বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ১৫
ভেজা চূলগুলো এক হাতে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছে হিমেল। দো তলায় এসে থেমে গেলো পা। কুমুদের বাড়ির দরজা খোলা। ভেতর থেকে রান্নার এক উটকো ঘ্রাণ আসছে। কয়েকজনের কথার আওয়াজ আসছে কানে। হিমেল সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নেমে গেলো। মেইন গেট পেরিয়ে বের হতেই চোখে পড়লো মৌ আর সেই ছেলেটা। হিমেলের মেজাজটা এখনো সেরকমই আছে। ছেলেটাকে দেখে সেটা উপলব্ধি করতে পারলো। নিজের বন্ধু আকাশকে দেখে যেমন হিংসে হচ্ছিল ঠিক এই ছেলেকে দেখেও তেমনই অনুভূতি হচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছন থেকে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে সামনে যেতে নিলেই মৌ চেচিয়ে ওঠে
–হিমেল ভাইয়া তুমি আমার সাথে কথা বলছ না কেন?
হিমেল থেমে গেলো। মৌয়ের এমন আদুরে কণ্ঠ উপেক্ষা করে যাওয়ার মতো ক্ষমতা তার নেই। পেছন ফিরে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড ভাবল যেখানে কুমুর প্রতিই তার কোন অনুভূতি নেই সেখানে বাকিদের সাথে এমন আচরন করাটা অযৌক্তিক। এগিয়ে গিয়ে মৌয়ের মাথায় হাত রেখে বলল
–কে বলল কথা বলছি না? এই তো বলছি।
মৌ দুই হাত বুকে গুঁজে অভিমানী কণ্ঠে বলল
–তাহলে চলে যাচ্ছিলে কেন?
হিমেল কথা বলার অমন ভঙ্গী দেখে হেসে ফেললো। বলল
–আমার ভুল হয়ে গেছে। আর এমন ভুল হবে না।
হিমেলের কথা শেষ হতেই পাশের ছেলেটি বলল
–আপনিই বুঝি হিমেল ভাইয়া?
হিমেল তার দিকে তাকাল। অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে বলল
–জি।
ছেলেটি চমৎকার ভাবে হেসে উঠলো। উতফুল্য কণ্ঠে বলল
–আপনার কথা শুনে যেমনটা ধারনা করেছিলাম আপনি ঠিক তেমনই। আমি আসার পর থেকে মৌ আপনার কথাই বলে। আমাকে সারাক্ষন পরিচয় করিয়ে দেয়। কিন্তু আপনার সাথে দেখা হওয়ার সুযোগটাই হচ্ছিল না। আপনি নাকি খুব ভালো মানুষ।
শেষের কথাটা শুনে কিছুটা লজ্জা পেলো হিমেল। অসস্তি ঘিরে ধরতেই বলল
–ভালো মানুষ বলার মতো জীবনে কিছুই করিনি।
হিমেল কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই ছেলেটি বলে উঠলো
–কুমু আপু খুব সহজে কাউকে ভালো মানুষ বলে না। আপু যখন বলেছে তাহলে অবশ্যই আপনি ভালো মানুষ।
হিমেল বিস্ময় নিয়ে তাকাল। কুমুকে আপু বলে সম্বোধন আর তাকে ভালো মানুষ আখ্যা দেয়ার ব্যাপারটা মস্তিস্ক বিদ্যুৎ গতিতে ধরে ফেললো। পুরো বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতেই মুচকি হেসে বলল
–তোমার সাথে তো পরিচয় নেই। নাম কি তোমার?
–অন্তু। আমি মৌয়ের খালাত ভাই। অনার্স ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল এক্সাম শেষ করে বেড়াতে এসেছি।
অন্তুর কথা শুনে হিমেলের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। নিজের বেশী বোঝার ব্যাপারটায় নিজের গালেই সজোরে একটা চড় মারতে ইচ্ছা করলো। আপাতত সেটা স্থগিত রেখে নিজেকে বিশ্রি কয়েকটা গালি দিয়ে বসলো মনে মনে। পরক্ষনেই মনে পড়লো সবথেকে বড় বোকামিটার কথা। নিজে দায়িত্ব নিয়ে কুমুকে আকাশের হাতে তুলে দেয়ার প্রস্তুতি করে এসেছে। এতক্ষনে কথা নিশ্চয় শেষ। কি কথা হয়েছে কে জানে? কুমু যদি সম্মতি দেয় তাহলে কি হবে? আর ভাবতে পারলো না সে। নিজেকে মুহূর্তেই অসহায় মনে হল। এর মাঝেই মৌ আঙ্গুল তাক করে চিৎকার করে উঠলো
–ঐ তো আপা আসছে।
হিমেল পেছনে তাকাল। কুমু হেটে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। মৌ আর অন্তুকে দেখে কঠিন গলায় বলল
–তোরা এখানে কি করছিস?
