পর্ব ১৩
নীলাক্ষী মগভর্তি চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অম্লানের বিকশিত সৌন্দর্যে কবলিত হয়ে অদৃশ্য প্রমত্ততায় ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে সে। মানুষটাকে বড় আপন আপন লাগে ওর। ছেলেটা যেন দুচোখে এক ডালি মায়া নিয়ে বসে আছে!
অম্লান মনেপ্রাণে চেষ্টা করছে স্বাভাবিক হওয়ার। মনের মনের ভেতর জ্বলছে প্রমত্ত দাবানল। মানসিক যন্ত্রণায় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়েও অন্যের সামনে সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথা বলাটা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন একটা কাজ। এই কাজটা করতেও অনেক ক্ষমতা দরকার। বিধাতা বোধহয় অম্লানকে সেই ক্ষমতা দিয়েছেন। অম্লানের জায়গায় অন্য কেউ হলে নীলাক্ষীর সাথে অনবরত খারাপ আচরণ করতো, সেখানে ভালোবাসার চেষ্টা, তাকে খুশি রাখা, পরিবারের সবাইকে ভালো রাখা, সবকিছুর ভীড়ে অম্লান যেন ধুকেধুকে মরছিলো। একটু বাঁচার চেষ্টা করতে চেয়েছিলো নীলাক্ষীর হাত ধরেই। এত রাতে প্রফুল্ল ফোন করে তীরে ফিরে আসা তরীটাকে আরেকবার ডুবিয়ে দিয়ে গেলো। সবকিছু ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলো অম্লান। মানসিক চাপ ওকে ভেতরে ভেতরে পুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে।
তবুও মুখে হাসি টেনে নীলাক্ষীকে বললো, ‘এত দ্রুত চা হয়ে গেলো! তুমি কিন্তু কাজে অনেক ফাস্ট। থ্যাংক ইউ সোনা।’
বাদামী সংসার
মিশু মনি
নীলাক্ষী বেলকনিতে রাখা একটা টুল অম্লানকে দিয়ে আরেকটায় ও বসে পড়লো। ফিরে গেলো সেই পুরনো গল্পে, ‘এই তারপর কি হইছিলো? ক্লাস সেভেনের একটা মেয়ে যে নিজের স্কুল ড্রেসের স্কার্ফ খুলে তোমার গা মুছে দিলো? তারপর?’
অম্লান হাসতে হাসতে বললো, ‘ওরে বাবা আর বলিও না। পরেরদিন থেকে স্কুলে যেতে পারতাম না। সবাই হাসাহাসি করতো। বলতো আমি নাকি নায়ক রিয়াজ আর মেয়েটা হচ্ছে পূর্ণিমা। আমাদের সময়ে আবার রিয়াজ পূর্ণিমার জুটি খুব জমেছিলো বুঝলা।’
– ‘হুম বুঝলাম। তোমাকে কি রিয়াজের মতো লাগতো? আমার তো মনে হয় তুমি মান্না।’
– ‘মজা নিতেছো না? হা হা হা।’
হো হো করে হাসতে লাগলো অম্লান। দাবানলের তীব্রতা এত বেশি যে হাসির স্রোতে একটুও সে আগুন কমলো না তবে অম্লানের চেহারা দেখে সেটা এতটুকুও বোঝার সাধ্যি নেই। সে এক চুমুক চা খেয়ে বললো, ‘চা টা ভালোই বানিয়েছো। যতটা কুৎসিত করে বলেছিলে ততটা খারাপ কিন্তু হয়নি। নাও একটু খেয়ে দেখো?’
নীলাক্ষী চায়ের মগটা নিয়ে নিজেও এক চুমুক খেয়ে আবার মগ ফেরত দিলো। অম্লান বললো, ‘শোনো সবসময় এভাবে এক মগ করে চা আনবা। দুজনে ভাগাভাগি করে খাবো।’
– ‘উফফ সেভেনের মেয়েটার কথা বলো। তারপর তারপর?’
– ‘তারপর আমার বন্ধু কিশোর মেয়েটাকে প্রপোজ করে দিলো।’
– ‘যাস শালা, রিয়াজের নায়িকাকে শাকিল খান প্রপোজ করে ফেললো?’
– ‘হা হা হা। না রে না। ও আমার জন্যই প্রপোজ করেছিলো।’
– ‘প্রেম হলো?’
