#বসন্তের_ফুল🌺🌺
#তারিন_জান্নাত
#পার্ট৪২
সতেজ এবং স্নিগ্ধতায় ভরপুর সকাল।বাড়ির ভেতরে আবছা আলো প্রবেশ করে। চারপাশে পাখির কলরব।
স্পষ্টভাবে অভ্রের কর্ণ ভেদ করে পাখিদের কোলাহল।
চোখ মেলে উপরের দিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে। কিছুসময় ঝাড়বাতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। নিজের অবস্থান খেয়াল হতেই ঝাড়বাতি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসে। প্রেমা এলোমেলো ভাবে সোফায় বসে ঘুমাচ্ছে। মুচকি হাসি হাসে অভ্র। বিষণ শান্তি এবং পরিপূর্ণ হয়েছে ঘুমটা। আগে সকালে উঠার অভ্যাস ছিলো অভ্রের। রাতভর জেগে শেষ ভোরের দিকে চোখ নিভে আসতো। পরে সকালো দ্রুত উঠে যেতো।কিন্তু মাথার ভেতরে অস্বস্তি ভোগ করতো। সে তুলনায় আজ ঘুম বেশ আরামের হয়েছে।
তীব্র কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে অভ্র দাঁড়িয়ে যায়। প্রেমাকে ঠিকভাবে শুইয়ে দিয়ে ওরনাটা জড়িয়ে দেয়। কপালে চলে আসা চুল গুছিয়ে একপাশে এনে রাখে।
প্রেমার মুখের দিকে হালকা ঝুঁকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে, ‘আজ আমার জন্য
একটু কষ্ট হয়েছে না, অনেক সরি ‘ (অভ্র)
প্রেমাকে নিচে রেখে অভ্র রুমে যায়।শাওয়ারের জন্য।
হাত থেকে ফোন রাখতেই একটা মেসেজ আসে ফোনে। কপাল কুঁচকে মেসেজটা দেখে, ‘বাসায় আসতে হবে না, আমি আসছি তোর সাথে দেখা করতে।’
এইটুকু লেখা দেখে অভ্র বুঝে যায় মেসেজটা কে করেছে। অতঃপর ওয়াসরুমে ঢোকে।
আড়মোড়া ভেঙে আশেপাশে তাঁকায় প্রেমা।সে একা সোফায় বসে আছে। নিজেকে সোফায় দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয়। সোফার সাথে ঠেসে আবারও শুয়ে চোখ বন্ধ করে। তখনি গতরাতের কথা মনে যায়।অভ্র ওর কোলে শুয়েছিলো। রুমটির কথা মনে পড়লে প্রেমা দ্রুত উঠে গলির মধ্যে ঢোকে শেষের রুমটির নিকটে গিয়ে দাঁড়ায়। হতাশার শ্বাস ছাড়ে। অভ্র বোকা নয়। তার আগেই বুঝা উচিত ছিলো।
রুমটি তালাবদ্ধ দেখে ফিরে আসে প্রেমা। কিচেনের দিকে তাঁকাতেই দেখে সাইকান নাস্তা বানাচ্ছে।প্রেমা মুচকি হেসে কিচেনের এগোয়।
-নাস্তা বানাচ্ছো? (প্রেমা)
-হ্যাঁ,আপু কিছু লাগবে? (সাইকান)
-নাহ,তুমি আসলে কেন? আমিই বানাতাম।অযথা…
-আরে আপু সমস্যা নেই আমরা বেশিরভাগ সময় এখানেই থাকি। নাস্তা বানানোতে আমি বেশ অভিজ্ঞত।
-তোমরা এখানেই থাকো? কেন?(প্রেমা)
প্রেমার প্রশ্নে সাইকান চমকে তাঁকায়।জিহ্বে ছোট একটা কামড় দেয়।অভ্র ঠিকই বলে ওর নাড়িভুড়ি মেয়েদের মতোই শর্ট। ভাগ্য ভালো এ মুহুর্তে অভ্র নেই,নাহলে অভ্রের হাতের চড় ওর গালে পড়তে সময় নিতো না।
-ওই মাঝেমধ্যে ছুটির দিন মানে শুক্রবারটা এখানেই কাঁটায় আমরা।সেসময় নাস্তা রান্না আমিই করি।(সাইকান বেশ আতংকিত হয়ে জবাব দেয়)
-আচ্ছা,(প্রেমা)
প্রেমা রুমে চলে যেতেই সাইকান হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।
রুমে এসে দেখে জেরিন ফ্রেস হয়ে সাজছে। প্রেমাকে দেখে সৌজন্য হাসি দেয়। প্রেমাও হেসে ওয়াসরুমে চলে যায়।প্রেমার মাথায় এখনো গতকাল রাতের কথা গেঁথে আছে।অভ্রের ব্যপারটা সে স্বাভাবিক নিতে পারছে না।অভ্র কিছু তো লুকাচ্ছে।কিন্তু কী?
