#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_১৯
#সুমাইয়া মনি
বিভা জারার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। জারা ফটোশুটে ব্যস্ত ছিল। বিভা’কে দেখে দশ মিনিটের ব্রেক নেয়। দু’জনে সবার থেকে একটু দূরে অবস্থান করছে।
‘জারা তোমার আপু যখন নিঁখোজ হয়েছিল। তার আগে কি কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিল?’
‘আমি সেটা কীভাবে বলবো মেডাম? আমি তো বাড়িতে ছিলাম না। আর আপু ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিল। তারপর আর ফেরেনি। কিছু জানতে পারলেন কী?’
‘ইনভেস্টিগেট চালছে। পুলিশের কাছ থেকে তেমন কিছু জানা যায় নি। সেদিন পার্টিতে সবাইকে দেখেছো তুমি। এই ফোনে তাদের ছবি আছে। দেখো তো চিনতে পারো কি-না তাদের।’
জারা একটার পর একটা ছবি পাল্টিয়ে দেখতে লাগলো। সন্দেহজনক তেমন কিছু নজরে পড়ল না তার। বিভা তীক্ষ্ণ নজরে পর্যবেক্ষণ করছে জারা’কে। সব ছবি দেখার পর জারা বলল,
‘আমি এদের কাউকে চিনি না মেডাম।’
বিভা ফোন লক করে পকেটে পুরে নেয়। বলে,
‘আচ্ছা মনে করে বলতে পারবে। তোমার আপু কোনো কাগজ বা ফাইল এমন কোনো জিনিস এনেছিল বাড়িতে?’
‘আপুর রুম চেক করে দেখতে হবে।’
‘তুমি দেখে আমাকে জানাবে।’
‘আমাকেও…’ বলেই আবির অন্য একটি চেয়ার টেনে ধুম করে বসে যায়৷ ওঁকে দেখে বিভা বিরক্ত বোধ করে। জারা বিস্ময় নিয়ে তাকায়। আবির ওদের চাহনি উপেক্ষা করে বলল,
‘আমি ভূত না। এভাবে না তাকালেও চলবে। বাই দ্যা এদিক-সেদিক, কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে?’
‘আপনাকে বলব কেন?’
‘আমাকে বলবে না কেন?’
বিভা রাগী চোখে তাকায়। আবির দুষ্টু হেসে হেলান দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ক’দিন পর তো আমি তোমার বর হয়ে যাব। তখন পার্সোনাল কথাও শেয়ার করবে। আগে থেকে বলতে সমস্যা কি?’
‘আপনার এমন ফালতু কথা শোনার সময় আমার নেই। জারা আমি চললাম।’ বলে হাঁটতে আরম্ভ করল। আবির এক ছুটে বিভার নিকট এগিয়ে এসে হাঁটতে আরম্ভ করল। বিভা রোদের কারণে সানগ্লাস চোখে পড়ে নেয়। আবির বলল,
‘শার্ট – প্যান্টে তোমাকে মোটেও মানাচ্ছে না বিভা। থ্রি-পিসে ভালো মানায় তোমায়।’
‘আপনাকে বলতে হবে না সেটা।’
‘আমি না বললে অন্য কেউ বলবে নাকি।’
‘আমার পিছু পিছু হাঁটবেন না।’
‘কেন? হাঁটলে কি সেদিনের মতো অজ্ঞান করবে ক্লোরোফর্ম শুকিয়ে?’
‘আমায় বাধ্য করবেন না।’
‘এ তো দেখছি দিনে-দুপুরে খুন করে।’
‘খুন কোথায় হলো?’
‘আধমরা’কে তো খুনই বলে।’
‘তর্ক করতে চাইনা আমি। পিছু ছাড়ুন।’
‘নেভার!’
বিভা থেমে গিয়ে আবিরের দিকে ক্রোধ দৃষ্টিতে তাকায়। বলে,
‘সমস্যা কী?’
‘তুমি?’
‘কি করলে পিছু ছাড়বেন?’
