#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ৩২
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি
বিছানার উপর হাঁটু ভাঁজ করে তার উপর চিবুক রেখে বসে আছে আম্বের।নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফাইরুজার দিকে।গত একমাসে মেয়েটা তাকে এতোটা আপন করে নিবে ভাবেনি।
ফাহাদ আর ওলিজা তটস্থ হয়ে আছে কখন ফাহাদ এর বাবা ফিরবে আর আম্বের আর ফাহাদ এর বিয়ে হবে।সারাদিনের মেন্টাল টর্চার এর মধ্যে আম্বের এর এই এক টুকরো সুখ ফাইরুজা।যতক্ষন ফাইরুজা তার পাশে থাকে আম্বের এর মনে হয় সব ঝামেলা এক নিমিষেই শেষ করতে পারবে।আম্বের এর পায়ে অতি মনোযোগ সহকারে নেইলপলিশ লাগিয়ে দিচ্ছে ফাইরুজা।সারাক্ষন সাজিয়ে গুঁছিয়ে একদম পুতুল বানিয়ে রাখে আম্বের কে।সারাদিনের এই উপচে পড়া ভালোবাসায় সবকিছু স্বাভাবিক হলেও রাতটা কাটে বিষন্নতায়।এখনো চোখ বন্ধ করলেই মাহাদ এর চেহারা ভেসে উঠে আম্বের এই অক্ষিযুগলের আরশিতে।এতো ভালোবাসা,এতো বিশ্বাস,এতো ভরসা সব কী মিথ্যে ছিলো!
নাকি অনেক কিছুই দৃষ্টির অগোচরে!
আম্বের কে চুপ করে থাকতে দেখে ফাইরুজা উদ্বিগ্ন গলায় বললো—
“কী হয়েছে ডল!
মন খারাপ?
আম্বের মাথা ঝাঁকিয়ে না বোধক সম্মতি দেয়।ঠোঁটে ফুটে বিরস হাসি।
অনেকটা ঝুঁকে আম্বের এর পায়ে নেইলপলিশ দিচ্ছিলো ফাইরুজা।আম্বের এর লেপ্টানো মুখ দেখে সোজা হয়ে বসে ধীর গলায় বললো–
“কালার ভালো লাগছে না?
অন্যটা দিবো?
আম্বের ব্যস্ত গলায় বললো–
“আরে না না।তেমন….।”
আচমকা আম্বের চোখ মুখ কুঁচকে তার মুখ চেপে ধরে।ওয়াশরুম গিয়ে গরগর করে বমি করতে থাকে।ফাইরুজা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।ওয়াশরুম এর আওয়াজ স্পষ্ট বাজছে তার কানে।বিচলিত হয়ে উঠে ফাইরুজা।একজন গাইনোকলোজিষ্ট হওয়ায় তার সন্দেহ যেদিকে যাচ্ছে তা একদম ঠিক নয় আম্বের এর জন্য।অনেকদিন ধরেই আম্বের কে সে খেয়াল করছে।খাবারে অনীহা,স্মেলিং সমস্যা,আর হুটহাট বমি তো আছেই।
ওয়াশরুম থেকে ক্লান্ত,শ্রান্ত হয়ে ফিরে আম্বের।বিছানায় বসে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয়।ওড়না দিয়ে মুখ মুছে ফাইরুজার দিকে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকায় আম্বের।ফাইরুজা গম্ভীর গলায় বললো—
“কী সমস্যা তোমার?
আম্বের স্বাভাবিক গলায় বললো—
“আর বলোনা,কয়েকদিন ধরে শরীরটা ভালো লাগছে না।কেমন ক্লান্তু লাগছে।”
ফাইরুজা গাঢ় চাহনি আবদ্ধ করে আম্বের এর দিকে।আম্বের এর হাত ধরে তার পালস্ চেক করে হকচকিয়ে উঠে ফাইরুজা।”
ত্রস্ত গলায় বললো—
“এই মাসে তোমার পিরিওড মিস হয়েছে?
আম্বের সপ্রতিভ হয়।শান্ত ভঙিতে বললো—
“হু।”
ফাইরুজা জ্বলে উঠে বললো–
“আগে কেন বলোনি আমাকে?
সত্যি করে বলোতো তুমি আর মাহাদ কখনো ইন্টিমেট হয়েছিলে নাকি?
