বাদামী সংসার
পর্ব ২৬
মিশু মনি
বিশ্ববিদ্যালয়ের বসন্ত বরণ অনুষ্ঠান। উপস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রফুল্ল’কে। মেয়েটা চমৎকার কথা বলে। হাস্যোজ্জ্বল লাবণ্যময়ী চেহারা। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। লম্বা চুলে ভলিউম লেয়ার কাট দেয়া। যখন করিডোরে পা ফেলে দ্রুতপদে হেঁটে যায়, জানালা দিয়ে দু একজন ছাত্র ক্লাসে অমনোযোগী হয়ে মুখ তুলে তাকায়। এমন করে প্রত্যেকটা ব্যাচেই দু চারজনের নজর কাড়ে মেয়েটি। গালে কন্টোরিংয়ের প্রয়োজন হয় না। মেদহীন চিবুকে প্রকৃতিগত ভাবেই কন্টোর করে দেয়া তার। গলার স্পষ্ট স্বর আর আত্মবিশ্বাসী চলন বলনেই কতক ছেলে মুখরে পড়ে। সে যখন স্টেজে উঠে গায়কের নাম ঘোষণা করবে, তার পরবর্তী ঘোষণা শোনার আগ্রহ নিয়ে গ্যালারিতে দর্শক জমবে, এটা তো নিশ্চিত বাক্য।
প্রফুল্ল ভার্সিটিতে আসার পর এটাই প্রথম অনুষ্ঠান যেখানে সে উপস্থাপিকা হিসেবে থাকবে। রিহার্সাল চলছে দুদিন ধরে। আজ প্রফুল্ল খাতা কলম নিয়ে রিহার্সাল রুমে এসে বসলো। কোন শিল্পী কি পরিবেশন করবে, কেমন করে গাইবে সেসব পর্যবেক্ষণ করে প্রফুল্ল নোট করে রাখবে। আর তারপর নিজেই কাব্যিক ভাষায় লিখবে যেসব কথা অনুষ্ঠানের দিন বলতে হবে। তারও তো প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে।
একটা চেয়ারে বসে হারমোনিয়াম বাজানোর দিকে মনোযোগ রেখে বুঁদ হয়ে শুনছে প্রফুল্ল। হঠাৎ জাহ্নবী ম্যামের গলা শোনা গেলো। ম্যাম প্রফুল্লকে উদ্দেশ্য করেই কিছু একটা বলছিলেন। প্রফুল্ল চমকে ম্যামের দিকে তাকায়। দাঁড়িয়ে বলে, ‘জি ম্যাম।’
ম্যাম একটা ছেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘প্রফুল্ল, ও হচ্ছে অম্লান। ফাইনাল ইয়ার। ও তোমার সঙ্গে উপস্থাপনা করবে।’
প্রফুল্ল এক পলক ছেলেটার দিকে তাকালো। উশকো খুশকো চুল। পরনে মেরুন রঙা পাঞ্জাবী। উদভ্রান্তের মতো চাহনি। গাল দুটো খানিক চিমসানো। চোখের নিচে জমাট বাঁধা কালো দাগ। দুটো জোড়া ভ্রু, লাল লাল দুটো চোখ, তবে চোখে ঢের মায়া। চিকন চাকন একটা ছেলে। দেখেই মনেহয় ডিপ্রেশনে ভুগছে। সে নাকি আবার স্টেজ পারফরম্যান্স করবে! প্রফুল্ল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
জাহ্নবী ম্যাম বললেন, ‘তোমরা পরিচিত হও কথা বলো। আর অম্লান, প্রফুল্ল’র কথা তোমাকে বলেছিলাম। তাহলে তোমরা নিজেদের মতো কাজ গুছিয়ে নাও কেমন? যেকোনো দরকারে আমি আছি, ঈশান স্যার আছে, মেহরিন আছে। আমাদেরকে জানাবে। কেমন?’
