বাদামি সংসার পর্ব-৩৬

0
1044

বাদামী সংসার
পর্ব ৩৬
মিশু মনি

অম্লান টেকনাফে চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। নীলাক্ষী অপেক্ষায় আছে অম্লান কবে তাকে নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ টানবে। কিন্তু সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তাকে কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অম্লান নির্বিকার। কখনো ভুলক্রমেও সে কথাটি উত্থাপন করেনা অম্লান। নীলাক্ষীও অপেক্ষা করে কেবল।

প্রথম প্রথম অম্লান দিনে কয়েকবার করে কল দিতো, কখনো ভিডিও কল। টুকটাক মেসেজ চ্যাটিং তো রয়েছেই। সবকিছুর ভীড়েও নীলাক্ষী যেন কোথায় একটা ক্ষুদ্র শূন্যস্থান খুঁজে পায়। যেই শূন্যস্থান আগে কখনো বোধ করেনি। অম্লান বিয়ের রাত থেকেই তাকে প্রচণ্ড ভালোবেসেছে, এখনও বাসে। কিন্তু শান্তি হয় না নীলাক্ষীর।

রাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে নীলাক্ষী। অম্লান দু মিনিট কথা বলার পর মোবাইল রেখে দিয়ে ঘুমে ঢলে পড়েছে। আরামের ঘুমে নিশ্চয় কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না। কিন্তু নীলাক্ষীর মনটা ব্যকুলতায় ভরে গেলো। জীবনের প্রথম পুরুষ অম্লান। এই মানুষটাকেই সে সবচেয়ে বেশী ভালোবেসেছে। তার দূরত্ব প্রতি ক্ষণে ক্ষণে পোড়ায় নীলাক্ষীকে। আজ যদি অম্লান পাশে থাকতো নিশ্চয় নীলাক্ষী হা করে অম্লানের মুখের পানে তাকিয়ে থাকতো!

চোখের জল টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়ছে বালিশে। নীলাক্ষী কান্না চেপে রাখতে পারলো না। নাহ, আর সে রাতের পর রাত কেঁদে কাটাতে পারবে না। অম্লানকে তার সবসময় চাই।

নীলাক্ষী সিদ্ধান্ত নিলো অম্লান তাকে একবার বলামাত্রই সে টেকনাফে ছুটে যাবে। তারপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোনো একটা ব্যবসা করার চিন্তাভাবনা করবে। নয়তো বসে বসে শুধুই অম্লানের সেবা করে যাবে সে। কিন্তু অম্লান কেন ডাকছে না? নিজের মুখে ওখানে যাওয়ার কথাও বলতে সংকোচ লাগছে নীলার।

সকালে ঘুম ভাংলো অম্লানের কল’এর শব্দে। ফোনে কানে ধরে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে নীলাক্ষী বললো, ‘গুড মর্নিং।’
‘নীলু পাখিটা কি ঘুমে বিভোর?’
‘হু।’
‘তোমাকে কতদিন ঘুমন্ত দেখি না!’

বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে নীলাক্ষীর। মোবাইল কানে নিয়ে বালিশে উপুড় হয়ে শোয়। একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘তুমি তো স্বার্থপর।’
‘আমি কেন? আমাকে এখানে ট্রান্সফার দিলে আমার কী দোষ বলো?’
‘নাহ তোমার কোনো দোষ নেই। আমাকে ট্রান্সফার দিলে আমি রিকুয়েষ্ট করবো যেন তেতুলিয়ায় পাঠায়।’

মুহুর্তের জন্য নিঃশব্দ হয়ে রইলো অম্লান। নীলাক্ষীর নিশ্বাসের শব্দ কানে আসছে।
“অম্লান তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারো?”
“পারি না। জোর করে আছি। কিছু তো করার নেই।”
“কিছুই কি করার নেই?”
“কিছু করার থাকলে আমি তো করতাম ই নীলু।”

অম্লান চুপ করে থাকে। হঠাৎ করেই কান্না পেয়ে যায় নীলাক্ষীর। সত্যিই কী তার কিছু করার নেই? নীলাক্ষী তো আশা করে আছে অম্লান তাকে কাছে নিয়ে যাবে। নীলাক্ষী চাপা ব্যথা লুকানোর চেষ্টা করে বললো, ” আমি ওয়াশরুমে যাবো। রাখি।”

নীলাক্ষীর কান থেকে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো মোবাইলটা। বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে কান্না। অম্লান তো কখনো এমন করে নি। আজকাল ছোটখাটো দু একটা ব্যাপারেও অম্লানকে ভীষণ অচেনা লাগে। কোথাও কী গণ্ডগোল আছে কোনো?

নীলাক্ষী সারাদিন কাজে মন দিতে পারলো না। তার খুব ইচ্ছে করছে সবকিছু ফেলে টেকনাফে চলে যেতে। চাকরি বাকরি আর ভালো লাগছে না। কী হবে এসব দিয়ে? যদি জীবনে সুখ না থাকে?

