বালির নীচে জলের শব্দ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্ব ২৬
তকিপুর! বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটা গ্রাম। গ্রামের আয়তন খুব একটা বড় নয়। একদম প্রত্যন্ত বলাই চলে। কারণ উন্নয়নের জোয়ার এখনো এখানে পৌছায় নি। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকায় এই গ্রামে সন্ধ্যার পর থেকে চলে নানা রকম অনৈতিক কর্মকাণ্ড। সন্ধার পর পুরো গ্রাম জনশূন্য হয়ে যায়। শেয়াল কুকুর গুলোও যেন রাস্তায় চলতে ভয় পায়। গ্রামের পাশেই ঘন জঙ্গল থাকায় সেখানে ডাকাতদের আস্তানা গড়ে ওঠে। ডাকাতদের ভয়ে লোকজনের আনাগোনা কমে গেলে ধীরে ধীরে শুরু হয় চোরাচালান কার্যক্রম। এখান থেকে শহর আর থানা অনেকটা দূর হওয়ায় সময় মতো কেউ পৌছাতে পারে না। তাই এসব বিষয় আটকানো সম্ভব হয়না। প্রশাসন অনেকবার হস্তক্ষেপ করেও ব্যর্থ হয়েছে। লোকমুখে শোনা যায় পাহারা দেয়ার জন্য গ্রাম্য পুলিশ নিযুক্ত করা হয়েছিলো। কিন্তু কয়েকদিন পরেই তারা হঠাৎ করেই কাউকে কিছু না জানিয়েই গায়েব হয়ে যায়। এটা নিয়ে অনেক হইচই হয়। সাংবাদিকরা আসে খবর সংগ্রহ করতে। কিন্তু গ্রামের কেউ মুখ না খুললে তারাও ব্যর্থ হয়ে চলে যায়।
এই গ্রামের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান সেলিম হাওলাদার। ২০ দিন আগেই জনগণের সম্মতিতে নির্বাচিত হন তিনি। আসলে চেয়ারম্যানের আর কোন পদপ্রার্থী না থাকায় সবাই মিলে তাকেই চেয়ারম্যান বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই গ্রামের চেয়ারম্যান হতে হলেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। অনেক জবাব দিহি করতে হয়। যার কারণে সবাই এই দায়িত্বটা নিতে চায় না। সেলিমের বাবা রশিদ হাওলাদার এক সময়কার চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি গ্রামের সবটা যতটা সম্ভব ভালভাবে চালানর চেষ্টা করেছেন। খুব ভালো মানুষ হিসেবে গ্রামে তার খ্যাতি রয়েছে। তাই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার ছেলেকে চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। সেলিম যথেষ্ট শিক্ষিত এবং ভদ্র ছেলে। মাত্র কয়েক মাস আগেই শহর থেকে পড়ালেখা শেষ করে গ্রামে এসেছে। রশিদ মিয়া চান তার ছেলে শহরে গিয়ে চাকরি না করে গ্রামের উন্নতিতে নিজের বিদ্যা বুদ্ধি কাজে লাগাক। তাই তার কাধেই দায়িত্বটা দিয়েছেন। এতো অল্প বয়সে এমন দায়িত্ব নেয়ার ব্যাপারে কেউ আপত্তি করেনি। কারণ সেলিম ছেলে হিসেবে যথেষ্ট ভালো আর বিচক্ষন। তাই সে ভালোভাবেই সবকিছু সামলে নিতে পারবে।
টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ আর মাটির সোঁদা গন্ধ বর্ষাকালের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে। ভোর থেকে আকাশ কাঁপিয়ে মেঘের গর্জন আর ঝুম বৃষ্টি চলছে। চারিদিকে প্যাচপ্যাচে কাঁদা। কোথাও আবার পানিও জমে আছে এক হাঁটু। হাট বাজারের জন্য সবাইকেই প্রায় শহরমুখি হতে হয়। এই কাঁদা ভেঙ্গে শহরে যাওয়ার মতো কোন অবস্থা নেই। যাতায়াতের জন্য রাস্তার যানবাহনও তেমন দেখা যাচ্ছে না। সেলিম বাড়ির সামনের কাচারি ঘরে দাঁড়িয়ে পুরো দৃশ্যটা অবলোকন করলো। কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল
–মেম্বার চাচা? এরকম বৃষ্টিতে শহরে যাওয়ার অসুবিধা হয়না? হাট বাজার করে কিভাবে লোকজন?
