুলে তড়িৎ বেগে গিয়ে এনাম এর গলার সামনে ধরে।ক্ষীপ্ত গলায় বললো—
“আরেকবার যদি এই নিয়ে আমার কাছে আছিস এইটা তোর গলায় আমি ঢুকিয়ে দিবো।তখন দেখবি ওয়েব সিরিজ কাকে বলে!শালা,এক পা কবরে তাও তোর শরীরের ধার কমেনা।আর কী বললি আমার শশুর! ওই মাহতাব খান কে বলবি তার যাকে ইচ্ছে মেরে ফেলুক।আই ডোন্ট কেয়ার।কিন্তু তুই যদি দ্বিতীয় বার এইসব নিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে আছিস তাহলে কিন্তু তোকে আমি ছাড়বোনা।মনে রাখিস।”
কাঁটা চামচ টা ছুঁড়ে ফেলে নিজের জায়গায় শান্ত হয়ে আবার বসে মাহাদ।এনাম যেনো তার প্রাণ ফিরে পায়।ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে।তার চোখের মনি উল্টে গিয়েছিলো প্রায়।আর এক মুহূর্তও সেখানে বসলেন না তিনি।হুরহুর করে দৌঁড় লাগালেন দরজার দিকে।
মাহাদ অস্ফুট গলায় বললো–
“শালা পার্ভাট।”
চলবে,,,