প্রফুল্ল মাথা দোলালো, ‘ওকে ম্যাম।’
ম্যাম শরীর দুলিয়ে চলে গেলেন। অম্লান নামের ছেলেটা তার উদভ্রান্ত চাহনি তাক করে প্রফুল্ল’র দিকে তাকালো, ‘হ্যালো।’
প্রফুল্ল মুখে ‘হ্যালো’ বললেও মনেমনে খুশি হতে পারলো না। তার সাথে একটা রোগা পটকা ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ছেলেকে ধরে এনেছে পারফর্ম করার জন্য। ইউনিভার্সিটিতে কি ছেলেপেলের অভাব! ওকে দেখলেই তো সব ছেলেরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
অম্লান বললো, ‘আপনার কথা ম্যামের কাছ থেকে শুনেছি। ম্যাম আপনাকে অনেক পছন্দ করে বুঝতে পেরেছি।’
– ‘ও। বসুন। রিহার্সাল দেখুন।’
– ‘আপনি কি আগেও রিহার্সালে এসেছিলেন?’
– ‘না। আজকে প্রথম আসলাম। আগের দুদিন রিহার্সালে তেমন কোনো গান হয় নাই। হালকা পাতলা।’
– ‘খাতায় কি লিখেছেন দেখতে পারি?’
– ‘শিওর। দেখেন।’
প্রফুল্ল খাতা এগিয়ে দেয়। উশকো খুশকো চুলওয়ালা ছেলেটা হা করে খাতার লেখাগুলো দেখে। “১ নাম্বারে জেরিন, রবীন্দ্র সংগীত। মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো… মাতাল করিয়া আমারে.. প্র দোল ম পা”
এরকম বেশ কয়েকটা লাইন। কিছু কিছু জায়গা বুঝতে না পেরে অম্লান জিজ্ঞেস করলো, ‘এগুলো কি?’
– ‘ওগুলো কোড।’
– ‘কিসের কোড?’
– ‘আপনি বুঝবেন না। আমি বুঝবো।’
– ‘বাহ ইন্টারেস্টিং তো! আপনি বুঝবেন কেন?’
– ‘কারণ ওগুলোর আবিষ্কারক আমি তাই। আপনার কিছু জানার থাকলে বলবেন। আপনিও খাতাকলম নিয়ে নিজের নোট নিজে করুন। আমারটা আপনার বোঝা লাগবে না।’
অম্লান ঠোঁট ওল্টালো। সে খাতা-কলম কিছু ই নিয়ে আসেনি। প্রফুল্ল’র থেকে দুইটা পৃষ্ঠা চেয়ে নিয়ে কলম দিয়ে দুজন শিল্পীর নাম লিখে রাখলো। এখন গানের রিহার্সাল চলছে, ‘বসন্ত বাতাসে সইগো, বসন্ত বাতাসে.. বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে, সইগো বসন্ত বাতাসে….’
অম্লান খেয়াল করে দেখলো প্রফুল্ল এক পাশে ছোট অক্ষরে লিখে রাখলো, ‘ব আ ভ্র ম কা বা লা।’
এবার কৌতুহল দমন করে রাখা দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে উঠলো। প্রফুল্ল মেজাজ তুঙ্গে তুলে বসে আছে। ভেতরে ভেতরে ক্ষুদ্ধ সেটা বুঝতে দিচ্ছে না। কাজের সময় কেউ তার লেখার দিকে তাকিয়ে থাকলে প্রফুল্ল’র মেজাজ গরম হয়।
অম্লান দাঁত কেলিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘বলুন না এই কোড গুলো কিসের?’
প্রফুল্ল বললো, ‘ব তে বসন্ত, আ তে আসিয়া, ভ্র তে ভ্রমর এভাবে..’
– ‘ম তে মন, কা তে কি?’