ফোন বেজে উঠলো। অম্লান কল করেছে। বেশ ঝলমলে গলা। বললো, “কী করছো? জানো আজকে একটা মজার কাণ্ড ঘটেছে।”
“কী?”
“একটা মেয়ে আমাকে প্রপোজ করেছে। হা হা হা।”

অম্লান হো হো শব্দ করে হাসছে। হাসতেই থাকে সে। নীলাক্ষীর একটুও হাসি হাসি পাচ্ছে না। তপ্ত হৃদয় নিয়ে কী হাসা যায়?

নীলাক্ষী বললো, “আছো তো একা। প্রেম করলেই পারো। সময় ভালো কাটবে।”

নীলাক্ষী রুক্ষ কণ্ঠে কথাগুলো বলে গেলেও অম্লান ঠাট্টার ছলে-ই গ্রহণ করে হাসতে হাসতে বললো, “তোমার জ্বলবে না?”
“না।”
“তাহলে হ্যাঁ বলে দিবো?”
“যদি ভালো মনে করো।”
“এ কি নীলু তুমি রেগে যাচ্ছো?”

নীলাক্ষী কথা না বাড়িয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখলো। বড্ড রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে সমস্ত মন খারাপিতাকে দূর করে দিই। তার ভেতরে অসহ্য দহন পুড়তে পুড়তে তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। নীলাক্ষী জানে না এটা কীসের দহন? জানে না এটা কীসের অশান্তি!

সৌখিনকে কল দেয় নীলাক্ষী। হাসিমাখা গলায় জানতে চাইলো, “কী অবস্থা? কেমন আছো?”
“আরে মহারানী যে! আমার তো ভালোই। তোমার কী অবস্থা?”
“আমার কোনো অবস্থা টবস্থা নাই।”

অনেক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। সৌখিন জিজ্ঞেস করলো, “তারপর বলো দিনকাল, সংসার টংসার কেমন যায়?”
“ভালো। সৌখিন একটা কথা বলো তো আমাকে। প্রফুল্ল’র সাথে তোমার সম্পর্ক কতদূর গড়ালো?”

সৌখিন একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘হাহ আমার আর সম্পর্ক। গরীবের কপালে ওসব নাই বুঝলা।”
“নাই মানে!’
” নাই মানে নাই।”
“ক্লিয়ার করে বলো?”

নীলাক্ষী নিজের বুকের ধুকপুকানি অনুভব করতে পারছে। হঠাৎ অস্থির লাগতে শুরু করেছে ওর। সৌখিন বললো, “প্রফুল্ল’র সাথে আমার অনেকদিন কথা হয় না। কেন জানি ধীরেধীরে যোগাযোগ কমে গেছে। প্রফুল্ল হয়তো চায় না আমার সাথে কোনোরকম সম্পর্কে যেতে।”

নীলাক্ষীর দেহে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো। ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো শরীর। অম্লান আবার প্রফুল্ল’র সাথে কোনোভাবে জড়িয়ে যাবে না তো? কিংবা এতদিনে হয়তো গিয়েছেও। আজকাল অম্লান আগের মতো মায়া নিয়ে কথা বলে না। বুকে কিছু ছিন্নভিন্ন হওয়ার শব্দ শুনতে পায় নীলা। বললো, “খোঁজ খবর রাখো না?”
“মাঝেমাঝে রাখি। ফোন দিয়েছিলাম একদিন, রিসিভ করেনি। এরপর কল ব্যাকও দেয়নি। তাই আর কল দেই না।”

নীলাক্ষীর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। আর বেশীক্ষণ কথা চালাচালি করতে পারলো না নীলাক্ষী। দ্রুত কথা শেষ করে ফোন রেখে দেয়। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে অনেক্ষণ ধরে কাঁদতে থাকে।

কান্নায় নাকি বুকের ব্যথা লাঘব হয়। কই একটুও তো কমলো না কষ্ট! সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। একবার অম্লান কলটাও দিলো না। কেউ দেখতেও এলো না বিছানায় পড়ে পড়ে কান্নায় ভাসছে নীলাক্ষী।

রাত সারে দশটায় ঘরের দরজায় শব্দ করে দোয়েল বললো, “ঘুমাচ্ছিস?”
নীলাক্ষী জেগে-ই ছিলো। ঘুমের ভান ধরে শুয়ে রইলো। ঘর অন্ধকার, কোনো শব্দ করলো না নীলাক্ষী। দোয়েল ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দিলো। বিছানার পাশে বসে মৃদু স্বরে ডাকলো, “নীলু, খাবি না?”

নীলাক্ষী কোনো শব্দ করলো না। দোয়েল নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। নীলাক্ষী নড়াচড়াবিহীন ভাবে পড়ে রইলো বিছানায়।

পরেরদিন রাতের বাসে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো নীলাক্ষী। সাথে নিয়েছে লাগেজভর্তি জামাকাপড়। এতটাও যন্ত্রণাময় রাত কখনো আসেনি ওর জীবনে। আর কখনো আসতেও দিতে চায় না। ব্যবহার্য সবকিছু সাথে নিয়েই বাসে চেপে বসেছে। এই প্রথম একা একা কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। এর আগে কখনো একা একা কলেজ আর অফিস ব্যতীত আর কোথাও যাওয়া হয় নি।

(রিভিশন দেয়া হয়নি। বানান ভুল থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here