ফাইরুজার কথায় আম্বের এর নিঃশ্বাস ভারি হতে থাকে।দুহাতে নিজের জামা খাঁমচে ধরে সে।টলমল করে উঠে চোখ।আম্বের এর আগেই সন্দেহ হয়েছিলো এমন কিছু একটা।কাঁপন শুরু হয় সারা শরীরে।অদ্ভুত গোঙানির আওয়াজ বের হয়ে আসে আম্বের এর গলা থেকে।
ফাইরুজা কপট রাগ দেখিয়ে বললো–
“এই মেয়ে কথা বলছো না কেন?
আম্বের ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।শশব্যস্ত হয়ে ফাইরুজা আম্বের এর মুখ চেপে ধরে।নিচু স্বরে বললো—
“চুপ,চুপ।মামি আর ফাহাদ নিচেই আছে।যদি একবার শুনতে পায় খবর আছে।”
ফাইরুজা আম্বের এর চোখ মুছে দেয়।শক্ত গলায় বললো—
“কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।আমি দেখছি।”
আম্বের কোনো কথা বললো না।পাথরের মতো চুপ করে বসে রইলো।
ফাইরুজা তার ঘরে এসেই কল করে মাহাদ কে।কল রিসিভ করতেই ইচ্ছে মতো ঝাঁড়তে থাকে।মাহাদ চুপ করে রইলো।ক্ষেপা গলায় ফাইরুজা বললো–
“আর ইউ ক্র্যাজি?
মাহাদ শান্ত গলায় বললো—
“নো।আই এম গোয়িং টু বি এ ফাদার।”
ফাইরুজা বিস্মিত গলায় বললো–
“তার মানে তুমি জানতে?
“বাবা হবো আর নিজে জানবো না।”
ফাইরুজা শীতল গলায় বললো—
“মেয়েটা ভয় পেয়ে আছে।”
“আই নো।আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো।তুমি এখনই তার কাছে যাবে।সে আমার কাছে আসতে চাইবে।তুমি…।”
মাহাদ কে কথার মাঝখানে ব্রেক ধরিয়ে ফাইরুজা বললো—
“তুমি কী করে জানো আম্বের তোমার কাছে যেতে চাইব!
স্মিত হাসে মাহাদ।ওপাশ থেকে ফাইরুজার তা বুঝতে কষ্ট হলো না।ধীর গলায় মাহাদ বললো–
“আমার সত্তা সে।
আমার প্রাণ।তাকে আমার চেয়ে ভালো কে জানবে!
এখন শোনো আমি যা বলি।তাকে নিয়ে হসপিটাল যাবে।আমি টেক্সট এ ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।মিসেস শেখ আর ফাহাদ কে বলবে তাকে শপিং করাতে নিয়ে যাচ্ছো।”
ফাইরুজা ঠাট্টামিশ্রিত গলায় বললো—
“হা হা হা।এই সন্ধ্যেবেলায় ওকে আমি শপিং এ নিয়ে যাবো আর তা বিশ্বাস করবে তোমার মা আর ভাই।”
মাহাদ নিঃশব্দে হাসে।শান্ত গলায় বললো—
“জানি বিশ্বাস করবে না।আর এও জানি আসতেও দিতে চাইবে না।কিন্তু তুমি তাকে হসপিটালে নিয়ে আসবেই।আর তার প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাবে।”
ফাইরুজা গাঢ় গলায় উৎসুক হয়ে বললো—
“মাহাদ!
তুমি কী চাইছো বলোতো?
“আমি আমার প্রাণ কে ফিরে পেতে চাই।আমার ভালোবাসার সুগন্ধি প্রজাপতি।আমার প্রজাপতি বউ।”
প্রসন্ন হাসে মাহাদ।এই পাশ থেকে শীতল নিঃশ্বাস ফেলে ফাইরুজা।থমথমে গলায় বললো—
“এতো ভালোবাসো মেয়েটাকে,তবুও নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলে!আর কী জঘন্য একটা চিত্র তৈরি করছো তোমার তার মনে।”
মাহাদ হতাশ গলায় বললো—
“কী করবো বলো!তোমার ওই শাখচুন্নি মামি,বক রাক্ষস ভাই আর ওই বিকট দৈত্য মাহতাব খান থেকে আমার ছোট্ট প্রজাপতিকে বাঁচানোর জন্যই এইসব করেছি।
আমি তো বুঝিনা এদের কী কোনো কাজ নেই!সেই ঘুরে ফিরে আমার পেছনেই লাগতে আসে।”
হি হি করে হেসে উঠে ফাইরুজা।মাহাদ গম্ভীর গলায় বললো—
“এতো হেসোনা।আমার বউকে একা রেখে আসছো কেন!