অন্তু বলল
–তোমার আসতে দেরি হচ্ছিল তাই মৌ বলল বাইরে দাঁড়াবে।
কুমু ক্ষিপ্ত মেজাজে বলল
–ভেতরে চল।
হিমেলকে সম্পূর্ণ না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল কুমু। এমন আচরণে হিমেলের সূক্ষ্ম অপমান বোধ হল। কঠিন গলায় বলল
–কোথায় ছিলে এতক্ষন?
কুমু থেমে গেলো। কথাটা যে তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা সেটা বুঝতে কষ্ট হল না। হিমেলের কথার মাঝে অধিকার বোধ খুঁজে পেতেই রাগটা আচমকাই মাথায় উঠে গেলো। অনুভুতির অপমানটা তখন ভালোভাবেই কুমুর গায়ে লেগেছিল। সেটাই নতুন করে আবার মনে পড়তেই ঘুরে তাকাল। জোরালো সরে বলল
–আমাকে বলছেন?
হিমেলের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মিনমিনে স্বরের সেই কুমু হঠাৎ করেই এমন বাঘিনি হয়ে যাওয়ার কারণটা বুঝতে পারলো না। কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও সেটাকে সম্পূর্ণ গোপন রেখেই স্বাভাবিক ভাবে বলল
–তোমাকেই বলছি। কোথায় ছিলে?
কুমু এগিয়ে সামনে দাঁড়ালো। তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–যেখানে রেখে এসেছিলেন সেখানেই ছিলাম। ভুলে গেছেন বুঝি?
কুমুর করা অপমানটা হিমেল ধরতে পারলেও গুরুত্ব দিলো না। বলল
–দুই ঘণ্টা হল। এতক্ষন নিশ্চয় কথা বলছিলে না? অনেক আগেই কথা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। বাকি সময়টা কোথায় ছিলে?
কুমু হেসে উঠলো। বলল
–কথা বলতে কতোটা সময় দরকার সেটা জানেন দেখছি। তাহলে নিশ্চয় কি কথা হচ্ছিল সেটাও জানেন? যাক ভালো লাগলো শুনে। একটা কথা স্পষ্ট বলতে চাই। আমার কোন কাজের কৈফিয়ত আমি আপনাকে দিতে চাইনা। আমার জীবন আমার ইচ্ছা। আর আমার কোন ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলার অধিকার আপনার নেই।
হিমেল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কুমুর কথা বলার ধরন কখনই এমন ছিল না। সেই প্রথমদিন যখন তাকে বখাটে বলে আখ্যা দিয়েছিলো সেইদিন শুধু এভাবে কথা বলেছিল। কিন্তু সেদিন এভাবে কথা বলার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু আজ এমন করার কারণ কি? তার ভাবনার মাঝেই কুমু আবারো বলল
–আপনার আর কিছু বলার আছে বলে আমার মনে হয়না। আমি অনেক টায়ার্ড। আমার আর কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় নেই।
ঘুরে দাঁড়ালো কুমু। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। চোখে পানি টলমল করে উঠলো। পা বাড়াতেই পেছন থেকে কানে এলো হিমেলের গম্ভীর আওয়াজ
–বুঝেছি। কার সাথে কথা বললে এখন সময় নষ্ট হবেনা জানতে পারি কি?
