বিদায়_বরণ ১৫ পর্ব

#বিদায়_বরণ
১৫ পর্ব
লেখা – মেহরুন্নেছা সুরভী

ভোরের আলোয় ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় শিখিনী। ভোর হয়েছে শহরে।
এখন আলোয় আলোকিত শহর। রাতের অন্ধকার কেটে গিয়েছে!
কিন্তু শিখিনীর জীবনের অন্ধকার শহরের আলোয় আলোকিত হচ্ছে না!ভিতরটা এখনো ততটাই অন্ধকার রয়ে গিয়েছে।
বরংচ সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে বিষাদের তিক্ততা যেন আরো বেড়ে চলছে! এই তিক্ততা কতদূর পর্যন্ত যায়, শিখিনীর জানা নেই! আর কারো কী জানা আছে? অথবা প্রেমের?
শিখিনী এ প্রশ্নের উত্তর কোথায় খুঁজে পায় না!

রক্তের সম্পর্কের থেকেও হৃদয় বন্ধনের সম্পর্ক নাকী জোড়ালো হয়। সময়ে অসময়ে একটু আধটু মন মালিন্য হতেই থাকে। তাই বলে তো আর সম্পর্কের ভিত্তি হারিয়ে যায় না! কোথাও না কোথাও সে ভিত্তি বাঁধা পরে থাকে। প্রেমের সাথে শিখিনীর সম্পর্কের ভিত্তিও কোথাও বেঁধে আছে, সেটা সময় এলে ঠিকই প্রকাশিত হবে।

শিখিনী বারান্দার দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ায়। গতরাতে এখানেই সময় কাটিয়েছে সে। প্রকৃতির মতই নীরবে নিভৃতে। হাতে ছিল প্রেমের ফোনকল। ফোনের ওপাশেও ছিল নীরবতা। কঠিন নীরবতা। শুধু একে অপরের নিশ্বাসের শব্দ শুনা যাচ্ছিল। কথা বলার মত তাদের ভাষা ছিল না, কোনো উৎকন্ঠা ছিল না। একরাশ নীরবতা, অভিমান, লজ্জা, চারপাশটাকে আবিষ্ট করে রেখেছিল! সে সাথে হৃদয় জুড়ে ধপাস ধপাস নীরব ভাঙচুরের ঝড়!

শিখিনীর কখন যে চোখ লেগে এসেছে বুঝতেই পারেনি। ভোরের আলোয় সচেতন ফিরে আসে তার।এখনো ফোনটা হাতে। তবে প্রেমের ফোনকলের লাইনটা বিচ্ছিন্ন। শিখিনী দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বারান্দায় হাটতে থাকে। বারান্দায় গ্রিল নেই। অনেক উপর তলায় বলে গ্রিল বসানো হয়নি। এতে অবশ্য শিখিনীর ভালো হয়েছে। গ্রিলে তার দম বন্ধ হয়ে আসে, আটক পাখি লাগে। মনে হয় খাঁচায় বন্দী পাখি তারা। এমনিতেই চার দেওয়ালের মাঝে বসবাস। তার উপর যদি বারান্দাটাও বন্ধ থাকে। গ্রিল না থাকায় শিখিনী প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারে। হালকা ঝুঁকে চারপাশে, নিচে উপরে তাকানো যায়। ভীষণ মজা হয় শিখিনীর।

মায়ের ডাকে সচল হয় শিখিনী। রুমে গিয়ে মোবাইলটা চার্জে বসিয়ে দরজা খুলে হলরুমে আসে। সকাল প্রায় ৮বেজে গিয়েছে। বিভাবরী বেগমকে বাহিরে যেতে হবে। যামিনী আজ ভার্সিটি যাবে না, তার ভাই আসবে বলে।সাখাওয়াতও বাহিরে। ক’দিন হলো সাখাওয়াত ভোর হলেই বাহিরে চলে যায়। ফিরে আসে ৯টার পরপর। এরপর রেডি হয়েই স্কুলর উদ্দেশ্য ছুটে।

বিভাবরী বেগমের হাতে এক গাথানি খাতা। শিখিনীকে দেখে তিনি এগিয়ে বললেন, ” এই চাবিটা রাখ, আলমারি থেকে ভালো কাপড় বের করে রাখিস। আর ভার্সিটি যাসনে, যামিনীর ভাই আসবে। বাসায় মানুষ থাকা প্রয়োজন। আমি ১২টার পর চলে আসব। জুথি এসে ঘর গুছিয়ে রেখে যাবে।

