বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ২৭
শান্ত হৃদপিণ্ড টা ছুটতে শুরু করেছে। আচমকাই শরীরে ছড়িয়ে গেলো শিরশিরে এক অনুভূতি। হাতটাকে বাধন ছাড়া করার চেষ্টা করতেই সেলিম গম্ভীর আওয়াজে আবার বলল
–এই বাধন ছাড়া এতো সহজ কথা না। এতোটা হালকা ভেব না যে তুমি চাইলেই ছুটে যেতে পারবে। এইভাবে টানাটানি করবানা। শান্ত হও।
ঝুম থেমে গেলো। এই শক্ত হাতের বাধন থেকে তার নরম তুলতুলে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়া এতো সহজ কথা না। সেলিম যতক্ষণ নিজে থেকে ছাড়ে নি ততক্ষন সে চেয়েও পারবে না। তাই অযথা এসব টানাটানি করে লাভ নেই। সেলিম এতো সহজে হাত ছাড়বে না। কারণ সে জানে হাত ছাড়লেই ঝুম পালিয়ে যাবে। আপাদমস্তক ভালো ভাবে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–এই অবস্থায় ঘোরাফেরা করাটা কতটুকু ভালো দেখায় ঝুম? বড় হয়েছ কিন্তু বুদ্ধি হয়নি মাথায়। কেন নামছ পানিতে? মানা করেছিলাম।
ঝুম উত্তর দিলো না। আসলে সে উত্তর দিতে পারলো না। কারণ যতই সে চঞ্চল হোক না কেন এই মানুষটার সামনে এসেই তার সমস্ত চঞ্চলতা হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় কথার খেই। এখন তার অসস্তিতে কথা তো দূরের কথা হাত পা গুলোও কেমন ভারী হয়ে আসছে। কারণ সামনের মানুষটার গভীর দৃষ্টি তার পুরো সিক্ত শরীর জুড়ে বিচরণ করছে। এখন নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকেই চড় মারতে ইচ্ছা করছে। সেলিম অস্বস্তিটা ধরে ফেললো। হাতটা আলতো করে ছেড়ে দিলো। ঝুম ছাড়া পেয়ে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। এক দৌড়ে চলে গেলো বাড়িতে। সেলিম তার দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে। ঝুম বাড়ির সদর দরজা পেরোতেই মুখোমুখি হয়ে গেলো নাজমা খাতুনের। তিনি যেন মেয়ের অপেক্ষাই করছিলেন। মায়ের এমন ভয়ংকর চাহুনি দেখেই তার আত্মা শুকিয়ে গেলো। নাজমা সজোরে গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতেই রেহানা এগিয়ে এসে হাত ধরে ফেললো। সে জানে নাজমা একবার মারতে শুরু করলে তার রাগ না কমা পর্যন্ত আর থামবে না। নাজমা কঠিন কণ্ঠে বলল
–হাত ছাইড়া দে ছোট। আমার রাগ তুলিস না।
রেহানা আরও শক্ত করে হাত ধরে ফেললো। বলল
–না বুবু তুমি এমনে মাইয়াডা রে মারতে পারনা। বড় মাইয়া। মাইনশে শুনলে কি কইব?
নাজমা ঝুমের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে রেহানার দিকে তাকিয়ে বলল
–সেইটা ওর চিন্তা করা উচিৎ আছিলো। বড় মাইয়া এমনে ভিজা গায়ে গেরামে ঢু ঢু কইরা ঘুইরা বেড়ায় কোনহানে দেখছিস? মাইনশে দেখলে নানা কথা কইব সেই হুশ কি তার আছে? এই মাইয়ার বিয়া হইব কেমনে?
