বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৭
“তোমাকে দেখার পর থেকে অসম্ভব বদলে গেছে
আমার ভূবন
বদলে গেছে জলবায়ু, দিনরাত্রি, ঋতু।
কেবল তোমারই মুখ দেখি বৃক্ষপত্রে, জ্যোতিস্কমণ্ডলে
উচ্ছল ঝর্নার জলে, বুকশেলফে, পড়ার টেবিলে,
টেলিভিশনের উজ্জ্বল পর্দায়-
মহদেব সাহার “আমূল বদলে দাও আমার জীবন” কাব্যগ্রন্থের “তোমাকে দেখার পর থেকে” কবিতার পাতাটা চোখের সামনে উন্মুক্ত। পুরো কবিতাটা কয়েকবার পড়ে শেষ করেছে কুমু। বলতে গেলে মুখস্ত করে ফেলেছে। পাশেই ফোনে বাজছে পরিচিত একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত। প্রেমময় সুর। চারিদিকে অনুভুতির ছড়াছড়ি। বাইরে থেকে মা ডাকতেই কুমু সব ঠিক করে বাইরে চলে গেলো। টেবিলে সবাই নাস্তার জন্য বসে পড়েছে। কুমুকে দেখেই বাবা ফয়েজ উদ্দিন বললেন
–এতো দেরি করলে যে? শরীর খারাপ নাকি?
কুমু মিষ্টি হেসে বলল
–না বাবা। ঐ…
–আপা পড়ছিল।
কুমুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ছোট্ট মৌ জবাব দিলো। সে দেখেছে তার আপাকে টেবিলে বই খুলে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে। আর মুচকি হাসতে। তাই আবারো বলল
–জানো বাবা আপা না পড়তে পড়তে হাসে।
তার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। কুমু একটু লজ্জা পেলেও সেটা চেপে গিয়ে সেও হেসে দিলো। খাবার শেষ হতেই ফয়েজ উদ্দিন পকেট থেকে টাকা বের করে সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন
–আজ তো এক মাস হল এই বাড়িতে। প্রথম মাসের ভাড়াটা তাড়াতাড়ি দেয়া ভালো। আমাকে তো এখনই বের হতে হবে। কুমু তুমি কি ভাড়াটা দিয়ে আসতে পারবে?
কুমু মাথা নাড়ল। সে খাওয়া শেষ করেই ভাড়া দিয়ে আসবে। তার বাবা বের হয়ে চলে গেলেন। কুমু নিজের খাওয়া শেষ করে হাত মুখ মুছে ওড়নাটা লম্বা করে টেনে দিলো। বের হয়ে গেলো মালিকের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তিন তলায় গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। এক মাস হল এই বাড়িতে এসেছে তারা। তিন তলা পার হয়ে ছাদেই যায় সে। কিন্তু এই জায়গাটায় সেভাবে কখনো খেয়াল করা হয়নি। আশেপাশে তাকাল কুমু। সেকেলে বাড়ি। দেয়ালের রঙ চটে গেছে। জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরেছে। সিঁড়িগুলোতে কেমন ময়লা। বাইরেটা ভীষণ স্যাঁতস্যাঁতে, শেওলা পড়া। দেয়ালের ফুটোয় জন্মে ওঠা লতাপাতা যুক্ত আগাছা গুলো অযত্নে কেমন দ্রুত বেড়ে উঠছে। পুরনো রংচটা কাঠের দরজাটায় হাতের সাহায্যে কয়েকবার ধাক্কা দিয়েই থেমে গেলো কুমু। এপাশ ওপাশ তাকাতেই পেরিয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ড। ঠিক তখনই খুলে গেলো দরজা। ভীষণ ভারী গম্ভীর আওয়াজে কেউ বলে উঠলো
–কাকে চাই?
চোখ ফিরে তাকাতেই থমকে গেলো দৃষ্টি। শরীর ঝমঝম করে উঠে ঘাম ছুটে গেলো। শীতল চাহুনি ভেতরটা তৃষ্ণার্ত করে তুলল কুমুর। পলকহীন দৃষ্টি দেখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা ভীষণ অসস্তিতে বিরক্ত হয়ে উঠলো। হালকা কেশে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে বলল
–কিছু বলবেন?
