পর্ব ১৫
রাত নেমেছে। ছিপ ছিপ করা বৃষ্টির রাতে অম্লান নীলাক্ষীকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য বের হলো। রাস্তার দুপাশে মাথায় আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্ট গুলোর চোখে ক্লান্তি নেমে এসেছে। বৃষ্টির ঝাঁপটায় কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। নীলাক্ষীর মন ফুরফুরে। গায়ে জলের ফোঁটা পড়লে স্বভাবতই স্যাঁতসেঁতে লাগার কথা। কিন্তু ওর আজ আনন্দ হচ্ছে, ভীষণ আনন্দ। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সবার প্রেমের গল্প শুনতে শুনতে মনের ভেতর এক ধরণের চাপা কৌতুহল জমে ছিলো। প্রেমের স্বাদ নেয়ার জন্য মাঝেমাঝেই সুপ্ত কৌতুহলটা ইচ্ছে হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইতো। কিন্তু পড়াশোনার ফাঁকে ওসব প্রেম টেমকে পাত্তা দেয়া আর হয়ে ওঠে নি। বিয়ের পর যতই সময় গড়াচ্ছে, মনে হচ্ছে ধীরেধীরে ততই প্রেমে পড়ে যাচ্ছে নীলাক্ষী। আর নতুন প্রেমের স্বাদ নিঃসন্দেহে অমৃতের মতো। মন আনচান করা একটা অনুভূতি। যা দেখে তাই ভাল্লাগে। বিশেষত অম্লান পাশে এসে দাঁড়ালে ওর কেমন যেন বুকটা ঢিপঢিপ করা শুরু করে।
বিকেলের সূর্য যখন ক্লান্তি ভরে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ে ডুবি ডুবি করছে, তখন রিসোর্টের ছাদে দাঁড়িয়ে অবাক সূর্যাস্ত উপভোগ করছিলো ওরা। খুব ভোরেই বাস রাঙামাটি শহরে শহরে নামিয়ে দিয়েছে। নীলাক্ষী তখন ছিলো তুমুল উত্তেজিত। আঁকাবাঁকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অম্লান ওকে এক অদ্ভুত সুন্দর লেকের পাড়ে নিয়ে এলো। একদিকে আরণ্যক, একদিকে লেক। লেকের টলটলে জলে নৌকায় করে পাড়ি দিয়ে এক রাজবাড়ীর মতো রিসোর্টে নিয়ে এসেছে অম্লান। চারিদিক নির্জনতায় ভরপুর। সারাদিনের ঘোরাঘুরি শেষে বিকেলের সূর্যাস্ত দেখতে ছাদে দাঁড়িয়ে সতেজ হাওয়ায় প্রাণভরে শ্বাস নিলো নীলাক্ষী।
বাদামী সংসার
মিশু মনি
ধীরেধীরে চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আকাশের লাল আভা পাহাড়ের গা জড়িয়ে ভেসে রয়েছে। কমলা রঙের শাড়ি পরে ছাদে কার্ণিশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে নীলাক্ষী। অম্লান পাশে এসে দাঁড়ালো। সামনে যতদূর চোখ যায়, দূরের বিস্তৃত পাহাড় চোখে পড়ে। নীলাক্ষীর মন বসন্ত বাতাসের মতোই একটা মিঠে হাওয়ায় দোল খেয়ে যাচ্ছে।
অম্লান বললো, ‘তোমাকে আমার কিছু কথা বলার ছিলো।’
নীলাক্ষী পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো, ‘হ্যাঁ বলো। কি কথা?’
অম্লান বললো, ‘তুমি কষ্ট পাও যদি?’
– ‘পাগল নাকি? বলে ফেলো। আমি এত সহজে কষ্ট পাই না।’
নীলাক্ষীর মন পাহাড়ের চূড়ার দিকে। জীবনে এই প্রথমবার পাহাড় দেখছে ও। তাও পাহাড় গুলো দূরে দূরে দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে ওদেরকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। অম্লান বলেছে, অন্য একবার হানিমুনে গেলে ওকে সরাসরি পাহাড়ে নিয়ে যাবে। সেটা ভেবেও উচ্ছ্বসিত নীলাক্ষীর মুখ।
অম্লান পাশে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি একটা মেয়েকে খুব ভালোবাসতাম।’
মুহুর্তেই চমকে ফিরে তাকালো নীলাক্ষী। এক ধাক্কায় মাথা থেকে পাহাড়, সূর্যাস্ত, আকাশের লাল আভা সমস্তকিছু উবে গেলো। অম্লান কি বললো সেটা ভুল শুনেছে কি না, তাই ভেবে আরেকবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কি বললা?’