মেম্বার দূরে পানিতে ডুবে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। শুধু অসুবিধা নয়। ভয়ানক পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ায়। একটানা দুই তিনদিন বৃষ্টি হতে থাকলে লোকজন রাস্তা দিয়ে চলেফেরা করতে পারে না। কেউ কেউ তো হাট বাজার করতে না পেরে না খেয়েই দিন কাটায়। কারণ এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দিন মজুর। দিনের বাজার তারা দিনেই করে। আর বৃষ্টিতে কাজ না হলে বাজারের টাকাও হাতে পায়না। হতাশ কণ্ঠে বললেন
–অসুবিধা তো হয় বাজান। কহনো কহনো না খাইয়াই থাকা লাগে। বৃষ্টি আইলে সবাই ঘরবন্দি হইয়া যায়। বাচ্চাগ কান্দন শুইনা মায়া লাগে।
সেলিম চোখ বন্ধ করে বড় শ্বাস ফেললো। গ্রামের মানুষ আশা করেই তাকে এই পদটার উপযুক্ত মনে করেছেন। আর সে কাউকে নিরাশ হতে দেবে না। কিছু একটা ব্যাবস্থা করতেই হবে। সেলিম একটু ভেবে বলল
–মেম্বার চাচা আমাদের গ্রামে বাজার বানানোর মতো কোন জায়গা আছে?
কালাম মেম্বার মলিন হেসে বললেন
–জায়গা তো আছেই। কিন্তু কে বাজার নিয়া বসবো? সবাই তো শহরে কাম করে। বিকাল হইলে তারপর আহে। বাজার নিয়া বসার মতন কেউ নাই বাজান।
–যারা শস্য ফলায় তারা সেগুলো অবশ্যই শহরে নিয়ে যায় বিক্রি করার জন্য। আমরা যদি তাদেরকে গ্রামেই সেই শস্য বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দেই আর একটা দাম নির্ধারণ করে দেই যাতে শহরে বিক্রি করে যে টাকা পেত তার থেকে কিছু টাকা বেশী হবে। তাহলে আমার মনে হয় তারা না করবে না। আপনার কি মনে হয় মেম্বার চাচা?
মেম্বার উচ্ছ্বসিত দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন। কৃতজ্ঞতায় চোখ ছলছল করে উঠলো। প্রশস্ত হসে উঠে বললেন
–আপনে বুদ্ধিমান মানুষ বাজান। আপনের অনেক বুদ্ধি। আপনে এই গেরামের ভালা করবেন। গেরামের মানুষ আপনারে বাইছা কোন ভুল করেনি।
সেলিম দৃষ্টি নত করে হেসে উঠলো। সে নিজের প্রশংসা শুনতে প্রস্তুত নয়। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে
–আপনি কাচারি ঘরে সবাইকে ডাকার ব্যাবস্থা করুন চাচা। বৃষ্টি থামলেই আমি সবার সাথে কথা বলতে চাই। ততক্ষন আমি বিষয়টা নিয়ে আব্বার সাথে একটু কথা বলবো।
———-
তুমুল বর্ষণের পরে মাঠ ঘাট ভরে উঠেছে। ধানের গাছগুলো অর্ধেক পানিতে ডুবানো। খাল বিল সব পানিতে টইটুম্বুর। মাছ ধরার উপযুক্ত সময় এটা। পরী, মাহিন আর ঝুম বড়শী কাঁধে নিয়ে হেটে যাচ্ছে বিলের ধারে। অল্প সময় আগেই বৃষ্টি থেমেছে। এখন বিলের পানি শান্ত। তাই মাছ পেতেও অসুবিধা হবে না। বিলের ধারে পৌঁছে মাহিন আটার দলা পাকিয়ে বড়শির কলে লাগাচ্ছে। পরী আর ঝুম আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করছে কোন জায়গায় বড়শী ফেললে মাছ ভালো পাওয়া যাবে। একটা গাছের ছায়ার নীচে ঝুম বসে পড়েছে। বড়শীটা পানিতে ফেলে বলল