– ‘নাহ। মেয়েটা ওকে বলে দিয়েছিলো, আপনার বন্ধুকে বলবেন আমরা স্কাউট। অন্যের সেবা করাই আমাদের কাজ। এটাকে প্রেম ভেবে ভুল করলে মানহানীর সম্ভাবনা থাকে। স্কাউট রা কিন্তু জীবনরক্ষার সূত্রগুলো ভালোই জানে।’
নীলাক্ষী দারুণ মজা পেয়ে হেসে উঠলো। অম্লানও হাসলো। প্রাণখুলে হাসলো। কিন্তু হাসির আড়ালে ওর বুকের দহনটুকু ক্রমশ বাড়লো বৈ কমলো না। কেউ জানলোও না মানুষটার ভেতরে কি বয়ে যাচ্ছে। অর্ধেক শুকিয়ে যাওয়া ঘা টাকে আবার খুব করে খুঁচিয়ে তাজা করে দিয়ে গেলো প্রফুল্ল।
নীলাক্ষী বললো, ‘চলুন আমরা গানের অনুরোধের আসর খেলি।’
– ‘অনুরোধের আসর? কেমন সেটা?’
– ‘আপনি একটা গান শোনার জন্য অনুরোধ করবেন, আমি সেই গানটা শোনাবো। আবার আমি যে গানের অনুরোধ করবো আপনি সেটা শোনাবেন।’
– ‘ওয়াও দারুণ আইডিয়া তো। তাহলে শুরু করো।’
শুরু হলো অনুরোধের আসর। অম্লানের অনুরোধকৃত গানটি খুব দরদ দিয়ে গাইলো নীলাক্ষী। গান শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো অম্লান। নীলাক্ষীর দিকে তাকিয়ে ওর মায়া বাড়তে লাগলো। আসরের মাঝখানে হঠাৎ বেলকনিতে নীলাক্ষীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে অম্লান বললো, ‘আমি ঘুমিয়ে গেলে ডেকো না।’
– ‘সে কি! এখানে ঘুমাবা?’
– ‘হ্যাঁ।’
নীলাক্ষী গান গাইতে লাগলো গলা ছেড়ে। চোখ বন্ধ করে সেই গানের লিরিক শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লো অম্লান। নীলাক্ষী ডাকলো না, ও একটার পর একটা গান গেয়েই চললো। অম্লান আরাম করে ঘুমাক। রাত বাড়লে সে নিজেও পাশে শুয়ে পড়ার চিন্তা ভাবনা করছে। খুব মশা কামড়াচ্ছে। এক ফাঁকে উঠে কয়েল নিয়ে এসে লাগিয়ে দিয়ে আবারও গান ধরলো নীলাক্ষী। ওর একটুও বিরক্ত লাগছে না, বরং ভালো লাগছে। রাতটাকে ভীষণ আপন মনে হচ্ছে ওর।
আমজাদ সাহেব ও নীলিমা বেগম পাশাপাশি শুয়ে নীরবতা পালন করছেন। তাদের দীর্ঘ সংসার জীবনকে খুব ছোট্ট মনে হচ্ছে। জীবনের ব্যপ্তি আরেকটু বেশি হলে খারাপ হতো না। বাতাসে ভেসে আসা মেয়ের গানের সুর শুনে নস্টালজিক হয়ে পড়ছেন স্বামী স্ত্রী দুজনেই।
বাড়ির দরজায় শব্দ করলে মা এসে দরজা খুলে দিলেন। প্রফুল্ল’র দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলি?’
প্রফুল্ল উত্তর না দিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো। মা ছুটে এলেন ওর ঘরে। আরো একবার জানতে চাইলেন, ‘সমস্যা কি তোর? মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিলি কেন? আমাদেরকে টেনশনে রেখে খুব মজা পাস? যখন মা হবি তখন বুঝবি কি জ্বালা।’
প্রফুল্ল একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘আম্মু, আমাকে নিয়ে তোমাদের আর কোনোদিনও টেনশন করা লাগবে না। সব খতম। যার জন্য টেনশন ছিল, সে মইরা গ্যাছে। আজকের মতো মাফ করো?’
মা কিছু বললেন না। রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ঘরে এলেন প্রফুল্ল’র বাবা। প্রফুল্ল বললো, ‘প্লিজ আব্বু কিছু জিজ্ঞেস কইরো না। আর কখনো টেনশন দিবো না। এইটাই লাস্ট ছিলো। যাও ঘুমাও।’
– ‘ভাত খাবি না?’
– ‘না। খিদা নাই।’
– ‘তোর আম্মু বললো তিন দিন কিছু খাস না? হইছে টা কি তোর? এতদিন তো ভালোই ছিলি। এখন আবার কি সমস্যা?’
– ‘আমি বড় হইছি আব্বু। খাবো না খাবো এইগুলা নিয়া তো এখনো তোমাদের চিন্তার দরকার নাই তাইনা? এইগুলা আমার উপর ছাইড়া দেও? যখন মন চাইবে খায়া নিবো।’
বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘দ্যাখ মা, তুই সব বুঝিস। তুই জানিস বাবা মায়ের মন কত চিন্তা করে?’
