#বিদায়_বরণ
১৩ পর্ব
লেখা- মেহরুন্নেছা সুরভী
বেশ কয়েকদিন পর,
সকালের সময়। শিখিনী বারান্দায় বসে ছিল। বিভাবরী বেগম দুটি চায়ের কাপ এনে মেয়ের পাশে বসলেন।
শিখিনী এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ভার্সিটি যাচ্ছে নিয়ম করে। একটি কাপ শিখিনীর দিকে এগিয়ে দিলেন। সাখাওয়াতের ঘুম এখনো ভাঙেনি।
যামিনীর আই-কিউ টেস্টের রেজাল্ট পাবলিশ করেছে গতকাল। যামিনীর ফলাফল এসেছে তিন নম্বরে। তিন নম্বরে যে এসেছে সেটাতেই যামিনী খুব খুশি হয়েছে। কারণ শহরে তার থেকেও অনেক ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট আছে। সেখানে সে ডিপার্টমেন্টের মধ্যে তৃতীয় হয়েছে। সকল ডিপার্টমেন্ট মিলিয়ে এক্সাম হলে তো যামিনীর হদিশই পেতো না।
অবশ্য এতে প্রিয়মের থেকে বেশ হেল্প পেয়েছে যামিনী। যামিনী আর প্রিয়মের সম্পর্কটাও এখন স্বাভাবিক।
যামিনী তাই খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে সাওয়ার নিয়ে নিলো। গতকাল সন্ধ্যায় রেজাল্ট দিয়েছে। প্রিয়মকে এখনো জানানো হয়নি। তবে, গতরাতে সামান্য কথা হয়েছিল। একটুপরই প্রিয়ম রিহার্সালে যাবে। সেজন্য চটজলদি তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলো।
শিখিনীর কাছে বলতে গিয়ে দেখল বিভাবরী বেগমের সাথে বসে চা খাচ্ছে।
তাই সেদিকে আর আগালো না। সোজা বেরিয়ে গেল।
যামিনী দরজা ঠেলে বেরিয়ে যাওয়ার সাথেই প্রিয়ম বেরিয়ে এলো। যামিনীকে সাজ সজ্জায় দেখে প্রিয়ম একটু চমকে উঠল। কয়েক মুহূর্ত চেয়ে বইল যামিনীর দিকে।
যামিনী তাঁতের থ্রি-পিস পরে আছে। চুল গুলো ছেড়ে দেওয়া।চোখে গাড় কাজল। মুখটা উজ্জ্বল সুন্দর দেখাচ্ছে। উড়নাটা এক পাশে ছেড়ে দেওয়া।
যামিনীর এ এক নতুন রুপ।
প্রিয়মকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যামিনী মাথা নীচু করে নিলো।
প্রিয়ম কেশে বলল, “যামিনী!”
“হ্যাঁ!”
“আমম, কিছু কী বলবে?”
যামিনী থেমে চট করে বলল, ” আমি কী তোমার সাথে যেতে পারি?”
প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে হেসে দিলো, “হ্যাঁ, চলো।”
প্রিয়ম আর যামিনী একসাথে নিচে নামল। আজ আর প্রিয়ম বাইক নিলো না।দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
রাস্তার পাশ দিয়ে দু একজন মানুষ আসছে, যাচ্ছে। এখনো সকাল, তাই সেভাবে মানুষের সমাগম নেই।
যামিনী নিজের রেজাল্ট জানালো খুব সাগ্রহে। প্রিয়ম কৃতজ্ঞতা স্বরূপ হাসল।
“প্রিয়ম, জানো আমি খুব খুশি। ”
প্রিয়ম শুধু হাসছে। কিছু বলছে না। মুগ্ধ হয়ে যামিনীকে দেখছে। যামিনীর কথা বলার ধরন, হাসি। এক পা এক পা আগানো, অদ্ভুত সুন্দর লাগছে যামিনীকে। কিছু একটা ভাবছে আর হাসছে।
“যামিনী, তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।”
যামিনী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে গেলো। প্রিয়মের থেকে প্রশংসা আশা করা! ভাবাই যায় না!
যামিনী মাথা নীচু করে হাসি মুখে শুধু বলল, ” ওকে, ধন্যবাদ তোমাকে।
যামিনী জানালো, দু’তিন দিনের মাঝেই সে মফস্বলের বাসায় যাবে। তার ছোট বোনের জন্মদিন। তাকে যেতেই হবে।
দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর পর্যন্ত চলে এলো। প্রিয়ম বলল, চলো রিক্সায় উঠি।
তখন যামিনীর খেয়াল হলো, সে তার পার্স আনেনি!
যামিনীর হাত চলে গেল কপালে। প্রিয়ম হেসে বলল, চলো, আজ নাহয় তোমাকে আমার টাকায় চড়িয়ে আনি।
প্রিয়ম একটি রিক্সা থামিয়ে আগে উঠে বসল, হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “যামিনী, যদি বিশ্বাস রাখতে পার, তবে উঠে আসো। ”
যামিনী হাসতে হাসতে প্রিয়মের হাত ধরে উঠে বসল।
“এই যে প্রিয়ম সাহেব, বিশ্বাস আছে বলেই এতদূর হেঁটে আসলাম। ”
রিক্সা চলছে। প্রিয়ম আর যামিনীর মাঝে কথাবার্তা চলছে। চারপাশে বাতাসে যামিনীর চুলগুলো হালকা উড়ছে। সেদিকে প্রিয়মের চোখ যেতে ভুলছে না!