‘আমায় বিয়ে করলে।’
বিভা চুপ হয়ে যায়। কিছু একটা ভেবে বলল,
‘কক্ষণো না।’
‘আমিও কক্ষণো না।’ ভাব নিয়ে বলল।
বিভা স্কুটারে উঠে বসে। আবির বসতে চাইলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। বলে,
‘আমার সঙ্গে আসবেন না।’
‘হাজার বার আসবো।’ বলে আবারও উঠে বসে।
বিভা প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে। নিরুত্তর থেকে স্কুটার স্টার্ট দেয়। অনেক দ্রুত চালাচ্ছে। আবির বিভার বাহুতে হাত রাখতে চাইলে বিভা সরিয়ে দেয়। আবির মুচকি হেসে বিভার পেট জড়িয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে বিভা জোরে ব্রেক কষে। এতে করে আবির বিভার উপর ঝুঁকে যায়। বিভা ক্ষেপে নেমে গিয়ে আবির’কে টেনে নামায়। দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
‘অসভ্যতা করার জায়গা পান না।’
‘তাহলে আড়ালে চলো।’
‘চুপ করুন।’ ধমক দিয়ে বলে বিভা স্কুটার নিয়ে চলে যায়৷ আবির এবার আর বিভাকে থামায় না। তবে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয় তার।
বিভা বাড়িতে ফিরে আসে। আগে থেকেই একটি মেয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল গেটের সামনে। তাকে নিয়ে বিভা ভেতরে প্রবেশ করে। দু’জনার মাঝে বেশ কিছুক্ষণ কথপোকথন হয়। মেয়েটি কিছু কাগজ বিভা’কে দেখায়। বিভা অনেক আগের কিছু পুরোনো কাগজের সঙ্গে সেগুলো মিলায়।
______
সুমনা সিমার পাশ কাঁটিয়ে যাওয়ার সময় ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে নিজেও পড়ে যাওয়ার অভিনয় করে। উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে,
‘স্যরি মেডাম। আমি দেখিনি আপনাকে। আমি দুঃখিত!’
সুমনা মুখ ভার করে কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়। সিমার চাল সে একটু হলেও বুঝতে পেরেছে। সিমা উঠে সুমনার শাড়ি ছেড়ে দিতে যাবে বাঁধা দেয় সে। সুমনা লজ্জা বোধ করে। ক্যাম্পাসের ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে পড়ে যাওয়া লজ্জাজনক ব্যাপার।
সিমা’কে কিছু না বলে তিনি ব্যাগ কাঁধে চেপে শিক্ষক কক্ষে এগিয়ে যায়৷ সুমনা এগিয়ে যেতেই ওর বান্ধবী’রা ঘিরে ধরে। সিমা বাঁকা হেসে হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে বলল,
‘যা বেশি করে আমার আফিনের সঙ্গে কফি খেতে। যতবার যাবি, ততবার আমি তোর এমন হাল করব দেখিস।’
‘ম্যাম প্রচণ্ড লজ্জা পেয়েছে।’
‘তাতে আমার কি।’
‘তুই অন্ধ হয়ে গেছির স্যারের প্রেমে পড়ে।’
‘হলে ক্ষতি কি? মানুষ ভালোবেসে পাগল হয়। আমি না হয় অন্ধ হলাম।’
‘তোকে বোঝানো সম্ভব না।’
‘বোঝাতে আসিসও না।’
‘এই ক্লাসরুমে চল তোরা। ও থাকুক এখানে।’
‘নাহ! শোন তোরা।’
______________
রাতে…..
দরজায় কলিং বেল বেজে উঠে। বিভা দরজা খুলে সামিম’কে দেখে সেখান থেকে ফিরে আসে। সামিম ভেতরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। বিভার দিকে ক্ষীণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
‘এটা কিন্তু কথা ছিল না।’
বিভা নিরুত্তর থেকে একটা ফাইলে নজর বুলাচ্ছে। সামিম বিরক্ত হয়ে পুনোরায় বলল,
‘আমি কিছু বলছি তোমাকে।’
‘আপনি কি চাইছেন?’ শান্ত কণ্ঠে বলল বিভা।
‘তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে, ফিরে আসার পর আবির’কে তুমি কষ্ট দিবে না। তাহলে এমন কেন করছো?’
