সোমবার, ১৯ই সেপ্টেম্বর।
সময় দুপুর ২:০৩,
একটি মেয়ে বিয়ের আগে তার ভালোবাসার মানুষকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা, হয়ত অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।
কিন্তু আমার কাছে সে অস্বাভাবিক বিষয় বটে কী, একেবারে প্রশান্ত মহাসাগরে ঝাপ দিয়ে পার হওয়ার মত!
ছোট থেকে যে একজন পুরুষ মানুষের ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়েছি, সেটা একমাত্র আমার প্রেমিক পুরুষ প্রেম।
প্রেম, আমার ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু আমাদের সম্পর্কের নির্দিষ্ট একটা নামের অভাবে ভবিষ্যৎ পরিনতি নিয়ে বড় ভয় আমার!
তবে, এতদিন যা আমি কখনো করিনি, আজ আমি সেটাই করতে যাচ্ছি! যার জন্য যতটুকু সাহস সঞ্চয় করেছিলাম, সে সময়ে থাকবে কিনা সেই ভয়ের আমার গা গুলাচ্ছে, বমি হবে হবে ভাব!
আমি বেশ অস্থিরতায় ও টেনশনে থাকলে বমি আসতে চায়, যা প্রেমের একদমই পছন্দ নয়। এই নিয়ে বহুবার ঝগড়া হলেও, প্রেমকে বুঝাতে পারিনি, আমার আয়ত্তে থাকে না এসব! হয়ে যাই অসুস্থ, এখানে আমার কী দোষ!
ঠিক এই কারণে বিরক্ত হয়ে আমার কোনো পরিক্ষায় আমার সঙ্গে প্রেম যেত না, যার জন্য আমার টেনশন দ্বিগুণ হয়ে যেত! বমি ভাবটা বেড়ে যেত।
যা’হোক, প্রেমের প্রতি আমার জমানো অভিমান লিখলে শেষ হবে না কখনো!
আমি বরং যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা প্রেমকে জানিয়ে আসি।
আজ বাসায় মা নেই! এই শেষ সুযোগ! যামিনী মেয়েটাও একটু আগে বেড়িয়ে গেল। সম্পূর্ণ একটা ফ্ল্যাটে একাটা মেয়ে আমি। একাকিত্ব অনুভব করায় আমার অস্থিরতা বাড়ছে, বিশেষ করে বমি হবে হবে ভাব!
যামিনী মেয়েটি আমাদের ফ্ল্যাটের আধা ভাগীদার।
নামটা ভীষণ সুন্দর, যামিনী। একমাস হয়েছে গ্রাম থেকে শহরে এসেছে। আমার ভার্সিটির জুনিয়র। কোনো এক কারণে ওর সাথে আমায় পরিচয় হয়ে যায়। শহরে হোস্টেল পাচ্ছিল না বলে, আমার বাসার অর্ধেক ওকে ভাড়া দিয়ে দেই। ভাড়াটা ও নিজেই চেয়ে নিয়েছে, বলেছে ওর বড় দা’ভাই খুব ব্যক্তিত্বসম্পূর্ণ মানুষ, গ্রামে বেশ প্রভাবশালী পরিবার, তাই বিনা মূল্যে বোনকে থরিই না থাকবে দিবে!
সে না-হয় নাই দিলো! অর্ধেক ভাড়া পেয়ে আমার মাও বেশ খুশি হয়েছে। অন্তত, একজন কাছের মানুষ পাওয়া গেল সাথে থাকার।
কিন্তু মেয়েটাকে নিয়ে আমার একটু সমস্যা আছে। সমস্যাটা প্রেম বিষয়ে।
সেটা আমার এখন লিখতে ইচ্ছে করছে না! অন্যদিন জানাব আপনাদের।
গোধূলি পরলেই প্রেম চিলেকোঠার রুমটায় যাবে, আকাশে সূর্যদয় থেকে সূর্যাস্ত দেখা প্রেমের প্রতিদিনের নিয়ম করা সময়। যেটা সারা শহরে একমাত্র আমিই জানি।
খুব কাছের মানুষ বলে কথা!
