#বিদায়_বরণ
পর্ব-১২
লেখা- মেহরুন্নেছা সুরভী
সন্ধ্যে নেমেছে শহরে। সন্ধ্যের পর শহরটা আরো সুন্দর ভাবে সেজে ওঠে। কৃত্রিম আলোয় জ্বলজ্বল করে ওঠে। কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে জাঁকজমকপূর্ণ শহর ছেড়ে বাসায় ফিরে শান্তির আশ্রয় পেতে। কেউ বা মনোরঞ্জনের জন্য রাতের আলোয় শহর ঘুরতে বের হয়।
সবাই সবার মত চলছে। কেউ কাউকে চিনে, কেউ বা কাউকে চিনে না, অথচ একই শহরে বাস করে।
প্রেমের রাতের শহর দেখতে ভালো লাগে। শহরটা হয়ত যুক্তরাষ্ট্রের শহরের মত সচ্ছ, জাঁকজমক নয়। কিন্তু দেশের মাটি যে, আর দেশের মাটির রাস্তার টং দোকানের চা জলও মধুর মত লাগে।
চারপাশের মানুষজনকে অচেনা লাগলেও আপন জন মনে হয়। কারণ, এরা সবাই দেশের মানুষ। দেশের মানুষ তো বিদেশের মানুষের মত পর নয়।
যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করার জন্য যে চারটা বছর সে কাটিয়েছে, এই রাতের বেলা একা একা শহর পরিদর্শন করাটা বেশ সুন্দর ভাবেই রপ্ত করেছে।
সেখানে তার আপন বলতে কেউ ছিল না, মা ছিল না, বাবা ছিল না, ভাই ছিল না, আর হৃদয়ে মাঝে পালন করা ভালোবাসার মানুষ শিখিনী ছিল না!
সেদিনগুলো খুব যে ভালো কাটত, সেটাও নয়। মানসিক অশান্তিতে জীবন টা তিক্ত হয়ে উঠেছিল, তাই তো শেষ বছরটা শেষ না করেই দেশের মাটিতে ছুটে এসেছে। যেখানে আর প্রেয়সী সহ সকল আপনজন আছে। যেখানে শান্তিতে নিঃস্বাস নেওয়ার মত আপন জায়গা আছে। আর আপন জায়গার প্রতি মানুষের অধিকার বোধটা একটু বেশিই থাকে।
কিন্তু দেশে সে নিজের প্রতি একটি প্রতিজ্ঞা করেই এসেছে। নিজের প্রেয়সীকে আপন করে আর তার মাকে একবার হলেও নিয়ে যাবে সে বিদেশে। এক একটা দিন সে যেভাবে একাকি কাটিয়েছে, সেসব জায়গা দেখাবে, অনুভব করাবে, কীভাবে কেটেছে দিনগুলো। কত বড় ভুল করেছে তার মা, সেখানে পাঠিয়ে।
সে কাজেই আজ আবার পাসপোর্ট অফিসে আসা। খুব শীঘ্রই এই দেশ ছেড়ে যাবে। ফাইনাল ইয়ারটা অন্তত শেষ করে বাবা-মার স্বপ্ন সফল করতে হবে। তারপর থেকে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। পড়াশোনাও শেষ, প্রেয়সীও সাথে। জীবনটা তখন উপভোগ করার।
পাসপোর্ট অফিস থেকে বের হয়ে গলির মোর ধরে হাঁটতে থাকে প্রেম। এখন সাখাওয়াতের জন্য গিফট কিনে শীঘ্রই ফিরতে হবে। হয়ত, এতক্ষণে অনুষ্ঠান শেষ হয়েও গিয়েছে। লেট করা উচিত হবে না, সবাই তার অপেক্ষায় আছে। স্পেশালি শিখিনী অধির আগ্রহে বসে আছে। কারণ, এ বছর সাখাওয়াতের জন্য গিফট কেনার ভারটা প্রেমের কাঁধেই দিয়েছে শিখিনী।
বিভাবরী বেগম সকলের জন্য পায়েস বারছিলেন। তখনি প্রেম আসে। মিসেস আনোয়ার, প্রিয়ম সহ বিল্ডিংয়ের অনেক সদস্য এসেছে। সেখানে মৌও এসেছে। বড়রা চলে গেছে খাওয়া দাওয়া শেষে।
সাখাওয়াত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।
যামিনী আর শিখিনী শোফায় বসে আছে। শিখিনীর এখন জ্বর নেই বললেই চলে। বেশ সুস্থ। তবে, জ্বর ছেড়ে আবার জ্বর আসছে, এরকম।
প্রেম এগিয়ে সাখাওয়াতের কাছে গেল, সাখাওয়াত প্রেমকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” ভাইয়া, তুমি এত সময় নিলে আসতে।”
“দুঃখিত ইয়ার, কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ”
” আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম তুমি আসবে না!”
সাখাওয়াতের হাতে একটি চাবি এগিয়ে দিলো প্রেম। সাখাওয়াত সহ সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল প্রেমের দিকে। শিখিনী হাসছে। বিভাবরী বেগম লজ্জায় পরে গেলেন।
প্রেমের থেকে এত বড় গিফট আশা করেননি। তাছাড়া, সাখাওয়াতের বয়সই বা কত, এখনি ওর হোন্ডা চালানো রিস্কি।
সাখাওয়াত খুশি হলো যদিও, প্রেমকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাইয়া, তুমি আমার জন্য এতকিছু করলে, আমি কী বলব!”
“খুশি তুই?”
“ভীষণ”
প্রেম চারপাশে তাকিয়ে পরিবেশটা বুঝে নিলো, সাখাওয়াতের কাঁধে হাত রেখে বলল, তাইলে, এই খুশিটা শিখির কাছে গিয়ে প্রকাশ কর, ঐ তো তোর পছন্দের বাইকটা কিনে দিলো। আমি তো শুধু সহচর মাত্র!
