বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৮
–অবশেষে তুইও প্রেমে পড়ে গেলি। ভাবতেই পারছি না। মারাত্মক ব্যাপার কিন্তু।
শেষ বিকেলে পাড়ার চায়ের দোকানে কয়েকজন যুবক চায়ের আড্ডা বসিয়েছিল। হাতে হাতে পুড়ছে নিকোটিন। তার তীব্র উটকো গন্ধে গুমোট বেধে থাকা উষ্ণ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকের মনোযোগ হাতে থাকা জ্বলন্ত নিকোটিন আর চায়ের কাপে নিবদ্ধ। কিন্তু নিষ্প্রাণ সেই চায়ের আড্ডায় সৌরভের কথাটা যেন প্রাণ এনে দিলো। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি গিয়ে ঠেকল হিমেলের উপরে। হিমেল তখন সবে চায়ে চুমুক দেয়ার জন্য কাপটা মুখ অব্দি নিয়ে গেছে। তাকে উদ্দেশ্য করে বলা সৌরভের উক্তি শুনেই সেও কৌতূহলী চোখে তাকাল। কৌতুক করে বলল
–আরে তাই নাকি? কই আমার তো এমন কিছুই চোখে পড়লো না।
সৌরভ অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লো। কোন রকমে হাসি থামিয়ে বলল
–তুই আর এসব কিভাবে দেখবি বল। তোর চোখ তো এক জায়গাতেই আটকে আছে। তাকে ছাড়া আজকাল কি আর কিছু চোখে পড়ে বন্ধু?
কথাটার সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই সবাই বেশ মজা নিয়ে হেসে উঠলো। তাদের হাসিতে কেঁপে উঠলো সেই চায়ের দোকান সহ আশপাশ। লোকজন থেমে গেলো। তাদের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। হিমেলের এবার মাথা গরম হয়ে গেলো। দুম করে সৌরভের পিঠে কিল বসিয়ে দিয়ে বলল
–জতসব বাজে কথা তোর মুখে।
সৌরভ সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিয়ে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বলল
–বাজে কথা নয় রে বন্ধু। আমি তো সবটা দেখতে পাচ্ছি। কালও দেখেছি।
হিমেল এবার আর চুপ থাকতে পারল না। তেতে উঠে দরাজ গলায় বলল
–কি দেখেছিস তুই? প্রেম করতে দেখেছিস আমাকে?
–ওই যে দো তলার ভাড়াটিয়া মেয়েটার সাথে কাল বিকেলে কথা বলতে দেখেছি। সে ছাদে আর তুই নীরব চোখে তাকিয়ে আছিস উপরের দিকে। আর সে লজ্জাবতির মতো কানে চুল গুঁজে মাঝে মাঝে চোখ তুলে তোর দিকে তাকাচ্ছে। আবার নামিয়ে নিচ্ছে। কি নিয়ে কথা হচ্ছিল সেটা নাহয় নাই জানলাম। কিন্তু নিরবে যে ভাবের আদান প্রদান হচ্ছিল সেটা তো চোখে ঠিকই পড়েছে।
হিমেল সরু চোখে তাকাল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–দো তলার ভাড়াটিয়া তুই জানলি কিভাবে? আমি তো নিজেই জানতাম না।
সৌরভ দাঁত কেলিয়ে বলল
–বাড়ির একমাত্র জামাই আমি। সবদিকেই খোঁজ খবর রাখতে হয় আমাকে।
সবাই এবার মনোযোগ তীক্ষ্ণ করলো। বেশ হট একটা টপিক পাওয়া গেছে বন্ধু মহলে। ফুয়াদ বিস্ময়কর ভঙ্গিতে হিমেল কে বলল
–আসলেই কি দোস্ত? এতো কিছু হয়ে গেলো আর আমরা জানলাম না।
তুহিন হিমেলের সামনে চেয়ার টেনে এনে বসে পড়লো। বিস্ময়কর ভঙ্গিতে বলল
–তুই আর প্রেম! এ যেন আমার বাড়ি থেকে সমুদ্রের তলদেশে মারিয়ানা স্ট্রেঞ্জ পর্যন্ত ভ্রমনের মতো এক অসম্ভব জার্নি।
হিমেল হতবিহবল দৃষ্টিতে তাকাল। বড় বড় চোখ মেলে বলল
–তোর কি মাথা ঠিক আছে? কি বলছিস বুঝতে পারছিস? আর তোর এই মারিয়ানা স্ট্রেঞ্জ ভ্রমন মানে কি?
