#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_১৮
#সুমাইয়া মনি
সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। আকাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে ঝুপঝাপ বৃষ্টি বর্ষিত হবার চান্স রয়েছে। শাঁ শাঁ শব্দ তুলে জানালার পর্দা উড়ছে। আবিরের চুল গুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। এক মনে সে মারুফ ও সামিমের কথা শুনছে এবং রাতের কথা ভাবছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর বিভা মারুফ’কে ফোন দিয়ে লোকেশন বলেছে। মারুফ, সামিম’কে সঙ্গে নিয়ে আবির’কে আনতে বিভার বলা লোকেশনে আসে। সেখান থেকে আবির’কে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে ফিরে তারা। বাড়িতে আনার পর মারুফ পানির ঝাঁপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে আবিরের। চেতনা ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে হন্নতন্ন হয়ে বিভা’কে খুঁজতে আরম্ভ করে।
কিন্তু মারুফ তাকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার কথা জানিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। তাদের কথপোকথন শুনে আইরিন বেগম হল রুমে উপস্থিত হলে ‘কি হয়েছে’ জানতে চাইলে সামিম তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রুমে পাঠিয়ে দেয়। রাতে এই বিষয় নিয়ে তারা আর কথা বাড়ায় না। দু’জনে রাতে থেকে যায়।
আবির সারারাত চোখের পাতা এক করেনি। তার মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কেন ক্লোরোফর্ম মাখান রুমাল তার নাকেমুখে ধরা হলো? তাকে অচেতন অবস্থায় রেখে বিভা এত রাতে কোথায় গিয়েছে? কি উদ্দেশ্য তার? ভেবে এপাশ, ওপাশ করতে করতে উঠে বসে। আপাতত যেভাবে বসে আছে এখন, সেভাবেই বসে রয়েছে। সকাল হয়। মারুফ, সামিম আবির’কে ডাকতে রুমের কাছে এসে দেখে দরজা খোলা। ভেতরে প্রবেশ করে বন্ধু’কে স্থির হয়ে বসে থাকতে দেখতে পায়। চোখমুখ দেখে বুঝে যায় রাতে ঘুমাতে পারেনি।
তার নিকট এসে কথা বলতে আরম্ভ করে।
‘কাল রাতে বিভা বলল তুই নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছিস। কীভাবে সেন্স হারালি?’ মারুফ প্রশ্ন করে।
‘মাথায় আঘাতের চিহ্ন নজরে এলো না। তাহলে অজ্ঞান হয়েছিলি কীভাবে?’ এবার সামিম প্রশ্ন করে।
‘আর এই বিভা আমার নাম্বার কোথায় পেলো? না এত বছরে কখনো দেখা হয়েছে। না কাল আমার নাম্বার নিয়েছে পার্টিতে থাকাকালীন। কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে বিভা।’
‘হাজারো প্রশ্ন লুকিয়ে আছে ওর মাঝে। কিন্তু এর উত্তর পাব কি-না জানা নেই!’
আবির এবার মুখ খুলে,
‘কাল রাতে কৌশলে ক্লোরোর্ফম মাখা রুমাল বিভা আমার নাকেমুখে চেপে ধরেছিল। যার ফলে আমি জ্ঞান হারাই।’
‘কিন্তু কেন?’ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে মারুফ।
‘যদি তোকে সেন্সলেসই করতে হতো, তবে আমাকে ফোন দিয়ে কেন ডাকলো।’
‘কারণ বিভা চাইছিল না আমি এত রাতে সেখানে পড়ে থাকি।’
‘বিবেক, বুদ্ধি প্রখর বিভার।’ সামিম বলে।
‘প্রচুর!’
‘বিভার নাম্বারটা দে মারুফ।’
‘ফোনে উঠা..’ বলে ফোন আনলক করল মারুফ।
আবির নাম্বার উঠিয়ে খাট থেকে নেমে গেলো। সামিম উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘অফিসে যাবি? দেখে তো মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমাস নি। এখন ঘুমাবি নাকি?’
‘নাহ! অফিসে যাব না। তুই গিয়ে বাকি কাজ গুলো সামলে নিস।’ আবির গুরুগম্ভীর কণ্ঠে শুধালো।
‘তুই কি করবি?’
‘কাজ আছে আমার।’
‘কি কাজ?’
‘লিভ!’
