বাদামি সংসার পর্ব-৩৪

0
966

বাদামী সংসার
পর্ব ৩৪
মিশু মনি

রাত বাড়ার সাথে সাথে অম্লানের দেহে হু হু জরে জ্বর নামলো। জ্বরের ঘোরে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না অম্লান। বালিশে রাখা মাথা বারবার এদিক সেদিক করছে, ছটফট করছে খুব। পাশে ঘুমন্ত অবস্থায় নীলাক্ষী। অম্লান বারকয়েক নাম ধরে ডাকলো, ‘নীলু, এই নীলু..’

নীলাক্ষী চমকে ওঠে ঘুম থেকে, ‘কি গো?’
অম্লান জড়ানো কণ্ঠে বললো, ‘আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে।’

নীলাক্ষী অম্লানের গলায়, গালে ও কপালে হাত ছুঁইয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো, ‘জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে! কি হলো হঠাৎ তোমার?’

হন্তদন্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো নীলাক্ষী। আলো জ্বালালো, বাথরুম থেকে নিয়ে এলো এক বালতি পানি। এক ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে একটা বড় পলিথিন এনে বালিশের ওপর বিছিয়ে দিলো। তার ওপর অম্লানের মাথাটা শুইয়ে দিয়ে কয়েক মগ পানি ঢাললো। অম্লান চোখ বুজে রেখেছে। জ্বরের শরীরে যখন মাথায় পানি ঢালার সময় চোখের ওপর দিয়ে ঠান্ডা পানির স্রোত বয়ে যায়, কি যে শান্তি লাগে!

কিছুক্ষণ পানি ঢালার পর গামছা ভিজিয়ে অম্লানের পুরো শরীর মুছে দিলো নীলাক্ষী। টেবিলের ড্রয়ারে সবসময় জরুরি ওষুধপত্র থাকে। দুই পিস পাউরুটি এরপর একটা জ্বরের ওষুধ খাইয়ে দিলো অম্লানকে। অম্লান ওষুধ খেয়ে বালিশে শুয়ে পড়লো। তার ভীষণ ক্লান্তিবোধ হচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে, সেইসাথে প্রচন্ড মাথাব্যথা। নীলাক্ষী মাথা ব্যথা উপশমের জন্য মলম লাগিয়ে মাথা টিপে দিতে লাগলো। একটুখানি আরামবোধ হতেই ঘুমিয়ে পড়লো অম্লান।

নীলাক্ষী পাশে বসে চিন্তিতমুখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। মুখখানা একদম শুকিয়ে গেছে অম্লানের। বড্ড খারাপ লাগছে নীলার। কি যে করি!

ভাবতে ভাবতে ঘরময় পায়চারি করতে লাগলো নীলাক্ষী। অম্লান ঘুমাচ্ছে ভেবে ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো নীলাক্ষী নিজেও।

সকালবেলা ঘুম ভাংলে দেখলো অম্লানের শরীরে একটুও জ্বর কমেনি। নীলাক্ষী নাস্তার পর ডাক্তারকে ফোন করে বাসায় আসতে বলে অফিসে রওনা দিলো। যাওয়ার আগে বাড়ির সবাইকে বলে গেলো অম্লানের দিকে খেয়াল রাখতে। আজকে অফিসে যাওয়ার প্রতি একটুও মন নেই ওর। তবুও যেতে হবে, না গিয়ে উপায় নেই।

অম্লানের জ্বর আরও বেড়েছে। ডাক্তার ওষুধপত্র দিয়ে গেলেন। দোয়েল অম্লানকে ওষুধ খাইয়ে পাশে বসে রইলো। অম্লান জ্বরের ঘোরে বারবার ‘প্রফুল্ল’র নাম উচ্চারণ করছে। বিরক্ত লাগছে দোয়েলের। একইসাথে দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। নীলাক্ষী যদি প্রফুল্ল’র নাম শোনে, না জানি কী কষ্টটাই পাবে সে!

দুপুরের মধ্যেই তিনবার ফোন করে অম্লানের ব্যাপারে খোঁজ নিলো নীলাক্ষী। বিকেলের দিকে অম্লানের জ্বর খানিকটা কমলো। খাবার খেয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসে রইলো অম্লান।

দোয়েল বললো, ‘তোমার কপাল ভালো জন্য এমন লক্ষী বউ পাইছো বুঝছো? মেয়েদের যা স্বভাব, সারাক্ষণ ক্যাচক্যাচ করা। তোমার বউ সেই তুলনায় কত ভালো। কী শান্ত একটা মেয়ে।’

অম্লান ফ্যালফ্যাল করে দোয়েলের দিকে তাকিয়ে রইলো। কী বলবে বুঝতেই পারলো না।

দোয়েল বললো, ‘সারা রাত তোমার সেবা করলো নীলাক্ষী আর তুমি প্রেমিকার নাম জপতেছো। এইগুলা ভালো না অম্লান। শুরু থেকে তো তোমাদের ভালোই প্রেম দেখছি, এখনও ওই মেয়েকে মনের ভেতর বসিয়ে রাখার তো মানে দেখি না। বিয়ে করছো, ছয় মাস পার হইছে বিয়ের। এখনও!’

