#বলবো_বলবো_করে_বলা_হয়নি
#পর্ব_০৫
#অনন্যা_অসমি
সবাইকে খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত তটিনী। মাধুর্য প্লেটে খাবার নিয়ে তটিনীর দিকে তাকিয়ে আছে। শাড়ি পরিহিত মাথায় ঘোমটা দেওয়া তটিনীকে দেখে সে স্তব্ধ হয়ে গেল, সে চেয়েও চোখ ফেরাতে পারছেনা। পেটে হালকা ব্যথা অনুভব হওয়ার পর মাধুর্য পাশ ফিরে দেখলে তার কাজিন মিটিমিটি হাসছে, বাকিদের দিকে তাকাতেই বাকি কাজিনরা চোখ দিয়ে নানান ইশারা করছে। অপ্রস্তত হয়ে পড়ল সে, দ্রুত মাথা নিচু করে খেতে লাগল।
তাড়াহুড়ো করে হাঁটার কারণে অসাবধানতাবশত শাড়ির আঁচলের সাথে পা পেঁচিয়ে পড়ে যেতে নিলে মাধুর্য তার হাত টেনে ধরল। কি হয়েছে তা ভালোমতো বোঝার আগে তাকে টেনে সোজা করে দাঁড়া করিয়ে দিল মাধুর্য। তটিনী ড্যাবড্যাব করে তার মুখপানে তাকিয়ে রইল।
” এভাবে ছুটছ কেন? কেউ তাড়া করছে নাকি? শাড়ি পড়ে কেউ এভাবে ছোটাছুটি করে?”
তটিনী কিছু না বলে এখনো তাকিয়ে আছে দেখে মাধুর্য তার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বলল,
” সাবধানে চলাফেরা করবে। হাত পা ভেঙে বসে থাকলে তখন তোমার পরিবার মনে করবে আমরা তোমার যত্ন নিচ্ছিনা, আমরা তোমার প্রতি মনোযোগী না।”
সে চলে যেতেই তটিনী নিজের সেই হাতটার দিকে তাকাল যা কিছুক্ষণ আগে মাধুর্য ধরেছিল। সেই জায়গায় স্পর্শ করে বলল, ” আ… কি রোমান্টিক। একেবারে রোমান্টিক সিনেমার দৃশ্য। শাড়িটাও পায়ের সাথে একেবারে সঠিক সময় পেঁচিয়েছিল। এতো তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল কেন? আরো কিছুসময় হাতটা ধরে রাখলে কি হতো?”
পরমুহূর্তেই নিজের বাচ্চামো ধরণের কথা শুনে তটিনী জিভ কাটল। গালে হালকা চাপড় দিয়ে নিজেই নিজেকে দমক দিয়ে করে বলল,
” তটিনী তুমি এখন আর কলেজ পড়ুয়া মেয়ে নেয়। যতই সে তোমার এককালের পছন্দের মানুষ হোক না কেন তুমি এখন যুবতী, বিবাহিত। এসব বাচ্চামো তোমার সাথে মানানসই নই একদম। তার চেয়েও বড় কথা তার সামনে তোমার দুর্বলতা প্রকাশ করা যাবে না। নো নেভার।”
এসব বলে নিজেকে সাময়িক সময়ের জন্য বুঝ দিলেও না চাইতেও সময়ে অসময়ে তার সেই কলেজ পড়ুয়া কিশোরীর সত্তা বেরিয়ে আসবেই।
.
.
ট্রেন চলছে নিজের গতিতে। জানালার পাশে মাথা ঠেকিয়ে মুখের সামনে বই ধরে আছে তটিনী। আজ তারা দু’জনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। চাকরির সূত্রে মাধুর্য সেখানেই একটা ফ্ল্যাটে থাকে। তটিনীর বিপরীত দিকে বসে ফোন চালাচ্ছে মাধুর্য। তটিনী বই নিয়ে বসে থাকলেও সে বই পড়ছে কম আঁড়চোখে মাধুর্যকে বারবার পরখ করছে বেশি। পুনরায় আবারো তাকাল সে।
” উফ… ব্রাউন কালারেও যে কাউকে এতোটা সুর্দশন লাগতে পারে একে না দেখলে বুঝতেও পারতাম না। এতো সুন্দর কেন এই ছেলে? আমি ওর বিবাহিত স্ত্রী হওয়ার স্বত্বেও যেভাবে নজর দিয়ে চলেছি না জানি অন্য মেয়েরা আরো কত নজর দেয়। বাবুদের মতো কালো কাজল লাগিয়ে দিতে হবে যেন কারো নজর না লাগে।” কথাগুলো বিরবির করতে করতে ব্লাশ করতে লাগল তটিনী। বইয়ের আড়ালে নিজের মুখ আড়াল করল সে। তার এই ব্যবহার মাধুর্যের নজর এড়িয়ে গেল না।
” এরকম করছ কেন? এমনও তো না যে কোন রোমান্টিক উপন্যাস পড়ছ। পড়ছ তো হরর থ্রিলার তাও এতো ব্লাশ করছ কেন? বইয়ের পাতা কি অন্য কোন বইয়ের সাথে পরবর্তী হয়ে গিয়েছে নাকি?”