নিজমনে প্রশ্নে করে।
রুমে এসে মুখ মুছতে মুছতে নানা প্রশ্নে বিভোর হয়ে পড়ে সে। যার ফলে অভ্রের উপস্থিতি সে ঠাওর করতে পারেনি। দরজায় দাঁড়িয়ে প্রেমাকে ভালোমতন পরখ করতে শুরু করে অভ্র।
যে প্রেমার নিঃশ্বাসের বেগ শুনে মনের অবস্থা বলে দিতে পারে,সে প্রেমার চোখমুখের অবস্থা দেখে নিভৃত মনের গুঞ্জন ও শুনতে সক্ষম।
দরজার করাঘাতে কৌতূহলপূর্ণ প্রশ্নের জগৎ থেকে বের হয়। ঘাঁড় বাঁকা করতেই চোখ আঁটকে যায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটির স্নিগ্ধরুপে। এতক্ষণ অন্য ভাবনার দুনিয়ায় বিচরণ করলেও এখন শুরু হয় অভ্রের সৌন্দর্য্যের রহস্য উন্মোচনে।
আবারও শুরু হয় বুকের মধ্যাকার উতাল-পাতাল ঢেউ।
ঠোঁট টেনে হাসে প্রমা।
– ‘মে আই কাম ইন ডিয়ার’ (অভ্র)
অভ্রের কন্ঠে বলা কথা অমৃত মনে হয় প্রেমার। যেনো ক্রমশই অভ্রের মুখ দ্বারা উচ্চারিত প্রত্যেকটি কথা সে শুনে যায়। কোন নিস্তব্ধ পরিবেশে বসে।
-‘ডিয়ার’ (অভ্র)
আবারও কেঁপে অভ্রের দিকে তাকিয়ে রুমে আসার জন্য সম্মতিসূচক ইঙ্গিত করে। অভ্র মিটিমিটি হেসে এগিয়ে আসে।
-চলো,নাস্তা করবো। (অভ্র)
হাতের তাওয়ালের দিকে তাকিয়ে প্রেমা অভ্রের দিকে তাঁকায়।চুল থেকে টপটপ পানি পড়ছে।
-চুল মুছো নাই কেন?(প্রেমা)
-ইচ্ছে করে না। (অভ্র)
অভ্রের কথায় প্রেমা অভ্রের কাছে গিয়ে হাত আলগা করে চুল মুছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু অভ্রের লম্বাটে গঠনের কারনে অভ্রকে নাগাল পায়নি প্রেমা। সে এতোটাও খাঁটো নয়।কিন্তু অভ্র বেশ লম্বা। প্রেমার কান্ডে অভ্র হেসে বিছানায় বসতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে যায়। রাতে বিছানায় প্রেমা ছিলোনা জেরিন ছিলো।আর প্রেমার বিছানা হলে অভ্র অবশ্যই বসতো।
দাড়িয়ে হালকা ঝুঁকলেই প্রেমা হাসে।এরপর অভ্রের চুল মুছে দেয়। ভীষণ মিষ্টি ঘ্রাণ আসে অভ্রের চুল থেকে।স্যাম্পু করছে হয়তো তাই।
চুল মুছে তাওয়ালটা মেলে দিয়ে অভ্র আর প্রেমা নিচে চলে যায় নাস্তা করতে।
চারজনে নাস্তা সেরে নেয়।
-আমি দুপুরের আগে ফিরে আসবো,ততক্ষন পর্যন্ত তোমরা একসাথে থেকো। (অভ্র)
-কোথায় যাবে? (প্রেমা)
-বাড়িতে, (হেসে উত্তর দেয় অভ্র)
অভ্রের কথায় সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাঁকায় প্রেমা।কেন যেনো অভ্রকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনেমনে অভ্রকে অনুসরন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
অভ্র যেতেই প্রেমার কৌতূহল আরো দ্বিগুন বেড়ে যায়। সাইকান আর জেরিনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রেমাও অভ্রের পিঁছু নেয়।
বাড়ি থেকে বেড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে বড় পিচঢালা রাস্তায় এসে পৌঁছায়। এতোক্ষণ সময় অভ্র ঠের পায়নি অভ্র।
পিচঢালা রাস্তাও অভ্র হেঁটে যাচ্ছে তাই অগত্যা প্রেমাকেও হাঁটতে হচ্ছে।