শিখিনী রুমে এসে বসল। প্রেমের সাথে ক’দিন যাবত ভালো মত কথা বলা হচ্ছে না। দেখাও হচ্ছে না। হঠাৎ কী হয়েছে, বুঝতে পারছে না।
সাখাওয়াতের জন্মদিন থেকে প্রেমের দেখা মেলা দুষ্কর! হঠাৎ আসে, খোঁজ খবর নিয়ে আবার চলে যায়! প্রেমের ব্যবহার কেমন লাগছে শিখিনীর।
বিভাবরী বেগম রান্না ঘরে কাজ করছিলেন। শিখিনী গিয়ে পাশে বসল।
“মা, কী ভাবছ?”
“কিছু না।”
“তাহলে, চুপচাপ আছো যে?”
“এমনি।”
শিখিনী গোমড়া মুখে বসে রইল। বিভাবরী বেগম কিছুক্ষণ বাদে বললেন,
” আচ্ছা শোন, শিখি।”
“হ্যাঁ, মা। ”
” তোর কী নানাবাড়ি যেতে ইচ্ছে করে?”
শিখিনী একটু ভেবে বলল, না মা,৷ ইচ্ছে করে না। আমরা এখানেই ভালো আছি।”
” কেন? তোর কী ছোটবেলার কিছু মনে নেই?”
” না, মনে নেই। শুধু ছোট একটা ছেলের সাথে খেলতাম, এতটুকু ই।
“ও তোর মামার ছেলে। তোর বড় ছিল। তোরা একসাথে খেলতি মাঝে মাঝে।”
“হুমম।”
শিখিনী চুপ ছিলো। বিভাবরী বেগম আবার বললেন, ” আমর না এতদিন এসব মাথায় আনলাম না। হঠাৎ সেদিন…
“হঠাৎ, সেদিন? কী মা?”
বিভাবরী বেগম আর কিছু বললেন না। শিখিনী আর তেমন কিছু বলল না। তার নন মেজাজ ভালো নেই এমনি। সেখান থেকে চলে গেল রুমে। পায়চারি করতে লাগল, কেমন যেন অসস্থি লাগছিল তার!
অস্থির মনেই প্রেমকে ফোন করল। কিন্তু প্রেম ফোন রিসিভ করল না।
ফোনটা বিছানায় ঠাস করে ফেলে দিয়ে শিখিনী বাহিরে বেরিয়ে গেল!
প্রায় সন্ধ্যা শেষে যামিনী বাসায় ফিরল। আজ সারাদিন প্রিয়মের সাথে ঘুরা হয়েছে তার। রিহার্সালে একটু গিয়েছিল, সেখানে অল্প কিছুক্ষণ থেকে তারপর নিজেদের মত সারা শহর হেঁটেছে।
যামিনী বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সকালে বাহিরে যাওয়ার সময়ও ভাবেনি, প্রিয়মের সাথে এতটা সময় কাটবে। চোখ বন্ধ করে সারা দিনের মুহূর্ত গুলো একবার ভেবে নিলো।
সাওয়ার নিয়ে শিখিনীর রুমে গেল। শিখিনী বিছানায় ওপর হয়ে শুয়ে আছে।
সাখাওয়াত বাসায় নেই। বিভাবরী বেগমের কাছে গিয়ে দেখল, তিনিও কপালে হাত রেখে বসে আছে।
যামিনী কাছে গিয়ে ডাকল, “আন্টি, কী হয়েছে?”
বিভাবরী বেগম যামিনীর ডাকে চমকে উঠলেন।হঠাৎ কারো উপস্থিতি তিনি খেয়াল করেননি। যামিনী প্রশ্নে ভার গলায় বললেন, ” যামিনী! তুমি এসে গেছ!কখন এলে? ”
“এই তো কিছুক্ষণ হলো, সকালে এত তারা ছিলো, বলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি?”
” এমনটা আর করো না, বলে যেও!”
“জি, আন্টি।”
যামিনী মাথা নীচু করে বসে রইল। বিভাবরী বেগম কোনো কিছু নিয়ে আপসেট। কিন্তু কীসের জন্য!
যামিনী নীচু গলায় জিগ্যেস করল, “আন্টি আপনি ঠিক আছেন? কিছু হয়েছে? ”
“হু, না কিছু হয়নি। ”
বিভাবরী বেগমের গলার স্বর এখনো ভার! তিনি একটু থেমে বললেন, শিখি কোথায়?”
” শিখি আপুকে দেখলাম, বিছানায় ওপর হয়ে শুয়ে আছে।”
“ওহ আচ্ছা, তুমি একটু ওর কাছে যাও তো।”
“জি আন্টি।”
যামিনী আসার সময় আবার পিছনে তাকিয়ে দেখল, বিভাবরী বেগম আবার কপালে হাত দিয়ে বসে আছেন।
যামিনীর মন অশান্ত হয়ে উঠল। সে সকালে চলে যাওয়ার পর কী কিছু হয়েছে। হলেও, কী হয়েছে!
শিখিনীর রুমে গিয়ে দেখল, সে ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে। যামিনী ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।
শিখিনীর চোখ-মুখ ফোলা ফোলা। গাল দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে।
শিখিনীর চোখ মুখ এমন ফ্যাকাশে থাকে না, যখন সে অতিরিক্ত কান্না করে, তখন চেহারার এমন বেহাল দশা হয়!
যামিনী এগিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করবে তখনি তার মোবাইলে কল বেজে উঠে।
কলটা ধরে যামিনী রুম থেকে বাহিরে বেরিয়ে আসে!
চলবে…