যাও তার কাছে।”
ফাইরুজা স্মিত হেসে ফিচেল গলায় বললো–
“বাব্বাহ!
ভালোবাসার সমুদ্রে দেখি জোয়ার শুরু হয়েছে!
“তা আর বলতে।আমার প্রজাপতি কে কতোদিন কাছে পাই না।
এইবার সময় হয়েছে তাকে জোয়ারের উত্তাল ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার।”
“হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে।আমি যাচ্ছি।”
মাহাদ মৃদু হেসে বললো—
“ওকে ডিয়ার বইনা।ভাবির খেয়াল রাখার জন্য আপনার এই ভাই সারাজীবন আপনার কাছে ঋনী।যখনই মনে হবে এই অধম ভাই আপনার কোনো কাজে আসবে একবার আওয়াজ দিবেন।”
ফাইরুজা কপট আর্তনাদ করে বললো–
“হায়!
দিলেতো বোন ডেকে আমার সর্বনাশ করে।ভাবলাম তোমার সাথে একটা রোমান্টিক ফিল্ম করবো।বোন ডেকে দিলো তো আমার রোমান্সের সত্যানাশ করে।”
আওয়াজ করে হেসে উঠে মাহাদ।তার মন জুড়ে বইছে স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া।তার মনে ফোটা ভালোবাসার চির যৌবনা বসন্তের ফুলে উড়ে বেড়ানোর জন্য তার প্রজাপতি কে যে আসতেই হবে।
,
,
,
চেম্বারে বসে আছে ফাইরুজা।আগ্নেত্রীর চেম্বারে এসেছে আম্বের কে নিয়ে ফাইরুজা।মাহাদ ঠিকানা দিয়েছে।প্রায় আধাঘন্টা পর রিপোর্ট নিয়ে আসে একজন নার্স।যাতে স্পষ্ট যে আম্বের কনসিভ করেছে।নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেলে আম্বের।এখন কী করবে সে!
মাহাদ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।ফাহাদ উন্মাদ হয়ে আছে তাকে বিয়ে করার জন্য।তাহলে তার অনাগত সন্তান!তার কী হবে!
বুক ভারি হয়ে আসে আম্বের এর।ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে থাকে।কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে ঘিরে ধরছে তার শ্বাসনালি।কেন তার সাথেই এমন হলো!কেন তার সন্তানের জীবনও তার মতোই হলো।মায়ের ভালোবাসা কখনো পায়নি আম্বের।বাবার ভালোবাসাও ছিলো অমাবস্যার চাঁদের মতো।নির্দিষ্ট সময় ছাড়া জুটতো না কপালে।আজ তার সন্তানের সাথে এমনটা হতে চলেছে।তবে দোষ কার?
শুধুই তার!ভালোবাসার মানুষকে বিশ্বাস করে সে ভুল করেছে আর তার মাসুল তার সন্তান কে দিতে হবে।জারজ বলবে সবাই তার সন্তানকে।হুমড়ি খেয়ে কেঁদে উঠে আম্বের।এমন জীবন সে কখনো চায় নি।
আম্বের কে কোনো কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না।সমস্ত নিঃশব্দতা,অপারগতা পেছনে ফেলে অনাগত সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর অন্ধকার ভুবন ঝেঁকে ধরেছে আম্বের কে।
তড়িঘড়ি করে চেম্বার এ ঢুকে ফাহাদ।অগ্নি বিস্ফোরিত হচ্ছে তার চোখ দিয়ে।কিড়মিড় করে বললো—
“কি হচ্ছে এখানে?
ফাহাদ এর কথায় চকিতে ফিরে তাকায় সবাই।আগ্নেত্রী তপ্ত গলায় বললো—
“এইসব কী ধরনের অসভ্যতা!পারমিশন না নিয়ে ভেতরে এলেন কেন আপনি?
ফাহাদ এর পেছনেই এসে দাঁড়ায় ওলিজা।চোয়াল শক্ত করে ক্ষীপ্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে সে।ফাহাদ আগ্নেত্রীর কথার তোয়াক্কা না আম্বের কে টেনে নিজের সামনে এনে কঠিন গলায় বললো—
“এইসব কী হচ্ছে আম্বের??
আম্বের এর শরীর থরথর করে কাঁপছে।ফাহাদ যদি জানতে পারে তার সন্তানের কথা!
