#বিদায়_বরণ
১৪ পর্ব
লেখা – মেহরুন্নেছা সুরভী
শিখিনীর রুম থেকে বেরিয়ে আসে যামিনী।
যামিনীর বড় ভাই কিংশুক ফোন দিয়েছে। ভাইয়ের সাথে যামিনী প্রায় অনেকক্ষণ কথা বলল। আগামীকাল কিংশুক আবার ঢাকায় আসছে, যামিনীকে নিতে। আর বিশেষ একটি কাজে!
যামিনীর সাথে এই নিয়েই অনেক কথা হলো কিংশুকের।
বৃহৎ ফরিদপুরের ভাঙায় যামিনীদের বাসা। ভাঙা একটি উপজেলা শহর। যামিনীদের বাসা একটু দূরে, মফস্বল এলাকা। যামিনীর পরিবার বলতে, তার বাবা, ভাই কিংশুক, আর ছোট বোন ইয়ামিনি। যামিনীর মা ইয়ামিনির জন্মের ক’দিন পরই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কিংশকদের পরিবার মাতুব্বর পরিবার নামেই সবাই চিনে থাকে। মাতুব্বর হচ্ছে তাদের এক গোষ্ঠীর নাম।
যামিনীর বাবা আহসান মাতুব্বরের বেশ নাম ডাক আছে এলাকায়। প্রায় দুই বিঘা জমির উপর তাদের বাসস্থান। দো’তালা বিল্ডিং, আর্সেনিক মুক্ত কল, গোয়াল ভরা গরু, খামারে হাঁস -মুরগী। যাকে বলে ভরা সংসার।
পাথরে যত বিঘা জমি আছে, সব চাষবাস হয়। এর সবই তদারকি কিংশুক করে থাকে। শিক্ষিত ছেলে, নিজের শহরেই কীসের ব্যবসা করলে লাভবান হওয়া যায়, বেশ দক্ষ সহকারেই জানে সে।
কিংশুকের বাসার সামনে বেশ বড় উঠান। বাসার পশ্চিম পাশে ১৫কাঠা নিয়ে বাগান, তার মাঝে মাঝারি সাইজের একটি দিঘি,বা পুকুর। মফস্বলে এক এক নামে পরিচিত আর কি!
বাসার চারপাশে দেওয়াল গাঁথা। ইটের দেওয়াল।
পাশাপাশি দু’টি দেওয়াল। একটার মাঝে তাদের বসবাসের স্থান, তার পাশেরটায় টিনের দোতলা একটি বাড়ি, সামনে গোয়ালঘর আর খামার। টিনের বাসায় ভৃত্যরা থাকে। কিংশুকের কর্মচারীরা সেই বাসায় বিশ্রাম নেয়, আর সকল কাজ কিংশুকের নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালনা করে।
যামিনীর ছোট বোন ইয়ামিনি এবার ক্লাস এইটে পড়ে। ভীষণ মেধাবী ছাত্রী। যামিনীর মত। ভাইয়ের ছায়ার দুই বোন পড়াশোনা করে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
তবে, পরিবারের দায়িত্ব আর বোনদের স্বপ্ন নিয়ে ভাবা ছেলেটারই অনেক স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়েছে। জীবনে আমাদের কাউকে খুশি রাখতে গেলে নিজের অনেক কিঢ়ুই ত্যাগ করতে হয়, সেটাই কিংশুক করেছে।
তাদের বাবা চলতে পারে না। উইলচেয়ারই তার জীবন। পরিবারের একমাত্র ভরসা কিংশুক।
মফস্বল থেকে শহরে গিয়ে যামিনীর পড়াশোনা অনেকেই খারাপ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। ইনিয়ে বিনিয়ে কিংশুকোর কান পর্যন্ত কথা পৌঁছে দেয়, যে যামিনীর বিয়ের বয়স হয়েছে। এভাবে শহরে পড়তে না পাঠিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেই হয়। নয়ত, যুবতী মেয়ে, শহরে গিয়ে বিগড়ে না যায়।
কিন্তু কিংশুকের কাছে এসব কথার কোনো মূল্য নেই। সে তার বোনদের চেনে। ভবিষ্যতে ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখে সে। চর সেটা সে পূরণ করবেই।
সামান্য মফস্বল এলাকা থেকে শহরে পড়তে যাওয়া, ভবিষ্যতে ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখা, খুব কম মানুষের ভাগ্যেই এমনটা হয়। নয়ত, মেয়েদের পড়াশোনা হওয়ার আগেই বিয়ে, আর ছেলেদের হালচাষ!