– ‘বুঝি বলেই বাসায় জ্যান্তা ফিরছি। নয়তো আমার লাশ ফিরতো।’
বাবা রেগে বললেন, ‘তুই মর। মরিস না কেন? কষ্ট করে বাবা মা বড় করছে আর একটা ছেলের জন্য সে মরে যাচ্ছে। মানে নিজের লাইফের চাইতে একটা ছেলের সাথে থাকাটা তার কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। পড়াশোনা শিখিয়ে লাভ কি হলো? বাবা মাকে অশান্তি ছাড়া কি দিয়েছিস জীবনে?’
প্রফুল্ল শান্ত গলায় বললো, ‘যাও তো আব্বু। কালকে যা ইচ্ছে হয় বইলো। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। প্লিজ যাও।’
– ‘এসব পাগলামোর অর্থ কি জানতে চাই?’
– ‘অম্লান বিয়ে করছে।’
বাবা চমকে উঠলেন। কপালের মাঝখানে দুইটা ভাঁজ পড়লো। মুখটা হয়ে গেলো পাংশুবর্ণ। তবে ভেতরে ভেতরে তিনি এতটা খুশি হলেন যে ইচ্ছে করছিলো আনন্দে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে এক কেজি মিষ্টি একাই খেয়ে ফেলবেন। কিন্তু আনন্দটাকে অপ্রকাশ্য রেখে তিনি প্রফুল্ল’র মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুই এতদিন বিয়ে করছিলি না। আজীবন নাকি এভাবেই থাকবি। অথচ দ্যাখ সে বিয়ে করে ফেললো। শোন মা, এবার তুইও বিয়ে কর। নিজেকে আর কত কষ্ট দিবি বল?’
প্রফুল্ল একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘এখন যাও।’
বাবা হাসিমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। প্রফুল্লকে এখন একা থাকতে দিতে ওনার কোনো দুশ্চিন্তাই নেই। আসল আপদ তো কেটে গেছে। মেয়েটা যেভাবে ইচ্ছে থাকুক।
প্রফুল্ল অনেক্ষণ ধরে ঝরনায় ভিজলো। একসময় শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেলে চলে এলো ঘরে। মা খাবার দিয়ে গেছেন। আজকে ও সামান্য খাবার তুলে মুখে দিলো। একটু আগেও মা রাগী রাগী চেহারায় তাকাচ্ছিলেন। অথচ এখন আদর করে ভাত খেতে বলছেন। পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। প্রফুল্ল’র ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো। জগতের সবাই ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। কেবল সে- ই সারাজীবন একইরকম থেকে গেলো।
শনিবার দিনটা অনেক রৌদ্রজ্জ্বল। নীলাক্ষী সকাল থেকে মায়ের সাথে কাজে সহায়তা করছে। মাঝেমাঝে দৌড়ে ঘরে যাচ্ছে অম্লানকে এক নজর দেখতে। বিকেলে শাশুড়ী মা এলেন। নীলাক্ষী ও অম্লানকে নিয়ে গেলেন বাসায়। আমজাদ সাহেব দ্বিতীয়বার মেয়েকে বিদায় দিতে গিয়ে নিজের ব্যথাতুর হৃদয়ের ক্রন্দন সংবরণ করতে পারলেন না। বেয়াইন সাহেবাকে বললেন, ‘প্রতি সপ্তাহে আমি একবার করে গিয়ে আমার মেয়েকে দেখে আসবো কিন্তু।’
বেয়াইন সাহেবা হেসে জবাব দিলেন, ‘আপনি প্রতিদিন আসুন কোনো সমস্যা নাই।’
এবার নীলাক্ষীর কাছে সবকিছু আর অচেনা মনে হলো না। দাদী ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন বুকে। দোয়েলও একবার জাপটে ধরতে ভুল করলো না। নীলাক্ষীর এখন ভীষণ আনন্দের সময়। পরেরদিনই একটা ছোটখাটো তর্ক বিতর্ক হয়ে গেলো অম্লান ও তার মায়ের। অম্লান চাচ্ছে বউকে নিয়ে হানিমুনে যেতে কিন্তু বাবা মা চাচ্ছেন অম্লানের বোনের বাসায় পাঠাতে। একে একে সব আত্মীয় স্বজনের বাসায় দাওয়াত খাওয়া শেষ করে তারপর হানিমুন।
অম্লান যখন মাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘বিয়েটা কি আত্মীয়দের ভালোর জন্য দিয়েছো নাকি আমার ভালোর জন্য?’ তখন মা কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। রাতে অম্লানের বাবাকে বুঝিয়ে বললেন ছেলে আর ছেলের বউকে ক’দিনের জন্য কোথাও বেড়াতে পাঠাতে হবে। অনেক প্রচেষ্টার পর অম্লান নীলাক্ষীকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি পেলো। লজ্জায় কারো সামনে যেতে পারছে না নীলাক্ষী। অম্লান গুগল নিয়ে বসে গেলো কোথায় যাওয়া যায় সেটা খুঁজতে।
চলবে..