বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ১৩

0
1585

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ১৩

শুক্রবার মানেই অলস সময় কাটে শুভ্রার। হাত পা গুটিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তন্দ্রা ভাবটা মাথা ভারী করে তুলেছে। সারাদিন এভাবে বিছানায় গড়াগড়ি করলে হালকা ঘুমের রেশটা থাকা স্বাভাবিক। চোখটা মেলে ভারী মাথাটা বালিশ থেকে তুলল। বাথরুমে গিয়ে পানির ঝাপটা চোখে মুখে দিয়ে ঘুম কাটানোর চেষ্টা করলো। ঘুমটা কেটে গেলেও শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। ঘর থেকে বেরতেই তার মা বলল তার খালা নাকি ডেকেছে। এভাবে বাসায় শুয়ে না থেকে খালামনির বাসা থেকে ঘুরে আসলেও ভালো লাগবে। তাই আর দিরুক্ত করলো না। দুইটা বাড়ি পরেই তার খালার বাসা। তাই আলাদা করে রেডি হওয়ারও ঝামেলা নেই। ওড়নাটা ঠিক করেই বেরিয়ে গেলো। বাসা থেকে বেরতেই রোদের তেজে শরীর ঝাঁঝরা হওয়ার উপক্রম। মাথার মগজ সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মনে হল। তাই ওড়নাটা মাথায় টেনে দিয়েই দ্রুত হাটা শুরু করলো। কিছুদুর যেতেই হুট করে সামনে কেউ এসে দাঁড়াতেই চমকে পা থেমে গেলো তার। প্রথমে একটু ভয় পেলেও সামনে ভালভাবে তাকাতে ভয়টা বিরক্তিতে পরিণত হল। শ্রাবণ নিস্পলক তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিরক্তি ভাবটা স্পষ্ট করে বুঝাতেই ঝাঁঝালো ভাবে বলল
–হুট করে এভাবে সামনে এসে দাঁড়ানো টা কোন ধরনের ভদ্রতা?

শ্রাবনের দৃষ্টির পরিবর্তন হল না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই ক্লান্ত গলায় বলল
–আমি ভদ্র নই সেটা জানি। তোমার কাছে অনেকবার শুনেছি। আমার মধ্যে এমন কোন গুন নেই যা হয়তো কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে। কিন্তু আমার ভালোবাসার জোর আছে। আর সে জোর তোমাকে দুর্বল করতে পারছে না সেটা আমি মানতে পারছি না। শুনেছি প্রতি পক্ষের কাছে দুর্বলতা প্রকাশ করতে নেই। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রকাশ করতে কোন সমস্যা নেই তো। আমাকে কেন খামাখা প্রতিপক্ষ ভাবছ শুভ্রা।

শুভ্রা ভ্রু কুচকে তাকাল। বিস্ময়কর কণ্ঠে বলল
–আপনার কি মাথায় সমস্যা হয়েছে? কিসব বলেই যাচ্ছেন। আমি কখন বললাম আপনি আমার ভালোবাসার মানুষ?

শ্রাবণ হাসল। রোদের তেজে লাল হয়ে যাওয়া ঘর্মাক্ত মুখেও হাসিটা কি প্রানবন্ত দেখাল। শুভ্রা একদম সামনে দাঁড়ানোয় পুরো রোদটা শ্রাবণের মুখ বরাবর এসে পড়েছে। শুভ্রার মায়া হল। বলল
–দেয়ালের পাশে দাঁড়ান। রোদ লাগছে মুখে।

শ্রাবণ হাসিটা থামিয়ে দিয়ে বলল
–আমি দাঁড়াব না। বাসায় যেতে হবে। আজ শুক্রবার। মসজিদে যাবো। এদিকে একটা কাজ ছিল। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম তোমাকে দেখে ভাবলাম একটু কথা বলি।