প্রফুল্ল রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো অম্লানের দিকে। অম্লান ভয় পেয়ে বললো, ‘সরি সরি। নাউ উই আর কলিগ। মানে আমরা এখন সহকর্মী। একসাথে কাজ করছি। আমাদেরকে তো একসাথে কাজের জন্য হলেও কোডগুলো জানা দরকার।’
– ‘লাগবে না আপনার জানা।’
– ‘আচ্ছা আপনার কি এই কোডগুলো মনে থাকবে? ধরুন ভ্র তে ভ্রমর। বাসায় যাওয়ার পর হয়ে গেলো ভ্র তে ভ্রমণ। বসন্ত আসিয়া ভ্রমণে মন কান্দিয়া বাচিয়া লাগিলো রে.. এরকম হয়ে গেলে কেমন উদ্ভট হবে বলুন তো?’
প্রফুল্ল দাঁড়িয়ে পড়লো। রাগী মুখে বললো, ‘আপনার চিন্তা ভাবনাও আপনার মতো উদ্ভট। যত্তসব আজেবাজে কথা। আসছে শেখাইতে। আমি ছোটবেলা থেকেই কোড দিয়ে লিখি। আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না।’
– ‘ও আচ্ছা আচ্ছা। সরি। আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?’
– ‘নাহ, রাগছি না তো। আমি তো এখন নাচবো। তা তা ধেই ধেই করে।’
– ‘তাই! আপনিও ডান্স করবেন?’
প্রফুল্ল তার লেখার খাতা দিয়ে অম্লানের মুখের ওপর একটা মাইর বসিয়ে হাঁটা ধরলো। বিরক্তিকর একটা ছেলের সাথে তাকে কাজ করতে হবে। আরেকজনের ব্যাপারে নাক গলাবেই বা কেন সে!
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো প্রফুল্ল। মিনিট চারেক দাঁড়িয়ে থাকার পর অম্লান এসে বললো, ‘আপনি তো খুব দ্রুত হাঁটেন। দুই মিনিটে এতদূর চলে এসেছেন।’
– ‘শাট আপ।’
– ‘রিল্যাক্স। আমি একটা জিনিস জানতে আসছিলাম।’
– ‘কি জিনিস?’
– ‘নজরুল সংগীত গাওয়া মেয়েটার নাম নূরজাহান লিখেছেন। কিন্তু এখন তো নূরনাহার গান গাইছে। নামটা নূরনাহার হবে।’
প্রফুল্ল একটা নিশ্বাস ফেলে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। কপালে পড়েছে সুক্ষ্ম কতক ভাঁজ। বললো, ‘প্রথমত, যেটা জানতে চাইছেন সেটা একটা বিষয়, নট জিনিস। আর দ্বিতীয়ত, নজরুল সংগীত গাওয়া মেয়েটার নাম নূরজাহান। এখন যিনি গান গাইছেন ওনার নাম নূরনাহার। আপনার জানা উচিৎ, এটা বাউল সংগীত। নজরুল নয়।’
– ‘ওহ। সরি।’
মাথা চুলকাতে লাগলো অম্লান। কি যাচ্ছেতাই একটা ব্যাপার। মেয়েটা নিশ্চয় প্রথমদিনেই তার ওপর ভয়াবহ রেগে যাচ্ছে। একসাথে কাজ করতে গেলে তো বিপদেই পড়তে হবে।
প্রফুল্ল বললো, ‘শুনুন। আপনারে একটা কথা ক্লিয়ার করে বলতেছি। এইরকম ফাত্রা মার্কা হেয়ার স্টাইল নিয়ে ভার্সিটিতে আসা যায় কিন্তু স্টেজ পারফরম্যান্স করা যায় না। ওকে? নেক্সট টাইম চুল কেটে পরিপাটি হইয়া আসবেন।’
অম্লান মাথাটা দুদিকে নাড়িয়ে উত্তর দিলো, ‘ওকে। চুল কি স্টাইল করে কাটবো? লাইক কোনো খেলোয়াড়ের মতো?’