বিব্রতবোধ করল তটিনী। সোজা হয়ে বসল, চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
” আমার বই আমার ইচ্ছে আমি তা পড়ে কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখব। আপনার কি?”
” আমার অনেক কিছু। চট্টগ্রামে আমি একা থাকি। তোমার উপর আবার কিছু ভর করলে তো সমস্যা। তোমার যা অদ্ভুত ব্যবহার দেখছি। যদি আমার অনুমান সত্যি হয় তখন তুমি রাত বিরেতে আমার উপর চওড়াও হলে তো আমাকে কেউ বাঁচাতে আসবে না। ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে।”
” আমার মতো মনে হচ্ছে আপনার উপর কিছু ভর করেছে। তাই তো সবসময় এতো বাজে কথা বলেন। এখন তো আমার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে দ্বিধা সৃষ্টি হচ্ছে।” বলে ভেঙচি কেটে অন্যদিকে ফিরে আবারো বইয়ের চোখ রাখল সে।
.
.
তাদের নতুন বাসায় আসার আজ দ্বিতীয় দিন। চার রুমের একটা মাঝারি সাইজের ফ্ল্যাট এটি। রাতে ঘুমানোর জন্য বিছানা ঠিক করছে তটিনী, মাধুর্যে পাশে থাকা চেয়ারে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। মাধুর্য ল্যাপটপটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নেবে সেই মূহুর্তে পুরো রুমে অন্ধকার ছেঁয়ে গেল।
” ও মাগো…..” পুরো রুম তটিনীর চিৎকারে ভরে উঠল। নিজের কোলের উপর ভর অনুভব করল মাধুর্য, বুঝতে বাকি নেই কি হয়েছে। হতাশা ভরা নিঃশ্বাস নিল সে। বিরবির করে বলল,
” এতো বড় মেয়েও নাকি ভয় পায়।”
কিছুমুহূর্ত পর নিজের হাতে জ্বালা অনুভব করল মাধুর্য। কেন এরকম অনুভব হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করছে, সময়ের সাথে সাথে জ্বালা অনুভূতিও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তার মনে হলো। একসময় আর সহ্য করতে না পেরে তটিনীকে নিজের কোল থেকে ঠেলে উঠিয়ে দিল সে। তটিনী উঠে দাঁড়াল তবে মাধুর্যের টি-শার্টের একপাশ খামচে ধরে আছে।
” এরকম বাচ্চাদের মতো ব্যবহার করছ কেন? সামান্য কারেন্টই তো গিয়েছে।”
” ও আপনি বুঝেন না। অন্ধকারে আমার খুব ভয় লাগে, দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। অন্ধকারে আমার খুব বাজে ধরণের ফোবিয়া আছে। এখন এতো কথা না বলে তাড়াতাড়ি ফোনের টর্চ জ্বালান।”
অন্ধকারে হাতড়ে ফোন খুঁজে পেল মাধুর্য। ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে তটিনীর দিকে তাকাল সে। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে মেয়েটা, চোখে মুখে এখনো আতঙ্কের ছাপ বিদ্যমান। হতাশাভরা নিঃশ্বাস নিয়ে পাশে থাকা তোয়ালেটা হাতে নিল সে। তটিনীর দিকে হাত বাড়াতে নিলে সে নিজের মুখ সরে নিয়ে প্রশ্ন করল,
” কি করছেন? তোয়ালে পেঁচিয়ে মারার চিন্তা করছেন নাকি?”