আমি আসছি প্রেম, দেখা হবে তোমার সাথে, শেষ দেখা!
~ শিখিনী
মেঘের আস্তরণের মত কালো ডায়েটি শিখিনী বন্ধ করে টেবিলের এক পাশে রেখে দিলো। কলমের খাপটা বন্ধ করতে করতে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো।
মায়ের রুমের ওয়ারড্রব থেকে টকটকে লাল বেনাসরি শাড়িটা বের করে বেশ মনোযোগে দেখতে লাগল। চোখ জুড়ানো শাড়ির কারুকাজ ।
বউ সাজে সেজে আয়নায় নিজেকে দেখে বিমোহিত হলো শিখিনী।তার মায়ের কথা খেয়াল আসতেই মুচকি হাসল,” মা ঠিকই বলত, আমার মেয়েটাকে বিয়ের কনে সাজলে, একদম হুরপরী লাগবে।
যদিও, প্রত্যেকটা মায়ের কাছেই তার মেয়ে হুরপরী।
খুব ভালোবেসে মেয়ের নাম রেখেছিলেন শিখিনী, যার অর্থ ময়ূর বা ময়ূরী।
ময়ূরের মত জ্বলজ্বল পাখনা না থাকলেও মুখটা দেখলে সবাই বিমোহিত হবে।
অবশ্য, শিখিনী ভাবে, সবাই তার অনাথ হওয়ার কষ্টের ছাপটা দেখেই বিমোহিত হয়। শিখিনীর মা মেয়ের কথায় আপন মনে হেসে চলে যায় আড়ালে!
শিখিনী বেশ মোটা করে চোখে কাজল দিলো। ঠোঁটে লাল গোলাপি লিপস্টিক লাগাল হালকা রঙে। মায়ের থেকে পাওয়া কিছু সামান্য গহনা পরে নিলো। মাথায় ঘোমটা দেওয়ার মত লাল উড়না খুঁজে না পাওয়ায় আঁচলটা টেনে বড় করে ঘোমটা দিয়ে নিলো।
আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিলো কেমন দেখাচ্ছে।
না, বেশ দেখাচ্ছে। একটু মোটা, তবে লম্বায় ঠিকঠাক চলে, গোলগাল চেহারা, নাকটাও সচু লম্বা, চিকুন ঠোঁট, সব মিলিয়ে একদম পার্ফেক্ট রাজকন্যা।
ও হ্যাঁ, শিখিনী গুচ্ছ চুলটা ছেড়ে দিতে ভুলল না। চুলগুলো কিন্তু কোমর ছাড়িয়ে নয়, কোমরের বেশ উপরে, তবে মেঘঘন!
মুরব্বিরা বলে মেঘঘন মানে মেঘের আস্তরণের ন্যায় কালো ঘন। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়!
প্রায় সন্ধ্যে নামছে, সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শিখিনী আর অপেক্ষা না করে বাহিরে বেড়িয়ে আসে। দরজা খুলে দেখে সামনে ফ্ল্যাটের দরজা ভিরানো, এর অর্থ প্রেম ছাদেই আছে। শিখিনী ধীর পায়ে ছাদের উদ্দেশ্য সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।
বিল্ডিংটা ৭তলা। শিখিনী আর প্রেমরা থাকে পঞ্চম তলায়। এই বিল্ডিংয়ের মালিক প্রেমের বাবা আহনাফ খান। সে নিয়ে শিখিনীর কোনো ভয় নেই। ভয় তো আর ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে।
প্রায় ২০বছর যাবত প্রেমের পরিবারের সাথে তাদের সম্পর্ক। শিখিনীর বাবা একজন আর্মির মেজর ছিলেন। বেশ বয়স করে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের এক বছর পর শিখিনীর জন্ম। বেশ সুখী একটি পরিবার হতে পারত তাদের, যদি না, শিখিনীর বাবা দূর্ঘটনায় মারা যেত।
সেই ছোট থেকেই সে অনাথ উপাধিতে বেঁচে আছে। শিখিনীর মাঝে মাঝে বেশ হাসি পায়। তারা অনাথ কী করে হলো, মা বেঁচে থাকতেও অনাথ শব্দটা শুনতে হবে কেন? বড় অদ্ভুত সমাজ ব্যবস্থা!
