#বলবো_বলবো_করে_বলা_হয়নি
#পর্ব_০৪
#অনন্যা_অসমি
ফুল সজ্জিত পালঙ্কে বসে সামনে থাকা বড় আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে তটিনী। বঁধুসাজে তাকে বেশ দারুণ লাগছে।
” এই পাগলটা এখনো আসছে না কেন? এতো ভারী ভারী গহনা, লেহেঙ্গা নিয়ে বসে থাকতে থাকতে আমার কোমড় ব্যথা করছে।”
আবারো আয়নায় তাকিয়ে নানারকম ঢং করতে লাগত তটিনী। ইতিউতি করতে করতে অবশেষে দীর্ঘ দু’মাস পর আজ তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। যদিও বা তটিনী মাধুর্যকে বিয়ে করতে শুরু থেকেই একপাশে খাড়া ছিল তবে তা কাউকে ঘূণাক্ষরেও টের পেতে দেয়নি। তার ভাবখানা এমন ছিল সে তেমন একটা রাজি নয় তবে বাবা-মায়ের কারণে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। সে চাইনা প্রথমেই নিজের অনুভূতির কথা জানান দিতে। সে লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবেসে যাবে তবে মাধুর্য যতদিন না নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবে ততদিন সেও নিজের অনুভূতি আড়ালে রাখবে।
দরজা খোলার শব্দে দ্রুত ঠিক হয়ে বসল তটিনী। লম্বা করে রাখা দুপাট্টার আড়ালে মুগ্ধ নয়নে মাধুর্যকে পর্যবেক্ষণ করল। বরবেশে তাকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল তটিনী৷ বিরবির করে বলল, ” এই বরবেশে থাকা সুর্দশণ পুরুষটি আজ থেকে শুধু আমার। এই মানুষটা এখন আমার জীবনের একটা অংশ, আমার স্বামী। ও মাই খোদা! আমার তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না মাধুর্য আমার স্বামী!”
” বিরবির করা শেষ হলে এটা ঘোমটা সরাতে পারি?”
নিজের সম্মুখে হঠাৎ মাধুর্যের উপস্থিত বুঝতে পেরে ঘাবড়ে গেলো তটিনী৷ বড় একটা শ্বাস টেনে বুকে হাত দিয়ে বলল,
” আপনি কোনো ভুতের বংশধর নাকি? হুটহাট কোথা থেকে উদয় হন?”
” আমি ভুতের বংশধর৷ তোমার সমস্যা, তুমি সবসময় নিজে নিজেই চিন্তায় মগ্ন থাকো৷ তখন স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও ভীতুদের মতে কেঁপে উঠো।”
তটিনী খেয়াল করল মাধুর্য তাকে “তুমি” বলে সম্বোধন করেছে। লাজুক হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটের কোণে।
” আপনার ভাবনার সমাপ্তি হলে কি এবার ঘোমটা সরাতে পারি? নাকি আপনি সরাবেন?”
হাত গুটিয়ে ফেলল তটিনী। মাধুর্য তার ইশারা বুঝে মুচকি হেসে ঘোমটা আলতো হাতে সরিয়ে দিল। বঁধুসাজে তটিনীকে দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল। সে নিজেও জানেনা এই মেয়েটার মাঝে কি এমন আছে যা তাকে এতো টানে।
” আপনার দেখা হয়ে গেলে এবার কি আমি উঠতে পারি? এক জায়গায় এতোটা লম্বা সময় ধরে বসে থাকতে থাকতে এবার আমার পা অবশ হয়ে যাচ্ছে।”
ধ্যান ভাঙল মাধুর্যের, অপ্রস্তত হয়ে পড়ল সে।
” দুঃখিত আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। যাও তুমি জামা কাপড় পরিবর্তন করে এসো।”
বিছানা থেকে নামতে তার কষ্ট হচ্ছে দেখে মাধুর্য তাকে সাহায্য করল। সাথে আনা লাগেজের চেইন খুলে একটা কাপড় নেবে তখন মাধুর্য বলল,
” বেশি ভারী কিছু পড়ার প্রয়োজন নেই। যেহেতু এখানে আমরা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই তাই শাড়ি পড়ার দরকার নেই এখন। আপাতত তোমার পছন্দ অনুযায়ী কোন থ্রি-পিস বা কুর্তি পড়ো, তাহলে সাচ্ছন্দ্যে ঘুমাতে পারবে।”
মুচকি হেসে একটা বেগুনি রঙের থ্রি-পিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল তটিনীর। আড়মোড়া হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখল সকাল থেকে আরো অনেকখানি সময় বাকি আছে। পাশে ঘুমিয়ে থাকা মাধুর্যের দিকে তাকাল সে৷ একটা হাত মাথার নিচে রেখে অন্যহাতে আলতো করে তার চুলগুলো স্পর্শ করল।
” নামের মতো চেহারায়ও তার মাধুর্যতা মিশে আছে, ইশ… কত স্নিগ্ধ লাগছে। আমার জীবনে যে তোমার আগমনই নির্ধারিত আছে এটা যদি সেসময় জানতাম তাহলে এতোটা চোখের জল বির্সজন দিতাম না। কিন্তু নাম মাধুর্য হলে কি হবে? কথাতে কোন রুপ মাধুর্যতা নেই, সব করলার মতো তিতা।” বলতে বলতে তার চোখ মুখ কুঁচকে এলো। মানসপটে ভেসে উঠল ঘুমতে যাওয়ার কিছু সময় পূর্বের ঘটনা।
বিছানার ধারে বসে আস্তে আস্তে পা নাড়িয়ে মাধুর্যের অপেক্ষা করছিল তটিনী৷ সাথে মস্তিষ্ক সাজিয়ে চলেছে নানা ধরণের কল্পনা। তার ভাবনার মাঝেই মাধুর্য বেরিয়ে এলো। ভেজা টাওয়ালটা কাঠের চেয়ারের হাতলে সুন্দর করে মেলে দিল। তটিনী ভাবল এবার হয়ত কিছু বলবে, নড়েচড়ে বসল সে। কিন্তু মাধুর্য কোন কথা না বলে চুপ বালিশ কাঁথা নিয়ে এক কদম সামনে যেতেই তটিনী বুঝল তার পরবর্তী পদক্ষেপ৷ ভ্রু-কুচকে এলো তার। ভাবল, ” আমি তো কিছুই বললাম না। এই কাজ করার জন্য আমার বলার কথা কিন্তু আমি তো এরকম কোন ইঙ্গিতই দেয়নি। একে মাথায় আবার কোন শয়তানে নাড়া দিয়েছে?”
