বালির নীচে জলের শব্দ
শেষ পর্বের শেষাংশ
কাপতে শুরু করে ঝুম। তার এমন দুর্বলতার সুযোগ লুফে নেয় উ’কি’ল। চিৎকার করে ভয় দেখাতেই ঝুম কেপে উঠে সত্যিটা স্বীকার করে বসে। অকপটে বর্ণনা করে সেদিন রাতের ভ’য়ং’কর সেই ঘটনা।
ঝুম আর পরী যে ঘরে থাকতো সেই ঘরের জানালায় এসে শামীম প্রায় প্রতিদিন দাড়াতো। পরীর সাথে কথা হতো। কিন্তু পরী মা’রা যাওয়ার পর সেদিন রাতে আবারও শামীমকে সেখানে দেখে ঝুম অবাক হয়েছিল। শামীম তাকে বলেছিল দেখা করতে। সে পরীর ব্যাপারে তাকে কিছু কথা জানাবে। কিন্তু বাড়ির কেউ যেনো না জানে। ঝুম কাউকে না বলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেও তার মা টের পায়। পরী মা’রা যাওয়ার পর বাড়ির একমাত্র মেয়ের উপরে তারা বেশ ন’জরদা’রি করে। তাই খুব সহজেই বুঝে যায় তার বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা। আর তার বাবা রফিক কে জানালে তিনি ভ’য় পেয়ে যান। পরীর মতো যাতে আর ঘটনা না ঘটে তাই দ্রুত সেই শালবনে চলে যান। আর তার আন্দাজ মতো সেখানেই পাওয়া যায় তাদেরকে। কিন্তু রফিক কে দেখে শামীম পালিয়ে যায়। যাওয়ার আগে কিছু করতে না পারার আ’ক্রো’শে ঝুমের হাতের র’গ কে’টে দেয়।
ঝুমের কথা শেষ হতেই উ’কি’ল আ’দাল’তে’র কাছে আরেকজনকে উপস্থিত করার অনুমতি চায়। আ’দা’ল’ত অনুমতি দিলেই তিনি মেম্বারকে ডাকেন। শুকনো মুখে মেম্বার উপস্থিত হয়। তার চেহারায় অনুশোচনার ছাপ। তীব্র অ’পরা’ধ’বোধ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। উ’কি’ল মেম্বারকে জিজ্ঞেস করেন
— আপনার ছেলের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত যা শুনলেন সব কি সত্যি?
মেম্বার মলিন মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
— আমার পোলারে আমি হারাইয়া ফেলছি। এক মাত্র পোলা আছিলো। যা করছি এই জীবনে সব ওর লাইগাই। কিন্তু আমি একখান কথা ভুইলা গেছিলাম। পা’প বা’প’রেও ছা’ড়েনা। হের লাইগা আমার পা’পে’র ফ’ল পোলার উপরে পড়ছিলো। হেও আমার মতন খা’রা’প কা’ম করবার লাগছিলো। অনেক বুঝাইয়াও ওরে ভা’লো ক’রবার পারিনি। শেষ পর্যন্ত আমি এই কা’ম ছা’ইড়া দিছি। কিন্তু আমার পোলা আমার কথা হুনলোনা। হেয় মা’ইয়া’গো নিয়ে ফু’র্তি করে। আমি বাধা দিলে আমারে মা’ই’রা ফেলতে চায়। আমি হাল ছাইড়া দিয়া ওরে শহরে পাঠাইলাম। কিন্তু হেয় শহর থেইকা ফিরা আইসা ওই রফিকের মা’ইয়া’রে শালবনে নিয়া যায়। আমি কিছুই জানতে পারিনাই।
কথাটা বলতে বলতেই কান্নায় ভেংগে পড়লো মেম্বার। নিজের ভুলটা এতদিনে তিনি বুঝতে পেরেছেন। মেম্বারের স্বী’কা’রো’ক্তি’মূল’ক জ’বান’ব’ন্দি শুনে আর বিভিন্ন সা’ক্ষী প্র’মা’ণ’ নিয়েই আ’দা’ল’ত সি’দ্ধা’ন্ত জানালো। শামীমের খু’নে’র মা’ম’লা’য় রফিকের শা’স্তি আর মেম্বারের অ’পক’র্মে’র জন্য তার শা’স্তি’র আ’দেশ দেয়া হলো।
———
আ’দা’লতে’র কার্যক্রম শেষ হতেই হিমেল চলে এলো কুমুর কাছে। কুমু জানালার পাশে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হিমেল ঘরে ঢুকেই মুচকি হেসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। কুমু ভয়ে কিছুটা কেপে উঠতেই হিমেল ফিসফিস করে বললো
— আর কোন ভয় নেই কুমু। সবাই উপযুক্ত শা’স্তি পেয়েছে। এখন সব ঠিক হয়ে যাবে।