অম্লান বললো, ‘আসো ওখানে বসি। কথাগুলো তোমাকে বলা দরকার।’
নীলাক্ষীর মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ছোট্ট কোনো বাচ্চাকে খাবার দেয়ার পর সেটা কেড়ে নিলে সে যেমন মন খারাপ করা চাহনিতে তাকিয়ে থাকে, নীলাক্ষীর মুখের অবস্থাও তাই। অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। ছাদের চারপাশ জুরে জ্বলছে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ বাতি।
নীলাক্ষী মৃদু পায়ে চেয়ারে এসে বসলো। ওর কৌতুহলী চোখ এখন পাহাড়ের গান ভুলে অম্লানের দিকে ভর করছে।
অম্লান বললো, ‘আমার একটা রিলেশন ছিলো।’
হাসার চেষ্টা করলো নীলাক্ষী। অন্ধকারে ছাদের সাদা রং উজ্জ্বলতা নিয়ে চেয়ে আছে ওদের দিকে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতে বসতে নীলাক্ষী মৃদু হেসে বললো, ‘থাকতেই পারে। তুমি একজন মানুষ, আর একজন মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই আরেকজন মানুষের প্রেমে পড়বে। ভালোবাসবে। এটা কি অস্বাভাবিক কিছু?’
অম্লান খানিকটা অবাক হলো। নীলাক্ষী বিষয়টাকে এত সহজভাবে নিলো কেন সেটাই বুঝতে পারছে না। ও নীলাক্ষীর দিকে ঝুঁকে এসে বললো, ‘তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কি বলছি? আমার একটা সম্পর্ক ছিলো।’
নীলাক্ষী কঠোর দৃষ্টিতে তাকালো, ‘হ্যাঁ। আমি ঠিকই শুনেছি। তাতে কি হয়েছে? সম্পর্ক থাকতেই পারে। এখন আছে কিনা সেটা বলো?’
অম্লান নীলাক্ষীর দিকে ভয় ভয় চোখে তাকায়। হেসে উঠলো নীলাক্ষী। কমলা রঙের শাড়ির আঁচল সামনে মেলে দিয়ে নীলাক্ষী বললো, ‘তোমার অতীত নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তুমি শুধু বলো এখনো ওই মেয়ের সাথে যোগাযোগ আছে কিনা?’
অম্লান কি উত্তর দেবে বুঝতে পারলো না। চিন্তিত দেখালো ওকে। নীলাক্ষী সত্যিই ভীষণ বুদ্ধিমতী এটা বুঝতে আর বাকি রইলো না। অম্লান বললো, ‘আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি?’
– ‘অবশ্যই পারো। ধরাও।’
অম্লান এবারও বিস্মিত হলো। বিয়ের পর একদিনও নীলাক্ষীর সামনে ও সিগারেট বের করেনি। যে কয়েকবার সিগারেট টেনেছে, হয় বাইরে নয়তো বেলকনিতে। এরপর দাঁত ব্রাশ করে মুখে চুইংগাম দিয়ে নীলাক্ষীর সামনে গিয়েছে। কেন যেন ওর সামনে সিগারেট ব্যাপারটা নিয়ে আসতে অম্লানের সংকোচ কাজ করছিলো। অথচ নীলাক্ষী ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছে এটা ভেবে ওর অবাক হওয়ার পালা।
অম্লান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো, ‘আমাদের চার বছরের সম্পর্ক ছিলো। দুই বছর হলো ব্রেক আপ হয়ে গেছে।’
– ‘ওহ আচ্ছা। তোমার অতীতে একটা সংসার থাকলেও আমার এ বিষয়ে কিছু বলার নেই। যোগাযোগ আছে কিনা আমি সেটা জানতে চাইছি।’
অম্লান সিগারেটে টান দিয়ে বললো, ‘হু।’
নীলাক্ষীর বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। ওর আশা ছিলো অম্লান বলবে, ‘নেই।’ তবুও যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় নীলাক্ষী বললো, ‘তোমার সম্পর্ক নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। যোগাযোগ না রাখলেই আমি খুশি হবো। তোমার বউ তার এক্স বয়ফ্রেন্ড এর সাথে যোগাযোগ রাখলে তোমার কেমন লাগবে?’