শুভ্রা এমন লাইন ছাড়া কথা শুনে বিরক্ত হল। যতবার ছেলেটার সাথে কথা বলতে যায় ততবারই তার বিরক্তিতে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ছেলেটা একদম গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। কিন্তু সে কি জানে না মেয়েরা গুছিয়ে কথা বলা বেশী পছন্দ করে। দূর থেকে তার কাজ কর্ম শুভ্রাকে যতটা না আকৃষ্ট করে কাছ থেকে তার কথায় ঠিক ততটাই বিরক্ত হয় সে। এভাবে এই ছেলের সাথে তার জীবনেও প্রেম হয়ে উঠবে না। একবারেই অসম্ভব। রাগে তেতে উঠে বলল
–তাহলে যাচ্ছেন না কেন? অযথা রাস্তা আটকে আমার দেরি করাচ্ছেন?

শ্রাবণ তার কথার জবাব না দিয়ে বলল
–তুমি কোথায় যাচ্ছ এই সময়?

শুভ্রা আবারো বিরক্ত হল। সে যে রাগ করেছে সেটাও কি বুঝতে পারছে না? এ কেমন ভালোবাসা যে তার কথাই বুঝতে পারে না। অদ্ভুত মানুষ! শুভ্রা তীক্ষ্ণ ভাবেই জবাব দিলো
–খালামনির বাসায়।

শ্রাবণ কোন ভঙ্গিমা ছাড়াই বলল
–ওহ আচ্ছা যাও।

শুভ্রা ভীষণ আহত দৃষ্টিতে তাকাল। বিরক্তির চরম পর্যায়ে গিয়ে সে খেয়াল করলো তার আর বিরক্ত হওয়ারও ইচ্ছা নাই। ক্লান্তিতে শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলো। মনে মনে আওড়াল বাবা মা এরেঞ্জ ম্যারেজ করিয়ে দিলেও এই ছেলের বউ টিকবে না আর প্রেম তো দূরের কথা। হতাশ শ্বাস ছেড়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। ভাবল শ্রাবণ হয়তো একবার তাকে ডাকবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। বাড়ির সামনে গিয়ে পেছন ঘুরে তাকাল। শ্রাবণ বড় ধাপ ফেলে হেটে অনেক দূর চলে গেছে। অসহায়ের মতো তাকাল সেদিকে শুভ্রা। শেষমেশ এই ছেলেটাকেই তার প্রেমে পড়তে হল? মনের মাঝে এক রাশ অভিযোগ আর অভিমান নিয়েই ভেতরে চলে গেলো।

———–
দুপুরে খেয়ে জরুরী কাজে বাইরে বেরিয়েছে হিমেল। বাড়ির পাশেই একটা দোকানে বসে অপেক্ষা করছে একজনের জন্য। নামাজ পড়ে এসে পাঞ্জাবিটাও বদলাবার সময় পায়নি। এই দুপুরে তার ইচ্ছা করছে বাসায় গিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি দিতে। কিন্তু কাজটা যে অনেক জরুরী। তাই সে ইচ্ছাটা পুরন করা সম্ভব নয়। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বেশ বিরক্ত ভঙ্গীতে ধোঁয়া ছাড়ছে সে। বেখেয়ালিভাবে সামনে তাকাতেই দেখল কুমু মাথায় ছাতা ধরে হেটে যাচ্ছে। লম্বা বিনুনিটা মাথায় দেয়া ওড়না ভেদ করে নীচে দিয়ে অর্ধেকটা বের হয়ে গেছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে শ্যাম বর্ণের মুখে। হিমেল ভাবল এই দুপুর বেলা রোদের মধ্যে কোথায় যাচ্ছে সে। তাও আবার শুক্রবারে। অবচেতন মন হুট করেই অদ্ভুত একটা কাজ করে বসলো। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে উঠে গেলো। এগিয়ে গিয়ে ডাকল
–মিস কুমুদিনী?

থেমে গেলো কুমু। তার পুরো নাম তেমন কেউ জানে না। আর এই এলাকায় নতুন এসেছে। এভাবে রাস্তায় নাম ধরে কে ডাকবে। ঘুরে তাকাতেই হিমেলকে দেখে ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো। ক্লান্তিটা প্রশান্তিতে পরিণত হল। পরক্ষনেই হিমেলের মুখে নিজের নাম শুনে কিছুটা অবাক হল। অবাক হয়েই বলল
–আপনি আমার নাম জানেন কিভাবে? আমি তো কখনো বলিনি?