কুমু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল। চোখ জোড়া পানিতে পরিপূর্ণ। টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়তেই হিমেল মুছে দিয়ে বলল
— অনেক কেঁদেছো। আর কাদবে না। তোমার সকল চোখের পানির দায়ভার আজ থেকে আমার।
কুমু হিমেলের বুকে মুখ লুকালো। হিমেল তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সেদিন হিমেলের পাশে মেম্বারকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কুমু জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। শামীম তার সহযোগীদের নিয়ে ডা’কা’তি করতে গেলে কুমু তাদেরকে দেখে ফেলে। এই দেখে ফেলার কারণে কুমুকে তু’লে নি’য়ে আসে তারা। সকালে কুমু কোন রকমে পা’লি’য়ে আসে। সেই রাতেই মেম্বারকে কুমু দেখতে পায় সেখানে। তিনি শামীমকে শা’সা’তে আসেন। কিন্তু তার কোন কথা শুনেনা শামীম। তিনি বাধ্য হয়ে ফিরে যান। মেম্বার তার পাশে দাড়িয়ে ছিলো সেটা মনে পড়তেই হিমেল রুশাকে বিষয়টা জানায়। রুশা কুমুর সাথে কথা বলে সবটা জেনে নেয় ভালো করে। তারপর সিদ্ধান্ত নেয় সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে মেম্বারের শা’স্তি’র ব্যবস্থা করবে। যেহেতু শামীম মৃ’ত তাই তার বিষয়ে তো আর কথা চলে না।
———-
তকিপুর গ্রামের কাজ শেষ। এবার ছাড়ার পালা। এই গ্রাম ছেড়ে আজ তারা চলে যাচ্ছে শহরে। তার আগে কুমুর দাদু বাড়ি যাবে তাকে নিয়ে। মা ভাই বোনদের সাথে দেখা করতে যাবে। ওরা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো কুমুর দাদু বাড়ির দিকে। সেখানে পৌঁছানো মাত্রই বাড়ির চৌকাঠে পা দিতেই দেখলো তার মা উঠোনে বসে মশলা বাটছে। কুমুর বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। চোখে পানি জমে গেলো। চাপা স্বরে মা শব্দটা উচ্চারণ করতেই তার মা চোখ তুলে তাকালেন। ঘটনা বুঝতে সময় লাগলো কিছুটা। মেয়েকে এতদিন পর দেখতে পেয়ে চমকে উঠলেন তিনি। নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছেন না কিছুতেই। সেদিনের ঘটনার পর তিনি মেয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। কত রাত নির্ঘুম পার করেছেন মেয়ের অপেক্ষায়। শেষ পর্যন্ত মেয়েকে দেখতে না পেয়ে তিনি ভেবেছেন হয়তো কুমু আর বেঁ’চে নেই। ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। কুমু দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। কিছু সময় চলল মা মেয়ের মধুর আলিঙ্গন। এক পর্যায়ে রাফি আর মৌ এসে জড়িয়ে ধরলো কুমুকে। ছোট্ট মৌ কিছু বুঝতে না পেরে অভিযোগ করে বলল
— আপা তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? বাসায় আসোনি কেনো?
কুমু উত্তর দিতে পারলো না। চুপ করে শুধু কাদতে লাগলো। মৌ অভিযোগের তাড়নায় কথা বলতে নারাজ আপার সাথে। তার এই অভিমান দুর থেকে খেয়াল করছিলো হিমেল। দেখেই হেসে ফেললো। তারপর এগিয়ে এসে ছোট্ট হাত দুটো ধরে বলল
— মৌ রাগ করেছে? রাগ করেনা। তোমার আপা এতদিন আমার কাছে ছিলো।
হিমেল কে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো মৌ। এতদিন পর আবারো হিমেলকে দেখতে পেয়ে তার খুশি বাঁধ মানলো না। এক গাল হেসে বলল
— তোমার কাছে ছিলো? তুমি নিয়ে গেছিলে আপাকে?