রেহানা হতাশ শ্বাস ছেড়ে বললেন
–বিয়া শাদি ভাইগ্যের ব্যাপার। কপালে লেহা থাকলে হইবই। তোমারে এতো ভাবতে হইব না। তুমি যাও এহন। আমি দেখতাছি।
নাজমা রেগে চলে গেলো। ঝুম এতক্ষন গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একটা শব্দ উচ্চারন করেনি। কারণ তার মুখ থেকে কথা বেরোলেই তার মা আরও রেগে যাবেন। ঝুম গাল থেকে হাত সরিয়ে বলল
–আমারে তো গেরামের কেউ দেখেনি চাচি। আম্মা খামাখা আমার উপরে রাগ করে।
রেহানা কান ধরে বললেন
–বড় হইচস কিন্তু বুদ্ধি এহনো হইল না। তোর মা কি এমনে রাগে তোর উপরে। যা ভিজা কাপড় ছাইড়া আয়। কাম আছে। পাকের ঘরের কাম শিখন লাগে মাইয়াগো।
———-
অন্ধকার গ্রাস করে ফেলেছে চারিদিকে। জন মানবহীন নিস্তব্ধ এলাকা। ঝি ঝি পোকার মাথা ধরে যাওয়ার মতো তীব্র শব্দ আর শেয়ালের হাঁক শোনা যাচ্ছে। সবাই এখন ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরে পরিবারের সাথে সময় কাটাচ্ছে। ভুলেও কেউ বাইরে বের হবে না। এর সুযোগ নিয়েই কয়েক জোড়া পা পায়চারী করছে শাল বাগানের ভেতরে। তারা খুব সচেতনভাবে আশেপাশে তাকাচ্ছে। কাউকে দেখা যাচ্ছে কিনা। যদিও এই সময় কেউ ঘর থেকে বের হয়না। তবুও সাবধানের মার নেই। দূরে মিটিমিটি জ্বলে ওঠা আলো দেখতে পেয়েই সবাই সচেতন হয়ে গেলো। কিছুটা ভয় গ্রাস করে ফেললো তাদেরকে। একে অপরের দিকে তাকিয়ে একেকজন একেকটা গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়লো। এমন ভাবে আড়াল করে নিলো নিজেদেরকে গাছ ছাড়া মানুষ গুলোকে দেখতে পাওয়ার কোন উপায় নেই। সবার দৃষ্টি ঐ আলোক উৎসের দিকে স্থির। আলোটা স্পষ্ট হতেই নিভে গেলো। আবারো সবাই মনোযোগ দিলো সেদিকে। অপেক্ষা করছে পরবর্তী দৃশ্য অবলোকনের। এভাবে পরপর তিনবার আলো জ্বলে ওঠে আর নিভে যায়। এবার সবার চিন্তাটা দূর হয়ে গেলো। সস্তির নিশ্বাস ফেলে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো সবাই। এ যে ওদের নিজেদের মধ্যেকার কিছু কাঙ্ক্ষিত সাংকেতিক ব্যাপার। পাশ থেকে একজন তাদের সরদারের কাছে এসে বললেন
–আইতাছে ওস্তাদ।
লোকটি কথার উত্তর দিলো না। সামনেই স্থির দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থাকলো। আলোর উৎসটা ধীরে ধীরে একদম কাছে এসে বন্ধ হয়ে গেলো। দুজনে মুখোমুখি দাঁড়াতেই সরদার বলল
–এতো দেরি করলেন যে? ভাবছিলাম আপনি আইবেন না।
লোকটি সরদারের কথার উত্তর দিলো না। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে গম্ভীর আওয়াজে বলল
–মাইয়াডার কোন খবর পাইছো?
সরদার হতাশ হল। তবে কণ্ঠের তেজ দমিয়ে যেতে দিলো না। বলল
–নাহ! তয় তাড়াতাড়িই পামু। মাইয়াডা জহন পলাইয়া গেছিলো তহন হেয় ঘায়েল আছিলো। ঐ ন্যাংরা পাও নিয়া বেশিদুরে যাইতে পারবো না। এই গেরামের ভিতরেই আছে। আমি পতিটা বাড়ির খোঁজ লইতাছি। আমরা খুইজা পামুই। আপনি চিন্তা কইরেন না।
সরদারের কথা শুনে লোকটি নিশ্চিন্ত হতে পারলো না। বরং মনের ভয়টা আরও বেড়ে গেলো। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এখনো মেয়েটার কোন খোঁজ পাওয়া গেলো না। আর এই গ্রামেই যদি থাকে তাহলে বিপদটা ভয়ংকর রুপ নিতে পারে। লোকটি কঠিন গলায় বলল
–সরদার তুমি কি এই ব্যাপারটা গায়ে লাগাইতেছনা? ভুল করতাছো এতো সোজা ভাইবা। ঐ মাইয়া যদি সত্যই এই গেরামে থাকে তাইলে কিন্তু আমাগোর বিপদ। যদি চেয়ারম্যানের কাছে যায় তাইলে কোনভাবেই রক্ষা নাই। হেয় কিন্তু আমাগোর চেহারা দেইখা ফালাইছে। যদি চিনবার পারে তয় আমাগোর হালত খারাপ করতে সময় লাগব না। আর আমারে যদি বিপদে পড়তে হয় তয় তোমারে আমি ছাড়ুম না। কইয়া দিলাম কিন্তু।
