বাদামী সংসার
পর্ব ১২
– ‘ফাইরুজ ভাই, কয়টা ঘুমের বড়ি খাইলে মরা সম্ভব?’
– ‘কি বলছো এসব?’
– ‘ফাইরুজ ভাই, বিশ্বাস করেন আমি লাস্ট তিনটা দিন ধইরা একফোঁটা পানিও খাইনাই।’
কান্নায় ভেঙে পড়লো প্রফুল্ল। ফাইরুজ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। প্রফুল্ল কে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য কি বলা উচিৎ তাও বুঝতে পারে না। ওর খুব অস্বস্তি লাগছে। প্রফুল্ল’র চোখ গর্তে বসে গেছে। চেহারা হয়েছে বিদঘুটে অভিমানী, চুল এলোমেলো। রাত সাড়ে এগারো টায় নিজের বাসায় প্রফুল্লকে আসতে দেখেও কম চমকায় নি ফাইরুজ। বসার ঘরে ঢুকে অনবরত ক্রন্দন করে চলেছে। ফাইরুজ পড়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। বাবা মা কি ভাবছে কে জানে! তাদেরকে সব কথা বলাও সম্ভবপর নয়।
ফাইরুজ বললো, ‘দেখো এত পাগলামি কোরো না। স্ট্রং হও। আমি জানি তুমি যথেষ্ট স্ট্রং একটা মেয়ে। এমন করলে তো তুমি অসুস্থ হয়ে যাবা।’
– ‘অসুস্থ হওয়ার জন্যও কপাল লাগে ফাইরুজ ভাই। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতেছে। খিদা কি জিনিস সেই ফিলিংস টাও পাইতেছি না। মরি না তো, মরলে তো বেঁচে যেতাম।’
– ‘প্লিজ প্রফুল্ল এমন কোরো না। তুমি বাসায় যাও। আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থাটা। বাসায় গিয়ে ফোন দাও, ফোনে কথা বলবো। এভাবে কান্নাকাটি করলে আব্বু আম্মু উল্টা পাল্টা ভাব্বে।’
– ‘আমার লাইফটা শেষ হয়ে যাইতেছে আর আপনি অন্যরা কি ভাবছে সেটা নিয়ে আছেন? আমার মনের অবস্থা কি বুঝতে পারছেন না?’
– ‘কিন্তু কিছু করার নাই। তুমি তো বুঝো সবকিছু।’
প্রফুল্ল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘ফাইরুজ ভাই একবার কথা বলার ব্যবস্থা করে দেন না। প্লিজ লাগে। ওর সাথে একটু কথা বলেই চলে যাবো।’
– ‘এটা সম্ভব না। বুঝতেছো না কেন প্রফুল্ল?’
– ‘প্লিজ আমি আপনার পা ধরতেছি একবার কথা বলাই দেন। প্লিজ?’
প্রফুল্লকে দেখতে এতবেশি অসহায় লাগছে যে ফাইরুজের নিজেরই মায়া লাগছে। কত স্মার্ট, পরিপাটি মেয়েটার কি হাল হয়েছে। একবার কথা বলার জন্য পা পর্যন্ত ধরতে চাচ্ছে। ডিপ্রেশন মানুষের জীবনকে কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যায় তা কেউই জানেনা। ফাইরুজ ভীষণ অবাক ভঙ্গীতে তাকিয়ে থাকে নিষ্পাপ চেহারার মেয়েটার দিকে।
বাদামী সংসার
লেখক- মিশু মনি
প্রেমের পরশে সাধারণ রাতগুলো হয়ে উঠেছে সুখময় নিশা। অম্লান ও নীলাক্ষী দুজন মেতে উঠেছে রাজ্যের যত আজগুবি গল্পে। বালিশে হেলান দিয়ে অম্লান বসে আছে, পাশেই শুয়ে আছে নীলাক্ষী। অম্লান ওর স্কুল জীবনের গল্প বলছে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে নীলাক্ষী। অম্লান একবার বৃষ্টির দিনে স্কুলের মাঠে ধপাস করে পিছলে পড়ে গিয়েছিলো। সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে নিজেও হাসছে, ওর সাথে হাসিতে ফেটে পড়েছে নীলাক্ষী নিজেও।
এমন সময় অম্লানের ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করে বললো, ‘হ্যাঁ ফাইরুজ বল।’
ফাইরুজের গলা শুনে মনে হলো ও কথাটা বলতে ইতস্তত করছে। নীলাক্ষী হা করে চেয়ে আছে অম্লানের দিকে। অম্লান বললো, ‘কি হয়েছে বল না?’