অম্লান নীলাক্ষীর চোখের দিকে তাকাতে পারলো না ভয়ে। নীলাক্ষীর কোমল চেহারা দেখতেই অভ্যস্ত হয়েছে সে। এমন কঠিন অগ্নিদৃষ্টি দেখে নিজেকে নিয়ে খানিক শঙ্কা জাগারই কথা। অম্লান বললো, ‘আমি যোগাযোগ রাখি নাই। ছয় সাত মাস দেখা বা কথা কোনোটাই হয় নাই। সেদিন রাতে ফায়রুজ কল দিয়ে বললো ও নাকি ফায়রুজের বাসায় গেছে। আমি তারপরও কথা বলতে চাইনি। ফায়রুজ জোর করে দিলো। মেয়েটা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। যোগাযোগ না থাকলেও হুট করে আমার বিয়ের ছবি দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে নি।’
নীলাক্ষী শান্ত ভঙ্গিতে অম্লানের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনলো। এক পা আরেক পায়ের ওপর তুলে দিয়ে আরাম করে চেয়ারে বসেছে ও। শাড়ির আঁচলটা আর্ট করে সামনে নিয়ে পা দোলাতে দোলাতে বললো, ‘হুম। বুঝলাম।’
অম্লান সিগারেটে আরেকটা ফুঁক দিলো। এক দলা থুথু দূরে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, ‘লাস্ট দুই বছরে আমাদের তেমন যোগাযোগ হয় নাই। তিন চার মাস পরপর হয়তো ও একবার কল দিতো, বা কখনো আমি কল দিতাম। কিছুক্ষণ কথা বলতাম। খোঁজ খবর নিতাম। এতটুকুই। গত ছয় মাসে আমি নিজেকে একেবারে গুছিয়ে নিয়েছি। ওকে ভুলে যাওয়ার সবরকম চেষ্টা করেছি, ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করেছি। আমার ফ্যামিলি বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলো। দিনশেষে আমিও ভীষণ একা ছিলাম। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ কষ্ট হচ্ছে একাকীত্ব। ভীষণ কষ্ট হতো। রাতে ঘুমাতে পারতাম না। বন্ধু বান্ধব তো দিনের বেলার জন্য, রাত হলে কাছে কেউ থাকতো না। কাউকে মনের কথা বলবো, কার কাছে গিয়ে একটু জড়িয়ে ধরে ব্যকুলতা ভরে কাঁদবো? ভয়ানক সময় যাচ্ছিলো। ভাবলাম বিয়ে করি। সারাজীবন তো এই একাকীত্ব বয়ে বেড়াতে পারবো না। জীবনটাকে ভালোভাবে উপভোগ করতে কে না চায় বলো? আরেকদিকে পরিবারের চাপ তো আছেই। তোমাকে দাদী পছন্দ করেছে। দাদী বললো তুমি আমাকে সুখী রাখতে পারবে। আর আমার প্রতি বিশ্বাস রাখো নীলু, আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি না। তোমাকে আঁকড়ে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করছি, তোমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করছি। আমি আমার অতীত নিয়ে পড়ে থাকতে চাই না। আমাকে বিশ্বাস করো।’
নীলাক্ষী গালে হাত দিয়ে অম্লানের দিকে চেয়ে আছে। ভীষণ ভাবুক চাহনি। অম্লান সিগারেট টা দূরে ছুড়ে মেরে বলল, ‘তুমি যদি আমাকে ভুল বুঝো আমি কার কাছে যাবো? আমি চাই তুমি আমার বন্ধুর মতো আপন হয়ে পাশে থাকো। আমাকে সবকিছু সাজাতে সাহায্য করো। যদি দূরে সরিয়ে রাখো আমি তো বাকি জীবনেও আর ভালো থাকতে পারবো না। তুমিও পারবে না।’
নীলাক্ষী ভাবলেষহীন চোখে জিজ্ঞেস করলো, ‘আলাদা হলে কেন?’