সামিম আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। দু’জনে বেরিয়ে যায়। আবির লম্বা শাওয়ার নেয়।
__________
ক্যাম্পাসের মাঠের মাঝখানে একা কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে সিমা’কে আফিন। স্টুডেন্ট’রা দূর থেকে ওঁকে দেখে হাসাহাসি করছে। এতে না আছে সিমার ভ্রূক্ষেপ, না বোধ করছে রাগ, অপমান। আফিনের জন্য শুধু কান ধরা কেন? ক্যাম্পাসের সকল স্টুডেন্টদেরও কান টানতে রাজি আছে।
মনে মনে এসব ভেবে মৃদু মুচকি হাসছে। আফিন দূর থেকে সেটা লক্ষ্য করে। রৌদ্দ নেই দেখে সিমার তেমন গরম লাগছে না। দেখে তো মনে হচ্ছে সে ইনজয় করছে খুব! দশ মিনিট হলো সে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাকি স্টুডেন্টদের হাসাহাসি তার নজরে এসেছে। সে এগিয়ে আসে সিমার নিকট।
সিমা আফিন’কে দেখে মুচকি হেসে নজর সরিয়ে নেয়।
আফিন বিরক্ত নিয়ে বলল,
‘আর কখনো বলবে?’
‘কোনটা?’
‘ভালোবাসি…’
‘ভালোবাসি টু।’ বাকি অবশিষ্ট কথা বলার পূর্বেই সিমা তড়িঘড়ি বলে হেসে দেয়।
রাগে চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয় আফিন। কঁপালে দুই আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘তোমার মতো অসভ্য মেয়ে আমি জিন্দেগীতে কক্ষণো দেখিনি।’
‘এখন দেখে নেন।’
‘সেটআপ! ক্লাসে যাও।’ ধমক দিয়ে বলল।
আফিনের ধমক শুনে সিমা ঈষৎ কেঁপে উঠে এক প্রকার দৌঁড়ে ক্লাসরুমে আসে। আফিন রাগী নিশ্বাস ত্যাগ করে ক্লাসরুমের নিকট এগিয়ে যায়। পথরোধ হয় তার সুমনা ম্যামের ডাকে। তিনি এই কলেজের নতুন টিচার। কাল জয়েন্ট হয়েছে। দেখতে বেশ সুন্দরী।
‘আসলে আপনাকে ডেকেছিলাম এটা জিজ্ঞেস করতে, প্রিন্সিপাল স্যার আপনাকে এই লেটারটি দিতে বলল।’
‘দিন।’ বলতে বলতে আফিন হাতে নেয়। একবার নজর বুলিয়ে আফিন তাকে ‘ধন্যবাদ’ জানায়। সুমনা আবার বলে,
‘ওয়েলকাম! আমরা কি এক সঙ্গে কফি খেতে পারি?’
‘শিওর!’ বিনয়ী কন্ঠে বলল আফিন।
‘নেক্সট ক্লাসে যাব তাহলে।’
‘ওকে!’
‘বাই।’ বলেই সুমনা চলে যায়। আফিনও তার বাকি ক্লাস নিতে চলে যায়।
____
বিভা বিরক্ত! বার বার আবিরের ফোন কেঁটে দিচ্ছে। এ নিয়ে দশ বার হতে চলল। শেষমেশ ফোন সাইলেন্ট মুডে ফেলে রাখে। এই মুহূর্তে সে আবির’কে ভুলে থাকতে চায়। কিছুতেই চায় না তাকে জীবনে জড়াতে। কফির মগ নিয়ে চেয়ারে হেলান দেয়। এক চুমুক দিতেই সাইলেন্ট ফোনে আলো জ্বলে উঠে। বুঝতে পারে আবারও কল দিয়েছে আবির। এবার রিসিভ না করে পারে না। চট করে কানে তুলে বলল,
‘সমস্যা কী? কল কেন দিচ্ছেন বার বার?’