– ‘তোর বউ পাশে আছে?’
– ‘হ্যাঁ পাশে। কেন?’
– ‘একটা পারসোনাল কথা বলবো। সাইডে আয়।’
– ‘আরে আমার বউই তো। সমস্যা নাই বল।’
– ‘না দোস্ত তুই একটু সাইডে আয়।’
অম্লান বললো, ‘নীলু ফাইরুজ কি যেন বলবে। তুমি আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসো। আমি ওর সাথে একটু কথা বলি।’
নীলাক্ষী ধীরপায়ে বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরে চলে গেলো। অম্লান নড়েচড়ে বসলো। একটা বালিশ কোলের উপর নিয়ে আরাম করে বসে বললো, ‘হ্যাঁ বন্ধু বল? কি হইছে?’
– ‘দোস্ত প্রফুল্ল’র সাথে একটু কথা বল।’
– ‘কিহ!’
মুহুর্তেই আরাম করে বসা অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসলো অম্লান। বসার আরামের সাথে সাথে ওর মনের আরামটুকুও উবে গেলো। শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হতে লাগলো। দরজার দিকে একপলক তাকিয়ে বললো, ‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? পাগল হইছিস তুই?’
– ‘জানি এটা উচিৎ না। তোর বউ পাশে আছে। তারপরও না বলে পারলাম না। প্রফুল্ল আমার বাসায় আসছে।’
– ‘মানে? এত রাতে! শোন তুই ওকে এক্ষুনি বাসায় দিয়ে আয়। এসব পাগলামি করতে মানা কর। নীলাক্ষী এখনই চলে আসবে। আর ফোন দিস না।’
– ‘দোস্ত তুই একবার ওর সাথে কথা বল? দুই মিনিট।’
অম্লান নিজের কপালে হাত দিলো। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে ওকে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ‘আমি পারবো না। ওকে বল চলে যেতে। আর এই ধরণের পাগলামি করতে বারণ কর। বুঝা ওকে।’
– ‘তুই একবার কথা বল।’
অম্লান বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। নীলাক্ষী এসে যদি কিছু শুনতে পায় তাহলে কি ভাব্বে কে জানে। ওদিকে প্রফুল্ল’র কথা শুনে অম্লানের দুশ্চিন্তা হু হু করে বাড়ছে। রীতিমতো ঘামতে শুরু করেছে অম্লান। ফাইরুজ প্রফুল্ল’কে বারণ করার সাহস পাচ্ছে না। প্রফুল্ল’র চোখেমুখে করুণ এক ছায়া নেমে এসেছে। কি যে মায়া লাগছে মেয়েটাকে দেখে! তিনদিন না খেয়ে থাকার দরুণ রুগ্ন দেখাচ্ছে। ও খুব করে চাইছে একবার কথা বলতে। বারবার অনুরোধ করছে। ফাইরুজ কিভাবে এই মেয়েটাকে না করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
অম্লান বললো, ‘ফোন রাখ। ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আয়।’
– ‘তুই কি চাস প্রফুল্ল সুইসাইড করুক?’