‘ভালোর জন্যই করছি।’
‘এটাকে ভালো বলে না বিভা। আবির তোমার অবহেলা সহ্য করতে পারছে না। ওর কষ্ট গুলো আমি কাছ থেকে দেখছি। তুমি বুঝো না? ছয়’টি বছর আবিবের একাকিত্বের সঙ্গী ছিলাম আমি। যন্ত্রণা গুলো অতি নিকট থেকে দেখেছি। আজ ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে তোমাকে ভুলে যেতো। বিয়ে করে নিতো অন্য কাউকে। কিন্তু আবির তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। প্রতিটা মুহূর্তে তোমার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনেছে। আর কত কষ্ট দিবে তুমি ওঁকে। এত পাষান কেন তুমি বিভা?’
বিভা পুরো কথা শুনে রেগেমেগে দাঁড়িয়ে যায়। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সামিম’কে বলল,
‘আমি যা করছি আবিরের ভালোর জন্য করছি। চারদিকে শত্রু আমার। কখন কোথায় আমার ওপর আক্রমণ করে সবে, ঠিক নেই। এর মধ্যে আমি আবির’কে আমার জীবনে জড়াতে পারব না। আমি চাই না আমার জন্য আবিরের কোনো ক্ষতি হোক।’ এতটুকু বলে বিভা থামে। সামিম কিছু বলে না। বিভা আবার বলল,
‘সেদিন রাতে আমার জীবনের মোড় পাল্টে দিয়েছেন আপনি। আপুর স্বপ্ন পূরণ করতে সাহায্য করেছেন। এতটা বছর আমি নিজেকে আড়াল করে রেখেছি আবিরের কাছ থেকে। শুধু মাত্র আমার উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য। আপনি কীভাবে ভাবলেন ভাইয়া আমি আপনার কথা রাখবো না।’
‘তবে কেন আবির’কে কষ্ট দিচ্ছো? ফিরে যাও ওর কাছে একে বারের জন্য। আবির কিন্তু তোমাকে একটি বারও জিজ্ঞেস করেনি এতদিন কোথায় ছিলে, কার সঙ্গে ছিলে। ও তো এটাও জানে না ওর প্রিয় বন্ধুই তার ভালোবাসার মানুষটি’কে আড়াকে রাখার শপথ নিয়েছিল। যদি কখনো জানতে পারে, মাফ করবে না আমায়।’
‘আমি কখনো বলব না আপনার কথা। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।’
‘সত্য চাপা রয় না বিভা।’
‘আপ্রাণ চেষ্টা করব রাখার।’
‘আর যাই করো। এবার আর আমার বন্ধুকে কষ্ট দিও না বিভা। ও মরে যাবে তোমাকে না পেলে।’ করুন সুরে কথাটি বলে সামিম স্থান ত্যাগ করেন। বিভা মাথা নিচু রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। মন্থর গতিতে এগিয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। ধীরে পায়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকায়। ছয় বছর আগের কিছু রঙিন স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠে। তিনজন সদস্যের কতই না সুন্দর ছিল তাদের ছোট্ট পরিবারটি। ছিল মা-মেয়ের খুনসুটি, দুষ্টুমি। হঠাৎ এক তান্ডবে হারিয়ে গেল সব। ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল আবির। তাকে স্বাভাবিক করার প্রখর চেষ্টা করেছে। নিজে হারিয়ে যাওয়ার পর আবিরের খবরা-খবর প্রতিটা মুহূর্তে সে পেয়েছে। বার বার চেয়েছিল ফিরে যেতে। কিন্তু কিছু একটা তাকে বাঁধা সৃষ্টি করেছে। চোখের জল মুছে বিভা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,
‘আপু! দেখো আমায়। আজ আমি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। তোমার স্বপ্ন পূরণ করেছি। দেখো আপু, মা, দেখো। জানো আপু, আমিও আবির’কে ভালোবাসি। হৃদয়ে বেঁধে রাখতে চাই আবির’কে। কিন্তু পারছি না। আমাকে বার বার বাঁধা দিচ্ছে আপু। বাঁধা দিচ্ছে।’ বলে অঝোরে কাঁদতে থাকে বিভা।
কাঁদতে কাঁদতে সেখানে বসে পড়ে। তার এই কান্না এখানেই সীমাবদ্ধ! না কেউ শুনতে পাচ্ছে। না কখনো জানতে পারবে তার মনের অনুভূতি গুলো!
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।