#বাঁধন_ছেঁড়া_প্রেম
পর্ব:২৩
#যারিন_তাসনিম
রাতের মধ্যেই সেদিন সবাই ঢাকা ফিরে আসে।
পরেরদিন,
নিয়াজ একজনের আসার জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছে। মোবাইলে ঢুকে ফোন দিতে যাবে, এমন সময়ই সে নিয়াজের বিপরীতে থাকা চেয়ারটা টেনে হন্তদন্ত হয়ে বসে বলল,
“এক্সট্রিমলি সরি।”
নিয়াজ ভারী গলার আওয়াজে সামনে তাকাতেই অবাক হলো। এরপর বলল,
“কে তুমি?”
রাব্বি একটু সংকোচবোধ করে বলল,
“ভাইয়া, আমি রাব্বি।”
নিয়াজ অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। বলল,
“তুমি এত বড় হয়ে গিয়েছো। এতটুকু বাচ্চা কিনা আমার সমান হয়ে গেল।”
রাব্বি হাতগুলো টেবিলের উপর ভাজ করে রেখে বলল,
“দুলাভাই, আপনি তো বোধহয় চাচ্ছেন, আমি সারাজীবন পিচ্চি থেকে যাই। আপনার মতো সুদর্শন পুরুষ যাতে কখনোই না হই।”
মৃদু হেসে নিয়াজ বলল,
“তোমার চরিত্র তোমার বোনের বিপরীত হয়েছে। একদম ঠাস ঠুস কথা বলতে জানো।”
রাব্বি নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলল,
“ওই শাকচুন্নির চরিত্র আমার হয়নি, তাই আমার ভাগ্য। যাই হোক, আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে। আমার কাছে টাকা নেই, কোচিং বাঙ্ক দিয়ে এসেছি। আপু জানলে আমাকে নরকে পাঠাবে। আপনি আপনার টাকায় আমাকে কিছু খাওয়ান।”
শব্দ করে হেসে নিয়াজ বলল,
“অবশ্যই, আমার পিচ্চি শালা। তুমি বলো, কি খাবে?”
রাব্বি মেন্যু কার্ড দেখে বলল,
“একটা পিজ্জা অর্ডার দিন।”
অর্ডার দিয়েই নিয়াজ বলল,
“কাল তোমার মেসেজ দেখে খুব অবাক হয়েছি। কি সাহস তোমার! আমাকে সরাসরি বলেছো, এই রেষ্টুরেন্টে দেখা করতে। তুমি আমার আইডি কোথায় পেয়েছো, বলো তো?”
চেয়ারে হেলান দিয়ে রাব্বি বলল,
“আরে দুলাভাই, আপনার শালা বলে কথা। আপনার আইডি বের করা আপনার শালার কাছে তুড়ি মারার মতো কাজ। আপুর ফোন থেকে চুরি করে আপনার ছবি নিয়েছিলাম। তারপর আপনার নাম দিয়ে সার্চ করতে করতে অবশেষে পেয়ে গেলাম। আর আপনার প্রোফাইলে থাকা ছবিগুলোর সাথে আপুর ফোনে থাকা ছবিগুলো মিলিয়েই বুঝে গিয়েছিলাম এটা আপনি। আপনি কিন্তু আগের থেকে একটু মোটা হয়েছেন। আপুকে ছেড়ে এত সুখে ছিলেন?”