অভ্র ফোনে কারো সাথে কথা বলতে বলতে অারো আধ ঘন্টা ধরে হাঁটে। প্রেমা উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে রাস্তা সমান জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটে। নিচু করে হাঁটার ফলে অভ্রের চোখে পড়েনি।
মজার ব্যপার অভ্র রাস্তা থেকে নেমে আবারও জঙ্গলের ছোট এলোমেলো রাস্তায় নেমে আসে।যার ফলে প্রেমাকে পথ বদলাতে হয়নি।সে অবস্থায় হেঁটে চলে।
আরো কিছু সময় হাঁটার পর নিচে নামতেই বড় একটা পুকুর, এবং তারপাশেই একটা বটগাছ।এবং ছায়াযুক্ত স্থান। নিচে কয়েকটা ব্যাঞ্চ বসানো।
অভ্র সেই বটগাছের দিকে যায়। আরেকটু এগোতেই একটা মেয়েকে দেখতে পাই।
অভ্রের পেঁছন পেঁছন প্রেমাও নেমে যায়। এবং অন্য একটা গাছের আড়ালে গিয়ে লুকায়।
অভ্র মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মেয়েটি হঠাৎ অভ্রকে জড়িয়ে ধরার জন্য এগোয়।
তখনি অভ্র দু’পা পিঁছিয়ে যায় এবং হাত দ্বারা ইশারা করে থামতে বলে।সাথে সাথে মেয়েটি থেমে যায়।
মেয়েটির মুখ এখনো প্রেমা দেখতে পায়নি।
কিন্তু তাতেও চোখের পানি আঁটকাতে পারেনি।
প্রেমার মনে শুধু একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।
‘ওর অভ্র ওকে ঠকাচ্ছে না তো?(প্রেমা)
________________
বিছানায় শায়িত জিহাদ রহামানের দিকে তাঁকিয়ে আছেন আয়শা আহমেদ। এই মুখেই তিনি এতোদিন হিংস্রতার চাপ দেখে এসেছেন আয়শা। আর আজ অসহায়ত্ব এবং নিষ্পাপ চাহনি।
আয়শাকে বাড়িতে না পেয়ে প্রচুড় ক্ষেপে যান জিহাদ সাহেব।ফলাফল বাড়ি ফিরেই বেধরম মার ক্ষেতে হয় আয়শাকে।
এ বয়সেও মার খেতে হয় কী লজ্জাকর ব্যাপার।ভাবতেই আয়শার মনে তিক্তাতায় চেয়ে যেতো মনপ্রাণ।
বিনাদোষে মার খেতে হয় স্বামীর।
যদিও বা স্বামী-স্ত্রীর কোন সম্পর্কই নেয় ছিলো না উভয়ের মধ্যে। যা ছিলো তা কারো মনে প্রতিশোধের আগুন, আর না বুঝে ভুল করার শাস্তি। আজীবণ পস্তাতে হচ্ছে।
একটা প্রবাদ আছে না,
ভাবিয়া করিও কাজ,
করিয়া ভাবিও না।
আয়শা আহমেদ আজ বিষণ পস্তাচ্ছেন। যদিও বা উনি যা করেছেন সব জিদের উপরে। অহংকার এবং জেদ বেশ ভয়ংকর। অহংকার সত্যিই একসময় সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।
নিজের রুপের অহংকার ছিলো বেশ।আজ তার ফলাফল হাড়ে হাড়ে ঠাওর করতে পারছেন।
জিহাদ সাহেবের রুম থেকে বেরুতেই, কারিমা বেগম আয়শাকে টেনে একপাশে নিয়ে আসেন।
-আপা আমারে মাফ করে দেন।(কারিমা)
-কেন কী হয়েছে?(অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন আয়শা)
-আপা ভাই সাহেবরে ওয়াসরুমে আছাড়টা আমি খাইয়েছিলাম। সাবানের প্যানা ফেলে। আপনারে এতো মারলো আমার সহ্য হয়নি তাই…(কারিমা)
-তাই বলে মানুষটার এই অবস্থা করলি?(রেগে)
-মাফ করেন আপা, আর হবেনা। দয়া করেন।(কারিমা)
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আয়শা আহমেদ নিজের রুমে চলে আসেন।যদিও বা মনেমনে দুঃখ-খুশী দু’টোই হচ্ছে।তবে তা অপ্রকাশিত রেখে দেন।
আর নয়। এবার তিনি আর এই অভিশপ্ত জীবণ কাটাবেন না। ফিরে যাবেন তাদের কাছে….
খোঁজে নিয়ে,মানিয়ে নিবেন নিজের শরীরের অংশীদারদের…….
(চলবে)
Tarin Jannat