হিমেল হেসে বলল
— হ্যা। আমি রেখে দিয়েছিলাম।
মুহূর্তেই সমস্ত অভিযোগ নিঃশেষ হয়ে গেলো। মুখ ভরে হেসে উঠে আপার দিকে তাকাল। যেনো হিমেলের কাছে থাকায় সব দোষ মাফ। তাদের কথোপকথনের মাঝেই কুমুর চাচী আসলো। এতদিন পর চাচীকে দেখে কুমু জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু চাচীর মাঝে সেরকম কোন অভিব্যক্তি দেখা গেলো না। উল্টা তিনি হিমেলকে ভালোভাবে দেখে নিয়ে থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করলেন
— কারে সাথে লইয়া আইচো?
কুমু থেমে গেলো। কি উত্তর দেবে সেটা বুঝতে পারলো না। কারণ তাদের বিয়ের কথা পরিবারের লোকজন এখনো জানে না। তাই চুপ করেই থাকলো। এর মাঝেই তার চাচী আবারও বলল
— এতদিন কই আছিলা? কোন খবর নাই। কিছুই জানলাম না হুট কইরা কারে না কারে বাড়িতে নিয়ে আইলা। এইডা গেরাম। এইহানে পোলা বন্ধু আইতে পারে না তাতো জানো নাকি? তার উপর সারা গেরাম জানে তোমারে ডা’কা’ত তুই’লা নিয়া গেছিলো।
কুমুর মা তার চাচির কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কিছুটা চাপা স্বরে বললেন
— মরিয়ম?
কুমুর চাচী তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঝাঁঝালো গলায় বলল
— আপনের মাইয়া তাই আপনের কথা গুলা খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু এইগুলা তো একদম সত্য কথা। এতদিন মাইয়ার খোঁজ আছিলো না। এহন কারে নিয়া আইসা পড়ছে।
কথাটার কু’রু’চিপূর্ণ ইঙ্গিত শুনে কুমু চুপ করে থাকতে পারলো না। সতেজ কণ্ঠে বললো
— আমি যারে তারে আনিনি চাচী। আমার স্বামীকে সাথে আনছি। ওনার সাথে আমার বিয়ে হইছে।
সবার মাঝে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। কুমুর স্বামী হিমেল! সব থেকে আশ্চর্য হলেন কুমুর মা। তার কাছে পুরো ব্যাপারটা ধোঁয়াশা লাগছে। হিমেল এর সাথে কুমুর কিভাবে দেখা হলো? আর বিয়েই বা কবে করলো? বিয়ের কথা শুনে কুমুর চাচী আরও আগ্রাসী রূপ ধারণ করলেন। চিৎকার করে উঠে বললেন
— নির্লজ্জ মাইয়া। শহরে গিয়া পোলা ধরছে। আর এহন কইতাছে স্বামী। কি অকাম করছে কে জানে। বিয়াই হইছে কিনা হেইডাই জানিনা। আর স্বামী। আমাগো বাড়িতেও মাইয়া আছে। এক মাইয়ার কারণে ওগো জীবন নষ্ট আমি হইতে দিমুনা। যেমনে আইছ অমনেই চইলা যাও।
এবার হিমেল মুখ খুললো। কঠিন গলায় বলল
— আমার স্ত্রীকে অপমান করার অধিকার আপনার নেই। গুরুজন হিসেবে এতক্ষণ কথা বলতে চাইনি। কিন্তু আপনি সম্মান নেয়ার মতো মানুষ না। সম্পূর্ণ অযোগ্য। আর আমরা এখানে থাকতে আসিনি। চলেই যাবো। তবে শুধু কুমুকে নিয়ে নয় মা, মৌ, রাফি সবাইকে নিয়ে যাবো। আমরা সবাই একসাথে শহরে থাকবো।
হিমেল এর এমন আওয়াজ আর কথার ধরন শুনেই কুমুর চাচী আর কথা বাড়ালো না। তিনি বুঝে গেছেন যে তার কথা বলাটা অন্যায় হয়েছিলো। কিন্তু কুমুর মা বাঁধ সাধলেন। কঠিন গলায় বললেন
— কবে বিয়ে করছো তোমরা? কিভাবে দেখা হলো তোমাদের?