সাখাওয়াতের খুশির পরিমাণটা আরো বেড়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরল। বিভাবরী বেগম এগিয়ে এলেন। তার চোখে জল চিকচিক করছে।
“দিদিভাই, তুমি এটা কীভাবে? ”
শিখিনী হাসছে, তবুও ওর চোখে জল এসেছে।।জলটা মুছে হাসি মুখে বলল, ” প্রেম ভুল বলেছে, এটা আমার একার পক্ষে সম্ভব ছিল না, আমার জমানো টাকার সাথে অর্ধেক ভাগ প্রেম দিয়েছে। সো, বেশী ক্রেডিট কিন্তু প্রেমের। থ্যাংক্স প্রেম, আমার এই ছোট ভাইটার মুখে হাসি ফুটানোর জন্য!
সাখাওয়াত আবার শিখিনীকে জড়িয়ে কেঁদে দিলো। শিখিনীর চোখে জল এলেও, নিজেকে সামলে বলল, দেখো না, কীভাবে কাঁদছে। বোকা ছেলে একটা। এখন যা তো, বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে আয় যা।
সাখাওয়াত চোখের জল মুছে, প্রেমকে আবার জড়িয়ে ধরে। প্রিয়ম আর সাখাওয়াতের বন্ধুরা এসে আনন্দ করতে থাকে।
প্রেম সংকোচে বিভাবরী বেগমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, নীচু কণ্ঠে বলে, “আন্টি আমি কিন্তু ক্ষুধার্ত। আপনার হাতের রান্না খাবো বলে সারাটা দিন না খেয়ে ছিলাম। খাবার দিন না প্লিজ! আর এইযে, সামান্য উপহারটা, ভাবুন, আপনার বড় ছেলে থাকলে যা করত,আমি আর শিখি মিলে সেটাই করেছি।আপনি প্লিজ নারাজ হবেন না, প্লিজ আন্টি।
বিভাবরী বেগম এবার চোখের জল ছেড়ে দিলেন। প্রেমের গালে হালকা চর বসিয়ে দিলেন, এরপরপ্রেমকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি কাঁদছেন, কিন্তু সুখের কান্না। পাশে দাঁড়ানো মিসেস আনোয়ার প্রেমের দিকে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাকালেন। ছেলের এমন কাণ্ডে নিজেকে অনেক গর্বিত মনে করলেন। অনেক স্বার্থ ছেড়ে দেওয়ার মাঝেও সুখ আছে।
সাখাওয়াত এসে শিখিনী আর যামিনীকে অনেক অনুরোধ করল, বাহিরে যেতে।কিন্তু ওরা রাজি হলো না, রাত হয়েছে, তাই ছেলেরা মিলেই ঘুরে আসুক। সাখাওয়াত আর প্রিয়ম বাহিরে চলে গেল। মৌ এতক্ষণ বসে সবাইকে দেখছিল, অবশ্য ভিতরে ভিতরে ভীষণ হিংসে করছিল! তাই আর অপেক্ষা না করে কাউকে না জানিয়েই চলে গেল। বিষয়টা যামিনী খেয়াল করল, তবে কিছু বলল না।
প্রেমের খাওয়া শেষ হলো।রাত বাড়ছে। মিসেস আনোয়ার আর বিভাবরী বেগম বসে কয়েকজনের সাথে গল্প করছিল। প্রেমের খাবার দিকটা যামিনী আর শিখিনী দেখছিল।
প্রেম উঠে দাঁড়ালো, শিখিনীকে বলল, তার জরুরি কাজ আছে, এখনি যেতে হবে। টিচারের সাথে ভিডিও কনফারেন্স আছে। তাই শিখিনী কিছু বলল না। দরজা পর্যন্ত সাথে হেঁটে এলো।
“শিখি, আমি যে ঔষধ গুলো দিয়েছি, খেয়ে নিয়ো। সুস্থ হয়ে যাবে, যামিনী একটু হেল্প করো।
যামিনী পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, প্রেমের কথায় হেসে মাথা দুলালো। প্রেম যাওয়ার আগে শিখিনীকে একবার জড়িয়ে ধরল, যামিনী মুচকি হেসে সেখান থেকে চলে গেল।
শিখিনীকে জড়িয়ে ধরাও বিষয়টা সবাই দেখল, কেউ ভ্রু কুঁচকে তাকালেও, মিসেস আনোয়ার, বিভাবরী বেগম , যামিনী স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে নিলো।
কারণ, দুজনের মাঝে ভাবটা একটু বেশিই। ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছে। সময় কাটিয়েছে। তাই বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
মিসেস আনোয়ার বিভাবরী বেগমের হাত ধরে মুচকি হেসে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বললেন।তবুও, বিভাবরী বেগম একটু লজ্জিত হলেন। প্রতিবেশিরা সামনে বসা।
প্রেমের জড়িয়ে ধরার সময়টা শিখিনী হতবিহ্বল হয়ে গেল। এটা তার কাছে খুবই লজ্জাজনক।বড়রা দেখেছে দেখল।প্রেম চলে যাওয়ার পর নীচু মাথায় শিখিনী রুমে এসে লজ্জায় মুখে হাত ঢেকে বিছানায় নিজেকে লুকালো। শিখিনীর এহেম কাণ্ডে যামিনী হাসতে হাসতে শিখিনীর পাশে বসল,
” শিখি আপু, এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে বলো তো! বন্ধুই তো তোমরা!”
যামিনী তো আর জানে না, সম্পর্ক বন্ধুত্বের থেকেও গভীর কিছু!
চলবে…