তিরতির করে অনুরণিত ওষ্ঠাধর ছড়িয়ে আম্বের কিছু বলবে তার আগেই ঝাঁঝিয়ে উঠে ওলিজা বললো—
“আরে এই মেয়ে বিন বিয়াতে মা হতে চলেছে।ছিঃ!ছিঃ!
ফাহাদ বিস্মিত গলায় বললো—
“আম্বের!
আম্বের কাঁপতে কাঁপতে তার অধর জোড়া ছড়িয়ে শ্বাস নিতে নিতে ঘন ঘন অর্ধ শ্বাস ফেলতে থাকে।ফাইরুজা হেঁচকা টানে আম্বের কে ছাড়িয়ে নেয় ফাহাদ এর কাছ থেকে।গমগমে গলায় বললো—
“হ্যাঁ।আম্বের মা হতে চলেছে।মাহাদ এর সন্তানের মা।
ডু ইউ এনি প্রবলেম?
“হোয়াট দ্যা **?কী বলতে চাস তুই?
“মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ ফাহাদ।”
ফাহাদ রুষ্ট গলায় বললো—
“ল্যাংগুয়েজ মাই ফুট!ওকে আমি…।”
ফাইরুজা আম্বের এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো—-
“একদম ওকে হাত লাগাবি না।”
রাগে ফুঁসতে থাকে ফাহাদ।ইচ্ছে করছে নিজের মাথা নিজেই ফাটিয়ে ফেলে।এতোবড় ধোঁকা সে কিছুতেই মানতে পারছে না।মস্তিষ্কের নিউরণ গুলো বেপরোয়া গতি বাড়াতে থাকে।পাশ থেকে ওলিজা দাম্ভিক গলায় বলে উঠেন—
“ভালো হয়েছে এখনো বিয়েটা হয়নি।বিয়ে হলে কী হতো একবার ভেবে দেখেছিস!
ফাহাদ জ্বলন্ত কয়লার মতো ছ্যাত করে উঠে বললো—
“জাস্ট শাট আপ মা।ওকে আমি বিয়ে করবোই।কার বাচ্চা ওর পেটে আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।”
ওলিজা অবাক গলায় বললো—
“এইসব কী বলছিস তুই!
“ঠিক ই বলছি।আমি ওকেই বিয়ে করবো আর আজই।”
ভয়ে আঁতকে উঠে আম্বের।রুদ্ধশ্বাসে বললো—
“নাহ।আমি কখনও তোমাকে বিয়ে করবো না।আমি মাহাদ কে ভালোবাসি।”
চিৎকার করে উঠে ফাহাদ,বললো–
“আম্বের!
ফাইরুজা দাম্ভিক হেসে বললো—
“আম্বের ঠিক ই বলেছে।আর তুমি এমনিতেও আম্বের কে বিয়ে করতে পারবে না।গর্ভবতী মেয়েদের বিয়ের নিয়ম নেই হাদিসে।”
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে ফাহাদ।শক্ত গলায় বললো—
“তাহলে আর কী!
এবোর্শন করাবো ওর।”
আম্বের ফুঁসলে উঠে শক্ত গলায় বললো—
“নাহ।আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি আমি হতে দিবো না।আর একবার যদি আমার সন্তান কে মারার কথা বলো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
ফাহাদ হা হা করে হেসে উঠে।বিদ্রুপপূর্ণ গলায় বললো—
“কী করবে তুমি?
মাহাদ তোমাকে ফিরিয়ে নিবে না।”
ফাইরুজা কে ধাক্কা মেরে সরিয়ে আম্বের এর হাত শক্ত করে ধরে ফাহাদ।হিসহিসিয়ে বললো—
“কে বাঁচাবে তোমার সন্তানকে?
ওর বাবা তো আসবে না।কী করবে তুমি?ওকে তো মরতেই হবে।”
আর্দ্র গলায় অস্ফুটভাবে আম্বের বললো—-
“নাহ।নাহ।”
আম্বের এর হাত ধরে টানতেই এক ধাক্কা এসে লাগে ফাহাদ এর গায়ে।ফাহাদ ছিঁটকে গিয়ে পড়ে আগ্নেত্রীর টেবিলের উপর।সোজা হয়ে হতবম্ভ হয়ে তাকিয়ে থাকে সে।
কাঁপা কাঁপা গলায় বললো–
“তততুইইই?
চলবে,,,