কুমু ঘুরে তাকাল না। দীর্ঘশ্বাসটা বুক চিরে বেরিয়েই এলো। কঠিন গলায় বলল
–যার কাছে আমার অনুভুতির নুন্যতম সম্মানটুকু আছে। তার সাথে।
কথাটা বলেই ভেতরে চলে গেলো। কুমুর অভিমান আর এমনভাবে কথা বলার কারণটা হিমেল এবার বুঝতে পারলো। এতদিনে মেয়েটার চোখের ভাষা যে হিমেলের দৃষ্টিগোচর হয়নি তা না। পুরো বিষয়টা স্পষ্ট না হলেও কিছুটা সে ঠিকই বুঝেছে। কিন্তু নিজের মনে সেসবের জন্য আদৌ কোন সাড়া আছে কিনা সেটা বুঝতেই এতোটা সময় পার করে ফেলেছে। আজ সেটাও স্পষ্ট তার কাছে। সাধারণ এই মেয়েটাই তার কাছে আজ অসাধারণ হয়ে উঠেছে। কিছু বিশেষ অনুভুতিতে হাওয়া লাগতেই প্রশস্ত হেসে উঠলো সে। নীচের ঠোঁট আলতো করে কামড়ে ধরে বলল
–সবই বুঝলাম। এখন শুধু মুখে শোনার অপেক্ষা। বলতে তো তোমাকে হবেই কুমু।
এইদিকে বাসায় ফিরে কুমু সোজা বাথরুমে গেলো কাপড় নিয়ে। মনটা ভীষণ খারাপ তার। কাঁদতে না চাইলেও নিজেকে আটকাতে পারলো না। অনেকটা সময় নিয়ে বাথরুমে বসেই কাঁদল। গোসল শেষে বের হয়ে এসে খাওয়া শেষ করে ঘরে গেলো। মৌ ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে স্থির করতে পারছে না। ভেতরটা কষ্টে ভরে যাচ্ছে। উঠে টেবিলে ডাইরি খুলে বসে পড়লো। কিছু একটা লিখতে ইচ্ছা করছে কিন্তু পারছে না। চোখ বেয়ে আবারো পানি গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু কেন কাঁদছে সে সেটা বুঝতে পারলো না। যে মানুষটার কাছে তার অনুভূতিটাই অস্পষ্ট তার কাছ থেকে সেই অনুভুতির সম্মান আশা করাটা নিছক বোকামি ছাড়া কিছু নয়। নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের পানি মুছে ফেললো। আজ সে নিশ্চিত হয়েছে যে হিমেলের মনে তার জন্য কোন অনুভূতি নেই। কোন সম্পর্ক তৈরি হতে গেলে দুজনের পূর্ণ সম্মতি প্রয়োজন। সেখানে হিমেল তাকে নিয়ে কখনো সেরকম কিছু ভাবেই নি। সে হিসেবে ভাবতে গেলে কুমুর অনুভূতি মূল্যহীন। আর এই মূল্যহীন অনুভুতিকে বয়ে বেড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এখানে শুধু কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাওয়া সম্ভব না। কলমটা হাতে তুলে নিলো। সাদা ডাইরির পাতাটা ভরে ফেললো কিছু অনুভুতির ছোঁয়ায়।
“উনি বাড়ীওয়ালার সেই বিদেশ ফেরত ছেলে। ওনারা অনেক বড়লোক। আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের শ্যাম বর্ণের মেয়ে কি তার যোগ্য হতে পারে? এ তো অসম্ভব! সমাজের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এ ঘোরতর অন্যায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জন্য ভালবাসাটা অন্যায়। তারা সব সময় নিষিদ্ধ মানুষকে মন দিয়ে বসে।“
ভগ্ন হৃদয়ে কলমটা কলমদানিতে রেখে দিলো কুমু। মনের ভেতরে একটু একটু করে গোছানো অনুভুতিকে আজ সে বাধন ছাড়া করবে। মুক্তো করে দেবে সেইসব সুখময় মুহূর্ত। মন ভালো করা স্মৃতিগুলোকে। মানুষটাকে নিয়ে আর ভাববে না সে। নিষিদ্ধ আখ্যা দেবে সেগুলোকে। তার মন সাগরে উতলে ওঠা জোয়ারের জলের ছলছল শব্দটা চেপে রাখবে নিষিদ্ধ নামক বালির নীচে। এই বালির নীচে জলের শব্দ কেউ শুনতে পাবে না। জানতে পারবে না তার গোপন প্রেমের কথা।
চলবে…