তারপর আর কী! শিখিনীর মা বিভাবরী, একজন সিঙ্গেল মাদার। শিখিনী আর তার ছোটভাই শাখাওয়াতকে নিয়েই চলছে।
প্রেম গুণে গুণে শিখিনীর ৮বছরের বড়। ছোট থেকে দুজনের আলাপ পরিচয়। চেনা-জানা জীবন ব্যবস্থা। তবুও তাদের দেয়ালটা কষ্টি পাথরের মতই শক্ত! তবে, এই যে দুজনের মাঝে ভালোবাসা, সেটা কিন্তু কষ্টি পাথরের থেকেও বেশ শক্তপোক্ত। ছোট থেকে একটু একটু করে জমানো অনুভূতি জমিয়ে আজ তারা দু’টি হৃদয়ের এক বন্ধন। অবশ্য স্বীকার করার বেলায় কারো মুখেই তখন কথা নেই, ভাষা নেই।
সামনে আর মাত্র একটি সিঁড়ির ধাপ। শিখিনীর বুকের বা-পাশে ধুকধুকানি বেড়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, সারা শরীরটাই ধুকধুক করে কাঁপছে। আর কয়েকটা ধাপ এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে, সন্ধ্যে আলোয় সুদর্শন এক যুবকের ছায়া, এরপর আস্ত একটা মানুষকে।
বড় বড় নিশ্বাস নিতে গিয়ে শিখিনী কান্নায় ফুপিয়ে উঠল, গুটিগুটি পায়ে চিলেকোঠার রুমের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জানালার অপর পাশে প্রেম দাঁড়িয়ে। প্রেমের নিশ্বাসের শব্দ যেমন শিখিনী অনুভব করতে পারছে, সেভাবেই প্রেমও শিখিনীর ফুপিয়ে উঠার শব্দ শুনে জানালার অপর পাশ থেকে ফিরে দাড়ালো।
দুটি মানুষ দু’পাশে, মাঝে ইট, বালু, সিমেন্টে একটি জানালা লাগানো!
টাওজারের দু’পাশে হাত ঢুকানো প্রেমের। গায়ে একটি নীল রঙের টি-শার্ট। ঘেমে নেয়ে এককার। কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম পরছে। সচু খাড়া নামটা লালে টকটকে হয়ে আছে।
শিখিনীকে বিয়ের সাজে দেখে প্রেম আশ্চর্য চোখে চেয়ে থাকে।
ভিতরে আসো, তোমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদব।মাঝে এই জানালার দেওয়ালটা কীভাবে পার করব, দেখতে পারছ না শাড়ি পরা। তাই, তুমিই আসো।
এত বছরে এত সাহসী কথা হয়ত শিখিনী এই প্রথম বলতে পারল। প্রেম আরেক ধাপ আশ্চর্য হয়ে জানালার কাঁচ সরিয়ে ভিতরে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে সন্ধ্যে ছেয়ে গেছে শহরে।
শিখিনী নিজেকে আর সামলাতে না পেরে প্রেমকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে। এই প্রথম শিখিনী কাঁদছে, জমানো সকল কান্না ঝর্ণার ধারার মত জল গড়িয়ে পরছে চোখ বেয়ে, সে জলে প্রেমের বুক ভেজে একাকার!
চলবে…
বিদায়_বরণ
পার্ট ১
©মেহরুন্নেছা সুরভী