– ‘না। আর্মি ছাট দেবেন।’
– ‘আমাকে কি আর্মির চাকরি দেবেন?’
– ‘শাট আপ।’
– ‘ওকে। চুপ।’
অম্লান মুখের ওপর আঙুল রেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রফুল্ল মিনিট খানেক চুপ করে থাকতেই রাগ পড়ে যায়। এবার হাসি পায় রীতিমতো। রিহার্সাল রুমের দিকে যাওয়া শুরু করলো সে। অম্লান নিতান্তই বাধ্যগত ছাত্রের মতো প্রফুল্লকে অনুসরণ করে রিহার্সাল রুমে ঢোকে।
পরেরদিন অম্লানকে দেখে প্রফুল্ল নরম সুরে বললো, ‘ভাইয়া আপনাকে না বলেছিলাম হেয়ার কাট দিবেন। মানে এভাবে তো পারফর্ম করা যায়না তাইনা? একটা প্রেস্টিজ তো আছে। আপনি রাতে মনেহয় ঠিকমতো ঘুমান না। একটু ঘুমাবেন কেমন? অন্তত প্রোগ্রামের আগের দিন পর্যন্ত।’
অম্লান করুণ মুখ করে বললো, ‘জি আচ্ছা আপু। আমি দ্রুত চুল কেটে ফেলবো।’
– ‘থ্যাংকস ভাইয়া।’
রিহার্সাল চলাকালীন অম্লান হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা আপু কালকে যে কোড গুলো লিখেছিলেন ওগুলো বলুন তো। দেখি মনে আছে কিনা।’
– ‘কেন? আপনারে কি পরীক্ষা দিতে হবে?’
– ‘না। এমনি শুনতাম আরকি।’
– ‘নো থ্যাংকস।’
– ‘নো ওয়েলকাম।’
– ‘আপনি এত ডিসগাস্টিং কেন? পরে এসেছেন একটা ঢোলা পাঞ্জাবী। সিরিয়াসলি আই ডোন্ট লাইক দিস টাইপ অব হিউম্যান। ইরিটেটিং।’
অম্লান মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। লজ্জা করছে তার। একটা মেয়ে এভাবে বারবার অপমান করে চলেছে। ছি ছি, কি বিশ্রী ব্যাপার।
অম্লান মন দিয়ে রিহার্সাল উপভোগ করছে। হঠাৎ প্রফুল্লকে বললো, ‘দুইটা পেজ দিন।’
‘পেজ মানে?’
‘আমি খাতা আনিনাই।’
‘আপনি খাতা আনেন নাই এটা আপনার ব্যাপার। আমি কালকেও আপনাকে পেজ দিছি। আজকে পারবো না।’
‘আরে ভাই কো অপারেট তো করতে হবে নাকি?’