অম্লান একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমি বুঝতে পারিনি জ্বরের ঘোরে ওর কথা বলছি।’
‘নীলা কষ্ট পাবে। ওকে কষ্ট দেয়ার মতো কাজ অন্তত কইরো না বুঝছো?’
‘হু।’

দোয়েল অনিকের গলা শুনতে পেয়ে ছুটে নিজের ঘরে আসলো। অনিক বেশকিছু মৌসুমী ফল নিয়ে এসেছে। দোয়েল অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে স্ত্রী’র প্রতি যত্ন বেড়ে গেছে তার। যত্নটা হয়তো সন্তানের জন্য। তবুও স্বামীর যত্ন আত্নি পেতে যে কারোরই ভালো লাগে। দোয়েলের এখন ভারী সুখের সময়।

অনিক দোয়েলের কপালে একটা চুম্বন করে বললো, ‘সারাদিন কেমন ছিলে?’
‘ভালো ছিলাম। অম্লানের জ্বর কমেছে একটু।’
‘ওর রুমে যাবো। আগে ফ্রেশ হয়ে আসি।’

অনিক তোয়ালে খুঁজতে বেলকনিতে গিয়ে দেখলো বেশকিছু ভেজা কাপড় ঝুলছে। রীতিমতো উদ্বিগ্ন কণ্ঠে চেঁচিয়ে বললো, ‘দোয়েল, কাপড় ধুইছো তুমি?’

দোয়েল বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো, ‘হ্যাঁ।’
অনিক রাগত স্বরে বললো, ‘তোমাকে না বলেছি কোনো কাজ করবা না। তুমি আমার একটা কথাও শোনো না। কাপড় কেন ধুতে গেছো?’

দোয়েল হেসে বললো, ‘আহারে, বউয়ের প্রতি কী দরদ!’
‘দরদ থাকবে না? আমার বউকে কী আরেকজন দরদ দেখাবে? কাপড় আমাকে দিবা, আমি ধুয়ে দিবো। তুমি একেবারেই করবে না ওসব।’

দোয়েল মুচকি হাসলো। অনিকের চোখেমুখে রাগের অভিব্যক্তি দেখে ওর দারুণ আনন্দ হচ্ছে। মুচকি হেসে কাছে এগিয়ে এসে অনিকের গলা জড়িয়ে ধরে দোয়েল বললো, ‘তোমার সন্তানের মা হচ্ছি বলে এত আদর তাই না? প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকেই দেখছি আমার প্রতি তোমার কেয়ারনেস জেগে উঠেছে। তো সেটা কী শুধুই সন্তানের জন্য? আগে তো এমন ভালোবাসা ছিলো না!’

অনিক ভীষণ লজ্জিতবোধ করলো। অনুশোচনা হওয়ার ভঙ্গিতে এদিক সেদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে লজ্জামিশ্রিত গলায় বললো, ‘আসলে… আসলে কী জানো এসব কেয়ারনেস কীভাবে করতে হয় আমি সেটাই জানি না। এখন মনে হচ্ছিলো যে এই কাজগুলো করা দরকার তাই করছি। মানে..’

দোয়েল বললো, ‘মানে? বাচ্চার জন্ম দিবো তাই তো এই কেয়ারনেস। সব বাচ্চার জন্য।’

দোয়েলের গলা অভিমানী শোনালো। লজ্জিত হয়ে অনিক হঠাৎ দোয়েলের দুহাত আকড়ে ধরে বললো, ‘প্লিজ এভাবে বোলো না। বললাম তো ওসব কেয়ার কীভাবে করতে হয় আমি আসলে জানি না। এখন তো জানলাম কীভাবে করে৷ সারাজীবন এভাবে করবো। শিখলাম তো।’