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো অম্লানের। দ্রুত বিছানা থেকে উঠে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। একহাতে মাথার চুলগুলো টেনে ধরে মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করে বললো, ‘আচ্ছা দে।’
প্রফুল্ল মোবাইল কানে নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে রইলো অনেকটা সময়। দুপাশেই নিরবতা, অথচ প্রফুল্ল’র মনটা প্রশান্তিতে ছেঁয়ে যাচ্ছে এই ভেবে যে, অম্লানের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে। আর অম্লান অশান্তির রাজ্যে প্রবেশ করতে করতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলো। প্রথমে অম্লানই কথা বললো, ‘তুমি এত রাতে ওর বাসায় কেন গেছো?’
– ‘শুইতে আসি নাই। তোমার সাথে কথা বলতে আসছি। নিজে তো ফোন নাম্বার চেঞ্জ করে সুখের স্বর্গে ভাসছো। আমার কি অবস্থা ভাবছো একবার?’
– ‘তোমার কি অবস্থা সেটা জানানোর জন্য আমাকে ফোন দিছো? তুমি জানো না আমার রুমে এখন একটা মেয়ে থাকে?’
– ‘জানি। কিন্তু এটা জানিনা তুমি ওই মেয়েটাকে কিভাবে আদর করতেছো।’
– ‘চুপ করো। প্রফুল্ল, মাথা ঠান্ডা করো। বাসায় চলে যাও। আমি শ্বশুরবাড়িতে আসছি। এখানে তোমার সাথে একটা কথা বলাও আমার জন্য রিস্ক। প্লিজ , শান্ত হও। বাড়ি যাও।’
প্রফুল্ল চুপ করে গেলো। অদৃশ্য কোনো ঝড়ো হাওয়া এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। নিজেকে সামলে রাখাটা ভীষণ কষ্ট সাধ্য হয়ে যাচ্ছে ওর পক্ষে গলা দিয়ে আর একটাও কথা বের হলো না। চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।
অম্লান বললো, ‘খাইছো রাতে?’
– ‘তিনদিন কিচ্ছু খাই নি।’
– ‘তোমার গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা বাড়বে।’
প্রফুল্ল কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘বাড়ুক। মরে তো আর যাবো না। অম্লান, তুমি বিয়ে করে ফেলছো এটা আমাকে তোমার বন্ধুর আপলোড করা ছবি দেখে জানতে হলো? তাও মিউচুয়াল ফ্রেন্ড। তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডের কেউই তোমার বিয়ের ছবি আপলোড করেনি, কারণ আমার চোখে পড়বে তাই। তুমি কেন জানাইলা না আমাকে? আমি তোমার বিয়েতে ঝামেলা করবো ভাবছিলা?’
অম্লান নিশ্চুপ। কিছু বলার শক্তিটাই বোধহয় হারিয়ে ফেলেছে ও। শরীর খারাপ লাগছে খুব।
প্রফুল্ল বললো, ‘যখন ফেসবুকে ঢুকে দুম করে তোমার বিয়ের ছবি আমার সামনে চলে আসলো, আমার কি অবস্থা হয়েছিলো তুমি ভাবতে পারতেছো?’
অম্লানের কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে। হাত পা অবশ হতে শুরু করেছে। তীক্ষ্ম ধারালো ছুরি দিয়ে শরীরে আঘাত করার মতো কথাগুলো এসে ওর বুকে বিঁধছে।
প্রফুল্ল বললো, ‘আমাকে জানাইতে পারতা। যাইহোক, তুমি বিয়ে করতে পারছো এরচেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। তোমার বউয়ের ছবি দেখছি। অনেক মিষ্টি দেখতে। নাম কি ওর?’
– ‘নীলাক্ষী।’
– ‘দিনে কয়বার আদর করো?’
– ‘প্লিজ চুপ করো।’
– ‘বলো না অম্লান। নিশ্চয় অনেক আদর করো। আমার তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। প্লিজ বলবে তুমি কি ওকে ভালোবাসতে পারতেছো?’
– ‘তুমি থামো। বাদ দাও। প্লিজ?’