অম্লান বললো, ‘ও হিন্দু ছিলো। আমি জেনেশুনে সম্পর্কে জড়াই নি। কিভাবে যেন সম্পর্কটা হয়ে গেছিলো। সম্পর্কটা দুই পরিবারের কেউই মেনে নেয়নি। আমার ফ্যামিলি ওকে মুসলিম হতে বলেছিলো। কিন্তু সেটা হলে বাবা মায়ের সাথে ওর সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যেতো। আর ও বাবা মাকে কষ্ট দিতে চায় নি।’
নীলাক্ষী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ছাদের এক কোণায় পড়ে থাকা অম্লানের ফেলে দেয়া সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ। মিটমিট করে আগুন জ্বলছে। নীলাক্ষী পায়ের তলা দিয়ে সিগারেটের আগুন নিভিয়ে দিলো। মুখটা ভাবলেষহীন। অম্লানের কাছে এসে ওর দিকে ঝুঁকে বললো, ‘আমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে থাকলে এখন ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতো। কিংবা মন খারাপ করে বসে থাকতো। আমি অত সেনসিটিভ নই। সংসারে সুখী থাকতে হলে ছাড় তো দিতেই হবে। আমি তোমার অতীতকে ছাড় দিচ্ছি। ও নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে কখনো আবারও ওই মেয়ের সাথে যোগাযোগ করেছো বুঝতে পারলে আর ছাড় দিবো না। তুমি নিশ্চয় চাইবে না তোমার বউ তার প্রাক্তনের সাথে যোগাযোগ রাখুক?’
অম্লান কিছু বললো না। ওকে ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো নীলাক্ষীর দিকে।
নীলাক্ষী চেয়ারে বসতে বসতে বললো, ‘ও কখনো ফোন দিলে বলবে বিয়ে করে সংসার করতে। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কখনো যোগাযোগ করতে নিষেধ করবে। আর তুমি আমার স্বামী, তোমার এখন একমাত্র কর্তব্য আমাকে ভালোবেসে সুখী রাখা। আমি জানি তুমি সেই চেষ্টা করছো। একদিন সব ভুলে আমাকেই ভালোবাসবে এটাও জানি। তবে আজ রাতে আমি একটা কথা বলে রাখছি। আমার আত্মসম্মান বোধ কিন্তু অনেক। যদি কখনো বুঝতে পারি আমার প্রতি তোমার কোনো ভালোবাসা নেই, সেদিন আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো। সমাজের বোকাসোকা মেয়েদের মতো নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তোমার সাথে পড়ে থাকবো না। সমাজ কি বললো, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। ভালোবাসা ছাড়া অযথা একসাথে থাকার কোনো মানে হয় না।’
নীলাক্ষী উঠে অন্যদিকে চলে গেলো। অম্লান দারুণ ভয় পেয়ে গেছে। মেয়েটার দম আছে বলতে হবে। অম্লানের ভেতর থেকে মেঘ কেটে যেতে শুরু করেছে। মনে মনে ভাবছে, এরকম একজনকেই দরকার ছিলো ওর। একটু কঠোর না হলে স্বামীকে ধরে রাখাটাও কষ্টকর।
অম্লান চেয়ারে হেলান দিয়ে নীলাক্ষীর দিকে তাকিয়ে রইলো। নীলাক্ষীর পিঠে এলিয়ে দেয়া লম্বা চুল। মুখটা দেখার জন্য মনটা ভীষণ উচাটন করতে লাগলো অম্লানের। ছাদের অন্য এক কোণায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছে নীলাক্ষী, ‘আমি তো অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে। তারপরও অম্লানের প্রেমিকার কথা শুনে আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। প্রকাশ করতে পারছি না। এই সময়ে অম্লানের সাথে খারাপ আচরণ করলে ও কষ্ট পাবে। কিন্তু ভেতরে আমার এত আগুন ধরে গেলো কেন? মনে হচ্ছে ধীরেধীরে সমস্ত শরীরে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। তবে কি অম্লানকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি!’
