বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ১১
পায়ের ব্যাথাটা ভালোভাবেই কাবু করেছে কুমুকে। গত দুইদিন একদম নড়াচড়া করতে পারেনি। বিছানা থেকেও নামতে পারে নি সেভাবে। ব্যথায় পা টনটন করে উঠে জ্বর চলে এসেছে। দুইদিন এমন অবস্থায় থাকার পর ফয়েজ উদ্দিন মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। এভাবে বাসায় বসে থেকে ব্যাথা কমছে না। ডক্টরের কাছে যেতে হবে। ফয়েজ উদ্দিন বিকেলের দিকে মেয়ের ঘরে গেলেন। জ্বর আর ব্যথার কারণে খুব প্রয়োজন ছাড়া বিছানা ছাড়ে নি সে। আজও শরীরটা ভালো নেই তার। ছোট্ট মৌ আপার এমন অসুস্থতায় ভীষণ কাতর হয়ে উঠেছে। আপাকে যেন ঘর আর বিছানায় দেখলেই সে অতিস্ট হয়ে যায়। তার ধারনা আপার জন্ম হয়েছে দাপিয়ে বেড়াতে। আর সেই আপা যদি এভাবে বাসায় থাকে তাহলে কি মানায়? ফয়েজ উদ্দিন মেয়ের কপালে হাত রাখতেই সে চমকে উঠলো। পাশ ফিরে বাবার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল
–বাবা তুমি?
উঠতে চাইলে তিনি মেয়েকে শুইয়ে দেন। বলেন
–উঠতে হবে না। এখন কেমন আছো?
কুমু আবারো শুয়ে বলল
–এখন একটু ভালো আছি বাবা।
ফয়েজ সাহেব মৃদু হেসে বললেন
–ভাবছিলাম আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই তোমাকে। ব্যথা তো কমছে না। কিভাবে হবে?
কুমু ভাবুক হয়ে গেলো। কিছু একটা ভেবেই বলল
–ব্যাথা কমে গেছে বাবা। আগের মতো আর নাই। আজকের দিনটা গেলেই হাঁটতে পারবো।
ফয়েজ সাহেব একটু জোর করেই বসলেন। কিন্তু লাভ হল না। কুমু কিছুতেই রাজি হল না। সে যাবে না মানে যাবেই না। ব্যর্থ হয়ে তিনি বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে। কুমু হতাশ শ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। এ মাসে অনেক খরচ হয়েছে। রাফির পরীক্ষার ফি মৌয়ের স্কুলের বেতন সবকিছুই দিতে হয়েছে। তার উপরে আবার নতুন বাসায় উঠতে অগ্রিম ভাড়া দিতে হয়েছে। ডাক্তারের কাছে গেলেই জতশত পরীক্ষা নিরিক্ষার ব্যাপার। অনেক টাকা খরচ। বাবার ছোট্ট দোকান দিয়েই তাদের সংসার চলে। বেহিসেবি কোন খরচ সামলে ওঠা তার বাবার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কুমু কয়েকটা টিউশনি করেই নিজের খরচটা কোন রকমে চালায়। মাঝে মাঝে বাবার কাছ থেকেও নিতে হয়। বড় মেয়ে হিসেবে তার তো একটা দায়িত্ব থাকেই। সে তো বোঝে সংসারের অবস্থা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। খানিকবাদেই কলিং বেলের আওয়াজ আসলো কানে। সেদিকে গুরুত্ব না দিয়েই শুয়ে থাকলো নিজের মতো। চোখ বন্ধ করেই বুঝতে পারলো কেউ একজন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ভাবল মৌ অথবা মা। তাই চোখ মেলে তাকাল না। অল্প সময়ের ব্যবধানে পরিচিত একটা গলা কানে আসতেই চোখ মেলে তাকাল। শুভ্রাকে তার পাশে বসে থাকতে দেখেই অবাক হয়ে বলল
–তুই কখন আসলি?