– ‘বলো না? বলো আমাকে। তুমি কি ওকে ভালোবাসতে পারতেছো? বলো?’
অম্লান বারবার প্রফুল্লকে চুপ করতে বলছে। ওদিকে প্রফুল্ল ধীরেধীরে উত্তেজিত হতে হতে জোরগলায় বলছে, ‘বলো তুমি বলো আমাকে? বলো?’
অম্লান বললো, ‘না পারছি না। খুশি? তবে চেষ্টা করছি। পারবো। এত ডিপ্রেশন নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। আমি একটা স্বাভাবিক জীবন চাই। মরার মতো বাঁচতে চাই না। আমাকে আমার ফ্যামিলিকে ভালো রাখতে হবে। আমার ঘরে যে নতুন এসেছে তাকে তো ঠকানোর অধিকার আমার নেই তাইনা? তাকেও ভালো রাখতে হবে। আমি নিজে ভালো থাকতে চাই। এত স্ট্রেস আর পারছি না নিতে। প্লিজ আমাকে আর পিছনে টেনো না তুমি। দোহাই লাগে।’
প্রফুল্ল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমিও তাই চাই। কিন্তু কষ্ট হয় জানো। আমি অনেক দূর্ভাগা। স্বপ্ন সাজাইলাম আমি, অথচ অন্য কেউ এসে সেই সব সুখ উপভোগ করছে। তোমার বিছানায় অন্য একটা মেয়ে, যাকে তুমি উষ্ণ আদরে ভরিয়ে দিচ্ছো। এটা ভাবলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় অম্লান।’
– ‘এসব জানানোর জন্যই ফোন দিয়েছো?’
– ‘নতুন নাম্বার কবে নিছো?’
– ‘বিয়ের আগের দিন।’
– ‘ও। নতুন আইডি খুলবা?’
– ‘না।’
– ‘বাসাতেই থাকবা না নতুন বাসা নিবা?’
– ‘বাসাতেই থাকবো।’
– ‘ও। অম্লান, ইদানীং খুব গরম পড়তেছে। তুমি তো আবার কোল্ড ড্রিংক্সের পাগলা। ঠান্ডা খাইয়ো না, টনসিলের সমস্যাটা বাড়বে।’
– ‘আচ্ছা।’
– ‘আমাদের কি আর কখনো কথা হবে না?’
অম্লান কিছু বলতে পারলো না। ওর ভীষণ বিব্রত লাগছে। অনুভব করছে এক ধরণের চিনচিনে ব্যথা। প্রফুল্ল একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘যাও বউকে সময় দাও। অধিকার হারানোর চাইতে কষ্টকর কিছু পৃথিবীতে নেই অম্লান। এ তুমি বুঝবা না। তোমার সাথে যোগাযোগ না থাকলেও যে অধিকারটা ছিলো, সেটাও আজ থেকে আর নেই। অনেক ভালো থাকো। আমাদের স্বপ্নগুলো সব তোমার নীলাক্ষীকে নিয়ে পূরণ কোরো। কিন্তু একটা কথা, আমাকে ভুলতে না পারলেও আমাদের ভালোবাসাকে ভুলে যেও। প্লিজ। অন্য কাউকে ভালোবাসবে হবে তো।’
প্রফুল্ল ফোন কেটে দিলো। অম্লানের ইচ্ছে করছিলো নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে ছিঁড়তে। একহাতে প্রবল জোড়ে চুল টেনে ধরে রইলো ও। আচমকা চারদিক থেকে এতবেশি যন্ত্রণা এসে ওকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেললো যে বেলকনি থেকে লাফ দিতে ইচ্ছে করছিলো। যন্ত্রণায় স্খলিত হতে হতে ওর এত কষ্ট হচ্ছিলো যেন শরীরে পিন ফুটাচ্ছে কেউ। নীলাক্ষী এসে বললো, ‘এই নিন চা। কথা শেষ?’
চলবে..