‘দরজা খোলো তারপর বলছি।’ শান্ত কণ্ঠে বলল আবির।
বিভা অবাক হয়ে দরজার পানে তাকায়। তার মানে কি আবির দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে? নাম্বার না হয় মারুফের কাছ থেকে নিয়েছে। কিন্তু এড্রেস কোথায় পেলো? পরক্ষণে বুঝতে পারে নিশ্চয় ট্র্যাক করেছে। ফোন রেখে দরজা খুলে দিয়ে ক্ষোভ নিয়ে তাকায় আবিরের ওপর। আবির চট করে বিভার দু বাহু শক্ত করে চেপে ধরে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে ক্রোধ নিয়ে তাকায়। বিভার রাগ-ক্ষোভ উবে যায়। আবির মুখ একটু কাছে এনে মৃদুস্বরে বলল,
‘পঁচা মেয়ে…’ বলেই আবির সেই চেয়ারে বসে পড়ে, যেখানে বিভা একটু আগে বসেছিল। হাতে বিভার কফির মগটি উঠিয়ে এক চুমুক দিতে যাবে বিভা বাঁধা দেয়। আবির বাঁধা শুনে না। এক চুমুক দিয়ে নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
‘চিনি ছাড়া কফি। এই জন্যই তো বলি মুখে রসকষ নেই কেন?’
‘কফির মগ দেন।’ রাগ নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল বিভা।
‘তোমার বাড়িতে এসেছি কফি খাওয়ার কথা তো বললেই না, উল্টো রেডিমেড কফিটাও খেতে দিচ্ছো না। আচ্ছা নিবে যখন, ঢেলে দেই হাতে।’
‘একদম ফাজলামো করবেন না।’
‘ভালো কথা বললেও দোষ, ফাজলামো করলেও দোষ। বিচারা আবির যাবে কোথায় বলো?’ বলে আরেক চুমুক বসায়৷
বিভা রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যস্ত। বলল,
‘আপাতত এখান থেকে চলে যান।’
‘কেন? তুমি কি ভয় পাচ্ছো?’ বলেই কফির মগ রেখে আবির বিভার মুখোমুখি দাঁড়াল। ফের বলল,
‘একটি ফ্ল্যাটে তুমি-আমি একই রুমে, যদি কিছু হয়ে যায় এই ভয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছো?’ ভূতুড়ে কণ্ঠ বানিয়ে বলল আবির।
‘সরেন!’ বলেই আলতো ধাক্কা দেয় আবির’কে।
আবির হেসে ফেলে। বলল,
‘উঁহু!’
‘আচ্ছা, মেয়ের কি অভাব পড়েছে? আমার পিছনেই কেন পড়ে আছেন আপনি?’
‘বাঁধিব হৃদয়ে তোমায় বলে….’ কথাটা বলে বিভার দিকে নেশাতুর দৃষ্টি ফেলে। বিভা নিরুত্তর হয়ে চেয়ে রয়। আবির’কে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। এতদিন পর ফিরে আসার ফলে আবির তাকে মোটেও উৎখাত করেনি। বরঞ্চ চাচ্ছে যেন তার হয়ে যাক। বিভা নজর সরিয়ে ফেলে। বিস্বাদ কণ্ঠে বলল,
‘চলে যান এখান থেকে…’
‘ওকে!’ স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠে দাঁড়ায় আবির। বিভা ভ্রু কুঁচকে ঘুরে তাকায়। কফি টুকু এক ঢোকে পান করে রুম ত্যাগ করে। যাওয়ার আগে দরজা লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। বিভা এবারও অবাক না হয়ে পারছে না। সে বিস্ময় নিয়ে খোলা দরজার পানে তাকিয়ে আছে। আসলে সে আবিরের মন পড়তে অক্ষম। কিছুতেই আবির’কে বুঝে উঠতে পারছে না। কখন কি করে বসে, বোঝা মুশকিল। কাল রাতের ঘটনার কথা একটি বারও জিজ্ঞেস করল না। না কোনো অভিযোগ করেছে তার বিরুদ্ধে! ভাবতে ভাবতে দরজা লাগিয়ে মৌন হয়ে রয় সে।
গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে আবির মৃদু হাসে। সে বিভার কথা মনে করে হাসছে। বিভা যে কনফিউজড হয়েছে। সেটা সে ঢের বুঝতে পেরেছে। রহস্যময় হয়ে গেছে বিভা। এই রহস্যের বেড়াজাল থেকে আবির তাকে বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু কিছু সময়ের প্রয়োজন মাত্র!
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। দুঃখিত! ব্যস্ততার জন্য গল্প দিতে পারি নি। এখন থেকে রেগুলার গল্প দেওয়ার চেষ্টা করব।