অম্লানের কথায় চমকে উঠলো নীলাক্ষী, ‘রুমে যাবা কখন?’
নীলাক্ষী ভেতরের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করে বললো, ‘আসো।’
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দুজনই নিরব। দূরত্ব বজায় রেখে একসাথে পা ফেলছে দুজনে। নীলাক্ষী ঘরে এসে বাথরুমে ঢুকলো। বিছানায় বসে আনমনা হয়ে পড়লো অম্লান। নীলাক্ষীর সাথে কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতেই পারছে না। মনে হচ্ছে দুজনের মাঝে বড় কোনো ঝড় বয়ে গেছে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে ওর। এসির তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে অম্লান মনে মনে ভাবলো, ‘নীলু এলে বলবো এদের এসি নষ্ট নাকি? ঘর ঠান্ডা হচ্ছে না।’ তখন নীলাক্ষী রিমোট নিয়ে বলবে, ‘টেম্পারেচার বাড়াই রাখলে ঠান্ডা হবে কি করে?’
এভাবেও কথা শুরু করা যায়। ঝগড়াঝাটি হলেও হোক কিন্তু ঝড় পরবর্তী পরিবেশটা ঠিক
করতে হবে তো। নীলাক্ষী বাইরে আসতেই অম্লান বললো, ‘ঘরটা গরম হয়ে…’
কথা শেষ করতে পারলো না। আচমকা নীলাক্ষী ছুটে এসে অম্লানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকের ওপর উঠে বসলো। অম্লানের গলা চেপে ধরে বললো, ‘আরেকবার ওই মাগীর কথা ভাবলে তোকে খুন করে ফেলবো। বিয়ে করছে আমাকে আর আরেকজনের কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছে। আমি বানের জলে ভেসে আসছি? শরীরের একটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গও ঠিক থাকবে না। সব কেটে রান্না করে খেয়ে ফেলবো। যদি আর কখনো ওর কথা ভাবতে দেখি।’
অম্লান বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো নীলাক্ষীর দিকে। হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝে আসছে না। নীলাক্ষী গলা চেপে ধরে জিভ বের করে ফেলবে মনে হচ্ছে। অম্লান হাত দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। নীলাক্ষীর এই রূপ ওর একেবারেই অচেনা। সত্যি বলতে বিয়ের পরের কয়েকটা দিন মেয়েরা এত লজ্জাবতী লতিকা হয়ে থাকে যে, তাদের ভেতর একটা ভয়ংকর রূপ থাকতে পারে এটা কল্পনাই করা যায় না।
নীলাক্ষী অম্লানের কলার চেপে ধরে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বুকে খামচি দিয়ে বললো, ‘আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। কোন আক্কেলে তুমি আমাকে প্রাক্তনের কথা বলতে পারলা? আর কোনোদিন বলছো তো জবাই করে ফেলবো। আমার কষ্ট হচ্ছে না?’
অম্লান নীলাক্ষীর মুখ টেনে ধরে কাছে এগিয়ে আনলো, ‘আচ্ছা আর বলবো না। আর ভাব্বোও না। প্রমিস।’
নীলাক্ষী অম্লানকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বললো, ‘এত গরম লাগছে কেন?’
অম্লান হাসতে হাসতে বললো, ‘শুধু কি গরম? পোড়া পোড়া গন্ধও বের হয়েছে। কোথায় যেন আগুন জ্বলছে। একজন জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে…’
নীলাক্ষী আবারও ঝাঁপিয়ে পড়লো অম্লানের ওপর। সমস্ত ব্যথা, যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে বাকি রাতটা হয়ে উঠলো খুনসুটিময়। জরিমানা নিয়ে ভাবনা নেই বলেই হয়তো রিসোর্টের দুটো বালিশের তুলো বের করে পুরো ঘরময় মেঘের ছড়াছড়ি করে ক্লান্ত হয়ে পড়লো তারা।
চলবে..