যামিনীর যে সুযোগ হয়েছে। আর সে ভবিষ্যতে ভালো কিছু করতে পারবে। নিজ পায়ে সম্বল হতে পারবে। আর এটাই কিংশুক চায়।
কিংশুক কল পারের পাশে বাঁধানো বসার জায়গায় বসে যামিনীর সাথে কথা বলছিল। মাগরিবের নামাজ পরেই এখানে এসে বসেছে সে। বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছে। চারপাশে ফুল ফলের গাছ পালা। গৃহের চারপাশে চোখ বুলালো কিংশুক। কত সুন্দর সাজানো তার সংসার। শুধু একজন লাল টুকটুকে বউয়ের অভাব।
সেটা ভাবতেই কিংশুক আকাশের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। ভরা জ্যোৎস্না চারপাশে।
মনে পরে যায় তার সেদিনের সকালের শুভ্র নির্মল নিষ্পাপ মুখটা। আগামীকাল সে তার দেখা আবার মিলবে? দেখা হওয়ার অপেক্ষায় কিংশুক।
শিখিনী বারান্দায় বসে ছিল। যামিনী এসে তার পাশে বসল। শিখিনী এখন অনেকটা স্বাভাবিক। চোখ-মুখ ফোলাও কমেছে।
যামিনীর দিকে তাকিয়ে সামান্য ঠোঁট প্রসস্থ করল শিখিনী। যামিনী বলতে লাগল,
” জানো শিখিপু, ভাইয়া কল করেছিল। বলল আগামীকাল আমাদের নিতে আসবে। সামনে আমার ছোট বোনের জন্মদিন। সাখাওয়াতের জমদিনের দিন যার সাথে তোমায় কথা বলিয়ে দিয়েছিলাম। সেই পুচকিটার। আমাকে ছাড় তার চলবেই না। ওর জন্মদিনে ভীষণ আনন্দ হয় জানো। এবার তোমরা গেলে আরো মজা হবে।
শিখিনীর মনটা ভীষণ খারাপ ছিল। প্রেমের জন্য। আজ সকালে প্রেমের সাথে হঠাৎ ঝামেলা হয়ে গেল। ঝামেলা যে বিশেষ গুরুতর, সেটা নিয়েই শিখিনীর মনটা ভীষণ বিষন্ন।
সম্পর্ক আদৌও ঠিক হবে কিনা। তার জানা নেই। সারাদিন এই নিয়ে অশান্তিতে কেটেছে। বিষয়টা বিভাবরী বেগমের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। সেই নিয়ে আরেক টেনশন।
যামিনীর সাথে শেয়ার করলে হয়ত মন হালকা হতো। কিন্তু বিভাবরী বেগমের নিষেধ। এই বিষয় নিয়ে তিনি একটা কথাও বলতে না করেছেন।
প্রেমের উপর তার রাগটা ভীষণ ভাবে বেড়েছে! প্রেমের সাথে আজ সম্পর্কটা এতটাই নিচে নেমেছে। ভবিষ্যতে তারা স্বাভাবিক সম্পর্কে আসতে পারবে কিনা সন্দেহ! এতটা নিচে নামত না, যদি না প্রেম শিখিনীর গালে চড় বসিয়ে দিতো।
শিখিনীর অন্যমনস্কে দেখে যামিনী বারবার ডাকে। যামিনীর ডাকে শিখিনী স্বাভাবিক হয়। প্রেমের কথা আর ভাবে না।ভাবতেও চায় না। আজ যা হয়েছে, সেটা সে খগব করে ভুলে যেতে চায়। আর তাকে ভুলতেই হবে!
যামিনীর সাথে তাই শিখিনী কথা বলতে লাগল, তাকে যত সম্ভব ব্যস্ত থাকতে হবে। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। প্রেমের কথা আর সে ভাববে না। অনেক তো কষ্ট পাওয়া হলো, এবার নতুন করে ভাবার বিষয়!
“শিখিপু, তুমি কী আমার কথা শুনছ?”
” হ্যাঁ, শুনছি। তুমি বলো।”
“হ্যাঁ, শুনো। ভাইয়া বলল, আগামীকাল এসে আন্টির সাথে কথা বলবে ভাইয়া। যেন আমরা সবাই আমাদের বাসায় যেতে পারি। এরপর ক’দিন বেড়িয়ে আবার চলে আসব।তুমি যাবে তো? ”
” মা, রাজি হবে?”
যামিনী উঁকি দিয়ে দেখল, কেউ আসে কিনা।কাউকে না দেখে যামিনী মুচকি হেসে শিখিনীর পাশ ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল, ” জানো, আমি না আন্টিকে পটিয়ে ফেলেছি। আন্টি না করতেই পারবে না।”
শিখিনী ফিক করে হেসে উঠে, কী বলে মেয়েটা! ” এই, কীভাবে পটালে শুনি?
যামিনী সেভাবেই নীচু কন্ঠে বলল, আরে বলো না, আন্টির মন তো খুব নরম। সেদিন আমার মা নেই জেনে খুব ব্যথিত হলেন।
“হ্যাঁ, এরপর?”
” তারপর আমার হঠাৎ মনে এলো ইয়ামিনির জন্মদিনের কথা। এই সুযোগ, তোমাদের আমার বাসায় নিয়ে যাওয়া। ”
শিখিনী ভ্রু কুঁচকে বলল, ” কেন আর সুযোগ নেই।”
” হ্যাঁ, আছে অবশ্যই। কিন্তু এই সুযোগে বললে, আন্টি না করতে পারবে না।তাই আমি সেদিন এ কথায় সেকথায় বলে দিলাম, আমাদের বাসায় যেতেই হবে। ইয়ামিনির জন্য হলেও যাবে। মায়ের জাত। এদের মন তো ভীষণ নরম হয়। দেখো আন্টি না করতেই পারবে না। আর যামিনীর বুদ্ধি বলে কথা, ফ্লপ যাবেই না, শুধু দেখবা তুমি!
কথাটা বলেই যামিনী একটা ভাব নিয়ে দাঁড়ালো। আর শিখিনী মজা পেয়ে হাসতে হাসতে বসে পরল। মেয়েটা এত বকবক করতে জানে। ভীষণ মজা করে কথা বলে।
শিখিনী হাসি মুখে বলল,
তারপর , বুদ্ধিমতি মেয়ে, আজ সারাদিন তুমি কোথায় ছিলে বলো তো?
প্রশ্নটা শুনতেই যামিনীর হাসি মুখটা পাল্টে যায় অন্য রঙে। শিখিনীকে কী প্রিয়মের বিষয়টা বলে দিবে, সেটাই ভাবছে সে!
যামিনীর চুপচাপ মুখটা দেখে শিখিনী তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় সেদিকে!
চলবে…