হিমেল হেসে ফেললো। বলল
–তুমি না বললে কি জানা সম্ভব নয়? আমাদের বাড়িতে উপর থেকে নীচের তলা পর্যন্ত সবাই তোমার নাম জানে। যা অদ্ভুত নাম তোমার।

এমন কথা শুনে কুমু ভ্রু কুচকে তাকাল। হিমেলের কথাটা কেমন যেন শোনালো। কিছুটা রেগে গেলো কুমু। রাগ নিয়েই বলল
–অদ্ভুত মানে? নামের আবার অদ্ভুতের কি আছে?

কুমুর কণ্ঠের তেজ শুনেই হিমেল আন্দাজ করে ফেললো সে রাগ করেছে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–আরে রাগ করছ কেন? অদ্ভুত বলতে খারাপ কিছু বোঝাই নি। অদ্ভুত বলেছি কারণ এমন নাম সাধারণত কেউ পছন্দ করে না। তবে আমার কিন্তু ভালই লাগে। সাহিত্যের স্পর্শ আছে এই নামের মাঝে। ‘কুমুদিনী চৌধুরী’! রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্রের মধ্যে কেউ বেঁচে থাকলে তোমাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখে ফেলত নির্দ্বিধায়। তোমার চরিত্র হতো কোন জমিদার বাড়ির বউয়ের। বাইরে থেকে ভীষণ কঠিন কিন্তু ভেতর থেকে একদম কোমল। যাকে পড়ে ফেলা খুব সহজ নয়।

কুমু অদ্ভুত ভাবে তাকাল। সে কি ভেবেছিলো আর হিমেল কি বলল। তার নাম নিয়ে এতো সুন্দর কথা এর আগে কখনো শোনে নি সে। তাকে বিস্ময় নিয়ে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হিমেল আবেগি কণ্ঠে বলল
–তুমি দেখতেও ঠিক সেরকম। উপন্যাসের কোন নায়িকা।

হিমেলের কথা শুনে কুমুর হৃদপিণ্ডের শব্দ তরঙ্গ সুর তুলল। লজ্জায় লাল হয়ে গেলো ঘর্মাক্ত মুখশ্রী। এলোমেলো অনুভুতিতে হাওয়া লাগতেই চোখ নামিয়ে আলতো করে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। হিমেল মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করছে। তার হাতে ধরে থাকা ফোনটা বেজেই চলেছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই।

———–
সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। দিগন্তে গাড় কমলা বর্ণের ছটা। সৌরভ এসেছে বাসায়। হিমেল শ্রাবণ আর সৌরভ ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ভ্যাপসা গরমে বাড়ির ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছে তারা। তাই বিকেলের চা টা ছাদে বসেই খাওয়ার চিন্তা করেছে। ফুরফুরে হাওয়ায় তিনজনে গল্পে মেতে উঠেছে। ঘেমে যাওয়ায় বাতাসটা শরীরে শীতল অনুভূতি ছড়াচ্ছে। পরিবেশটা বেশ আরামদায়ক। হিমেল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রেলিঙ্গে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। দূর আকাশের আলোকসজ্জা দেখছে সে। মনে হচ্ছে রঙ তুলিতে আঁকা কোন স্থিরচিত্র। হিমেল ঠিক করে ফেললো দিনের শেষ বেলার একটা ছবি আকবে সে। মনের মাধুরি মিশিয়ে আঁকবে। আরেকবার চায়ে চুমুক দিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। সেদিকে তাকিয়েই হিমেলের ফুরফুরে মেজাজটা আচমকাই খারাপ হয়ে গেলো। স্নিগ্ধতায় ঘেরা পরিবেশটা পাল্টে গেলো। বিরক্ত এসে গেলো সবকিছুতেই।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here