শিখিনী চাবিটা হাতে বিভাবরী বেগমের সামনো দাঁড়িয়ে রইল। বিভাবরী বেগম চোখের চশমা ঠিক করে শিখিনীর কাঁধে হাত রাখলেন। নরম সুরে বললেন, ” ঠিক মত থাকিস শিখি, সকালের খাবারটা খেয়ে নিস। আমি শীঘ্রই ফিরব। ”

শিখিনী তার মাকে জড়িয়ে ধরে রাখল কিছুক্ষণ। মায়ের হাতে মাথায় হাত বুলানো পেয়ে চোখ বুঝে নিলো। হৃদয়টা যেন এখন একেবারে শান্ত, নির্জীব।

মেয়ের কপালে চুমু এঁকে বিভাবরী বেগম বেরিয়ে গেলেন। শিখিনী দরজাটা বন্ধ করে হলরুমের শোফায় বসে রইল কিছুক্ষণ।
জুথি তাদের বাসায় কাজ করে। সবকিছু পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন, গুছিয়ে রাখার কাজ করে।
বেশ কিছুক্ষণ হলেও যুথি আসছে না দেখে শিখিনীই কাজে লেগে পরল। প্রথমে শোফা, বিছানা ঝাড়ল, এরপর প্রতিটা রুম পরিষ্কার করল।

শিখিনীর দেখাদেখি যামিনীও হাত লাগালো। যামিনী কথা বলে থাকলেও শিখিনী চুপিচুপি কাজ করছিল। বেডরুম, হলরুম গুছিয়ে রান্নাঘরে গেল। তখনি কলিংবেল বেজে উঠল।
শিখিনী তখন যামিনী শুধু বলল, ” দরজা খুলো না, যুথি এসেছে হয়ত। একটু পর চলে যাবে। ”

য়িখিনী অনেকটা জোড়ালো গলায় কথাটা বলেছে। তাই যামিনী আর আগায়নি। যামিনী ভাই হবে কিনা, সেটা যামিনীর খেয়াল ছিল। কিন্তু তার ভাই পৌঁছে অবশ্যই ফোন দিতো। তবুও, শিওর হতে যামিনী রুমে গিয়ে কিংশুককে কল করে জেনে নিলো কতদূর এসেছে।

শিখিনীর কথা মত প্রায় আধাঘন্টার বেশি পর্যন্ত কলিং বেলের আওয়াজ হলো। এরপর আর কোনো আওয়াজ এলো না। যুথি তারমানে চলে গিয়েছে।

শিখিনীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। আপন মনে রান্নাঘর পরিস্কার করে নিচ্ছে। বাসান ধোঁয়া থেকে সম্পূর্ণ রুম, ফ্রিজ, তাক মুছে নিয়েছে সে। যামিনী সাহায্য করতে চাইলেও রান্না ঘরে পা রাখতে দেয়নি শিখিনী।
এরপর শুরু হয় কাটাকুটি। শিখিনীর কাজকর্ম দেখে যামিনী হা হয়ে সেদিকে দেখতে থাকে। মেয়েটা করছে টা কী!
যে মেয়ে হাত দিয়ে ভাত বেড়ে ভাত খায় না, সে মেয়েটা আজ সারা ঘরের কাজ সেরে ফেলল! আশ্চর্য হলো যামিনী।
শিখিনীর এক নতুন রুপ তার সামনে প্রকাশিত হলো।

শিখিনী নিজের পছন্দ মত একের পর এক খাবারের আইটেম রাঁধতে লাগল।সময় দেখতে দেখতে ১১টা বেজে গেল। আজ আর সাখাওয়াত বাসায় ফিরল না। হয়ত এখন স্কুলেই আছে। যামিনী আর শিখিনীর সেটা নিয়ে ভাবনাও নেই।
অবশ্য শিখিনীর মনটাই ছিল অন্যধ্যানে। কাজের মাধ্যমে নিজের ব্যস্ত রাখার ছুতোয় কাজ করছিল। নয়ত, এত লক্ষ্মী মেয়ে শিখিনী নয়।

শিখিনী চাইছিল না, তার ভাবনায় প্রেম বারবার এসে দখল করে বসে থাকুক। সে আর এসব ভাবতে চায় না। এসব ভাবলেই তার হৃদয় পুড়ে উঠে। গতকালের প্রেমের ভয়ংকর রুপটা সামনে ভেসে উঠে।