হিমেল এগিয়ে এসে বললো
— কুমুর সাথে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা কাকতালীয় হলেও বিয়ে করার ইচ্ছা টা কাকতালীয় নয়। আমি শুরু থেকেই কুমুকে বিয়ে করতে চেয়েছি। আপনাদেরকে জানানোর সুযোগ হয়নি। জানানোর আগেই আপনারা গ্রামে চলে আসেন। আর এতো কিছু হয়ে যায়। তবে আমি কুমুকে নতুন করে যখন খুঁজে পেয়েছি তখন আর হারাতে চাইনি। তাই কারো অনুমতি না নিয়ে বিয়েটা করেই ফেলেছি। কুমুর অবশ্য আপত্তি ছিলো। কিন্তু আমি সেটাকে প্রশ্রয় দেইনি।
কুমুর মা কি বলবেন সেটা বুঝতে পারলেন না। হিমেল কে তিনিও পছন্দ করতেন। যথেষ্ট ভালো ছেলে সে। কিন্তু এত দ্রুত ব্যাপারটা ঘটে যাবে সেটা ভাবেন নি। হিমেল তার দ্বিধা বুঝতে পেরেই বলল
— মনের মাঝে কোন দ্বিধা রাখবেন না। আমি কথা দিচ্ছি কুমুকে ভালো রাখবো। কোন অভিযোগের সুযোগ দেবো না। কিন্তু আমার কথা আপনাকে রাখতে হবে। ছেলে মনে করেই নাহয় আমার কথাটা রাখবেন। আমাদের সাথে যাবেন। আমরা আবার সবাই একসাথে থাকবো।
কুমুর মায়ের চোখে পানি চলে এলো। মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন তিনি। কিন্তু এমন হবে সেটা ভাবতে পারছেন না।
———
প্রচন্ড শীতে শরীর জমে যাওয়ার উপক্রম। খোলা জানালা দিয়ে শিরশির করে ঠান্ডা হাওয়া ঘরে ঢুকছে। বাইরে থেকে এসে ঘরের জানালা খোলা দেখেই চমকে গেলো হিমেল। আরো চমকে গেলো কুমুকে কোন শীতের কাপড় গায়ে না জড়ানো দেখে। দ্রুত আগে জানালা বন্ধ করে দিলো। এতক্ষণ হিমেলের আগমন কুমুর বোধগম্য না হলেও জানলা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনেই সেদিকে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল
— বন্ধ করলেন কেনো?
হিমেল সরু চোখে তাকাল। কাছে এসে বললো
— বাইরে কত ঠান্ডা জানো? জানালা কেনো খুলে রেখেছো? ঘরটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর তোমার শীতের কাপড় কোথায়?
কুমুর ভ্রু কুঁচকে এলো। কিছুটা রাগ নিয়ে বলল
— আমার ঠান্ডা লাগছে না।
হিমেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
— কতবার বলেছি এভাবে জেদ করবে না। এটা কি জেদ করার সময় কুমু? তোমার নিজের কথা নাহয় ভাবলে না। আরেকজনের কথা তো ভাবতে হবে।
কুমু চাপা রাগ নিয়ে বলল
— আমি ভাবিনা? আপনি একাই ভাবেন?
হিমেল হার মেনে দমে গেলো। ইদানিং মেয়েটার রাগ জেদ বেড়ে গেছে। সামলাতে হিমসিম খেতে হয় হিমেলকে। দরজায় শব্দ হতেই কুমু উঠে দাঁড়ালো। হেলেদুলে গেলো সেদিকে। সাত মাসের উচু পেট নিয়ে হাঁটতে তার বেশ কষ্ট হয়। আর কথায় কথায় রাগ করে। কিছু বললেই কান্নাকাটি করে। হিমেল ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসেই দেখে মৌ দাড়িয়ে আছে। হিমেল মুচকি হেসে বললো
— কখন আসলে?