ধ্যান ভাঙল কুমুর। অপ্রস্তুত হয়ে নিচের দিকে তাকাল। উত্তর দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে খেয়াল করলো গলার স্বর নিস্তেজ হয়ে এসেছে। ঠোঁট নাড়ালেও শব্দ উচ্চারিত হবে কিনা সেটা নিয়েই দ্বিধা। তবুও চুপ করে থাকা সম্ভব নয় ভেবেই মিনমিনে স্বরে বলল
–ভাড়াটা।
ভাইকে এমন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শ্রাবণ এগিয়ে এসে বলল
–কে এসেছে ভাইয়া?
ভাইয়ের পেছনে দাঁড়াতেই কুমুর উপরে চোখ পড়লো। ভূত দেখার মতো চমকে গেলো শ্রাবণ। বজ্রাহতের মতো দৃষ্টি। কুমুও একই দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। হিমেল কুমুর এমন দৃষ্টি দেখে পেছন ফিরে শ্রাবণের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। কুমু কৌতূহলী দৃষ্টি ফেললো দুজনের দিকেই। সমীকরণটা মিলে ফেললো কয়েক সেকেন্ডেই। বাড়ীওয়ালার দুই ছেলে। সামনের টা বড় আর পেছনের টা ছোট। দুই ছেলের পেছন থেকে শান্তি বেগম গম্ভীর আওয়াজে বললেন
–কে তুমি?
সবার দৃষ্টি পরিবর্তন হল। শ্রাবণ চোরা দৃষ্টি ফেলে একবার কুমুর দিকে তাকায় তো আরেকবার মায়ের দিকে তাকায়। কিন্তু সেখান থেকে নড়ল না এক ফোটাও। হিমেল সেখানে দাঁড়ালো না। অপরিচিতের মতো চলে গেলো সেখান থেকে নিজের ঘরে। কুমুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মানুষটা এমন কেন? আর কিছু সময় দাঁড়ালে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? শান্তি দুই কদম এগিয়ে আসতেই কুমু সেদিকে তাকিয়ে বলল
–আমি দো তলায় থাকি। এই মাসের ভাড়াটা দিতে এসেছি।
হাত বাড়িয়ে দিতেই শান্তি মুচকি হেসে বললেন
–দো তলার নতুন ভাড়াটিয়া?
কুমু মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–জি।
শান্তি টাকাটা হাতে নিয়ে বললেন
–তুমি ফয়েজ ভাই সাহেবের কে হও?
–আমি ওনার মেয়ে।
শান্তি হেসে বলল
–ওহ! আচ্ছা। ভেতরে আসো।
কুমু মৃদু হাসল। মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–আরেকদিন আসবো আনটি। আজ আসি।
যাওয়ার আগে তির্যক দৃষ্টিতে একবার শ্রাবণকে দেখে নিলো। কুমুর সেই দৃষ্টি দেখেই শ্রাবণের ভেতর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। ঢোক গিলে অসহায়ের মতো তাকাল তার দিকে।
————-
দুপুরের পরে মৌকে নিয়ে ছাদে উঠেছে কুমু। গাছের খুব সখ তার। তাই কয়েকটা টবে নিজের পছন্দের কিছু গাছ লাগিয়ে সেগুলো ছাদে রেখে দিয়েছে। রোজ তাদের পরিচর্যা করে সে। সরাসরি মেইন লাইনের সাথে একটা পাইপ আটকে দিয়েছে। সেটা দিয়েই গাছে পানি দেয়। খুব যত্ন করে সেটা দিয়ে গাছে পানি দিচ্ছে সে। ছাদে কিছু পানি পড়ে যাওয়ায় অসাবধানতা বশত সেখানে পা পড়তেই পড়ে যেতে লাগে কুমু। হাত থেকে ছুটে যায় পাইপ। রেলিঙের ধার ঘেঁষে ঝুলে থাকা পাইপটা দিয়ে তখনও পানি পড়ছে নীচে। সড়সড় আওয়াজ আসছে নিচ থেকে। ছোট্ট মৌ এক দৌড়ে রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। হাত দুটো রেলিঙ্গে রেখে যতটা সম্ভব গোড়ালি উঁচু করে পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে মাথা ঝুঁকে নিচের দিকে তাকাল। কালো শার্ট পরা ছেলেটির মাথার উপরে সম্পূর্ণ পানিটা পড়ছে। আর ছেলেটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো ভিজছে। মৌ আর্তনাদ করে উঠে বলল