গতকাল সামান্য একটা বিষয় প্রেম বড় ইস্যু বানিয়ে নিয়েছিল। হাসি খুশি মুখে শিখিনী প্রেমের কাছে গিয়েছিল। কথায় কথায় প্রেম বলছিল, শিখিনীকে বিদেশে নিয়ে যাবে, সে ভাবে যেন সে প্রস্তুতি নেয়। শিখিমীর তো মাথায় হাত। সে তার মা, ভাইকে দেশে রেখে বিদেশে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না! সেই নিয়েই তর্ক। একটা সময় শিখিনী বলে,” কেন জেদ করছ তুমি? বিদেশে আবার কেন যাবে, কাকে রেখে এসেছ তুমি সেখানে?

ব্যস এতটুকুই। প্রেমের রাগ, বিরক্ত সবকিছু একসাথে চর হয়ে শিখিনীর ডানগালে গিয়ে লাগল।
শিখিনীর সারা শরীর কাঁপছিল। এই প্রেম তার অচেনা, অজানা। আজ পর্যন্ত তার গায়ে এতটুকু আঁচড় কেউ লাগায়নি। সেখানে ভালোবাসার মানুষের হাতের চর! শিখিনী বুখ ফেঁটে কান্না বেড়িয়ে এলো। চোখের জলে গালা দু’টো ভরে গেল।

সে দৃশ্য বিভাবরী বেগমের চোখ এড়ালো না। বিভাবরী বেগম ঘরের ভিতর এক পা এগোতেই প্রেম সোজা হাতটা জানালায় আঘাত করে বসল। জানালাটা ভেঙে না গেলেও চুচরে গেল। শিখিনী আরেক দফা কেঁপে উঠল।।
এক টুকরো কাঁচে প্রেমের হাতে ঢুকেছে কিনা শিখিনী না জানলেও রক্ত দেখতে পেয়েছিল। বিভাবরী বেগম এগিয়ে এসে শিখিনীকে ধরে নিচে নেমে এলো। মায়ের আলিঙ্গনে এসে শিখিনীর আবেগ, অনুভূতি দ্বিগুণ হয়ে উঠল, চিৎকার দিয়ে কাঁদতেছিলো শুধু!
আর প্রেম, সেই জানালার পাশেই হাতটা হাঁটুর উপর রেখে দেওয়ালের সাথে হেলে মাথা নীচে দুলিয়ে বসে রইল।

শিখিনী প্রথমে হাঁসের মাংস রান্না করল, এরপর মোরগ পোলাও,(বিরিয়ানি) শুটকি ভর্তা, খাসির মাংসের ঝোল, আলোর চপ, ইলিশের ডিম ভুনা। সেই সাথে ছিদরুটি পিঠাও বানাতে ভুলল না, আবার মাংসের সাথে ভুনাখিচুড়ি উঠিয়ে দিল কুকারে, আরেক প্যানে মুরগির রান ভাজছিল, কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই শিখিনী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল কাপড় নিয়ে।

যামিনী হতবিহ্বল চেয়ে চেয়ে দেখতেছিল সব। সবকিছু বিস্ময় লাগছিল তার! এতকিছু শিখিনী কেন করল! খাবার দেখেই তার মাথায় হাত! বিভাবরী বেগম এসে এসব দেখলে কী বা বলবেন? জোর করেও শিখিনীকে বাঁধা দিতে পারেনি যামিনী।

চরম বিস্ময়ে বাকী রান্নাটা সে শেষ করল। টেবিলে খাবারটা রেখেই কলিং বেলের আওয়াজ পেলো, যামিনী দরজা খুলে দেখল কিংশুক দাঁড়িয়ে আছে। ভাইকে দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠল যামিনী।

শিখিনীর রুমের দরজা আর মেইন দরজা একদম সামনাসামনি। শিখিনী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই কিংশুকের চোখে চোখ পড়ল।

কিংশুক চিনতে ভুল করল না, এই সেই সেদিনের দেখা শুভ্রতার পরী। কিংশুকের হৃদয়ে পদ্মফুলের পুষ্পে পুষ্পবীত হয়ে উঠল।
মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল গুপ্ত হৃদয়ে লালন করা ভালোবাসার মানুষটাকে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here