শুভ্রা কুমুর কপালে ঠাণ্ডা হাত রেখে বলল
–এই তো। তুই অসুস্থ তাই দেখতে এলাম।
কুমু উঠে বসতে বসতে বলল
–এখন ঠিক আছি।
শুভ্রা পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
–কোন পায়ে ব্যথা পাইছিস? দেখি?
–ডান পায়ে। এখন ব্যথা নাই। ঠিক আছে।
শুভ্রা ভ্রু কুচকে তাকাল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–সিঁড়িতে পড়লি কিভাবে বল তো? দেখে নামিস নি?
কুমুর মনে পড়ে গেলো সেই ঘটনা। হিমেলের গভীর চাহুনি। শীতল স্পর্শ। হৃদয় হরণ করা সেই সব বাক্য। হেসে ফেললো সে। শুভ্রা সরু চোখে তাকাল। মুখটা এদিক সেদিক ঘুরিয়ে নিয়ে বলল
–সত্যি কথা বল তো। কেমন যেন অন্যরকম কিছুর আভাস পাচ্ছি।
কুমুর হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। চোখের মণি অস্থির হয়ে এদিক সেদিক ঘুরছে। শুভ্রা তার অনুভূতি বুঝে গেলো নাতো? অস্থির পলক ফেলে বলল
–বৃষ্টির পানি সিঁড়িতে পড়েছিল। আর সেখানেই পা পিছলে পড়ে গেছি।
শুভ্রা রেগে গিয়ে বলল
–কে এই কাজ করলো? এমনি এমনি তো আর পানি আসেনি। নিশ্চয় কেউ ভিজে সিঁড়ি বেয়ে উঠেছে। তাই এমন হয়েছে। এসব অশিক্ষিত লোক যে কোথা থেকে আসে। নুন্যতম ভদ্রতাটাও শিখে না। এভাবে বেপরোয়া চলাফেরা করলে যে কারো অসুবিধা হবে সেটা তাদের কোন খেয়াল থাকে না। যতসব অসভ্য।
এভাবে অনেকটা সময় নিয়ে মন ভরে গালি দিলো শুভ্রা। কুমু সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে বলল
–হইছে থাম। আর কিছু বলিস না। এবার মাফ করে দে। উনি তো ইচ্ছা করে কিছু করে নি।
–উনি? তার মানে তুই জানিস কে করেছে? তাকে কিছু বলিস নি কেন? পা টা তো ভেঙ্গেও যেতে পারতো। সামনে তোর পরীক্ষা। পা ভেঙ্গে যদি পরীক্ষা দিতে না পারতিস তাহলে কি হতো ভেবেছিস।
কুমু অসহায়ের মতো বলল
–আমার মাথা ব্যাথা করছে। চুপ কর।
শুভ্রা চুপ করে গেলেও কুমু শান্ত হতে পারলো না। হিমেলকে এভাবে গালি দেয়াতে কুমু শুভ্রার উপরে ভীষণ বিরক্ত হল। রেগেও গেলো মনে মনে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না। কারণ হিমেল তো ইচ্ছা করে করে নি। হিমেলের মতো মানুষ ইচ্ছা করে এমন করতেই পারে না।
————
আকাশে ভরা জ্যোৎস্না। চারিদিকে শুভ্র আলোয় আলোকিত। সবাই মাত্র ঘুমিয়েছে। রাফি হয়তো এখনো জেগে পড়ছে। কুমু পুরো দুইদিন একদম বিছানায় শুয়ে থাকায় এখন আর পারছে না। তাই বিছানা থেকে নেমে টেবিলে বসেছে। বই নিয়ে পড়তে চেষ্টা করলেও পড়ায় মন বসছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। চাঁদটার পাশে কিছু শুভ্র মেঘ এসে ভিড় করেছে। চাঁদটাকে ছুঁয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতা চলছে তাদের মাঝে। আজকের রাতটা অনেক সুন্দর। এই সময় ছাদে গেলে খুব একটা খারাপ হয় না। বই বন্ধ করে চূলগুলো ঢিলে খোপা করে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো ছাদের দিকে। খুব সাবধানে পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠলো। ওঠার সময় তিন তলার দরজায় দৃষ্টি ফেলতে ভুল করলো না। সেদিকে তাকাতেই মনটা ছটফট করে উঠলো কাউকে দেখার প্রয়াশে। সেটাকে দমিয়ে রেখেই ছাদে উঠে গেলো সে। দাঁড়ালো ছাদের রেলিং ঘেঁষে। দুই হাত আলতো করে রেলিঙ্গে রেখে চাঁদের দিকে দৃষ্টি স্থির করলো। দৃশ্যটা অসম্ভব সুন্দর। কিন্তু কুমুর কিছু একটা নেই মনে হচ্ছে। উদাস দৃষ্টিতে সেদিকে কতক্ষন তাকিয়ে থাকলো তার মাথায় নেই। হঠাৎ এক দমকা হাওয়া এসে ঢিলে করে বাধা খোপাটা খুলে দিলো। আচলটাও পড়ে গেলো মাথা থেকে। পিঠ ভর্তি ঝলমলে চূলগুলো ছড়িয়ে গেলো বাতাসে। মুখে পড়লো। কুমু ঠিক করলো না। সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলো। বাতাসে তার চুল আর ওড়না উড়ছে ক্লান্তিহীন এলোমেলো। খানিকবাদেই কানে এলো গম্ভীর আওয়াজ
–শুনছেন?
চমকে উঠলো কুমু। ভয়ে গা শিউরে উঠলো। বুকের ভেতরে কেঁপে উঠতেই ঘুরে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড স্থির তাকিয়ে থেকে পরিচিত মানুষটাকে দেখেই অনুভূতি পাল্টে গেলো। ভীত দৃষ্টি শান্ত হয়ে গেলো। বুকের ভেতরটা এখনো কাঁপছে। তবে ভয়ে নয়। ভালো লাগায়। এমন স্নিগ্ধ এক চন্দ্রিমা রাতে প্রিয় মানুষটার সাথে জ্যোৎস্না বিলাস! ভাবা যায়? মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যাবধানে পরিবর্তন হল তার দৃষ্টির। চোখ জোড়া নত হল। অসস্তি ঘিরে ধরল। কারণ তার চেয়েও গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের মানুষটা। তার চোখ জোড়া অদ্ভুত ভাবে বিচরণ করছে কুমুর চোখে মুখে। শ্যামকন্যা দাঁড়িয়ে আছে হিমেলের সামনে। ঘন কালো লম্বা চূলগুলো বাতাসে উড়ছে। তার ঠিক মাথার উপরেই আস্ত চাঁদ। চাঁদের আলোয় শ্যাম কন্যার রুপ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সৌন্দর্য দুই রকমের হয়। কিছু সৌন্দর্য চোখ ঝলসে দেয়। তাদের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ জালা করে। যেমন আলোক কোন উৎসের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। ঠিক তেমন। আর এক প্রকার সৌন্দর্য আছে যা দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে ওঠে। প্রথম দেখায় যতটা না ভালো লাগে দ্বিতীয়বার দেখলে তার থেকে ভালো লাগা কয়েকগুন বেড়ে যায়। প্রতিবার একটু একটু করে বেড়ে গিয়ে এক সময় চোখ ফেরানো ধায় হয়ে যায়। হিমেলের মনে হল মেয়েটা দ্বিতীয় পর্যায়ের সুন্দরী। প্রথম দেখায় খুব সাধারণ মনে হলেও কয়েকবার দেখার পর রুপ অসাধারণ হয়ে উঠছে। কুমুর অসস্তি চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল। লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠলো। চূলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–কিছু বলবেন?
হিমেলের দৃষ্টির পরিবর্তন হল না। বরং কণ্ঠে আরও আবেগ মিশিয়ে বলল
–চুল বাঁধো!
চলবে……