অনিকের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া লাগলো দোয়েলের। ফিক করে হেসে ফেললো দোয়েল। অনিকের শক্ত বুকে মাথা রেখে দুহাতে আঁকড়ে ধরে ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগলো। হঠাৎ করেই নিজেকে নিয়ে বড্ড প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে। কলিজাটা বড় হয়ে যাচ্ছে। দোয়েল এতদিন ধরে নীলাক্ষীকে জগতের সবচেয়ে সুখী মেয়ে ভেবে এসেছে। অথচ আজ মনে হচ্ছে নীলাক্ষী কোনো সুখে নেই। দোয়েল নিজেই সবচেয়ে সুখী। অন্তত তার স্বামী কোনোদিনও মিথ্যে করে ‘ভালোবাসি’ বলে নি। কখনো প্রেমের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়ে লুকোচুরি খেলেনি। মুখে সারাদিন ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ বলে লাভ কী, যদি অন্তরে আরেক দেয়াল সর্বদা আড়াল করে রাখে! সেই ভালোবাসার বিষে মরার চাইতে ভালোবাসাহীন জীবন কাটানো ভালো।

নীলাক্ষী আজ তারাতাড়ি বাসায় ফিরলো। অম্লান কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। নীলাক্ষী আলতো করে অম্লানের কাথা সরিয়ে কপালে হাত স্পর্শ করাতেই খপ করে হাত ধরে ফেললো অম্লান।
নীলাক্ষী বললো, ‘আমি এসেছি।’
‘কখন এলে?’
‘এইমাত্র।’
‘যাও ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে এসো।’

নীলাক্ষী অম্লানের কপালে আলতো করে চুম্বন রেখা এঁকে দিলো। ঝটপট গোসল সেরে বেরিয়ে এলো মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে। শহরের পরিবেশ ধুলোময়, বাইরে থেকে এসে গোসল না করলে গা কেমন ঘিনঘিন করে। অম্লান নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে।

নীলাক্ষী গরম গরম পাস্তা নিয়ে এসে বসলো। বললো, ‘এই নাও তুমিও খাও।’
‘খেতে ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা নীলু, আমি যদি হঠাৎ মরে যাই আমাকে ক্ষমা করবে তো?’

খাওয়া বন্ধ করে অম্লানের দিকে তাকালো নীলাক্ষী, ‘কি যা তা বলছো এসব?’
‘না কিছু না।’

অম্লান বালিশে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। নীলাক্ষী মাথা নিচু করে ভাবছে। চকিতে মুখ তুলে তাকালে দেখলো অম্লান তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

নীলাক্ষী বললো, ‘হঠাৎ এই প্রশ্ন? তুমি তো কোনো অন্যায় করোনি যে ক্ষমা করবো।’
‘না। এমনি বললাম। তুমি খাচ্ছো না কেন? খাও?’

নীলাক্ষী খাওয়া বন্ধ করে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে। তার অশান্তি বোধ হচ্ছে। কেন হচ্ছে সেটা নিজেও জানে না। ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কোথাও হারিয়ে যাই। কিন্তু ‘কোথাও’ বলে পৃথিবীতে কোনো জায়গা নেই। আসলেই কী নেই?

অম্লানের জ্বর ছেড়ে গেলো রাতে। পরেরদিন শরীরটা দূর্বল বোধ হচ্ছিলো। অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিলো আজকেও সে যেতে পারবে না। ফোন রাখার পর অনেক্ষণ শান্ত হয়ে বসে রইলো অম্লান।

নীলাক্ষী গতকালকেই ছুটি নিয়ে এসেছে। আজকে সেও অফিস যাবে না। কাথা গুছিয়ে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি গো, অমন করে বসে আছো কেন?’

অম্লান নির্বিকার গলায় বললো, ‘আমার টেকনাফে ট্রান্সফার হয়েছে।’

অর্ধেক ভাঁজ করা কাথা বিছানার একপাশে রেখে অম্লানের সামনে এসে দাঁড়ালো নীলাক্ষী। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে তার।

‘তোমার ট্রান্সফারের কথা চলছে আগে তো আমাকে বলো নি।’
‘আগে তো আমিও জানতাম না। একবার শুনেছিলাম। তখন ভেবেছিলাম আরো অনেক পরে দেবে। আর আমি তো জানতাম ঢাকার ভেতরেই ট্রান্সফার হবে।’

বউকে যাতে কষ্ট করে কাপড় ধুতে না হয়, সেজন্য একটা ওয়াশিং মেশিন কিনে এনেছে অনিক। সেই খবরটা দিতে নীলাক্ষীর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে দোয়েল। খুশিতে হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। দোয়েল অবাক হয়ে দেখলো বিছানার দুই কোণায় গম্ভীরমুখে বসে আছে অম্লান ও নীলাক্ষী! যেন একটু আগেই প্রবল ঝড়ের তাণ্ডবে কিছু একটা এলোমেলো হয়ে গেছে এখানে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here