তুহিন দাঁত কেলিয়ে বলল
–এই যে আমি এখান থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে পৌছব এটাই তো প্রায় অসম্ভব। আর সেখানে গিয়ে একদম নিচে মারিয়ানা স্ট্রেঞ্জ ভাবতেই কেমন গা শিউরে উঠছে। আর আমার কাছে মনে হয় তোর মতো ছেলের দ্বারাও এই প্রেমটাও একেবারেই অসম্ভব। তাই কল্পনায় এরকমটা ভেবে মিলিয়ে নিলাম। এর থেকে ভালো আর কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আবারো সবাই হাসিতে ফেটে পড়লো। হিমেল বেশ বিরক্ত হল। চোখ বন্ধ করে নিয়ে বিরক্তি কাটানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল
–তোর কল্পনা শক্তির প্রশংসা না করে পারলাম না। আমি সত্যিই মুগ্ধ।
তুহিন বেশ গর্ব সহকারে পায়ে পা তুলে বলল
–আমি জানি বন্ধু। আমার কল্পনা শক্তি প্রবল। যে কাউকে মুগ্ধ করতে সক্ষম। সে যাই হোক। এখন আসল কথা বলতো। এই সৌরভ যা বলল তার কতটুকু সত্যি। আমার তো আর তর সইছে না।
হিমেল সিগারেটে একটা টান দিলো। চায়ে চুমুক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে সহজ স্বাভাবিক ভাবে বলল
–সেরকম কিছুই না। কাল নিছক একটা এক্সিডেন্টের কারণেই কথা বলা। তখনই টুকটাক কথা হয়। এর থেকে বেশী কিছু না। পিচ্চিটা কে আমার খুব ভালো লেগেছে। একদম নিষ্পাপ চেহারা। কথাও বলে বেশ আদুরে কণ্ঠে। পাশের মেয়েটাকে এই নিয়ে মনে হয় তিনদিন দেখেছি মাত্র। এতো কিছু খেয়াল করা হয়নি এখনো। প্রেম তো দূরের কথা।
সৌরভ আবারো বলে উঠলো
–ওই পিচ্চির সাথে বোনটাও ফ্রিতে থাকে তাই না বন্ধু। মেয়েটার চেহারাতেও কিন্তু মায়া আছে। রঙটা শ্যামলা হলেও মায়াবী।
হিমেল তার মাথায় জোরে একটা মেরে বলল
–বোন ফ্রি মানে কি? ওসব ফ্রি জিনিস হিমেল গ্রহন করে না। আমি চাইলে এলাকার সব মেয়ে রাস্তায় বের হয়ে লাইন ধরবে। কিন্তু আমার এসব মেয়েদের প্রতি কোন ইন্টারেস্ট নেই। সব কেমন ন্যাকা। বিরক্তিকর! ভাবতেই গা গুলিয়ে ওঠে।
ফুয়াদ হিমেলের ঘাড়ে আলতো করে দুইবার হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলল
–আচ্ছা মানলাম সেরকম কিছুই নয়। কিন্তু তুই চাইলেই হতে পারে তো। একটা চান্স নিতেই পারিস।
তুহিনও সায় দিয়ে বলল
–আমারও তাই মনে হয়। এবার তোর এই মেয়ে বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিৎ। অনেক তো হল। আর কতদিন সিঙ্গেল থাকবি?
হিমেল মৃদু হাসল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল
–খুঁজে পেলে কি আর আমি এতদিন সিঙ্গেল থাকতাম। মনের মতো কাউকে খুজেই পাই না।
সৌরভ আগ্রহ নিয়ে তাকাল। বলল
–তোর মন আবার কেমন চায়? খুলে বল তো।
হিমেল চায়ে চুমুক দিয়ে বলল
–আমার সৌন্দর্য নয় প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মেয়ে চাই। যার ব্যক্তিত্ব আমাকে মুহূর্তেই আকৃষ্ট করবে। যার মাঝে কোন ছলচাতুরী থাকবে না। ন্যকা মেয়েদের মতো এক গাদা আটা ময়দা মেখে গায়ে এসে পড়বে না। অতিরঞ্জিত সাজ সজ্জা পছন্দ করবে না। একদম মায়াবতীর মতো। এরকম মেয়ে পেলেই বন্দি করে ফেলবো মনের খাঁচায়।
সিগারেট টাতে শেষ টান দিয়েই দুই আঙ্গুলে বিশেষ ভঙ্গীতে ছুড়ে ফেলে দিলো দূরে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল
–আমার কি আর যার তার প্রেমে পড়া সাজে। আমি যার প্রেমে পড়বো সে হবে এই জগতের মায়াপরি। যার চোখের ভাষায় থাকবে দুর্ভেদ্য রহস্য। যা ভেদ করা সবার পক্ষে অসম্ভব। ব্যক্তিত্ব অসাধারন হলেও সে হবে সাধারণ। যাকে সবার চোখে সাধারণ মনে হলেও আমার চোখে সে হবে সাধারণেই অসাধারণ!
সৌরভ হেসে উঠলো উচ্চ শব্দে। কৌতুক করে বলল
–এ জীবনে তাহলে প্রেমটা আর হল না বন্ধু। এবার চিরকুমারের উপাধিটা জড়িয়ে নিয়ে দেশ ভ্রমনে বের হ।
সবাই তার কথা শুনে আবারো হেসে উঠলো। হিমেল মৃদু হাসল। তার বন্ধু জাতির মতে এরকম মেয়ে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু হিমেলের মনে হয় সেটা অসম্ভব কিছু না। এতো বড় পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও তার জন্য এমন কেউ আছে। যাকে দেখেই তার মনে হবে সে কাঙ্খিত মানুষটাকে পেয়ে গেছে। সেই অপেক্ষাতেই বসে আছে সে। আরেকদফা প্রশস্ত হেসে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল
–মন বলছে এবার বসন্তে প্রেমটা হয়েই যাবে। এই বসন্তেই পেয়ে যাবো আমার সেই সাধারণেই অসাধারণ রমণী। যার অপেক্ষায় জীবনের এতোগুলো বছর থাকলাম। সে এবার নিশ্চয় আসবে।
সৌরভ ফিচেল কণ্ঠে বলল
–এসব সাধারণ অসাধারণ বাদ দিয়ে বাস্তবে ফিরে আয় বন্ধু। বাস্তব জিবনে প্রেম হেটে আসে না। প্রেম করতে নিজেকে এগিয়ে যেতে হয়।
চলবে…
(রিচেক করা হয়নি। ভুলভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরধ রইল।)