নিয়াজের হাসিমুখে আঁধার নেমে আসলো। বলল,
“নাহ। আসলে আগে এক্সারসাইজ করা হতো। এরপর আমেরিকায় চলে যাওয়ার পর মন মেজাজ ভালো থাকতো না। এসবও করা হতো না। তাই একটু মোটা হয়েছি।”
পিজ্জা এসে পড়েছে। রাব্বি এক পিস পিজ্জা প্রথমে নিয়াজের প্লেটে দিল। আরেক পিস নিজের প্লেটে নিল। এরপর বলল,
“ভাইয়া, আপু কিন্তু আপনাকে ছাড়া খুব কষ্টে আছে। প্রায় প্রতিটাদিনই কাঁদে। চন্দ্রিমা আপুকে তো চিনেনই, আমার মামাতো বোন! ও আসলে ওর উপর হামলে পড়ে কাঁদে। আমার সামনে অবশ্য কখনো প্রকাশ করেনি। প্রকাশ করেনি দেখেই আমার এত পরিশ্রম দিয়ে আপনাকে খুঁজা লাগলো। কেন ছেড়ে গিয়েছিলেন বলুন তো?”
নিয়াজ জবাবে বলল,
“প্রথম থেকে উত্তরগুলো দেই৷ তোমার আপু কষ্টে আছে না, ছিল। হুম, তোমার আপু শুধু তিনজন মানুষের সামনেই চোখের পানি দেখাতে পারে। কিন্তু তিনজনের একজন হারিয়ে গিয়েছিল। আর সেই একজন হচ্ছে, আমি। আর আমি ছেড়ে যাওয়ার পিছনে তেমন বড় রিজন নেই। আসলে আমি স্কলারশিপের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম তোমার আপুকে না জানিয়ে। স্কলারশিপটা যে আমি পাবো, আমি কল্পনাও করি নি। স্কলারশিপ পাওয়ার পর আমার বাহিরে পড়ার সুযোগ হয়। কিন্তু এই কথাটা তোমার আপুকে বলার সাহস হয়নি আমার। আমি জানতাম, সে এগুলো জানলে কেঁদেকেটে একাকার করবে। এরপর আর আমার যাওয়া হবে না। আর এদিকে আমি না গেলে আমার পরিবার থেকে প্রেশার পরতো। আসলে কম বয়সে প্রেম করাটা না খুব চাপের বিষয়, বুঝলে? কম বয়সে প্রেম করলে পরিবার থেকে পড়াশোনার চাপ থাকে আর গার্লফ্রেন্ডকে সময় দেওয়া, তার কথা শোনা, তার কষ্ট দেখা এসব দিক দিয়েও চাপ থাকে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি তাকে না জানিয়েই যাবো। এরপর বিদেশ থেকে একটা ভালো ক্যারিয়ার গড়ে তোমার বাবা, মা-র কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিব। আমি সব আইডি অফ করে দিলাম, ফোন নাম্বার চেঞ্জ করে ফেললাম। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার কিছু বছর পর খোঁজ নিয়ে জানলাম, তোমার আপু আমাকে ভুলে গিয়েছে। এন্ড, নাউ সি ইজ এ ডক্টর। এবার আমি ভেঙে পড়লাম। বুঝে গেলাম, সে তার পুরনো প্রেমিককে কখনোই ফিরিয়ে নিবে না। দেশে আসার আগ্রহ, ইচ্ছা কোনোটাই ফিরে পেলাম না। কিন্তু ভাগ্য আমাকে এখানেই নিয়েই এল আর তোমার আপুকে ফিরিয়ে দিল।”
রাব্বি হতবাক হলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“এত সামান্য বিষয়ের জন্য আপনাদের বিচ্ছেদ হয়েছিল। আর আপুকে ফিরিয়ে দিল মানে? আপু জানে, আপনি দেশে ফিরেছেন?”