চট করে নিজের জায়গা পরবর্তী করে বিছানা থেকে সোফায় গিয়ে বসল তটিনী। মাধুর্য শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল৷ তটিনী ভ্রু-নাচিয়ে ইশরা করল।
” এরকম বিশ্রিভাবে ভ্রু-নাচ করছ কেন? তোমার নতুন ট্যাল্টেট নাকি? গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম দেওয়ার শখ জেগেছে নাকি? জাগলে বলো ভিডিও করে পাঠিয়ে দি তবে তার আগে তোমাকে সুন্দর করে, কায়দা করে ভ্রু-নাচ আয়ত্ত করতে হবে। এরকম ব্যাঙের মতো নাচালে কেউ ফিরেও তাকাবেনা।”
মাধুর্যের এতো আজগুবি কথা শুনে বিরক্ত ছেঁয়ে গেল তটিনীর সারা মুখশ্রীতে।
” এই ছেলেটাকে নাকি আমি পছন্দ করতাম! বর্তমানে নাকি আমার স্বামী! কত ভয়ানক ব্যাপার! ভেবেছিলাম অনেক গম্ভীর, রুডি হবে। দশটা কথার একটা সোজা জবাব দিবে কিন্তু এতো দেখি আমার কল্পনারও বাইরে। কি ফালতু জোকস বলে সাথে ইলজিক্যাল কথাবার্তা।” বিরক্ত নিয়ে কথাগুলো মনে মনে আওড়ানোর পর মাধুর্যের দিকে তাকাল সে। তাকে আরেকবার পর্যবেক্ষণ করে প্রশ্ন করল,
” তলপিতলপা বেঁধে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? এই রাত বিরেতে নিশ্চয়ই ছাদে ঘুমাতে যাবেন না।”
” আরে ছাদে যাবো কেন? মশার কামড় খেয়ে রোগ বাঁধার শখ আমার নেই, মাত্র বিয়ে করেছি। এখনো তো বিবাহিত জীবনের সুখই উপভোগ করতে পারিনি।”
” বাজে কথা বন্ধ করে যেটা জিজ্ঞেস করেছি তার উওর দিন তো।”
এবার মাধুর্যও সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, ” এই রাতে মানুষ কি করে তুমি জানো না? ঘুমাতে যাচ্ছি, সোফা থেকে সরো।”
” কেন? খাটটা কি চোখে পড়ে না? এতোদিন কি সোফায় থাকতেন নাকি আপনার খাটের ধারণ ক্ষমতা কম যে দু’জন থাকলে ভেঙে যাবে।”
” আমার খাটের ধারণ ক্ষমতা অনেক। একটা আস্ত হাতি এসে বসলেও কিছু হবে না।”
” তাহলে কি সমস্যা?”
” সমস্যা আমার না। সমস্যা অন্য একজনের। যদিও বা বিছানাটা আমার তাও আমি যদি তার সাথে বেড শেয়ার করি তখন দেখা যাবে আমাকে ধাক্কাটাক্কা দিয়ে হয়তো বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছে। কারণ সে তো আবার আমার সম্পর্কে জানেনা, দ্বিধায় আছে আমাকে নিয়ে। আমি আবার এতোটাও নির্দয় নয়। তাই আরকি নিজে থেকেই সরে যাচ্ছিলাম।”
মাধুর্যের মিষ্টি মিষ্টি কথায় আকারে ইঙ্গিতে দেওয়া খোঁটা তটিনী বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে। সোফা ছেড়ে উঠে বিছানার দিকে যেতে যেতে দাঁত চেপে বলল, ” কেউ যদি নিজেকে বাংলা সিনেমার নায়িকা মনে করে তবে সে নিজ ইচ্ছায় অন্য কোথাও থাকতে পারে। তখন আমারই লাভ, এই বড় সাইজের বেডে একা আরাম করে থাকতে পারব।” বলে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়ল তটিনী।
বালিশ – কাঁথা নিয়ে দাঁড়িয়ে মাধুর্য নিজেকেই প্রশ্ন করল, ” ও কি আমাকে বাংলা সিনেমার নায়িকা বলল?”
তটিনী চোখ বন্ধ করেই আবারো বলল, ” এভাবে কাঁথা বালিশ নিয়ে অসহায় শিশুর মতো দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে আসুন। লাইট বন্ধ করবেন না, আমার ভয় লাগে। দ্রুত বিছানায় আসুন, আমার মাথা গরম হয়ে গেলে বিছানায় তো থাকতে দেবই না সাথে সোফাও পানি ঢেলে ভিজিয়ে দেব। তখন অসহায় নায়িকাদের মতো নিচে ছেঁড়া কাঁথা বিছিয়ে থাকবেন।”
তটিনীর শান্তে কন্ঠে ধমক শুনে বিছানা এসে শুয়ে পড়ল মাধুর্য। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” আপনা টাইম বি আইয়ে গা।”
চলবে….