‘পারবো না ভাই। বালের কো অপারেট। সে প্রোগ্রামে হোস্ট থাকবে অথচ খাতা-কলম আনে নাই। আজিব’
বিরক্তিকর মুখে প্রফুল্ল উঠে বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে। অম্লান গালে হাত দিয়ে নিরীহ ভঙ্গীতে বসে রইলো।
প্রফুল্ল জাহ্নবী ম্যামের কাছে এসে মুখে নরম অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বললো, ‘ম্যাম আমি সরি। যে ছেলেটাকে আপনি আমার সাথে দিয়েছেন উনি অনেক বিরক্তিকর। চুল কাটে না, জামাকাপড় কেমন যেন। প্রেজেন্টেশনে একটা পরিপাটি লুক এট লিস্ট থাকা উচিৎ। ম্যাম, আমি ওনার সাথে কাজ করতে পারবো না।’
জাহ্নবী সাহা অনেক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে প্রফুল্ল’র মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ওনার ছোট করে ছাঁট দেয়া চুলগুলো বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসে উড়ছে। চশমার আড়াল দিয়ে কৌতুহলী চোখে তিনি প্রফুল্লকে দেখছেন।
প্রফুল্ল বললো, ‘ম্যাম কিছু মনে করবেন না। ওনাকে আমার ভালো লাগে নি।’
ম্যাম মাথা দোলালেন। চশমা খুলে বললেন, ‘আমার তো ভালো লাগে প্রফুল্ল।’
‘সরি ম্যাম। আমি বলতে চাইছিলাম পরিপাটি কাউকে.. উনি তো ভালো করে কথাও বলতে পারেন না।’
‘প্রফুল্ল, রিহার্সাল রুমে যাও। একসাথে কাজ করো। তাকে হেল্প করো। হি ইজ ইয়োর সিনিয়র।’
প্রফুল্ল হতাশ হয়ে মাথা নিচু করে বললো, ‘ওকে ম্যাম।’
মনেমনে দারুণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেও বাইরে নিতান্তই নরম প্রকৃতি প্রকাশ পূর্বক প্রফুল্ল রিহার্সাল রুমে ঢোকে। গান বাজনা ভালোই চলছে। অম্লান একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে দার্শনিক স্টাইলে তাকিয়ে আছে শিল্পীর দিকে। গান শুনছে নাকি শিল্পীর রূপে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে সেটা ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছে প্রফুল্ল’র। সে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লো। অম্লানের চেয়ারের হাতলে খাতা কলমও নেই। ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে প্রোগ্রামের ব্যাপারে একটুও সিরিয়াস নয়। কেন যে ম্যাম এসব ছেলেপেলেকে কাজে লাগায়! বিরক্তি নিয়ে নিজের কাজে মন দিলো প্রফুল্ল।
এমন সময় একজন এসে প্রফুল্লকে বললো, ‘আপু ঈশান স্যার ডাকছেন।’
প্রফুল্ল ঈশান স্যারের রুমে এসে নমস্কার জানায়। ঈশান স্যার বললেন, ‘বসুন।’
প্রফুল্ল স্যারের ডেস্কের সামনে রাখা চেয়ারে বসলো। স্যার ল্যাপটপে কাজ করছেন। কাজ বন্ধ করে প্রফুল্ল’র দিকে তাকালেন, ‘কি খবর প্রফুল্ল? সবকিছু ভালোভাবে চলছে?’
‘জি স্যার।’
‘কোনো সমস্যা নেই তো?’
‘না স্যার।’
‘জাহ্নবী ম্যাডাম বললেন সমস্যা আছে।’
প্রফুল্ল মাথা নিচু করে রইলো। ম্যামের মুখের ওপর দিয়ে কথা বলার দুঃসাহস তো তার নেই। প্রফুল্ল হাসিমুখ ধরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করে উত্তর দেয়, ‘না স্যার। সমস্যা নেই।’
স্যার ল্যাপটপ এগিয়ে দিলেন প্রফুল্ল’র দিকে। বললেন, ‘ভিডিওটা দেখুন প্রফুল্ল।’