–ঐ পরী অইহানে বসে যা। অইহানে মাছ পাইবি।
পরী বিনাবাক্য ব্যায়ে ঝুমের দেখান জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। বড়শীটা ফেলে গভীর দৃষ্টিতে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সে উপর থেকে মাছ দেখার চেষ্টা করছে। তাদের থেকে অল্প দুরত্তে কয়েকজন বাচ্চা ছেলে এসে পর পর লাফ দিয়ে পানিতে নামল। মনের সুখে সাতার কাটছে তারা। কিন্তু তাদের এই সাতার কাঁটা খুব বেশী সময় চলল না। ঝুম ধমকে উঠে বলল
–ঐ বিচ্ছুর দল। পানি থেকে উইঠা যা কইলাম। নাইলে কিন্তু আমি নামলে সবাইরে পানিতে চুইবা মারমু।
ছেলে গুলো ঝুমের ধমকে তেমন দমে গেলো না। তারা এই ধমকের বিপরীতে তাচ্ছিল্যের হাসি উপহার দিয়েই আরও জোরে সাতার কাটতে শুরু করলো। এদিকে তাদের এতো জোরে সাতার কাঁটার দরুন মাছ পাওয়া দুস্কর হয়ে উঠছে। মাছ না পাওয়ার কষ্টের থেকে ছেলেগুলোর কথা না শোনার রাগটা বেশী পিড়া দিলো ঝুমকে। তাদের হাসির শব্দ শরীরে অপমানের উদ্রেক ঘটাতেই কোন কিছু না ভেবেই ওড়নাটা কোমরে গুঁজে লাফ দিলো পানিতে। বিলের পানি ছিটকে এসে পড়লো পরীর মুখে। ওড়না দিয়ে পানি মুছে চেচিয়ে বলল
–ঝুম উইঠা আয় কইছি। এমন করিস না। কেউ দেখলে বাসায় কইয়া দিবো। কপালে মাইর ছাড়া আর কিছুই জুটব না। জলদি উইঠা আয়।
ঝুমের কানে পরীর কথা গুলো ঢুকলেও তার মস্তিস্ক এখন আর সেসব ভাবার মতো অবস্থায় নেই। সে তাদের শায়েস্তা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সাঁতরে তাদের কাছে গিয়ে একটা বাচ্চাকে ধরে ফেলতেই বাকিগুলো ধস্তাধস্তি করে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। ঝুম মহা রাগ বিরক্তি নিয়ে উঠে আসে কাকভেজা হয়ে। তার এই ভেজা শরীর দেখেই পরী আর্তনাদ করে বলে ওঠে
–তুই তো ভিইজ্জা শ্যাষ। এহন বাড়ি জাইবি কেমনে? একটা মাইরও মাটিত পড়বে না ঝুম। কেন গেলি? কথা শুনলি না কেন? কইছিলাম।
ঝুম বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলল
–চুপ কর তো। আজাইরা ফেদলা পাড়িস না। এহন এসব শুনতে মন চাইতেছে না। কত্ত খারাপ পোলাপাইন। আমারে এক বিন্দু ভয়ও করেনা। অগোরে মাইর দিতে পারলে শান্তি পাইতাম।
পরী মুখটা ফ্যাকাশে করে বড়শীটা গুছিয়ে নিলো। মাহিনকে বলল
–চল বাসায় যাই। এইহানে থাকা জাইবনা।
মাহিন অসহায়ের মতো ঝুমের দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেললো। যার অর্থ সে পরীর সাথে বাসায় যেতে চায়। ঝুম তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল
–মাইয়া মানশের বেহাজ। মুখ খুলে কথা কইতে পারে না ব্যাটা পুরুষ।
মাহিনের এসব কথা শুনে মোটেও খারাপ লাগে না। কারণ সে অত্যন্ত শান্ত একজন ছেলে। কোন গণ্ডগোল সে পছন্দ করেনা। কিন্তু ঝুম সম্পূর্ণ বিপরীত। মেয়ে হয়েও ছেলেদের মতো ছুটে বেড়ানোই তার কাজ। এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না সে। এর জন্য বাড়িতে অনেক মার খেয়েও তার কোন যায় আসেনা। তার এসবের কারণে পরীকেও কথা শুনতে হয়। তাই সে ঝুমের উপরে মনে মনে খুব রাগ করে। মাঝে মাঝে তার আচরনেও প্রকাশ পায়। তবে ঝুম এসবে খুব একটা পাত্তা দেয়না। পরী আর মাহিন চলে যাওয়ায় ঝুম একা হয়ে গেলো। এই ফাঁকা জায়গায় একা থাকা বিপদ বুঝেই তাদের পেছন পেছন হাটা ধরল। গ্রামের রাস্তায় উঠতেই চোখ পড়লো চেয়ারম্যান বাড়ি। কাচারির সামনে সারা গ্রামের মানুষ। পরী থেমে গেলো। পেছন ফিরে ঝুমের উপরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলল
–এই ভর্তি মানুষের সামনে দিয়া বাড়ি জাইবি কেমনে?
ঝুম নিজের ভুল বুঝতে পারলো। উত্তেজিত হয়ে পানিতে ঝাপিয়ে পড়া একদম ঠিক হয়নি। সেটা বুঝেই দৃষ্টি নত করে মিনমিনে সরে বলল
–একটু দাঁড়াই। এহনি সব ফাঁকা হইয়া জাইব।
পরী রাগে ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলো। আর যাই হোক এতো মানুষের সামনে দিয়ে এই অবস্থায় অন্তত ঝুমকে সে কিছুতেই নিয়ে যেতে পারে না। সেলিম লোকজনের সাথে কথা বলছিল বাজার নিয়ে। সবাই তার সিদ্ধান্তে খুব খুশী। এরকম কোন ব্যবস্থা হলে ভালই হয়। কথা শেষ করে যে যার মতো চলে গেলো কাজে। পরী, ঝুম আর মাহিন এতক্ষন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো। সবাই চলে যেতেই তারাও এগোতে শুরু করলো। অল্প কয়েক পা এগুতেই আচমকা কেউ পথ আটকে দাঁড়ালো। পরী আর মাহিন সেদিকে একবার তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে দৃষ্টি নত করে ফেললো। গুরু গম্ভীর কণ্ঠস্বর বলে উঠলো
–তোমরা যাও।
পরী মাহিন দুজনেই হাফ ছেড়ে পা বাড়াল। ওদের পিছে পিছে ঝুম পা বাড়াতেই শক্ত হাতের বাধনে আটকা পড়ে গেলো তার নরম তুলতুলে হাত। কানে এলো গম্ভীর কণ্ঠস্বর
–তোমাকে যেতে বলেছি?
চলবে…
(সব নতুন চরিত্র। নতুন পরিবেশ। বুঝতে আপনাদের প্রথমে অসুবিধা হবে। প্রথম পরিচ্ছেদের সাথে মেল বন্ধন পাবেন না। তবে পুরাতন চরিত্র গুলো অবশ্যই থাকবে। সেটার জন্য একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ রহস্যে ভরপুর। তাই অনেক ধৈর্য নিয়ে প্রতিটা পর্ব পড়তে হবে। ধীরে ধীরে খোলাসা হবে। আর ধীরে ধীরে ঘটনা প্রবাহ অগ্রসরের মাধ্যমেই পুরাতন চরিত্র গুলোর দেখা মিলবে। সবাইকে ধন্যবাদ।)