মৌ ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। বলল
— আপু চালতার আচার খেতে চেয়েছে। তাই মা বানিয়ে দিলো।
হিমেল লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লো। কুমুর কানে পৌঁছাতেই সে বিরক্তি নিয়ে পেছনে তাকাল। হিমেল বলল
— সেদিনই না এনে দিয়েছিলাম।
কুমু মিনমিনে কণ্ঠে বললো
— শেষ।
হিমেল হেসে ফেললো। মৌ ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল
— আমি আসছি।
হিমেল কিছুটা গলা তুলে বলল
— মাকে উপরে আসতে বলো।
— মায়ের পায়ে ব্যথা। তাই এখন আসতে পারবে না। কমলেই আসবে।
বলেই মৌ আর দাড়ালো না। কুমু আচার নিয়ে ঘরে চলে গেলো। হিমেল মুচকি হাসলো। সেদিন এক প্রকার জোর করে কুমু সহ তার পরিবারকে হিমেল শহরে এনেছিলো। তার দাদু বাড়ির লোকজনের ব্যবহার দেখেই হিমেল বুঝে গেছিলো এখানে তারা অনেক কষ্টে থাকে। আর ফিরে এনে সেই দোতলায় তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়েই রুশার সাথে হিমেলের পরিচয়। এন জি ওর একটা কাজে সে হিমেলের সাথে এসেছিলো বাংলাদেশে। কাজ শেষ করেই আবার ফিরে যাবে। তাই হিমেলদের বাড়ির দোতোলা ফাঁকা থাকায় সেখানে তাকে থাকতে দেয়। তার মাঝেই ঘটে যায় এতো ঘটনা। সেই তকিপূর গ্রামে তাদের ডাক পড়ে। সেখান থেকে এতো ঘটনার পর কুমুকে উদ্ধার করে তাদের পরিবার সহ ফিরে আসে। তার কয়েকদিন পরেই রুশা ফিরে যায় তার দেশে। কুমুর এই দুর্ঘটনার কথা হিমেল কাউকে জানায় নি। এমন কি কুমুর পরিবারকেও জানাতে নিষেধ করেছিল। কথা ছিলো তারা নতুন করে তাদের জীবন শুরু করবে। কুমুকে বাসায় এনেই হিমেল শান্তি বেগমকে তাদের বিয়ের ব্যাপারটা খুলে বলে। যদিও বা ঘটনা একটু অন্যরকম করে সাজিয়ে বলেছিলো। তবুও শান্তি বেগম মেনে নিয়েছেন। কারণ কুমুরা চলে যাবার পর হিমেলের মানসিক অবস্থা তার মা বুঝতে পেরেছিলেন। নিজের ছেলেকে প্রতি নিয়ত এমন কষ্টে থাকতে দেখে বুঝে গেছিলেন তার সুখের জন্য কি দরকার। তাই ছেলে তার মানসিক শান্তি ফিরে পাওয়ায় শান্তি বেগম আর কোন আপত্তি করেন নি। এক কথায় মেনে নিয়েছিলেন কুমুকে।
শান্তি নীড় এখন শান্তিতে পরিপূর্ণ। শুভ্রা আর শ্রাবণের একমাত্র ছেলে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখে। নিলু আর সৌরভের মেয়ে। মাঝে মাঝেই তারা মেয়েকে নিয়ে চলে আসে। এখন সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কুমুর অনাগত সন্তানের। এই সন্তান দুনিয়ার আলো দেখলেই শান্তি নীড়ে ষোলোকলা পূর্ণ হবে।
প্রথম দেখায় যে মানুষটাকে নিজের মন দিয়ে বসেছিলো তার প্রতি সেই সুপ্ত অনুভূতি আবেগ সুপ্তই রয়ে গেলো। তার সেই সুপ্ত ভালোবাসা স্থান পেয়েছিল ডাইরির পাতায়। সেখান থেকে হিমেলের কাছ অব্দি পৌঁছায় নি। ভালোবাসার অধিকার নিয়ে হিমেল এগিয়ে না আসলে হয়তো কুমু কোনদিন সেই ভালোবাসা প্রকাশ করার সাহস পেতোনা। সংসার জীবনে পা দিয়েও আজ অব্দি সেই ভালোবাসা প্রকাশ করার ক্ষমতা হলো না তার। মন সাগরের প্রেম জোয়ারের ছলছল জ্বলের শব্দ চাপাই রয়ে গেলো বালির নীচে। সেই বালির নীচে জলের শব্দ প্রকাশ না পেলেও হিমেলের কোন আফসোস নেই। কারণ কুমুকে তার বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়না। কুমুর সব অনুভূতি হিমেলের কাছে আয়নার মত স্পষ্ট। মেয়েটার ভালোবাসার ধরন হয়তো এমনই।
সমাপ্ত
( এতদিন ধৈর্য ধরে যারা গল্পটা পড়েছেন সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। ব্যস্ততার কারণে শেষের দিকে এসে কিছুটা অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলাম। তার জন্য আমি দুঃখিত। অনেক ব্যস্ত সময় কাটছে। চলমান গল্প গুলো শেষ করে একটা লম্বা বিরতি নেয়ার চিন্তা করেছি।)