এতকথা বলে নিয়াজ হাঁপিয়ে গিয়েছে। তাই কোক এক চুমুক খেয়ে খুলনায় ঘটা সব ঘটনা রাব্বিকে খুলে বলল। রাব্বি এবার পুরোই থ হয়ে গেল। ঠোঁট দুটো যেন কেউ গ্লু দিয়ে আটকে রেখেছে। ঠোঁট নাড়াতে পারছে না। কথা বেরুচ্ছে না। নিয়াজ ওর অবস্থা দেখে হেসে দিল। রাব্বির প্লেটে থাকা পিজ্জাটা নিয়ে রাব্বির মুখে ঢুকিয়ে দিল। রাব্বি চিবোতে থাকলো। এরপর আবার প্রশ্নের ভান্ডার নিয়ে বলল,
“ভাইয়া, আপনারা বিয়ের ডেট ফিক্স করেছেন? ভাইয়া, প্লিজ আমার এস.এস.সি এক্সামের পর ডেট ফিক্স করবেন। আর বিয়ে কোথায় করবেন, ভেবেছেন কিছু? আম্মু, আব্বুকে রাজি করাবেন কীভাবে? আপু জানে, আপনি কেন ছেড়ে গিয়েছিলেন?”
নিয়াজ রাব্বির সামনে থাকা কোকের বোতলটা রাব্বির সামনে ধরে বলল,
“ওরে আমার শালা! আস্তে ধীরে প্রশ্ন করো। উত্তর দিচ্ছি তো। পালিয়ে যাচ্ছি না।”
রাব্বি কোকটা নিয়ে কয়েক ঢোক খেল। নিয়াজ বলল,
“বিয়ে কোথায় করবো, কবে করবো, এসব প্রশ্ন না করে ভাবো যে, বিয়েটা কার সাথে হচ্ছে।”
রাব্বি ভ্রু কুচকে বলল,
“মানে? কার সাথে আবার হবে, আপনার সাথেই তো হচ্ছে।”
নিয়াজ চিন্তিত গলায় বলল,
“তোমার আপুর যে বিয়ে ঠিক হয়েছে, জানো না?”
রাব্বি আবার হাফ ছাড়লো। বলল,
“এই ব্যাপার! আপনিও না, শুধু ভয় পাওয়ায় দেন। ওই বুইড়া বেটাকে ভাগানো আমার বা’ হাতের খেল।”
নিয়াজ আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
“তাই নাকি? আপাতত তোমার এস.এস.সি এক্সামকে বা’হাতের খেল বানাও।”
একরাশ বিরক্তি নিয়ে রাব্বি বলল,
“আপনিও আপুর মতো এক্সামের কথা তুলবেন না, প্লিজ। কাজের কথায় আসি, আপু কিন্তু আপনাকে ভুলেনি। আপনি এসব গুজব কোথা থেকে পান? আপু সবার সামনে স্বাভাবিক থাকতো। কিন্তু দরজা লাগিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতো। আর আমি দরজার বাহিরে চোরের মতো কান দিয়ে শুনতাম। আর আমি ড্যাম শিউর, আপু আপনাকে চিটার ভেবেছে। কিন্তু আপনার অপেক্ষাতেও থাকতো। এজন্য এতদিন বিয়েও করেনি। বিয়ে করলে আপনি দেশে ফিরে আপুর বাচ্চা দেখতেন।”
বলেই হেসে দিল রাব্বি। নিয়াজ রাব্বির হাসির সাথে তাল মিলিয়ে বলল,
“সেটা হয়নি। তবে এবার তুমি তোমার আপু আর আমার বাচ্চার চেহারা দেখতে পাবে।”
বলেই জিহবায় কামড় দিল। বলল,
“ইশ! ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার শালাটা পিচ্চি।”
রাব্বি পিজ্জা খেতে খেতে ভাবলেশহীনভাবে বলল,
“কীসের পিচ্চি? আমি যথেষ্ট ম্যাচিউরড। আচ্ছা ভাইয়া, আমাদের কিন্তু আপুকে জানানো উচিত, আপনি কেন আপুকে ছেড়ে গিয়েছিলেন, অহনা আপুর ঘটনাগুলোও।”
বিল পে করে নিয়াজ বলল,
“জানানোর জন্য আমার কাছে একটা গ্রেট প্ল্যান আছে।”
নিয়াজ তার সম্পূর্ণ প্ল্যান রাব্বিকে গুছিয়ে বলল।
চলবে,