” বোকা মেয়ে নিজের অবস্থা দেখেছ? নাও তুমি নিজেই মুছে নাও।”
লজ্জা পেল তটিনী। মাথা নত করে মাধুর্যের থেকে তোয়ালেটা নিয়ে ঘাম মুছে নিল। এখনো সে মাধুর্যের টি-শার্ট খামচে ধরে আছে।
গরমে দু’জনেরই অবস্থা খারাপ। মাধুর্য হাফ সাফ করছে। পূর্বে সে একা থাকার কারণে কারেন্ট চলে গেলে গায়ে থাকা পোশাকটা খুলে ফেলত, তখন একটু হলেও অস্বস্তি কম অনুভব হতো। কিন্তু এখন তটিনী কি ভাববে এই ভেবে খুলছেনা। যতই তার স্ত্রী হোক। এখনো তাদের মাঝে অদৃশ্য দ্বিধার দেয়ালটা বিদ্যমান।
মাধুর্যের টি-শার্ট ধরে থাকতে থাকতে এবার তটিনী হাত ব্যথা করছে৷ নিজের ভেতরে থাকা ভয়ের কারণে ছাড়তেও মন সায় দিচ্ছে না। এবার আর থাকতে না পেরে বলেই বসল,
” কি ফালতু জায়গায় থাকেন আপনি। আধঘন্টা হয়ে গেল এখনো কারেন্ট এলোনা৷ ইলেক্ট্রিসিটির দায়িত্বে থাকা লোকটা কি ঘুমে পড়েছে নাকি? না বেহুশ হয়ে পড়ে আছে?”
” হতে পারে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে প্রকৃতিতে বিমোহিত হয়ে কারেন্ট দেওয়ার কথা ভুলে গিয়েছে।”
এই গরমে মাধুর্যের কথা শুনে তটিনীর হাসি তো এলো না বরং মুখশ্রীতে আরো বিরক্তি ছেঁয়ে গেল। সে পরবর্তীতে কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে সেসময়ই কারেন্ট চলে এলো। হাফ ছেঁড়ে বাঁচল তটিনী, এতো সময় পর মাধুর্যকে ছাড়ল সে। পাশ থেকে মাধুর্য হাসতে হাসতে বলল,
” মনে হয় তোমার কথা টেলিপ্যাথির মাধ্যমে শুনে নিয়েছে। তোমার উপর দয়া করে প্রাকৃতিক কাজে বিরতি দিয়ে কারেন্ট ফেরত দিয়ে গিয়েছেন।”
” রাখুন তো আপনার বাজে কথা। কিসব অশ্লীল কথাবার্তা বলছেন।”
” কিসের অশ্লীল কথাবার্তা? আমি তো অশ্লীল কথাবার্তার ‘অ’ পর্যন্ত বলিনি। কেন তুমি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দাও না।”
তটিনী রেগে চিৎকার করে বলে উঠল, ” চুপ করুন আপনি। না হলে এক্ষুনি রুম থেকে বের করে দিব।”
তার কথার ধরণ দেখে মাধুর্য উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। তার হাসির মাঝে তটিনী লক্ষ্য করল মাধুর্যের হাতের কিছু অংশ লাল হয়ে গিয়েছে। সে রাগ ছেড়ে চিন্তিত হয়ে মাধুর্যের পাশে বসল, তার হাত টেনে সামনে এনে দেখল হাতে কিছু জায়গায় চামড়া উঠে গিয়েছে। দাঁত দিয়ে জিভ কাটল সে, বুঝতে বাকি নেই হাত চেপে ধরার কারণে মাধুর্যের হাতে তার নখ গেঁথে গিয়েছিল। মাধুর্যও এতোসময় পর বুঝতে পারল তখন জ্বালা অনুভব করার কারণ। সে তটিনীকে রাগানোর জন্য বলল,
” ইশ… আমার সাধের হাতটার কি বাজে অবস্থা হয়েছে।”
লজ্জা পেল তটিনী। দ্রুত উঠে সব ড্রয়ার খুলে ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজতে লাগল কিন্তু কোনটাতেই পেল না।তার অস্থিরতা দেখে মৃদু হাসল মাধুর্য। উঠে এসে তটিনীর হাত ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে বলল,
” খুঁজে পাবে না তুমি। কোথায় কি আছে তুমি তো জানোই না, তো খুঁজে লাভ নেই। ঘুমিয়ে পড়ো।”
” কিন্তু আপনার হাতে যে লেগেছে।”
” আমি ওষুধ লাগিয়ে নেবো। তুমি শুয়ে পড়ো।”
তটিনীকে শুয়ে দিয়ে তার গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে মাধুর্য বলল, ” তুমি ঘুমাও আমি দরজা জানালা চেক করে আসছি।”
তটিনী মাধুর্যের যাওয়া দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের অজান্তে করা কাজে সে ভীষণ অনুতপ্ত।
” ইশ… কত ব্যথা পেয়েছে ছেলেটা।”
চলবে…..