–আপা দেখো ভিজে যাচ্ছে।
কুমু ভ্রু কুচকে তাকাল। মৌয়ের কথা বুঝতেই এগিয়ে গেলো। নিচের দিকে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া। বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেলো তার। দুই হাতে মুখ ঢেকে বড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। তার ভুলের কারণে মানুষটার শরীরের দামী চকচকে শার্টটা ভিজে একাকার। সেটা নিয়ে আক্ষেপটা ঠিক কতটুকু সেটা বুঝতে পারলো না কারণ ঐ মানুষটার চেহারাটাই তখন মুখ্য ভুমিকা পালন করছে। অন্যকোন মানুষ হলে হয়তো ভেতর থেকে এতো আহত হতোনা কুমু। কিন্তু এই মানুষটা যে তার সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি। তার সাথে এমন ভুলের ফলাফল কেমন হতে পারে সেটা ভেবেই শঙ্কিত সে। পরিচয় হওয়ার আগেই মনে হয় সব শেষ হয়ে যাবে। সেটা ভেবেই অসহায় মনে হল নিজেকে। মৌ চিৎকার করে বলল
–এই, তুমি তো ভিজে গেছো।
ভীষণ রকম বিরক্ত নিয়ে উপরের দিকে তাকাল হিমেল। কিন্তু চোখের সামনে নিষ্পাপ আদুরে একটা চেহারা দেখেই বিরক্তিটা কেটে গেলো নিমেষেই। রাগটা যেমন দ্রুত চাড়া দিয়ে উঠেছিল। ঠিক তেমনই দ্রুত সেটা হারিয়ে গেলো। কুমু ততক্ষনে নিজের বিস্ময় কাটিয়ে পাইপটা টেনে নিয়েছে। হিমেল ফুস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–সমস্যা নেই পিচ্চি। আমি কাপড় বদলে নেবো।
মৌ আদুরে কণ্ঠে বলল
–তাড়াতাড়ি। নাহলে কিন্তু তোমার জ্বর হবে।
হিমেল মৃদু হাসল। এমন আদুরে কণ্ঠ শুনে তার চাহুনি শান্ত, শীতল হয়ে গেলো। এমন আদুরে কথা রাগ ভাঙ্গাতে যথেষ্ট। দৃষ্টি ফিরিয়ে কুমুর দিকে তাকাল। কুমু ভয় পেলো ভীষণ। মৌ ছোট বলেই কিছু বলল না। কিন্তু তাকে কি ছেড়ে দেবে? অসহায়ের মতো কান্না জড়িত কণ্ঠে আমতা আমতা করে বলল
–আ…আমি ই…ইচ্ছা করে করিনি। হাত থেকে ছুটে গিয়েছিল। আমি খুবই দুঃখিত।
স্থির, শান্ত আর শীতল চাহুনির মানুষটা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। তারপর ভীষণ সুন্দর করে বলল
–ঠিক আছে। আমি বুঝতে পেরেছি। এটা দুর্ঘটনা।
দুই হাতে শার্ট ঝেড়ে ফেলে দ্রুত চলে গেলো বাড়ির ভেতরে। কুমু বেশ অবাক হল। সে শুনেছে বাড়ীওয়ালার বড় ছেলে নাকি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিল। এতো বছর বিদেশে থাকার পরও এতো সুন্দর বাংলা! মানুষটা যেন আস্ত এক ইন্দ্রজালের সমন্বয়!
চলবে…।
(রাতে আরেক পর্ব পাবেন। রিচেক করা হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)