সরদার এতক্ষন বিষয়টা সত্যিই সহজভাবে নিয়েছিলো। কিন্তু এই মধ্য বয়স্ক লোকটার কথা তার মাথা খুলে দিয়েছে। মেয়েটা চেয়ারম্যানের কাছে গেলে কিন্তু সত্যিই তাদের রক্ষা নেই। তবে সে চেয়ারম্যানের কাছে গেলে চেয়ারম্যান এতদিন কোনভাবেই চুপ করে থাকতো না। এর বিচার অবশ্যই বসাতো। সবাইকে ডেকে জমা করতো। আরও গভীর ভাবে ভাবতে হবে বিষয়টা নিয়ে।
————
শামিম বড় দীঘির পাড়ে গাছের নীচে বসে আছে। জ্যোৎস্নার আলোয় দীঘির পানি ঝলমল করছে। চারিদিকে আলোর ছড়াছড়ি। সেই আলোয় রাস্তা ঘাট একদম পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। পায়ের শব্দ কানে আসতেই শামিম দ্রুত পেছন ফিরে তাকাল। ওড়না দিয়ে পুরো মুখ ঢাকা রমণী তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। এদিক সেদিক অস্থির দৃষ্টি ফেলছে। কেউ যাতে দেখে না ফেলে। খুব সাবধানে হেটে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। শামিম তাকে দেখেই ঠোঁট এলিয়ে হেসে উঠে বলল
–আইছো তুমি? কেউ দেখে নাই তো?
পরী মাথা থেকে ওড়নাটা ফেলে দিলো। খিলখিল করে হেসে উঠে বলল
–না। কেউ দেখে নাই। আর দেখবো কেডা? সবাই তো বাড়ির ভেতর। এই সুজোগেই তো তোমারে দেখা করতে কইলাম।
শামিম মুগ্ধ চোখে রমণীর দিকে তাকাল। চাঁদের আলোয় বুঝি মেয়েদের সৌন্দর্য সাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়। সাধারণ পরীকে আজ জ্যোৎস্না সিক্ত অবস্থায় অসাধারণ লাগছে। শামিমের অমন দৃষ্টি দেখে পরী কিছুটা লজ্জা পেলো। নিচের ঠোঁট আলতো করে কামড় দিয়ে বলল
–কি দেখতাছো? আমারে আগে দেখো নাই?
শামিম হাসল। ঠোঁটের আগায় হাসি রেখেই বলল
–দেখছি। তয় তোমারে যতই দেখি মন ভরে না। মনে হয় দেখতেই থাকি। তুমি সত্যই পরী। নামেও পরী চেহারাতেও পরী।
পরী আবারো খিলখিল করে হেসে উঠলো। শামিম আবেগি কণ্ঠে বলল
–কি কইবা পরী? কেন ডাকছ আমারে?
পরী হাতের বাধন থেকে একটা কাগজ বের করে বলল
–এইডা তোমার চিঠি। এইডা দিবার জন্য ডাকছিলাম। এইহানে সব লেখা আছে। পড়লেই বুঝতে পারবা। আর বেশী থাকা জাইবে না। আমি এহন আসি। কেউ দেখলে বিপদ হইবো।
শামিম চিঠিটা হাতে নিয়ে পরীকে বিদায় দিলো। পরী কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে আবারো থেমে গেলো। পেছন ঘুরে বলল
–পইড়ো কিন্তু।
শামিম জবাবে মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নাড়ল। সে সামনে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। গত ১ বছর ধরে পরীর সাথে এভাবে লুকিয়ে প্রেম করছে। এই গ্রামে ছেলে মেয়েদের এভাবে মেলামেশাকে কেউ ভালো চোখে দেখে না। প্রেম নিষিদ্ধ এই গ্রামে। তবুও কিভাবে যেন তারা এই নিষিদ্ধ বাধনে বাধা পড়ে গেছে। এই বাধন থেকে আর কোনভাবেই বের হওয়া সম্ভব না। রাতের আধারে লোকজনকে ফাঁকি দিয়ে এভাবেই তারা লুকিয়ে দেখা করে মাঝে মাঝে। চিঠি আদান প্রদান করে। পরী সম্পূর্ণ অন্ধকারে মিলিয়ে যেতেই শামিমের চেহারায় হুট করেই জায়গা করে নিলো এক দুর্বোধ্য হাসি। তার সেই দুর্বোধ্য হাসি নতুন কোন রহস্যের সংকেত বার্তা দিচ্ছে। কে জানে গ্রামবাসী কাল সূর্যোদয়ের সাথে সাথে কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছে। যা হয়তো ঘটনায় নতুন কোন মোড় এনে দেবে।
চলবে…