প্রফুল্ল’র বুক ধক করে উঠলো। কিসের ভিডিও! চমকে উঠে ধুকপুক করা বুকসমেত সে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রাখে। একটা অনুষ্ঠানের মঞ্চ। সেখানে উপস্থাপন করছে অম্লান। একদম খাঁটি আনুষ্ঠানিক পোষাক। কোট, প্যান্ট, সু, টাই। ভীষণ স্মার্ট দেখাচ্ছে তাকে। চুলগুলোও সুন্দর ছোট ছোট করে ছাঁট দেয়া। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলে, প্রত্যেকটা শব্দ কানে এসে ধারালো সুরের মতো নিক্কণ তোলে। এত ভালো লাগে শুনতে। উপস্থাপনের স্টাইল আর কথা শুনেই গান শোনার আগ্রহ জাগে। কত মাধুর্যতা ভরা একটা পারফরম্যান্স। মুগ্ধ না হয়ে পারলো না প্রফুল্ল। চার/ পাঁচ মিনিট সে স্তব্ধ ও লজ্জিত ভঙ্গীতে মাথা নামিয়ে বসে রইলো।
ঈশান স্যার বললেন, ‘দেখুন।’
পরপর কয়েকটা ছবি দেখালেন স্যার। একটাতে অম্লান ব্লেজার পরিহিত। মাইকের সামনে কথা বলছে। আরেকটাতে তার হাতে পুরষ্কার। স্যার বললেন, ‘ছেলেটা বিতর্ক অলিম্পিয়াড। পরপর দুবার বিভিন্ন পাবলিক ইউনিভার্সিটিকে হারিয়েছে। ভার্সিটির রেগুলার বিতর্কে তো তুখোড় পারফর্ম করে। ওর উপস্থাপনা তো দেখলেন ই। এখন হয়তো এলোমেলো মনে হচ্ছে। প্রোগ্রামের দিন ওর জাদু দেখাবে। ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা সবসময় তাদের প্রতিভা দেখিয়ে বেড়ায় না। একটা কথা কি শোনেন নি, ডোন্ট জাজ এ বুক বাই ইটস কভার?’
প্রফুল্ল লজ্জায় মুখ কাচুমাচু করে বললো, ‘স্যার আমি রিয়েলি সরি। স্যার আসলে একটা ভুল হয়ে গেছে। ওনার কোনো দোষ নেই। আমিই আসলে ভুলভাল ভেবে বসেছিলাম। থ্যাংকস স্যার আমার ভুলটা ভাঙানোর জন্য।’
– ‘মোস্ট ওয়েলকাম। আশাকরি একে অপরকে হেল্প করবেন এবং একটা চমৎকার প্রোগ্রাম আমাদেরকে উপহার দেবেন।’
– ‘আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো স্যার। থ্যাংক ইউ।’
– ‘এখন যান আপনি। কোনো সমস্যা হলে আমাদেরকে জানাবেন।’
– ‘ওকে স্যার।’
প্রফুল্ল স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এসে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অপরিচিত বড় ভাইয়ের সাথে কি আজগুবি ব্যবহারটাই না সে করলো। না জানি উনি কি ভাবছেন!
প্রফুল্ল রিহার্সাল রুমে এসে নিজের খাতা নিয়ে অম্লানের পাশে এসে বসলো। মিষ্টি হেসে বললো, ‘কিছু লেখার হলে এখানে লিখবেন। আমি আপনাকে ছবি তুলে মেইল করে দেবো।’
– ‘থ্যাংকস। আমার খাতা লাগবে না। এমনি মনে থাকবে।’
– ‘এমনি মনে থাকবে!’
– ‘আপনি কোড মনে রাখতে পারলে আমার নাম মনে থাকবে না?’
লজ্জা পেয়ে হাসলো প্রফুল্ল। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে সে লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করলো। সিনিয়রের সাথে বেয়াদবি করাটা মোটেই তার উচিৎ হয়নি। এর জন্য কড়া করে ‘সরি’ বলতে হবে ওনাকে।
কিন্তু ‘সরি’ বলবো কিভাবে! আমি তো ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম।
গল্প শুনে হো হো করে হেসে উঠলো পাঞ্জাবীওয়ালা। এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রফুল্ল’র গল্প শুনছিল সে। প্রফুল্ল কথা থামাতেই সে নড়েচড়ে বসলো। আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো, ‘তারপর?’
চলবে..
মিশু মনি’র নতুন উপন্যাস “সুন্দরের চোখে জল” এর প্রি অর্ডার চলছে। পাচ্ছেন ২৫% ডিসকাউন্টে, মাত্র ২১৮ টাকায়। প্রি অর্ডার করতে কল করুন – +8801519-521971 (রকমারি)